🏵তুইতেই আমি🏵
লেখিকাঃইসরাত আয়রা ইচ্ছে
পর্বঃ২৪
🍁🌼🍁
এতো দিন পরে আজ আহানের সত্যি মনে হলো ইচ্ছের খবর নেয়া উচিত। নিশ্চয়ই ও কষ্ট পাচ্ছে।তবে আহান ভেবে রেখেছে সামনে পেলে গুনে গুনে দশটা চর মারবে তারপর যত কথা।দাড়া তোকে বিদেশের লেখাপড়া ছুটাচ্ছি। ওয়েট এন্ড ওয়াচ।কেন বুঝলো না যে আমার বেবি চাই কিন্তু ওর থেকে বেশি কোনো কিছু না।ওকে না পেলে আমি কোনো কিছুই চাই না কিচ্ছু না কিচ্ছু না।কেন বুঝল না?
এতোদিন পরে আহান ফেসবুকে ইচ্ছের মেসেজ চেক করে,নাহ ইচ্ছে কোনোই মেসেজ দেয় নি তাকে।তবুও ইচ্ছের ইনবক্সে গেলো ওর আইডির পাশের সবুজ বাতি জ্বলতে দেখে আইডিতে ঢুকে দেখে ইচ্ছেও ওর আইডির মধ্যেই সিন মুডে আছে কিন্তু মেসেজ দিচ্ছে না।আহানের চাপা রাগ বেড়ে গেল।আহান আইডি ব্লক করে দিলো।কিন্তু কিভাবে ইচ্ছের সাথে ফেস টু ফেস যোগাযোগ করবে?
কিছু কিছু ভুল বোঝাবুঝি সামনাসামনি সমাধান করাই ভালো। ইচ্ছে একবার বলতে পারতো সব কিছু । কেন বললো না? আমি কি চাই তা শুনতো একবার?ভালোবাসা মানে সব কিছু ফেলে শুধু মানুষ টাকেই চাওয়া। ভালোবাসা মানে আর কিচ্ছু চাই না শুধু তোকেই চাই।আমিও এভাবেই চাই তা কেন বুঝলি না ইচ্ছে?
ইচ্ছের শুন্যতার সাথে সাথে এখন ইচ্ছের রোগটাও আহানকে কুরে কুরে খাচ্ছে।হারানোর ভয় যেনো দিনে দিনে তীব্র হচ্ছে আহানের মধ্যে। আহান ভাবে আজ আমার জন্যই এতো বছর ইচ্ছে অপারেশন করতে পারলো না।সব কিছুর জন্য নিজেকে দায়ী মনে হয়। কোথাও একটা আমিই দায়ী ইচ্ছের বর্তমান জীবনের জন্য।
সেদিনই আহান আয়ানারের থেকে হেল্প নিয়ে ইচ্ছে কোথায় থাকে ফোন নাম্বারসহ সব ইনফরমেশন জোগার করে ফেলে।আহান পাসপোর্ট করে ফেলে যাতে সে বিদেশ ছুটতে পারে।
শিরিন নিধির সাথে এখনও কথা বলছে না।নিধি কথা বলতে চেয়েছে কিন্তু কাজ হয় নি।শিরিন ডিরেক্ট জানিয়ে দিয়েছে সে কথা বলতে চায় না।যে ছেলে নেশার ধারে কাছেও যেত না আজ সে রেগুলার এসব করছে।নিষেধ করলে শুনছে না বুঝালে বুঝছে না।ছেলের অবনতির জন্য নিধিকেই দায়ী করে শিরিন।সে কড়া শপথ নিয়ে ফেলেছে” আমার ছেলে ওর মেয়ে না পেলে আমিও আমার মেয়ে ওর ছেলেকে দেব না”
******
রাত নয়টা। আহান খাবার সময় হটাৎ বলে ওঠে
-আম্মু আমি বিদেশ যাবো। পাসপোর্ট করে ফেলেছি।পরশু ফ্লাইট।
আহানের কথায় রাকিব খাওয়া বন্ধ করে ফিরে তাকালেন।তারপর আবার খাওয়ায় মনযোগী হলেন। নেহাৎ লোকটা শান্তশিষ্ট নইলে এতো কিছু মুখ বুঝে সহ্য করতে পারতেন না।।
শিরিন মুখ খুলল
— ইচ্ছের কাছে যাচ্ছিস?
— হু
— ফিরিয়ে আনতে?
— হুম।আহান নিচুস্বরেই জবাব দিচ্ছে।
–আচ্ছা যা।কিন্তু একটা কথা ওর সমস্যার বিষয় গুলো তোকে বলেছি আমি।এই নিয়ে ফিউচারে ওকে কথা শুনানো বা খোটা দিবি এমন মেন্টালিটি যেনো জীবনেও তোর মধ্যে না দেখি আমি বলে দিলাম।আমার বান্ধবীর মেয়ে মানে আমি ওকে কম ভালোবাসি তা একদমই ভাব্বি না।আমার বান্ধবীর কাছে তখন যেনো আমার মুখ ছোট হয় না।তখন যেনো নিধি বলতে না পারে যে জোর করে আমার মেয়েকে বিয়ে করে এখন কথা শুনানো হচ্ছে বা প্রাপ্য মূল্য ওর মেয়ে পাচ্ছে না।তাই যা করবি বুঝে শুনে পরে যেনো আমার নাক না কাটে।
— আম্মু আমি এমন করবো ভাবলে কিভাবে?
— শোন আহান। বর্তমান জেনারেশনের রোগই হলো প্রথমে পাগলামি তারপর আস্তে আস্তে আবেগ ভালোবাসা হাওয়াই মিঠাইয়ের মতো হাওয়া হয়ে যাওয়া।তাই বলছি যা করবি বুঝে শুনে।
— আম্মু আমি বুঝে শুনে ভেবে চিন্তেই যা করার করছি। ফিউচারে তোমার নাক কাটা যাবে না।কথা দিলাম।
— না গেলেই ভালো। বিশ্বাস করি তোকে কিন্তু জেনারেশন টার কথা ও মাথায় রাখতে হয় কিনা?
— হুম তোমার চিন্তা ভাবনা লিগাল আম্মু।কিন্তু তোমার ছেলে এমন না। এক্কেবারে বাপকা ব্যাটা।( মজা করে)
এবার রাকিব চোখ ঘুরিয়ে তাকায়
–।তুই কি বুঝালি সি কথা দিয়ে?( রাকিব ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে)
— আব্বু আমি বুঝিয়েছি আমি তোমার মতো প্রেমি।গার্ল ফ্রেন্ডের কথায় লেখা পড়া ছেড়ে ব্যবসা সামলানো শুরু করলে।তা লাগলে আমিও করবো। ভালো মা ভালো বাবা বেকার ছেলের কাছে মেয়ে না দিলে আমিও ব্যবসা বাপের টা।
শিরিন হেসে ওঠে।
— আগে ইচ্ছেকে আন। বিয়ে কর তারপর দেখবো। (রাকিব্)
আহান হাসতে হাসতে খাওয়া শেষ করে চলে গেলো নিজের রুমে। আজ নিজেকে মুক্ত পাখি মনে হচ্ছে।মন খুলে কতো দিন পর আজ কথা বলা হলো। কিন্তু বুকের পাথর সরাতে তোকেই চাই আমার হাদুরাম, অামার বউ, আমার ইচ্ছুপাখিটা।বলেই ইচ্ছের ছবিতে লাগাতার কিছু চুমু লাগায়।রুম জুরেই এখন ইচ্ছের ছবি।আর আহান ঠিক জ্যোৎস্না রাতে ব্যালকুনিতে দাঁড়িয়ে ইচ্ছের কাধে হাত দেয়া হাস্যজ্জল সেলফিটার দিকেই তাকানো।শাড়ি তে দেখে সেদিন আহান কয়বার দিন হারিয়েছিল তার হিসেব কি ইচ্ছে পাগলিটা রেখেছে?
******
আহানকে এয়ারপোর্টে এগিয়ে দিতে আয়ান আর ইশালকে নিলো আহান। যাওয়ার আগে আহান ইশাল আর আয়ানকে দুইটা আনড্রোয়েড ফোন কিনে দিয়ে গেলো। ওদের কারণে ছোট ছোট বাচ্চা দুইটা কষ্ট কেন পাবে?তাই ই এই কাজ। ওরা যাতে যোগাযোগ করতে পারে।আয়ান ইশালের ব্যাপারে নিজের মা কে বুঝাতে আহান ব্যর্থ। শিরিনের এক কথা “ইচ্ছেকে বউ করে আন তারপর আমি ওদের জন্য আর বাধা হবো না।”
ড্রাইভার গাড়ি ড্রাইভ করছে।ড্রাইভারের পাশে আহান বসেছে।আর পিছনে ইশাল আয়ান। ওরা এতো দিন পরে নিচু আওয়াজে মন খুলে গল্প করছে।শুধুমাত্র এই জন্যই নিজের মাকে বাবাকে আনেনি।ওদের এতো দিন পরে কথা বলার উৎফুল্লতা আহানের কানে আসছে হালকা পাতলা।
আহানের হঠাৎ মনে হলো ওদের দুজনকে আর একটা সুযোগ করে দেয়া যায় কথা বলার জন্য।
— দুই পাগল শুন।আমি ইচ্ছেকে নিয়ে না আসা পর্যন্ত রাতে আমার রুমের আর ইচ্ছের রুমের ব্যালকুনি দিয়ে দুজন কথা বলবি।আমি না আসা পর্যন্ত রুম ছেড়ে দিলাম তোদের।।অনেক দিন কষ্টে আছিস আমাদের কারণে এই এই ছাড় বুঝলি।তবে কেউ ব্যালকুনি এপাশ ওপাশ যাবি না।আমার রুমে ক্যামেরা লাগানো। মাথায় রাখবি।
দুই জনের খুশি দেখে কে? তারা কথা দিয়েছে দুই ব্যালকুনি দিয়ে কথা বলতে পারলেই হবে।
— আয়ান ভাইয়া জানো আমার এত্তগুলা কথা জমা হইছে পেটে।তোমাকে সব আজই বলবো।রাতে কেমন?জানো আমি পড়াশুনায় ও মন দিতে পারছি না ভাইয়া।মন খারাপ করে বললো ইশাল
— আজ সব শুনবো ইশু। ভাই শুনছে আস্তে কথা বল(আয়ান)
ওদের আস্তে করে বলা কথাটাও আহানের কানে এলো। আসলেই যখন ভালোবাসা বিকাশ হয় তখন বাধা আসলে তা ব্রেনে খুবই ইফেক্ট ফেলে।তাই পড়াশুনায় অমনোযোগী হওয়াই সাভাবিক।
******
এদিকে ইচ্ছে এখানে একদমই ভালো নেই। নতুন আবহাওয়ায় মানিয়ে নিতে পারছে না একদমই।জ্বর সর্দি লেগেই আছে।খাওয়া দাওয়ায় অনিয়ম বাড়ছে।পরিবার প্রিয় জন থেকে এতো দূরে আসতে হবে ভাবেই নি ইচ্ছে।বড্ড একলা পরে গেছে এখানে।নতুন একটা মেয়ে বন্ধু হয়েছে বটে কিন্তু তার কালচারের সাথে একদমই মিলতো না প্রথম দিকে ইচ্ছের।বিদেশি মেয়ে কি আর হবে কালচার।ওদের কালচারই সর্ট ড্রেস আর প্রচুর আধুনিকতা।এই মেয়ের সাথেই একটা ঘর ভাড়া করে শেয়ারে থাকছে ইচ্ছে।মেয়েটার ছেলে বন্ধুর অভাব নেই।কিন্তু ইচ্ছে ছেলেদের সাথে মিশতে চায় না বলে ড্রেনিলা তাকে জোরও করে না পারলে হেল্প করে।তার কোনো ছেলে বন্ধুকেই জানতে দেয় না তার সাথে আর একটা মেয়ে থাকে।ইচ্ছে আসার পর নাকি সে তার বন্ধুদের আনা বন্ধ করে দিয়েছে আগের থেকে অনেকটা। ইচ্ছেও দেখছে আগের থেকে ওর আড্ডা গেছে।বাংলায় কথা শিখতে চাইছে মাঝে মাঝে নিজে থেকে কিন্তু শিখালেও পেরে ওঠে না তেমন।তার নাকি বাংলা কথা গুলো শুনতে খুবই ইন্টারেসটিং লাগে।ইচ্ছেকে পেয়ে তাই সে খুব খুশি।এখন ইচ্ছের দেখা দেখি থ্রি-পিচ পরছে মাঝে মধ্যে।ইচ্ছের স্যাড লাভ স্টোরি শুনে ইচ্ছের সাথে অনেক কেদেছিলো সেদিন।সেদিন থেকে বন্ধুত্ব আরও গাড়ো হয়েছে। বয়সও প্রায় সেম সেম সব মিলিয়ে তাদের বন্ধুত্বতা দিন দিন গভীর হচ্ছে।
ওর নাম ড্রেনিলা।ড্রেনিলার বাবা মা নেই।সে সেল্ফডিপেনডেন্ট মেয়ে।ইচ্ছের সাথে ভার্সিটি যায়।আর বাকি টাইম রেস্টুয়ারেন্টে পার্টটাইম জব।
*****
আহান পৌছে পেট ভরার উদ্দেশ্যে রেস্টুয়ারেন্টে ঢুকলো।আগে পেট ঠান্ডা করে তারপর ঠিকানা অনুযায়ী খোঁজা যাবে ইচ্ছেকে।
খাবার অর্ডার নিতে একটা হোটেল বয় এলো। আহান পছন্দ মতো খাবার অর্ডার দিলো।আহান কিছুক্ষণ ধরেই খেয়াল করছে একটা মেয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবার ফোনে কিছু একটা দেখছে আবার তার দিকে তাকাচ্ছে।মেয়েটার মেয়ে হোটেলের পোশাক। আহান বুঝে গেল মেয়েটা
হোটেলেই কাজ করে।বেশ কিছুক্ষণ পরে মেয়েটা এক আঙুল আহানের দিকে তাক করতে করতে এগিয়ে এলো। আহান তার ব্যবহারে চরম অবাক।
মেয়েটা আহানের কাছা কাছি এসেই বললো
–হেই হ্যান্ডসাম।ইউ আহান। এম আই রাইট?
আহান তখন অবাকের চূড়ান্ত।প্রথম এই দেশের মাটিতে পা দিয়েছে সে, এর মধ্যে কেউ তাকে চিনে ফেলেছে তাও আবার মেয়ে? নিজেকে বড্ড ফেমাস ফেমাস লাগছে এই মুহুর্তে আহানের।সব ভাবনা বাদ দিয়ে জবাব দিলো
— ইয়েস বাট হু আর ইউ? আই ডিড নট রিকগনাইজ ইউ।
— ড্রেনিলা,, মাই নেইম।ইউ ডোন্ট নো মি বাট আমি তমাক্কে চিনি
মেয়েটার ভাঙা ভাঙা বাংলায় আহান অবাক হয়।
— এই তুমি বাংলা জানো?
ড্রেনিলা ভ্রু কুচকে জবাব দেয়
— আই ডোন্ট আনডার্স্টান্ড হোয়াট ইউ আর সেইং
আহান এবার বুঝতে পারে এই মেয়ের বাংলার দৌড় কতদূর।
— হাউ ডু ইউ নো মি?আমাকে চেন কিভাবে?
— ও ইয়া। ইটস ম্যাজিক হ্যান্ডসাম। খাও খাও।আই উইল টেল ইউ লেটার।
আহানের খাওয়া শেষ হতেই ড্রেনিলা পোশাক পাল্টে চলে এলো। এসেই আহানের হাত টেনে উঠিয়ে বলে
— লেটস গো।
— হোয়ার?
— ইউ উইল আনডার্স্টান্ড হোয়েন ইউ গো উইথ মি
— অকে
একটা বাসার সামনে গাড়িটা থামল।লিফটে করে তিনলায় উঠে ড্রেনিলা কলিং বেল প্রেস করে।আহান এখনও ভাবছে একটা অপরিচিত মেয়ের সাথে এসে ঠিক করেছে কিনা।
দরজা খোলার পর সামনে দাড়ানো মানুষটাকে দেখে নিজের অজান্তেই আহানের চোখে অশ্রুকণা জমতে শুরু করে।
ইচ্ছে তো ভুত দেখার মতো চমকেছে।শ্বাস বুঝি থেমেই গেছে।হাত পা থর থর করে কাপছে। ভুল দেখছে না তো? সামনে তারই আহান? তার আহান?চোখের কোণ টা ভিজে আসছে।মাথা যেনো আর কিছু ভাবতে পারছে না
ড্রেনিলা সারপ্রাইজ বলে চিল্লানি দিলো।ওদের চোখের দিক তাকিয়ে ড্রেনিলা আবার বলে
— হেই গাইজ।ডোন্ট ক্রাই প্লিজ।স্মাইল স্মাইল
ইচ্ছে আর কিছু শুনতে পায় না চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে।চোখের পলকেই ইচ্ছে অজ্ঞান হয়ে ধপাস করে ফ্লোরে পরে গেলো।
ড্রেনিলা চিৎকার দিয়ে ওঠে।
— আহান শি হ্যাজ বিকাম সেন্সলেস।
চলবে,