হারানো সুর পর্ব-১৯

0
923

হারানো সুর- ১৯ তম পর্ব
©শাহররিয়ার

সাবার শরীরের জ্বর কমেনি খুব চিন্তা হচ্ছে। সাবাকে রেখে বিকেলে আমি একাই ডাক্তারের কাছে আসলাম। এবং তাকে সবটা জানালাম।

ডাক্তার: দেখুন ভয়ের কোন কিছু নেই, সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। আসলে আবহাওয়ার পরিবর্তনটা ও মানিয়ে নিতে পারেনি। দুই চার দিনের ভিতর ঠিক হয়ে যাবে। আমি আরও কিছু ঔষধ দিচ্ছি চালিয়ে নিন।

ডাক্তার আরও কিছু ঔষধ দিলো, আমি সেগুলো নিয়ে বাসায় ফিরে আসলাম। সাবার পাশে বসে ওর মাথা হাতিয়ে দিচ্ছি। এমন সময়

সাবা: মা আমরা নানু বাড়িতে যাবো না?

তুমি বড় হলে আমরা যাবো। আমি যে চাকরি নিয়েছি মা। অনেক ছোট ছোট ছেলে মেয়েকে পড়াবো তোমার মত।

সাবা: নানু, আংকেল আসবে না আমাদের সাথে দেখা করতে?

হুম আসবেতো তুমি বড় হলেই আসবে এখন কথা না বলে চুপ করে শুয়ে ঘুমিয়ে থাকো।

সাবা চুপ করে শুয়ে রইলো। আমি উঠে যেয়ে ব্যাগ খুলে ডায়েরিটা বের করে নিয়ে এসে সাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টাতে শুরু করলাম।

ডায়েরির প্রথম পৃষ্ঠা থেকে: আমার তেমন ডায়েরি লেখার অভ্যাস নেই, আজ কত বছর পর ডায়েরিতে লেখছি তা মনে করতে পারছি না। বেশ কিছুদিন আগে রত্না নামক একটা মেয়েকে বাসায় নিয়ে এসেছি ওর সাথে ছোট একটা বাচ্চা মেয়েও রয়েছে নাম সাবা। খুবি মিষ্টি চেহারা বাচ্চা মেয়েটার আমার ভীষণ ভালো লাগে সাবার সাথে খেলা করতে।

অপর পৃষ্ঠায়: দেখতে দেখতে ছয় মাসের বেশী ওরা দু’জন আমার বাড়িতে। মাকে টুকটাক কাজে সহযোগিতা করে। মা রত্নাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে। যখন জেনেছে মেয়েটা খুব অসহায় ওর কেউ নেই। সবচেয়ে বড় কথা স্বামী পরিত্যাজ্য। মা চায় মেয়েটা নিজের পায়ে দাঁড়াবে। শিক্ষিত হবে। সকলে মিলে এক সাথে ঈদের মার্কেটিং করলাম। বাসায় এসে মেয়েটাকে খুব কান্নাকাটি করতে দেখে আমার মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। আমার মনে হলো মেয়েটা তার স্বামী সংসারের কথা মনে করেই কাঁদছে। তাই আমি ঈদের পর দিন সেখানে চলে আসলাম সকল ঘটনা জানার জন্য। বাসায় জানে আমি কলিগের গ্রামের বাড়িতে এসেছি। কিন্তু না আমি এসেছি রত্নার শ্বশুড় বাড়িতে। কিন্তু ওর স্বামীকে পেলাম না। সে সত্যি সত্যিই বিয়ে করেছে আর সে স্ত্রীকে নিয়েই তার বাবার বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে।

সব কিছু আমি জানতে পারি রত্নার শাশুড়ির কাছে। সত্যিই রত্নার শাশুড়ি খুব ভালো মানুষ। আমি উনার কাছে মিথ্যা বলতে পারলাম না। বলে দিলাম রত্না আমার বাড়িতেই আছে। উনি কান্না করে দিলো। দু’হাত দিয়ে আমার হাত চেপে ধরে বললো আমার মেয়ে আর নাতনীটাকে দেখে রাখবেন বাবা। এই অশান্তি থেকে গিয়ে বেঁচে গিয়েছে আমি আল্লাহর কাছে নামায শেষে ওর ভালোর জন্য দোয়া করি। আমার ছেলেটা নষ্ট হয়ে গেছে বাবা। এখানে থাকলে আমার নাতনী রত্না কেউ বাঁচতো না।

আরও অনেক কথা হলো উনার সাথে। আশেপাশের মানুষ জনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম রত্না সত্যিই খুবি ভালো একটা মেয়ে ছিলো। স্বামীটার চরিত্র খারাপ হওয়াতে আর সংসার করতে পারলো না।

আমি রত্নার স্বামীকে বুঝিয়ে রত্নাকে তার কাছে ফেরৎ দেবার জন্য গেলেও। রত্নার শাশুড়ি আর গ্রামের অন্য মানুষ জনের কথায় বুঝতে পারলাম তাকে আর এখানে ফেরৎ পাঠানো যাবে না। আসলে সে চলে যেয়ে খারাপ কিছুই করেনি। বরং ভালোই করেছে। এখানে থাকলে হয়তো তিলে তিলে মারা যেতো মেয়েটা। সব কিছু জানার পর মেয়েটার প্রতি খুব মায়া হচ্ছে।

এরপর, এক বছরের বেশী সময় রত্না আমাদের বাড়িতে, আজ ওর ইন্টার এক্সাম ছিলো আমিই সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু অফিসের কাজে আটকে যাবার কারণে আসতে দেরী হয়ে যায়। কিন্তু রত্নাকে আমি যেখানে দাঁড়াতে বলেছিলাম ও সেখানেই দাঁড়িয়ে ছিলো। রোদ্দে ঘেমে মেয়েটা একাকার হয়ে গিয়েছিলো।গাড়ির ভিতর বসে যখন হিজাবটা খুলে রাখলো তখন দেখতে পেলাম ওর ফর্সা মুখটা রোদে পুড়ে লাল টকটকে হয়ে গিয়েছে। সব দোষই আমার, আমি যদি সময় মত আসতাম তাহলে এমনটা হতো না।

ওকে নিয়ে আইসক্রিম খেলাম। ওর আইসক্রিম খুব পছন্দের আমি বুঝতে পারলাম। আমি অপলক ও খাওয়া দেখে চলেছি ও মাথা নিচু করে খাচ্ছে।

ডায়েরির এই পর্যন্ত পড়ে আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। মানুষটা আমার জন্য আমাদের গ্রামে গিয়েছিলো। যাতে করে আমি শাকিলের কাছে যেতে পারি। আমার এই মুহুর্তে আর সামনের পৃষ্ঠা গুলো পড়ার মত সাহস হচ্ছে না। তাই ডায়েরিটা বন্ধ করে রেখে দিলাম। সাবা ঘুমিয়ে রয়েছে আমি ওর ঘুমন্ত মুখে আলতো করে চুমু এঁটে দিলাম।

দেখতে দেখতে সাতটা দিন কেটে গেলো। সাবার শরীরও অনেকটা সুস্থ আমি স্কুলে ক্লাস নিচ্ছি এমন সময় পরিচিত একটা কণ্ঠ দরজার বাহির থেকে বুবু বলে ডেকে উঠলো। আমার সমস্ত শরীর কেঁপে উঠলো দীর্ঘ পাঁচ বছর পর আমি এই ডাকটা শুনতে পেলাম। রুমন এসেছে, আমি ভেবেছিলাম হয়তো ও চিঠি পায়নি, তাই কোন উত্তর আসেনি। কিন্তু ও নিজেই আমার সাথে দেখা করতে ছুটে এসেছে। আমার দু’চোখে পানি টলমল করছে। আমি ছুটে যেয়ে দরজার সামনে দাঁড়ালাম।

রুমন ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।

রুমন: বুবু কতদিন পর তোমাকে দেখছি, তোমার মুখটা এতো মলিন হয়ে আছে কেন? আমাদের সাবা বুড়িটা কোথায় কেমন আছে?

আমি বাচ্চাদের ছুটি দিয়ে দিলাম। সাবা ভিতর থেকে বের হতেই দেখিয়ে দিলাম। রুমন ছুটে যেয়ে সাবাকে কোলে তুলে নিলো। রুমনকে নিয়ে বাড়িতে চলে আসলাম। রুমন আর সাবা দুষ্টমি করছে, কেমন আছিস ভাই?

রুমন: খুব ভালো আছি বুবু কতদিন পর তোদের দেখা পেয়েছি আমি কি ভালো না থেকে থাকতে পারি?

চাচা, চাচী কেমন আছে?

রুমন: হুম দু’জনেই ভালো আছে। মা বাবা তোকে খুব করে মনে করে। তোর জন্য কিছু খবর আছে।

কি?

রুমন: তোর শাশুড়ি আর শাকিল ভাই দু’জনেই মারা গেছেন।

আম্মা মারা গেছেন কথাটা শুনে যেন হৃদয়টা ফেটে যাচ্ছিলো। চোখ বেয়ে নিজের অজান্তেই টপটপ করে পানি গড়িয়ে পরছে। খুব কষ্ট লাগছে আমার মেয়েটা অল্প বয়সে এতিম হয়ে গেছে। কি করে হলো এমনটা?

রুমন: তোর শাশুড়ি তুই চলে আসার পর থেকেই অসুস্থ থাকতো শাকিল ভাই তেমন কেয়ার করতো না। তুই আসার বছর খানিক পরেই উনি মারা যান। ব্যাগ থেকে একটা চিঠি বের করে দিয়ে এটা শাকিল ভাই তোকে দেবার জন্য আমাকো দিয়েছিলো।

আমি চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।
প্রিয়, রত্না জানিনা কোথায় আছো, কেমন আছো? তবে বিশ্বাস করি আমার কাছ থেকে চলে যেয়ে ভালোই আছো। কেননা আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তোমার সাথে বেঈমানি করেছি। তোমার ভালোবাসা নিয়ে করেছি প্রতারণা। তোমার মনে অনেক প্রশ্ন আর অভিমান নিয়েই এ বাড়ি ছেড়ে তুমি চলে গেছো। আমি নষ্ট ছিলাম না। কিন্তু তোমার মনে আছে সাবা হবার কিছুদিন পর আমি বন্ধুদের সাথে ঢাকা শহরে বেড়াতে যাই। সেখান থেকেই আমার নষ্ট হওয়া শুরু হয়। ওদের পাল্লায় পরে আমি অন্য নারীতে আসক্ত হই। যেখান থেকে আর ফিরে আসতে পারিনি। হয়তো তুমি কোন দিনও জানতে না যদি আমি ধরা না খেতাম আর আমার বিয়ে না হতো। আমি তোমার সাথে আর মায়ের সাথে যে অন্যায় করেছি তার শাস্তি আল্লাহ আমাকে দিতে ভুল করেন নি। এটকু দেরীতে হলেও আল্লাহ তার শাস্তি দিয়েছেন। আমার শরীরে ক্যান্সার ধরা পরেছে। আমি জীবনের শেষ মুহুর্তে রয়েছি। জানি না আর কতদিন পৃথিবীর আলো দেখতে পাবো। তোমাকে আর সাবাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। আমি তোমাদের অনেক জায়গায় খুঁজেছি। জানি পাবো না, তবুও খুঁজেছি। জানি তোমাদের না দেখার অপূর্ণতা নিয়েই আমাকে চলে যেতে হবে এই পৃথিবী ছেড়ে। আমার খারাপ সময় দেখে দ্বিতীয় স্ত্রী ছেড়ে চলে গেছে। আমার যাবতীয় সম্পত্তি আমি তোমার আর সাবার নামে লেখে দিয়েছি। যার দলিল রুমনের কাছে আমি দিয়ে দিচ্ছি। যদি কখনো পারো আমাকে ক্ষমা করে দিও। ভালো থেকো খুব ভালো থেকো।

এরপর আর কিছুই লেখা নেই। নিজের চোখের পানি মুছে নিলাম। না শাকিলের মৃত্যুতে আমার খুব কষ্ট লাগছে না। সে তার শাস্তি পেয়েছে। আল্লাহ ছাড় দেন কিন্তু ছেড়ে দেন না। কষ্ট লাগছে মেয়েটার জন্য, সে আমার মতই অল্প বয়সে বাবা ছাড়া হয়েছে। যদিও সারাটা জীবন আমি ওকে বাবা ছাড়াই মানুষ করতাম। মায়ের জন্য ভীষণ কষ্ট লাগছে।

রুমন: বুবু কাঁদিস না। আল্লাহ যা করেন সকলের ভালোর জন্যই করেন। চল গ্রামে ফিরে যাবি। তুই না বলেছিলে আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে। বুবু আমি প্রতিষ্ঠিত হয়েছি। আমি এখন একজন ইঞ্জিনিয়ার। তোর আর সাবার দায়িত্ব নিতে আমার একটুও কষ্ট হবে না।

রুমন ইঞ্জিনিয়ার হয়েছে শুনে আমার ভীষণ ভালো লাগলো। আমি আর গ্রামে ফিরবো নারে। আমি এখানেই ভালো আছি। দোয়া করি তুই অনেক বড় হবি একজন সফল মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলবি।

রুমন: কি বলো বুবু তোমাকে ছাড়া আমি বাড়ি ফিরবো না। আর আগামি মাসে আমার বিয়েও ঠিক হয়েছে। তুমি না গেলে সব আয়োজন কি করে হবে?

ঠিক আছে আমি তোর বিয়ের আগেই চলে যাবো বাড়িতে তবে। শুধু তোর বিয়ে হওয়া পর্যন্ত। তারপর আমি আবার ফিরে আসবো।

বিকেলে আমি রুমন আর সাবা বের হলাম ঘুরার জন্য। রুমন মার্কেট থেকে আমাকে একটা মোবাইল আর সিমকার্ড কিনে দিলো। ওর নাম্বারটা সেইভ করে দিলো। বললো এখন আমরা যতটা দূরেই থাকি না কেন আমাদের রোজ কথা হবে।

রুমন দুই দিন থেকে গ্রামে চলে গেলো। আমার জীবনের সংগ্রাম চলতেই থাকলো। বাচ্চাদের স্কুলে আমি সাবাকেও পড়াচ্ছি। সাবাও ওদের সাথে মিলে বেশ আনন্দেই আছে মাঝে মাঝে মা আর স্যারের কথা জানতে চায়। আমি ওর প্রশ্নের জবাবে শুধু বলি তুমি বড় হলে নানু আর আংকেল তোমার সাথে দেখা করবে। তার জন্য তোমাকে লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত হতে হবে। সাবা কি বুঝে জানি না, সে খুশি হয়ে বলে আমি অনেক পড়ালেখা করবো।

অবসর সময়ে আমি মাঝে মাঝেই স্যারের লেখা ডায়েরিটা পড়ি। এ মানুষটা কেমন করে জানি আমাকে ভালোবেসে ফেলে। এতোটা ভালোবাসে অথচ মুখ ফুটে কখনো বলেনি। হয়তো বলার সুযোগই তৈরি হয়নি। মানুষটাকে আমিও অনেক ভালোবেসে ফেলেছিলাম। ভাগ্যে না থাকলে অনেক কিছু চেয়েও পাওয়া যায় না। মাঝে মাঝেই ডায়েরিটা পড়ে দু’চোখের পানি ফেলি সকলের অগোচরে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here