#জঠর
#পর্বঃ৩
লেখনীতেঃতাজরিয়ান খান তানভি
প্রভাতের মিষ্টি রোশনাই এলোথেলো হয়ে ঢুকে পড়ছে থাই গ্লাসের কাঁচ ভেদ করে। দেয়ালের সাথে লাগোয়া কৃষ্ণচূড়া গাছটায় কচিপাতার সয়ম্বর। শীতল, মিহি প্রভঞ্জনে সয়লাব হয়ে উঠেছে মেদিনী। প্রভাকরের হলদে রঙের দুষ্ট আলো যখন নায়েলের চোখের পল্লবে খেলছে, তখন তার মাথায় লাগা আঘাতের জায়গায় ছোটো ছোটো বারো সেন্টিমিটারের হাতের পাঞ্জার প্রগাঢ়, তুলতুলে স্পর্শে মত্ত হতে থাকে। আঁখি মেলে চাইতেই নায়েলের মুক্ত চাহনিতে ঘেরাও হয় পিউলীর ছোট্ট আনন। বিহঙ্গের মনোহারী হাসি। অলস হাসিতে ওঠে বসে নায়েল। পিউলীর কপালে আস্ত চুমু খেয়ে বলল—
“গুড মর্নিং লিটল বার্ড। ”
পিউলী মুক্তো ঝরা হাসে। কচি কচি ঠোঁটে ইঁদুর দাঁতের হাসি। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল—
“গুড মর্নিং পাপা।”
চোখে হাসে নায়েল। তার সমস্ত অবসাদ, ব্যথা এক নিমিষে মিশে গেল বাতাসে। পিউলী ওঠে দাঁড়ায়। নায়েলের কপালের ক্ষত জায়গায়টায় হাত দিয়ে বারংবার ছোঁয়। কিন্তু অতি সন্তর্পনে। পাছে ব্যথা লেগে যায়! অর্হিতা তার রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটায় নায়েলকে আঘাত করে। নায়েল প্রতিবাদ করেনি। ড্রেসিং করে ওয়ান টাইম স্ট্রিপ লাগিয়ে নেয়। পিউলীর কক্ষেই জায়গা হয় তার।
বাবার ব্যথায় মন ভারাক্রান্ত হয় পিউলীর। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল—
“ব্যথা পেয়ছ পাপা?”
নায়েল অধর ছড়ায়। আলতো অনুভূতিতে বলল—
“নো, মাই প্রিন্সেস। কাম।”
মেয়েকে পায়ের উপর বসিয়ে গালে চুমু খায় নায়েল। পিউলীর ছোট্ট চুলের অরন্যে হাত গলিয়ে বলল—
“ব্রাশ করেছ?”
“হুম।”
“খেয়েছ?”
“না।”
“কেন?”
শিয়র নত করে পিউলী। বিষণ্ণ গলায় বলল—
“আমি তোমার সাথে খাবো।”
মলিন হাসে নায়েল। নিরুত্তাপ গলায় বলল—
“যাও টেবিলে। পাপা ফ্রেশ হয়ে আসছি।”
“ওকে পাপা।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে নায়েল।
,
,
,
খাওয়ার টেবিলে সবাই উপস্থিত থাকলেও নেই অর্হিতা। মিঠে অভিমানে শান্ত পিউলী। তার মা কেন আসে না? বারবার সিঁড়ির দিকে চোখ ফেলছে সে। আচমকা পদধ্বনিতে উচ্ছল হাসে পিউলী। অর্হিতা এসে দাঁড়িয়েছে ডাইনিং স্পেস থেকে একটু দূরে। পিউলী উচ্ছ্বাসিত মেজাজে চেয়ার থেকে নেমে এসে ব্যাকুল হয়ে অর্হিতার আঙুল চেপে ধরে। ঝরঝরে হাসির ফোয়ারা বইয়ে বলল—
“মামুনি, এসো, এসো। খাবে চলো।”
অর্হিতার সুপ্ত রাগ বিক্ষিপ্ত হলো। ঝাঁড়া মেরে হাতটা ছাড়িয়ে বলল—
“এই মেয়ে, তোমাকে না বলেছি আমাকে মামুনি বলে ডাকবে না। আমি তোমার মা নই। যাও এখানে থেকে।”
শিরা ফুলে ওঠে নায়েলের। বাবার দিকে দুঃখী দুঃখী চোখে চেয়ে থাকে পিউলী। নায়েল গম্ভীর আওয়াজে বলল—
“নিজের জায়গায় বসো পিউ।”
পিউলী তার ছোট্ট কদমে ফিরে আসে নিজের জায়গায়। তাচ্ছিল্যভরা চাহনি অর্হিতার। উপহাস করে বলল—
“জুতো মেরে গুরু দান।”
ঘরের কেউ কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। অর্হিতার মেজাজ চড়ে গেল দ্বিগুন। নওশাদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে জ্বলন্ত গলায় বলে উঠে—
“আপনি তো তার বাবা তাই না? আপনি পারতেন নিজের অবিবাহিত মেয়ের সাথে একটা বিবাহিত ছেলের বিয়ে দিতে? পারতেন?”
নওশাদ সাহেব কোনো কথা বলল না। নায়েলের দিকে তাকিয়ে গিলে নিলেন কথা। সরোষে ফের বলে উঠে অর্হিতা—
“মেয়ে তো আপনাদের বাসাতেই ছিল। তাহলে আমাকে কেন জোর করে বিয়ে করল আপনার ছেলে?”
হৃতি মৃদু চোখে নায়েলের চক্ষুদর্পণে তাকাল। নায়েল প্রতিক্রিয়াহীন। যেন কিছু শোনেইনি সে। অর্হিতার রাগ মানলো না। রাগে হতবিহ্বল অর্হিতা চওড়া গলায় বলল—
“এই জন্যই হয়তো আপনার বউ মরে গেছে। টাকার প্রভাবে মানুষ কেনাবেচা করা যার স্বভাব তার সাথে এর চেয়ে আর ভালো কী হবে!”
নিজেকে কন্ট্রোল করার সমস্ত ক্ষমতা হারালো নায়েল। তীব্র ক্রোধে চেয়ার ছেড়ে ওঠে এসে সজোরে এক চড় বসিয়ে দেয় অর্হিতার গালে। উপস্থিত সকলে হতভম্ব। নায়েল সহজে রাগে না। আর নিজের মেয়ের সামনে তো কখনোই না। পিউলী কেঁপে ওঠে। তার চোখের পাতায় নামে শ্রাবণ মেঘের ঢল। সক্রোধে খেঁকিয়ে উঠে নায়েল—
“আপনার সাথে যা হয়েছে তার জন্য আমি দায়ী। এই ব্যাপারে পরিবারে কোনো মানুষের সামনে আঙুল তোলা যাবে না। এই বাড়ির কুকুরও আমার মেয়ের সামনে জোর গলায় ডাকে না। আর আপনি তো একটা মানুষ! মিনিয়াম ম্যানার্সটুকু আপনার নেই? একটা বাচ্চার সামনে কীভাবে কথা বলতে হয় আপনি জানেন না?”
ছলছল চোখে অর্হিতার ফোঁস ফোঁস করছে। তার চোখের দিকে দৃঢ়তার সাথে তাকিয়ে কাঠখোট্টা গলায় নায়েল বলে উঠে —
“পিউলীর খাবার বক্সে দিয়ে দাও। চলো পিউ।”
নীরবতায় আচ্ছন্ন হয় ঘর। কারো অন্ত:করণে তীব্র আক্রোশ, কারো চেহারায় মলিনতা। কেউবা উল্লাসিত!
,
,
,
খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে পিউলী। চেয়ারে বসে ডেক্স ডিঙিয়ে মেয়ের দিকে কাতর চোখে চেয়ে আছে নায়েল। কেবিনের একপাশে ডিভান। সেখানে নির্বিকার বসে আছে পিউলী। নায়েল চেয়ার ছেড়ে ওঠে আসে। ছোট্ট টি টেবিলের উপর হাত রেখে হাঁটু ভাঁজ করে বসে। মর্মাহত গলায় বলল—
“খেয়ে নাও পিউ।”
“আমি খাবো না। তুমি মামুনিকে মারলে কেন?”
বুকের কার্ণিশ ছুঁইয়ে রক্তক্ষরণ হয় নায়েলের। ছোট্ট করে বলল—
“আই এম সরি।”
“তুমি মামুনিকে সরি বলোনি।”
ফোঁস করে শ্বাস ফেলল নায়েল। গাঢ় গলায় বলল—
“বলব।”
“আর সরি গিফ্ট?”
হতাশ শ্বাস ফেলে নায়েল। মেয়েটার গায়ে হাত তোলা তার ঠিক হয়নি। যে অপরাধে সে অর্হিতার গায়ে হাত তুলেছে সে একই অপরাধে সেও দোষী। নায়েল ভেবে পায় না, লুবানার সাথে দীর্ঘ সময় কাটিয়েও তার প্রতি পিউলীর কোনো মায়া তৈরি হয়নি। কিন্তু অর্হিতাকে প্রথম দেখাতেই তার প্রতি অমোঘ টান অনুভব করেছে পিউলী। হাসপাতালের সফেদ বিছানায় যখন শুয়েছিল পিউলী তখন পুরো পৃথিবীকে বিস্বাদ মনে হয়েছিল নায়েলের কাছে। চোখ পিটপিট করে চেয়ে প্রথমবার যখন পিউলী অর্হিতাকে দেখে আর জানতে পারে যে তার রক্তেই বেঁচে ওঠেছে পিউলী তখন থেকে এক অমীমাংসিত, অজ্ঞাত, আছোঁয়া মায়ায় আবিষ্ট হয় পিউলী। নায়েলকে বাধ্য করে বারবার অর্হিতার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। মায়ের আদরহীন এক সন্তানের আকুতি ফেলতে পারে না নায়েল। বেহায়ার মতো বারবার কড়া নেড়েছে অর্হিতার অন্ত:রিন্দ্রিয়ের বদ্ধদ্বারে। প্রতি বারেই সে ফিরে এসেছে রিক্তহস্তে। তাই বাধ্য হয়ে এমন গর্হিত কাজ করেছে সে। অর্থের প্রলোভন দেখিয়ে, ক্ষমতার জোর খাটিয়ে মেয়েকে মা এনে দিয়েছে।
কেন, জন্ম না দিলে কী মা হওয়া যায় না?
চলবে,,,