“হালাল প্রেম”
পর্ব-৩
(নূর নাফিসা)
.
.
বাসায় ফিরে আজ আর কোনো অবসর সময় কাটায়নি শারমায়া। হাতমুখ ধুয়ে লাঞ্চ করে এলার্ম দিয়ে শুয়ে পড়লো। আসরের আযানের সময় এলার্মের শব্দে জেগে উঠলো অত:পর নামাজ আদায় করে বই নিয়ে পড়তে বসলো। সাফওয়ানা এসে বললো,
“আপু, চলো ছাদ থেকে ঘুরে আসি। অনেক সুন্দর বাতাস। এত্তো এত্তো ঘুড়ি।”
“না, পড়তে বস।”
“এখন পড়তে বসবো না। মাগরিবের পর বসবো। চলো…!”
“না, আমার পড়া আছে।”
“আরে পড়বেই তো। কিছুক্ষণ কাটিয়ে চলে আসবো। চলো চলো।”
কথা বলতে বলতে সাফওয়ানা বই টানতে লাগলো। শারমায়া বিরক্ত হয়ে তার মাকে ডাকলো,
“আম্মু, সাফওয়ানা আমার পড়ার ডিস্টার্ব করছে।”
এদিকে শারমিন সাখাওয়াত রুমে এসে সাফওয়ানাকে বললো,
“সমস্যা কি তোর?”
“আম্মু, গরম লাগছে তাই ভাবলাম ছাদ থেকে ঘুরে আসি।”
“গরম লাগছে, মাথার উপর ফ্যানও চলছে। ছাদে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। পড়তে বস।”
“আমি সারাদিন স্কুলে পড়েই এসেছি। হুহ্!”
সাফওয়ানা বেরিয়ে যাচ্ছিলো শারমিন সাখাওয়াত তাকে পিছু ডাকলেন। এবং চোখ পাকিয়ে তাকেও পড়তে বসতে বললেন। বের হলেই পিটুনি। সাফওয়ানা মনে মনে ফুসতে ফুসতে বই নিতে লাগলো। নিজে তো গেলোই না তাকেও ফাসিয়ে দিলো! এদিকে শারমায়া তাকে ফাঁসিয়ে দিতে পেরে মিটিমিটি হাসছে। শারমিন রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন আবার ফিরে এসে বললেন,
“তোর না রেজাল্ট দেওয়ার কথা? রেজাল্টের খবর কি?”
শারমায়া দাতে দাত চেপে বইয়ের পাতা উল্টাতে লাগলো। অত:পর যথাসম্ভব স্বাভাবিক গলায় বললো,
“এখন সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তিনমাস পর আবার চেষ্টা করুন।”
“থাপড়াইয়া দাত ফেলে দিবো একেবারে।”
“ওফ্ফ আম্মু, এই রেজাল্টের খবর দিয়ে কি করবে তুমি? এটা কোনো এক্সাম হলো। সামনে কি হয় সেটা দেখো।”
তার কথার ধরণে সাফওয়ানা হুট করেই বলে উঠলো,
“মা, আপু ফেইল করছে।”
শারমিন ব্রু কুচকে বললো,
“ফেইল?”
শারমায়া সাফওয়ানাকে ধমকে বললো,
“কুটনি, তুই জানিস? না জেনে এতো বেশি কথা বলিস কেন?”
“না জেনে বলি? তো দেখাও রেজাল্ট কার্ড। পাস করলে তুমি এখনো চুপ করে বসে আছো? এতোক্ষণে আমাকে খোটা দিতে দিতে বাড়ি উল্টে ফেলতা! আম্মু, রেজাল্ট কার্ড নিয়ে দেখো তোমার মেয়ে ফেইল করছে।”
“চুপ কর তুই। শারমায়া, রেজাল্ট কার্ড দেখি?”
শারমায়া বই বন্ধ করে সাফওয়ানার দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ব্যাগের কাছে গেলো। অত:পর রেজাল্ট কার্ড নিয়ে তার মায়ের হাতে দিলো। সাফওয়ানা দ্রুত পায়ে তার মায়ের কাছে এসে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলো এবং পড়তে লাগলো,
“পঞ্চান্ন, সাতচল্লিশ, ঊনষাট, তেতাল্লিশ, একান্ন, চল্লিশ…! হে হে হে… এগুলো রেজাল্ট! দারুণ পাস করেছো তো আপুনি!”
কথাটা বলেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো সাফওয়ানা। রেজাল্টের অবস্থা দেখে শারমিন হতবাক! এরপর ইচ্ছেমতো বকাঝকা! শারমায়ার চোখে পানি চিকচিক করছে। শারমিন তার রেজাল্ট কার্ড নিয়ে রাগান্বিত হয়ে রুম থেকে বের হতে লাগলো আর বলতে লাগলো,
“তোর বাবা আসুক। সারাবছর কোচিং করে এতো এতো টাকা খরচ করে কি মূল্যবান রেজাল্ট করেছিস তা দেখাবো। কাদের পেছেনে এমন খেটে মরি তা জিজ্ঞেস করবো। এতো পরিশ্রমের এই ফল! এমন প্রস্তুতি নিয়ে এইচএসসি দিবি! সি গ্রেট, ডি গ্রেট এনে মানসম্মান ডুবিয়ে দিবি তা হতে দিবো না কি! পড়াশোনাই করাবো না আর।”
একটুখানি হেয়ালিপনার জন্য আজ সর্বত্র অপমানিত! শারমায়া চোখ মুছে মন খারাপ করে পড়তে বসলো। ওদিকে সাফওয়ানা সুযোগ পেয়ে মেইনডোর খুলে বেরিয়ে গেলো চাচীদের ফ্ল্যাটে। চাচাতো বোন ফারিয়া আপুকে টেনে নিয়ে সে ছাদে গেলো ঘুরতে। বিকেলে ছাদে দাড়িয়ে ভাড়াটিয়া ছেলেরা ঘুড়ি উড়ায়। ছাদে বড় ছেলেরা থাকলে সাফওয়ানা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুড়ি উড়ানো দেখে আর ছোট ছেলেরা থাকলে সে ছোটদের কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে নিজেও উড়ায়। ঘুড়ি উড়াতে তার খুব ভালো লাগে। কিছুদিন আগে একটা কিনে এনেছিলো। নিচ থেকে উঠাতে পারে না, কেবল এটাই সমস্যা। তবে কেউ উঠিয়ে দিলো সে আরও উপরে নিয়ে যেতে পারে ঘুড়ি। প্রতিদিনই ছাদে ঘুড়ি উড়াতে চলে যায় তাই মা তাকের উপর তুলে রেখেছিলো। কিছুদিন পর সাফওয়ানা নিতে গেলে দেখলো ইঁদুর তার ঘুড়ি কেটে মানচিত্র বানিয়ে রেখেছে! এখন আবার মাথায় পরিকল্পনা চলছে আরেকটা ঘুড়ি কেনার।
সন্ধায় সাখাওয়াত বদরুদ্দোজা বাড়ি ফিরেই বলতে লাগলো,
“শারমায়া, রেজাল্টের এ কি অবস্থা তোমার? পড়াশোনার কথা তো কখনো বলতে হয়নি। এখন কলেজ থেকে ফোন আসে পড়াশোনায় চাপ দেওয়ার জন্য। প্রশ্ন কি খুব কঠিন হয়েছিলো?”
শারমায়া নিচু স্বরে বললো ,
“আব্বু, ইচ্ছে করেই ফুল আন্সার করিনি৷ নেক্সট টাইম এমন হবে না আর।”
” এইচএসসি তে জিপিএ ফাইভ আসার চান্স আছে তো?”
শারমায়া মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলো। ওদিকে শারমিন বকবক শুরু করে দিয়েছেন একটাকেও পড়াশোনা করাবে না। একজনকে টিভির ভেতর ভর্তি করাবেন আরেকজনকে ঘুড়ির সাথে লটকিয়ে আকাশে উড়িয়ে দিবেন। আজকের পর থেকে তাদের আহারে ভাতের পরিবর্তে বইয়ের পাতা ছিড়ে খেতে দিবেন।
বরাবরের মতো সাফওয়ানা মস্করা স্বরূপ রুম থেকে জোর গলায় বললো,
“মা গো, বইয়ের পাতা আমি হজম করতে পারবো না। আমাকে ভাতের পরিবর্তে বার্গার দিও, মাঝে মাঝে খিচুড়িও দিতে পারো…! মাইন্ড করবো না।”
বাবা বাড়ি ফিরলে তাদের জোর বাড়ে আর এমনিতে হুলোবেড়াল। কিন্তু সাফওয়ানা আজ জবাব দিলেও শারমায়া নিশ্চুপ ছিলো। পরদিন সকালে ব্যাগ গুছিয়ে বাবার সাথে সাফওয়ানা চলে যাচ্ছে হাজারিবাগ। দুদিন পর খালাতো বোন সুষনার বিয়ে। ইচ্ছে ছিলো শারমায়ার এক্সামের পর প্রোগ্রাম করবে। কিন্তু এক্সামের মাঝামাঝি সময়ে সুষনার হাসব্যান্ড আরিফ, জার্মান চলে যাবে। তাই এক্সামের আগেই করতে হচ্ছে প্রোগ্রাম। সাফওয়ানা নাচি নাচি চলে যাচ্ছে আর শারমায়া মন মরা! তাকে যেতে হবে বিয়ের দিন। আপুকে বউ সাজে দেখবে, দাওয়াত খাবে আর চলে আসবে! শেষ তার বিয়ে খাওয়া!
সারাদিন একা ঘরে বই নিয়ে পড়ছে শারমায়া। ওদিকে ভাইবোনসহ বিয়ে বাড়ির আত্মীয়ের সাথে ফোনে আলাপ করছে শারমিন সাখাওয়াত। একএকজন ফোন দেয় আর বারবারই বলে মেয়ের পরীক্ষা তাই এখন আসতে পারবে না সে। এক কথা শুনতে শুনতে শারমায়া বিরক্ত হয়ে দরজা বন্ধ করে পড়ছে।
যদিও বলেছে বিয়ের দিন যাবে, সুষনা খালামনির কাছে বারবার অনুরোধ করে তাদের গায়ে হলুদের দিন যেতে বাধ্য করলো। তবুও শারমায়া খুশি হতে পারলো না। কারণ তার সাথে মেহমান হিসেবে এসেছে বইখাতা! কিন্তু বিয়ে বাড়িতে কি আর পড়া হয়! জমে গেছে অনুষ্ঠান-আড্ডায়! সন্ধ্যায় বরপক্ষ লগনে আসবে তাই তারা সেজেগুজে প্রস্তুত। মেয়েগুলো একটু ভদ্র হলেও ছেলেগুলো বড্ড পাজি! তাদের বরণ করে নেওয়ার জন্য মেয়েপক্ষ যা সামগ্রী নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো, মেয়েদের শান্তভাবে বরণ করতে পারলেও শেষ দিকে ছেলেরা এসে খাপাখাপি করে হুলুস্থুল বাধিয়ে দিয়েছে। শারমায়ার হাতে ছিলো চকলেট। দুটি ছেলে খাপাখাপি করে প্লেটই ফেলে দিয়েছে। শারমায়া রেগে আগুন! সাফওয়ানার হাতে ছিলো গাদা ফুলের পাপড়ি। তাদের মধ্যেই একজন প্রথমে মুঠো করে ফুল নিয়ে সাফওয়ানার মাথায় দিয়েছে। সাফওয়ানা রেগে বললো,
“হোয়াট রাবিশ!”
ছেলেটি হেসে আরেক মুঠো ফুল হাতে নিয়ে সাফওয়ানার মুখের দিকে এগিয়ে নিতে নিতে বললো,
“বেয়াইন, রাবিশ না তো। ফুলের পাপড়ি, খেয়ে দেখুন…!”
সাফওয়ানা তার হাতে এক ঘা মেরে সরিয়ে দিতেই ছেলেটি বললো,
“বাবারে বাবা! বেয়াইন তো ভালো কেরাতি জানে! কুংফু মাস্টার নাকি?”
“শুধু কুংফু না, কাটিং মাস্টারও। দ্বিতীয়বার আপনার সিংহ মার্কা চুলগুলো কেটে তার প্রমাণ দিবো।”