#Ragging_To_Loving__2
#পর্বঃ- ৩৭
#রিধিরা_নূর
নূর থামানোর পূর্বেই আফরান পুষ্পর সামনে গিয়ে দাঁড়াল। চোখ মুখে এক রাশ রাগ। পুষ্প,রিহান একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল। আফরানের রাগ সম্পর্কে দুজনেরই ধারণা আছে। রিহানের এখনো মনে কলেজে এক ছেলের সঙ্গে ঝামেলায় হওয়ায় রেগে তাকে মেরে রক্তাক্ত করেছিল। ছেলেটির মাঝে রিহান এখন নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছে। বন্ধু হিসেবে আফরান ভালো। ভীষণ ভালো। কিন্তু একবার রেগে গেলে কারো কথা শুনে না।
আফরান — কবে থেকে চলছে? (শান্ত গলায়)
পুষ্প — ভা..ভাই।
আফরান এক নজর তাকাতেই পুষ্পর গলা শুকিয়ে গেল। মুখ দিয়ে কোন শব্দই বেরুচ্ছে না। রিহান দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
আফরান — আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি।
রিহান আমতা আমতা করে সব বলল। আফরান শান্ত হয়ে সব শুনল।
আফরান — রিহান তুই আমার বেস্টফ্রেন্ড। ছোট বেলা থেকে আজ পর্যন্ত আমাদের দৃঢ় বন্ধুত্ব। তোর সম্পর্কে যতটুকু না তুই জানিস তার চেয়ে বেশি আমি জানি। এবং আমি এটাও জানি আমার বোনের জন্য তুই বেস্ট পার্টনার হবি। কিন্তু পুষ্পকে নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন। যে স্বপ্ন আমাকে নিয়ে ছিল। বাবা চেয়েছিল আমি এডভোকেট হয়। কিন্তু আমার স্বপ্ন, আমার প্যাশন অনলি মিউজিক। এবং বাবার আদরের মেয়ে পুষ্প। তাই সে-ই অটল সিদ্ধান্ত নেয় এডভোকেট হবে। তোদের রিলেশন নিয়ে আমার আপত্তি নেই। কিন্তু তোদের ফিউচার….
পুষ্প আফরানকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
পুষ্প — আমি বাবার স্বপ্ন পূরণ অবশ্যই পূরণ করব। তোমাদের কখনো নিরাশ হতে দিব না। (রিহানের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো)
নূর কোমরে দুই হাত দিয়ে নাক সিটকানি ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু কেউ তার দিকে কোন ধ্যান দিচ্ছে না।
নূর — বাহ্! মানে জাস্ট ওয়াও। সব প্লানিং করলাম আমি। সব পরিশ্রম করলাম আমি। সব টেনশন মাথায় নিয়ে ঘুরলাম আমি। আর সব ক্রেডিট নিয়ে গেল এই উগান্ডার প্রেসিডেন্ট।
আলিফা — এদিকে যে আমার কোমর ভাঙল তার ক্রেডিটও দিল না। আয় বোইন আমরা এক লগে কাঁদি।
রিহান — সরি আলিফা। তখন কি করব বুঝতে পারিনি তাই হালকা করে ধাক্কা দিলাম।
আলিফা — হালকা? আমি কোমর সোজা করতে পারছি না।
পুষ্প — তুই তো আমার জান। আমার মিষ্টি গুড়। (দু’হাত বাড়িয়ে)
নূর গুটিসুটি পায়ে দৌড়ে এসে আফরান আর পুষ্পর মাঝে দাঁড়াল। হাতের কুনুই দিয়ে আফরানের পেটে খোঁচা মেরে দূরে ঠেলে দিল। আফরান পেটে হাত দিয়ে বিরক্তিকর ভঙ্গিতে নূরের দিকে তাকাল। নূর আফরানকে ভেঙচিয়ে পুষ্পকে টেনে রিহানের পাশে দাঁড় করালো। পুষ্প,রিহান মিষ্টি হাসি দিল। এই বুঝি নূর তাদের জড়িয়ে ধরবে। কিন্তু নূর রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে দুজনের চুল মুটি ধরল।
নূর — সাহস কি করে হয় তোদের দুইটার। আমার জন্য তোদের প্রেমের মিলন হলো আর তোরা আমাকেই ভুলে গেলি। হাউ অকৃতজ্ঞ।
আফরানের ফোন আসায় তাদের কাছ থেকে বিদায় নিল। ক্যাফেটেরিয়ার অপর পাশে একজন লোক অপেক্ষা করছে। দেরি করে আসার জন্য আফরান বিনম্রতা সহিত লোকটির কাছে ক্ষমা চাইলো। লোকটিও বিনম্র ভাবে আলাপ করল।
সিমা — চল না আমরা ভার্সিটি যায়। এই লাভ বার্ডস একান্তে কিছু সময় কাটাক।
নূর — হ্যাঁ! জানি ঢং করতে হবে না। তুমি যে তোমার লাভ বার্ড-এর সঙ্গে একান্তে সময় কাটাতে চাও সেটা বল। তোরা ভার্সিটি যাহ্। রিহান,পুষ্পর জন্য কিছু আয়োজন করেছি। আমি গিয়ে সব ঠিক করে এরপর আসছি।
সিমা — বাহ্! নূর বাহ্! নিজের ভাই এবং বেস্টফ্রেন্ডের জন্য ডেইট প্লান করছস। আজ আমরা বেস্টফ্রেন্ড না বলে।
নূর — জুতা খুইলা মোজা দিয়া বাইরামু। ফকিন্নির দল। তোরা যে প্রেম করছস আমাকে জানিয়েছিস? হ্যাঁ! তলে তলে টেম্পো চালাও আর আমরা বললেই হরতাল। এক্কেরে থাপরাইয়া মুতাই দিমু।
সিমা আমরিন একে অপরের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেল। মেহের হাসছে।
আলিফা — তোরা যা। আমার কোমরের অবস্থা ভালো না। সোজা করতে পারছি না। বাসায় গিয়ে একটু বিশ্রাম নিব।
নূর — ঠিক আছে। তোরা যা।
বাকিরা চলে গেল। ভেতরে প্রবেশের সময় খেয়াল করল আফরান একা বসে আছে। একেবারে নিস্তব্ধ, মাথা নিচু করে স্থির হয়ে আছে। নূর ভ্রুক্ষেপহীন ভেতরে গেল। একজন ওয়েটারের সঙ্গে কথা বলে সব বুঝিয়ে দিল। বের হওয়ার সময় আবারও দেখল আফরান একই অবস্থায় বসে আছে। নূর চমকে উঠল যখন দেখল আফরানের চোখ থেকে এক ফোঁটা অশ্রুজল টুপ করে তার হাতের উপর পড়ল। নূর বিস্ময়ের ঘোরে ঘিরে আছে। আফরানের মতো শক্ত মানুষের চোখে জল? ব্যাপারটা হজম হচ্ছে না। নূর আফরানের পাশে এসে দাঁড়াল অনেক্ষণ যাবত আফরানের খেয়াল নেই। নূর কাঁপা কাঁপা হাতে আফরানের কাঁধে স্পর্শ করল। কাঁধে কারো ছোঁয়া পেয়ে আফরান মাথা উঁচু করে দেখে নূর। হুট করে নূরকে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয়। দুজনে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। আফরানের হৃদস্পন্দন মধুর ধ্বনি নূরকে মাতোয়ারা করে তুলছে। দুজনেই স্থির। আফরান নূরকে এমন বদ্ধ করে আছে যে নূরের শ্বাসরুদ্ধ হচ্ছে।
আফরান — সবকিছু স্বপ্নের মতো লাগছে। আনন্দ লাগছে আবার ভয়ও লাগছে। চোখ খুললে স্বপ্নের ন্যায় হারিয়ে যাবে না তো। কি করব বল। আমি বুঝতে পারছি না।
নূর — কি হয়েছে বলুন। (চাপা গলায়)
নূরের কথায় আফরানের ধ্যান ভাঙল। তবুও ছাড়ছে না। নূরের দম আটকে আসছে। আলতোভাবে আফরানকে সরিয়ে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো। আফরান বেশ লজ্জিত হলো। আবেগের বশে কি করে ফেলল। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে উপস্থিত লোক জনের নজর তাদের উপর।
নূর — কিছু হয়েছে?
আফরান প্রফুল্লচিত্ত হাসি দিল। খুশিতে আত্মহারা হলে যেমন হয়। নূর বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকাল। একটু আগে কাঁদছিল। এখন আবার পাগলের মতো হাসছে। ব্যাপার কি? মাথার স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেল নাকি? নাকি ভূতপ্রেত ভর করল? নূর যথেষ্ট দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করল।
আফরান — জানো আমি এখানে কেন এসেছিলাম? (উত্তেজিত হয়ে)
নূর — আমি কীভাবে জানব? আমাকে বলে এসেছেন নাকি?
ত্যাড়া জবাব দিল। অন্য সময় হলে আফরান রেগে যেত। কিন্তু আফরান হেসে উত্তর দিল।
আফরান — সংগীত পরিচালক জামান হামিদ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। সিনেমার গানের জন্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে আমাকে বেছে নিয়েছে। ভাবতে পার! আমার সত্যি বিশ্বাস হচ্ছে না। এটা স্বপ্ন নয়তো? একটা চিমটি দাও প্লিজ।
নূর — এত বড় খুশির সংবাদ। সামান্য চিমটি দিয়ে কি হবে। আমি বরং আপনাকে কামড় দেয়। (বলতে না বলতে কামড় বসিয়ে দিল।)
আফরান — আহহ! (হাত ঝাড়ছে) আজ মুড ভালো দেখে কিছু বললাম না। কিন্তু এটা স্বপ্ন নয়। সত্য।
নূর — আপনি পরিশ্রম করেছেন বিধায় ফল পেয়েছেন। অনেক অনেক শুভেচ্ছা। অভিনন্দন। (হাত বাড়িয়ে)
আফরান — ধন্যবাদ। (হাত মিলালো)
নূর বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আফরান চুক্তিপত্র নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। গাড়িতে উঠে দেখে নূর বোধহয় গাড়ির অপেক্ষা করছে।
আফরান — কোথাও যাবে?
নূর — ভার্সিটি যাব। বাস, রিকশা কোন গাড়ি পাচ্ছি না।
আফরান — আমিও ভার্সিটি যাচ্ছি। তুমি চাইলে ড্রপ করতে পারি।
নূর অনেক্ষণ ভেবে মনে সংকোচ নিয়ে সম্মতি জানালো। দুজনে পাশাপাশি বসল। আফরান বারবার আড়চোখে নূরের দিকে তাকাচ্ছে। তখনকার ঘটনার জন্য লজ্জিত।
আফরান — (অপরিচিত লোকের সামনে নূরকে এভাবে জড়িয়ে ধরা লজ্জাজনক ব্যাপার। সবার সামনে তাকে লজ্জিত হতে হলো। তবুও সে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার জন্য টু-শব্দ করল না। এখন যদি আবার এখন সেই বিষয়ে তাকে কিছু বলি তাহলে বিদঘুটে পরিস্থিতি তৈরি হবে।)
দুজনে চুপটি ধারণ করে সম্পূর্ণ পথ কাটিয়ে দিল। ভার্সিটির কিছু দূরত্বে নূর নেমে গেল। কারণ সে চাই না কেউ উল্টাপাল্টা চিন্তা করুক। দুজনে চোখাচোখি করছে।
আফরান-নূর — কি?
একই সময়ে বলায় দুজনে হাসলো।
নূর — যান।
আফরান — জান? কার জান? (অবাক হয়ে)
নূর — আপনাকে যেতে বলছি। (দাঁতেদাঁত চেপে)
আফরান — ওহ্! তুমি আগে যাও।
নূর — না। আপনি আগে যান।
আফরান — তুমি যাও।
নূর — এখন আমরা তুমি আগে যাও, আপনি আগে যান এভাবে ফরমালিটি করতে থাকব?
আফরান — আবার খিটখিট শুরু। তোমাকে যেতে বলছি কারণ এটা পার্কিং এরিয়া। তুমি গেলে এদিকে গাড়ি পার্ক করব।
নিজের বোকামিতে নূর জিবে কামড় খেল। জোর পূর্বক হেসে ভৌ-দৌড় দিল। আফরান ফিক করে হেসে দিল।
আফরান — হায়! মিস খিটখিট।
এক মাস পর_______________________
আফরানের গানের রেকর্ডিং সম্পন্ন হলো। সবাই তাকে শুভেচ্ছা জানালো। আগামী দিনের জন্য শুভকামনা জানালো। তিন দিন পর গান মুক্তি পাবে। সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।
গত এক মাস ধরে আলিফা আরিফকে সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেছে। সবার সামনে স্বাভাবিক, হাসি-খুশি থাকে। আড়ালে একাকিত্বে লুকিয়ে কাঁদে। এই বিদ্রোহী মন বারবার তাকেই চাই যে বারবার এই মনে আঘাত করে। পূর্বে আরিফের অবহেলা সে এমনিতেই মেনে নিয়েছিল। কিন্ত সেদিন আরিফের কথাগুলো তার মনে ভীষণ আঘাত দিয়েছিল। মাঝে মাঝে এমন হয় মানুষ হাজারো কটু কথা শোনালে গায়ে লাগে না। কিন্তু আপনজন যদি উচ্চস্বরে কোন কথা বলে তা হৃদয়ে আঘাত করে। আলিফার ক্ষেত্রেও তাই। আরিফের প্রতি তার অনুভূতি ভিত্তিহীন নয়। এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে সব গ্লানি নিজের মাঝে আবদ্ধ করে নেয়।
আলিফার অবহেলা সবাই খেয়াল করল। কিন্তু তার যথা যুক্ত কারণ কেউ খুঁজে পেল না। তাই এই প্রসঙ্গে কেউ কিছু বলল। আরিফও ব্যাপারটা খেয়াল করল। কিন্তু সেও কিছু বলল না।
তিন দিন পর আজ আফরানের গান মুক্তি পেল। আচমকা বিষন্নতার আঁধার ছেয়ে গেল।
আফরান গানটা সুন্দর করে গেয়েছে ঠিকই।
কিন্তু পরিচালক গানটার সাথে মানানসই থিম মিলাতে পারেননি। উপস্থাপনাটা কোন ব্যক্তির মন ছুঁতে পারেনি। গানের সাথে যুক্ত থাকে সেই গানের সাথে কোন ধরনের থিম মিলবে সে হিসাবে উপস্থাপনা করা হয়। যেটা এখানে ফুটে উঠেনি। ফলস্বরূপ আফরানের গান কারো মন ছুঁতে পারি নি। এইজন্যেই আফরান গান টা ফ্লপ হয়।
নিজের কক্ষ অন্ধকার করে বসে আছে আফরান। সংগীত আফরানের কাছে তার সব। বাবার অবাধ্য হয়ে উকালতি ছেড়ে সংগীত বেছে নিয়েছিল। যার কারণে আজ পর্যন্ত তার বাবা তার উপর ক্রুদ্ধ। অবশেষে তার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছিল। বাবাকে আশার এক কিরণ দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল। বাবাকে আশার কিরণ দিতে পারেনি। কিন্তু নিজে বিষন্নতার আঁধারে হারিয়ে গেল। মেনেই নিল সংগীত বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত তার ভুল ছিল। এক পলক গিটারের দিকে তাকাল। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।
.
.
.
চলবে
বিঃদ্রঃ পরবর্তী পর্ব আগামীকাল পাবেন