তুইতেই আমি🏵পর্বঃ২৩

0
1999

🏵তুইতেই আমি🏵
লেখিকাঃইসরাত আয়রা ইচ্ছে
পর্বঃ২৩

🍁🌼🍁

কেটে গেছে আরও সতেরো দিন।আহান এখন বেশির ভাগ সময় ঘরের বাইরে থাকে। বন্ধুবান্ধব জোর করেই তাকে ক্লাসে নিয়ে যায়।ভার্সিটি ক্লাস করা বাধ্যতামূলক তাই ই আহান একপ্রকার বাধ্য হয়েই যায়। আহানের এমন অবস্থা তার কোনো বন্ধুই মেনে নিতে পারছে না।আহানের বেস্ট ফ্রেন্ড সাকিবই আহানকে ধরে বেধে ক্লাসগুলোতে নিয়ে যাওয়ার কাজ বেশি করে।

শিরিন রাকিবও ছেলের অবস্থা মেনে নিতে পারছে না।আহানের নেশায় বুদ হয়ে গভীর রাতে বাড়ি ফেরা , খাওয়া দাওয়া অনিয়ম, পড়াশুনা তো নেই।ছেলেকে এভাবে দেখতে তারা অভ্যস্ত না।তাদের ছেলে এমন হবে কল্পনার বাইরে।শিরিন রাকিব বেশ কয়েকবার নিধি আব্দুর রাহমান কে বুঝানোর চেষ্টা করেছে।তাদের এক কথা ” এই অবস্থা কিছু দিন পরেই ঠিক হয়ে যাবে।এতে ফিউচার নষ্ট হবে না।কিন্তু ওদের মিল হলে আহানের ফিউচারই নষ্ট হয়ে যাবে”

শিরিন সেদিন নিধির দিকে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটাই কথা বললো ” দেখবো এতে তুই আমার ছেলের ফিউচার কতো ভালো করলি। আর আমার ছেলে শেষ হয়ে গেলে আমার মেয়েকেও তোর কাছে দিব না।তখন নিজের ছেলের অবস্থা নিজ চোখে দেখবি কেমন লাগে ছেলে নেশা করে ঘরে ফিরলে”

সেদিন থেকেই থেমে গেল ইশাল আয়ানের যোগাযোগ। মূলত শিরিনই ইশালকে আটকে দিয়েছে।

এতো কিছুর পরও নিধি চুপ।ইচ্ছে তো নিজেকে রুম বন্দী করেই রেখেছে। খাওয়ার সময় বের হলে হয় নয়তো না।আয়ান ও রাগের বসে ঘরের মানুষের সাথে কথা বলে না।তাই সে ঘরে কি হচ্ছে তাও জানে না।

একদিন বিকেল বেলা ইচ্ছেকে দেখা গেলো বড় ব্যাগ নিয়ে বের হয়েছে রুম থেকে। গায়ে বাইরে যাওয়ার ড্রেস।আয়ানের রুমের সামনে ব্যাগ রেখে ভিতরে প্রবেশ করলো। আয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো “ভালো থাকিস পড়াশুনা করিস”।

আয়ান রেগে জবাব দিলো

— তুই ভালো থাকলেই হলো। নিজের ভালো দ্যাখ অন্যের কথা তোর মুখে সাজে না।

ইচ্ছে কষ্ট পেলেও মুচকি হাসে।তার ভাইও তার উপর রাগ ভাবতেই আর এক চোট হাসে।তারপর বের হয়ে যায়।আয়ানের এতক্ষণে খেয়াল আসে তার বোন ওত বড় ব্যাগ নিয়ে যাচ্ছে টা কোথায়?

পিছু পিছু আসতেই দেখে তার বাবা মা ও রেডি হয়ে কোথাও বেড়োচ্ছে।

আয়ান এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছ কই তোমরা।
নিধি বলে” তোমার আপুকে এয়ারপোর্টে পৌঁছতে যাচ্ছি তুমি বাসায় থেকো”

— কেন আপু যাচ্ছে কই?এয়ারপোর্টে কাজ কি?

নিধি গম্ভীর মুখে বললো ” চলে যাচ্ছে বিদেশ ”

— মানে কি কখন হলো এগুলো আর আমি টের পেলাম না।আমাকে জানানোর কোনো প্রয়োজনীয়তাই নেই?

— না নেই। তোমার আপু ভার্সিটিতে স্টুডেন্ট ভিসার জন্য আবেদন করেছিলো। সেটা কনফার্ম হয়ে গেছে তাই চলে যাচ্ছে।দেরি হয়ে যাচ্ছে যাই ঘরে থেকো।

গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পরতেই আয়ান ছাদে যায়।উদ্দেশ্য ছাদ থেকে আহানদের ঘরে ঢুকবে। এই খবর আহান ভাইকে দিতেই হবে।ভাগ্যক্রমে ছাদেই আহানকে পেয়ে গেলো শোয়া অবস্থায়। নেশায় বুদ হয়ে অচেতন অবস্থায় পরে আছে।এই দুনিয়ায় আর খবর নেই তার কাছে।

আয়ান বেশ কবার ডাকলো কাজ হয় নি।হবে বলেও মনে হলো না।তাড়াহুরো সময় আয়ানের মাথায়ও কিছু আসে না

******

আহানের ঘুম ভাংলো পাঁচ ঘন্টা পরে।সে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে।ফ্রেস হয়ে নিচে নামে।সামনের ঘরে সবাই গম্ভীর মুখে বসা।রাকিব শিরিন ইশাল। এমনকি আয়ানও বসা।
আহান বেশ কয়বার জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে এভাবে মুখ করে আছো কেন সবাই?

ইশাল কাদো কাদো স্বরে উত্তর দেয়
–ভাইয়া ইচ্ছাপু চলে গেছে।

— বেড়াতে গেলে গেছে আমাকে বলার কি আছে?

এবার আয়ান বলে
— না ভাই বিদেশ চলে গেছে। স্টুডেন্ট ভিসা নিয়ে।পড়াশোনা শেষ করে ফিরবে হয়তো। আমি জানতাম না কিছু।ঘর থেকে যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেলো। তোমাকে ডেকেছিলাম কিন্তু তুমি নেশা……….

আহান স্থির কন্ঠে জিজ্ঞেস করে
— কখন গেছে

— পাঁচ ঘন্টা আগে ভাই।

তখন আহান কাদবে হাসবে নাকি মরে যাবে তা নিজেই বুঝতে পারছিলো না।একদলা কষ্ট গলার কাছে আটকে কন্ঠস্বরকে চেপে ধরেছে খুব শক্ত করে।খুব।চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো।তারপর আর কিছু মনে নেই আহানের।

আহানের দুদিন পরে জ্ঞান ফেরে। প্রচুর অ্যালকোহল আর মানুষিক প্রেসার খাওয়া দাওয়া অনিয়মের কারণেই এমন হয়েছে।আহানকে নিধি আব্দুর রাহমান হসপিটালে দেখতে গেলে খুব খারাপ ভাবে অপমান করে পাঠিয়ে দেয় শিরিন। যা আয়ান ইশালের দূরত্ব আরব বাড়িয়ে দেয়।ওরা দুজন বিনা অপরাধেই পরিস্থিতির শিকার হচ্ছিলো বার বার।শিরিনই ইশালকে কড়া নজরে রাখছে।আয়ান এখন বাবা মায়ের সাথে কথাই বলে না।হাসি খুশি পরিবার দুটো দেড় মাসের মধ্যেই শেষ হয়ে গেলো। আহানকে বাসায় নিয়ে আসার পরে আহান দশ দিন মুখ দিয়ে টু শব্দটাও করেনি।শিরিনই আহানকে খাওয়াই দিতো।আহানের সব কাজ শিরিনই করতো। আহানকে দেখা যেতো মাঝে মাঝে দুচোখ দিয়ে পানি ফেলছে।আর ফোনে কিছু একটা দেখছে।যা কেউ আসলেই বন্ধ করে দিচ্ছে।

আরও দশ বারো দিন পর আহান বাসার মানুষের সাথে কথা বলা শুরু করে।মানুষগুলো কেন তার কারণে কষ্ট পাবে? তাই ই নিজেকে সামলে নিয়েছে কিন্তু বুকের ভিতরের জালা নিজেই বুঝে।

*****

বিকেলবেলা আহান নিজের ব্যালকুনির দোলনাটায় বসে এক দৃষ্টিতে ইচ্ছের ব্যালকুনির দোলনার দিকে তাকিয়ে আছে।হঠাৎ কাধে কারোর হাতের ছোয়া পেয়ে সাভাবিক ভাবেই পিছনের দিকে তাকালো

— কি হয়েছে আম্মু? আসো বসো

শিরিন হাসি দিয়ে ছেলের পাশে বসে চুলে হাত দিয়ে চুলগুলো অগোছালো করে দেয়।

— আম্মু ওখানটায় আমি ইচ্ছুর সাথে অনেক বসে গল্প করেছি। দিনগুলো কেমন অতীত হয়ে গেল বলো? চাইলেও দিনগুলোকে বর্তমানে আনতে পারছি না আমি।অনেক চেষ্টা করছি আম্মু। বাট আম ফেইলড।
আহানের কন্ঠস্বর আটকে আসছে।

শিরিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার ছেলে এতো দিন পর ইচ্ছের সম্পর্কে কিছু বলেছে।আজই তার কাছে সুযোগ

— আহান ইচ্ছের সম্পর্কে কিছু বলার ছিলো

— শুনতে চাই না আম্মু।বাদ দাও

— শুনলে হয়তো তুই তোর না পাওয়া প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাবি।যে কারণে ইচ্ছে তোকে ছেড়ে চলে গেছে তা জানতে পারবি।

এবার আর আহান না করেনি আবার হ্যা ও বলে নি ছেলের নিরবতা শিরিন সম্মতি ধরে নিলো

— আহান তোর মনে আছে এসএসসি এক্সামের আগে ইচ্ছে একবার খুব অসুস্থ হয়ে গেছিলো?

— হুম

— তাহলে নিশ্চয়ই এটাও মনে আছে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে ওঠার কিছুদিন পরই নিধি ওর বিয়ে ঠিক করছিলো?

— হুম।

— তাহলে শুন। আমি মা হিসেবে যতটুক বলতে পারবো তা দিয়ে বুঝে নিবি। ইচ্ছের টিউমার ছিলো। জরায়ু, যেটা একটা মেয়ের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ।এটা নিয়ে লজ্জার কিছু নেই।মেয়েদের সন্তান হওয়ার জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করে।ওর টিউমার সেখানেই ছিল।খুব পেটে ব্যাথায় অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে ওর এই রোগ ধরা পরে।যেহেতু বাচ্চা মেয়ে বিয়ে হয় নি।অপারেশন করা সম্ভব ছিলো না তাহলে আর বাচ্চা হবে না তাই।ঔষধ দিয়েই কন্ট্রোলে রাখা হতো। তাই নিধি ঠিক করে তারাতারি বিয়ে দিয়ে দেবে।আর তারাতাড়ি বাচ্চা নিলেই অপারেশন টা সেরে ফেলা যাবে।মেয়ে মানুষের সন্তান জন্ম দেওয়ার ক্ষমতা ছাড়া তেমন মূল্য নেই।পরে যদি বেরে যায় বিয়েও হবে না মেয়েটার।এসব ইচ্ছেও জানত না।সে জানত খাবার পরে তার দুটো ঔষধ খেতে হবে নইলে পেটে ব্যাথাটা বেড়ে যাবে।নিধি খাবার টেবিলেই ইচ্ছেকে ঔষধটা খাইয়ে দেয়। হাতেও দেয় না ইচ্ছের।যখন ইচ্ছেকে দেখতে এলো সেদিন তুই বাইরে থেকে এসে যখন শুনলি ইচ্ছের বিয়ে।তুই সেদিন মেহমানের সামনেই সারা বাড়ি মাথায় তুললি।তোর খেলার সাথির এতো তারাতাড়ি বিয়ে মানতে পারলি না।চিৎকার করে শুধু বলছিলি ওকে বিয়ে যে করবে তাকে খুন করবো।বাল্য বিবাহ কেস করবো এই সেই।যারা দেখতে এসেছিল তারা চলে গেলো তোর কাছে অপমানিত হয়ে। নিধি তোকে খুব ভালোবাসে তাই সেদিন ও চুপ ছিলো।আর ইচ্ছে তো বরাবরের জন্যই চুপচাপ একটা মেয়ে। রাহমান ভাই রাগ করলেও নিধি মানিয়ে নিয়েছিলো।তুই নিধিকে দিয়ে প্রমিস করিয়েছিলি ইচ্ছের বিয়ে যাতে না দেয় নিধিও তাই করলো। নিধি ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছিলো মেয়ের জীবনটা।কিন্তু যখন শুনলো তোর সাথেই সম্পর্ক জড়িয়েছে নিধি তখন আর রাজি হয় নি। যেহেতু ইচ্ছে এখন ও ঔষধের উপরই আছে আর অনেক দিন হয়ে গেছে অপারেশন করে নি তাই ওর জন্য সন্তান জন্ম দেয়া মানে মৃত্যুকে ডেকে আনা।বাচ্চা বাচবে নয়তো ইচ্ছে।আর অপারেশন করলে তো আর সন্তান জন্মই দিতে পারবে না। আর এইসব ইচ্ছেকে খুলে বলায় ইচ্ছে তোর ফিউচারের কথাই ভেবেছে।নিধি যা বলেছে তাই করেছে। নিধিকে অনেক বার বুঝিয়েছিলাম অপারেশন করে ফেল।বাচ্চা লাগবে না ইচ্ছেকে পেলেই আহানের আর কিচ্ছু চাই না। কিন্তু নিধি তা মানে নি। নিধি বলছে তুই ইচ্ছের বিয়ে ভেঙে দিয়েছিলি সেই অপরাধবোধ থেকে নাকি আমি দয়া করছি।

শিরিন দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

সব কিছু শুনে আহান কি বলবে বুঝতে পারে না।ইচ্ছের উপর রাগ করবে নাকি কি করবে তা নিজে ভেবে পাচ্ছে না।ইচ্ছে কেন বুঝলো না ওর ইচ্ছেকে ছাড়া কোনো চাওয়া ছিলো না।

আহানের হঠাৎ মনে পরে গেলো একদিন সে ইচ্ছের কাছে কিউট কিউট বেবি খুব করে আব্দার করে ছিলো।

সেদিনের কথা,
চাঁদনী রাত।আহান ইচ্ছের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।হঠাৎ ইচ্ছের পেটে দুটো চুমু খেলো।পেটে শক্ত করে মুখ গুজে রাখলো।ইচ্ছে নিজেকে খুব কষ্টে শক্ত রেখেছে। আহান হেসে বললো

–শ্বাস বন্ধ করে রেখেছিস কেন?

— এমনি আহান।

— পেটে মুখ দিয়েছি তাই সহ্য করছিস দম বন্ধ করে?

— হু

— সহ্য করছিস কেন কাছে টেনে নে।যা ইচ্ছা হয় করে ফেল(মজা করে)

— নাহ আমার লজ্জা করে।

— আচ্ছা। তবে বিয়ের পর আমার কিন্তু তোর মতো একটা শান্ত নরম গুলুমুলু গালওয়ালা ইচ্ছু চাই। একদম তোর মতো। চাই ই চাই। আমার এক প্রিন্সেস হবে।তার হাত ধরে হাটবো।কতো মজা হবে বল? ভাবতেই আমার কেমন যে লাগে। ছোট্ট ছোট্ট হাতের আঙুল হবে।সব কটা অাঙুল দিয়ে আমার একটা আঙুল টেনে ধরবে।এটা হয়তো সব থেকে সুন্দর মুহুর্ত তাই না বল।
সেদিন আহানের কথায় খুশির ঝরনা ঝরছিল।
আহান এসব বলেই আবার ইচ্ছের পেটে মুখ গুজে লাগাতার দুটো চুমু খেল।

ইচ্ছে এতক্ষণ লজ্জায় লাল হচ্ছিলো। আহান মুখ তুলে আবার হাত বাড়িয়ে বললো কথা দে দিবি একটা কিউট মেয়ে বাবু?

ইচ্ছে হাতটা শক্ত করে ধরে একরাশ লজ্জা মিশ্রিত গলায় বললো “একটা আপনার মতো ছেলে বাবুও দেব”

আহান অতীত থেকে ফিরে এলো। নিজেকে নিজের শেষ করে দিতে ইচ্ছা করছে।কেন ওয়াদা করালো ও ইচ্ছেকে দিয়ে? কেন? কেন বললো না ইচ্ছে তোকে ছাড়া আর কিচ্ছু চাই না কিচ্ছু না।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here