💛 #_ফাগুন_প্রেম_ 💛
❤ লেখনীতে: Bornali Suhana ❤
💚 পর্ব: ০১
বিদায় নিয়েছে শীতল কুয়াশার চাদর প্রকৃতিতে লেগেছে রঙের ছোঁয়া। লীলুয়া বাতাসে পাতা ঝরার শব্দ আর ডালে ডালে কচিকচি পাতার উঁকিঝুকি। কোকিলের ডাক যেনো বসন্তের আহ্বান জানান দিচ্ছে। রক্তিমবর্ণের পলাশ ফুলেরা স্বাগতম জানিয়েছে পহেলা ফাল্গুনকে।
অনেক্ষণ ধরে ইভান বাইরের সৌন্দর্য উপভোগ করছে আর তার বাইকটাকে পরিষ্কার করছে। বাইক বললে যন্ত্র বলা হয় কিন্তু তার কাছে ঠিক যেনো নিজের বাচ্চা। ইভানের চেহারাটা কিছুটা লম্বাটে, মুখ ক্লিন শেভ করা। উচ্চতা প্রায় ছয় ফুট দুই ইঞ্চিখানেক হবে। স্বাস্থ্য তার উচ্চতা অনুযায়ী সুন্দর। তারউপর জিম করায় অলরেডি সিক্স প্যাক বডি আর মাসসেলস তৈরি হয়ে গেছে। গায়ের রং খুব বেশি ফর্সা না উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের। অবশ্য শ্যামলা রঙের ছেলেরাই সুন্দর। অতিরিক্ত ফর্সা ছেলেদের কেমন ফার্মের মোরগ দেখায়। গেটের কাছেই বড়সড় একটা পলাশ ফুলের গাছ। অনেকটা ফুল নিচে পড়ে আছে কিছু ফুল থেতলে গেছে। দেখতে ভালো লাগছে না এখন। ফুলতো গাছেই সুন্দর নিচে পড়লেও সুন্দর দেখায় কিন্তু যতক্ষণ তাজা থাকে ততক্ষণই। দীপু ভাইয়া ঝাড়ু হাতে সেদিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। মনে হচ্ছে উঠানটা পরিষ্কার করবেন। পুরো উঠান জোরে সবুজ ঘাস শুধু এই দু’তলা বিশিষ্ট ঘর থেকে গেট পর্যন্ত রাস্তাটা পাকা করা। এই বাসাতে আজ প্রথম সকাল। বাসাটা বাবাই বানিয়েছেন। এর আগে কখনো এখানে আসা হয়নি। তবে মা-বাবা নাকি বিয়ের পর অনেকবার এখানে এসেছেন। বাসা দেখতে অনেক সুন্দর আগে যেখানে জীবনের প্রায় ঊনিশটা বছর পার করেছি সে বাড়িটাও অনেক সুন্দর। অবশ্য সেটা একতলা বিশিষ্ট বাড়ি। পরিবেশটাও অনেক মনোরম। এই বাসাটা বিশাল জায়গা জুড়ে আছে। ডান পাশে সুইমিংপুল, সুইমিংপুলের পাশে অনেকটা গাঁদা ও গোলাপ ফুলের গাছ লাগানো। সামনে একটা দোলনা ঝুলছে। বা পাশে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা। যেখানে ইভান বসে বাইক পরিষ্কার করছে। ফারহান আহমেদের কথায় তার কাজে এবং ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটে।
-“কিরে আর কত পরিষ্কার করবি? এবার নিজে ফ্রেশ হয়ে চল কলেজে যেতে হবে তো।”
ইভান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-“বাবা না গেলেই কি নয়? আমি না হয় পরিক্ষার সময় গিয়ে পরিক্ষাটা এটেন্ড করলাম।”
বাবার লম্বা, ফর্সা মুখটা খুব গম্ভীর দেখালো এটা সবসময় হয় না। গম্ভীর হলেই তিনি মিনিটের ভেতর হেসে দেন। এবারো তাই হলো। বাবা এক গাল হেসে পাশেই বসে গেলেন আর আমাকে বললেন,
-“আরে না তা হবেনা। কলেজে গেলে ক্লাস করলে পরিক্ষার সময় তোর জন্যই ভালো হবে। আর অনেক বন্ধুও পাবি নতুন জায়গা বন্ধুবান্ধব থাকলে সময়টাও ভালো কাটবে।”
ইভান খুব ভারী একটা নিশ্বাস নিলো। তারপর বাবার দিকে তাকালো। ততক্ষণে ঈশা হাই তুলতে তুলতে বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে। সে তার ছোট ভাই আর বাবার কথা ব্রু কুচকে তাকিয়ে শুনছে। কিন্তু বেশিক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলো না।
-“বাবা তোমার ছেলের আর লেখাপড়া এস.এস.সি তে একবার ফেল করাতে বাইক দিয়ে খুশি করেছো এইবার এইচ.এস.সি তে যখন ফেল করবে একটা BMW কার কিনে খুশি করে দিও। নয়তো তোমার বাচ্চা ছেলেটা ন্যাকা কান্না করে দেশকে না আবার বন্যা কবলিত করে দেয়। হাহাহাহাহা।”
-“হ্যাঁ বাবা এই পৃথিবীতে তোমার মেয়ে তো একাই পড়ালেখা করেছে আর কেউ করেনি।”
-“হ্যাঁ করেছিই তো। তোর মতো নই আমি। অনার্স প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষেও ফাস্ট ক্লাস পেয়েছি দেখিস এবারও তৃতীয় বর্ষেও ফাস্ট ক্লাস পাবো।”
-“হুম আমাকে মিষ্টি খাওয়াস প্লিজ।”
এক গাল হেসে ইভান ঈশাকে উদ্দেশ্য করে কথাটা বলে দিলো।
-“হয়েছে ঈশা তুই থামবি? আমার ছেলেকে আর কত জ্বালাবি?”
-“এজন্যই তো বলি মা বুমনিকে বিয়ে দিয়ে দাও সব জ্বালানো খতম হয়ে যাবে।”
ঈশা আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলো না।
-“হ্যাঁ তোমার ছেলেকে লাই দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে রেখেছো। আমাকে বিয়ে দেবার পরই টের পাবে।”
কথাটা বলেই ব্রাশ হাতে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ওর কেমন যেনো সবকিছুই খালি খালি লাগছে এখানে। নতুন জায়গা কাউকে চেনে না। ভার্সিটি থেকেও TC নিতে হয়েছে। আগের ফ্রেন্ডগুলাও পেছনে পড়ে গেলো। হয়তো ওরা আজকেও ভার্সিটিতে যাবে। শুধু আমিই যাবো না। মিস করছি খুব বেশি।
সাহারা ইসলাম নাস্তা বানাতে ব্যাস্ত আছেন। সাথে উনাকে সাহায্য করছে রানু। রানু সেই ছোট বেলা থেকেই উনাদের বাড়িতে থাকে। মেয়েটাকে বিয়ে দিয়ে এই বাড়িতেই রেখে দিয়েছেন সাহানা ইসলাম। দীপুই হলো রানুর স্বামী। খুব বিশ্বাসী দুজন ব্যাক্তি এরা। তাই তো নিজের পরিবারের মতোই দেখেন ওদের। কখনোই কাজের মানুষ হিসেবে আড় চোখে দেখেন নি কেউ। ছেলে-মেয়ে আর স্বামীকে খাইয়ে অফিসে পাঠাতে হবে। এই রান্নাটাই তার প্রধান কাজের মধ্যে পড়ে। আগে অবশ্য একটা প্রাইভেট স্কুলে পড়াতেন। কিন্তু এখন নিজের ছেলেমেয়ে আর স্বামীর খেয়াল রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
-“কি হলো সবাই খেতে এসো।”
নিচে থেকেই সবাইকে আওয়াজ দিলেন। সাথে সাথে সবাই তৈরী হয়ে ডাইনিং টেবিলে এসে হাজির। ইভান ফরমাল সাদা একটা শার্ট আর ব্ল্যাক প্যান্ট পড়েছে, এক হাতে ব্ল্যাক ঘড়ি, অন্য হাতে ব্রেসলেট। চশমাটা খুলে হাতের মাঝে রেখেছে। বাইকে উঠেই চোখে লাগাবে। পারফিউমের মিষ্টি গন্ধে চারদিক ছেয়ে আছে। মনে হয় সব পারফিউম আজকেই গায়ে মেখে নিয়েছে।
নাস্তা শেষ করে ইভান মাকে জড়িয়ে ধরলো আর উনি তার কপালে ভালোবাসার পরশ একে দেন সাথে হাজারো দোয়া। ঈশা আজকে ভার্সিটি যাবেনা বলে ঠিক করেছে। আজকে বাসায় থেকে মাকে সাহায্য করবে এবং বিকেলের দিকে একটু বাইরে যাবে রানুকে নিয়ে। শপিং করবে একটু ঘুরবে চারপাশ ভালো করে দেখবে। হুম এটাই ঠিক হবে। নিজেই নিজের মনের মাঝে কথাগুলো বলে নিলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে ফেইসবুকে ঢুকতেই টের পেলো আজকে পহেলা বসন্ত। ও তো ভুলেই গিয়েছিলো। অবশ্য ভুলার কথাও বাসা পরিবর্তনসহ এতো ঝামেলা হয়েছে যে এসব মনে থাকার কথাও নয়। কত ইচ্ছে ছিলো এই বসন্ত উৎসব নিয়ে। সবাই একরকম শাড়িও কিনে রেখেছিলাম। ঈশা একবার সেই শাড়িটা লাগেজ থেকে বের করে হাতে নিয়ে হাত বুলালো। একটা ম্লান হাসি দিয়ে ফেইসবুকে বেস্ট ফ্রেন্ডদের ট্যাগ করে স্ট্যাটাস দিয়ে দিলো।
-“সাদামাটা বসন্ত মোবারাক।”
`
আজ পহেলা ফাল্গুন সাথে ইভানের কলেজের প্রথম দিন। কলেজের প্রথম দিন বলতে এই কলেজে প্রথম যাচ্ছে সে। বাবার বিজনেসের কারণে যা হলো আর কি। রাজশাহীর কলেজ থেকে টিসি নিয়ে ঢাকা একটা প্রাইভেট স্কুল এন্ড কলেজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে এডমিশন নিয়েছে। আগের কলেজের সব বন্ধুদের কথা খুব মনে পড়ছে। কত ঘুরাফেরাই না করতো তাদের সাথে। যদিও ও এস.এস.সিতে ফেল করায় তার স্কুল ফ্রেন্ড সবাই তাকে রেখে এক বছর এগিয়ে গিয়েছিলো। ছোটদের সাথে ক্লাস করলেও দিনশেষে সেই স্কুল ফ্রেন্ডদের সাথে রাসু মামার চায়ের দোকানে আড্ডায় জমে উঠতো।
`
কলেজে যাওয়ার কোন ইচ্ছাই ছিলো না। এখানে কারো সাথে পরিচিতিও নেই তবুও ফারহান আহমেদের জোরাজোরিতে যেতে হচ্ছে। তিনি একজন ব্যাংকার ছিলেন। অল্প সময়েই জব ছেড়ে এখন নিজে একটা গাড়ি কোম্পানির মালিক। বেশ নামডাক আছে উনার কোম্পানির। দা আহমেদ গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ নামেই সবখানে খ্যাত। এক নামেই সবাই আহমেদ গ্রুপকে চিনে। ঢাকাসহ বিভিন্ন ছোট বড় কোম্পানি উনাদের থেকে গাড়ি কালেকশন করে। ২০১৮সালে বেস্ট বিজনেসম্যান অফ দা ইয়ার এওয়ার্ডও পেয়েছেন। বিভিন্ন নতুন নতুন গাড়ি বেশির ভাগ উনার কোম্পানিই ডিজাইন করে। ঢাকায় ওই কোম্পানির একটা নতুন শাখা খুলছেন। তাই জন্য এখানে আসা।
ইভানও সেই একই পথের পথিক। আপাদত বিজনেস স্টাডিজ নিয়ে পড়ছে। ভবিষ্যতে বাবার কোম্পানি জয়েন করবে। ইন্টার কম্পলিট করেই তাকে পড়ার জন্য দেশের বাইরে পাঠানো হবে। ফারহান আহমেদ সবকিছুই আগে থেকে ভেবে রেখেছেন।
`
বাইক চলছে তার আপন গতিতে বাবা-ছেলে একসাথে যাচ্ছেন। ইভান বাইক চালাচ্ছে আর বাবা পেছন থেকে তাকে ধরে বসে আছেন। এটা উনার সবসময়ের কাজ। অফিসে যাওয়ার সময় ছেলের বাইকে করে কলেজ পর্যন্ত যান ছেলে কলেজে ঢুকে গেলেই তিনি তার নিজের গাড়ি করে অফিসে পৌঁছে যান। ছেলের সাথে বাইকে চরে যেতে উনার মাঝে এক অন্যরকম আনন্দ কাজ করে। বাইকের পেছন পেছন ফারহান আহমেদের কার খুব ধীর গতিতে চলছে। কলেজের সামনে এসেই বাইক থেকে নেমে কারে উঠে গেলেন। ইভান তাঁকে বিদায় জানিয়ে কলেজে ঢুকে গেলো।
কলেজে পা দিতেই বুঝতে পারলাম আজকে বসন্ত উৎসব। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে গেটের সামনে আসলাম। অনেক সুন্দর একটা আলপনা আঁকা। বাইকটা পাশে পার্ক করে আলপনাকে পা দিয়ে পিষে সামনে চলে গেলাম। হয়তো তাতে এই আলপনার কোন কিছুই আসে যায় না। তার তো আর বুঝার ক্ষমতা নেই। অবশ্য আলপনাটা রঙ দিয়ে আঁকা হয়েছে পা দিয়ে পিষে গেলেও তার সৌন্দর্যে কোন ঘাটতি হবেনা। কিছুদূর এগুতেই কানে সুর এসে বিঁধছে সাথে হৃদয়েও। অডিটোরিয়ামে গান হচ্ছে যার মিউজিক এখানেও ভেসে আসছে। একটা মেয়েলি কন্ঠ গান গাইছে। অসম্ভব সুন্দর তার কন্ঠ। ঠিক যেনো কোন মধুরকন্ঠী যার জন্মই হয়েছে গান গাওয়ার জন্য। কিছুক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে গান শুনছিলাম একটা নজরুল গীতি গাইছে।
`💛
আসে বসন্ত ফুল বনে সাজে বনভূমি সুন্দরী
চরণে পায়েলা রুমুঝুমু মধুপ উঠিছে গুঞ্জরি
আহা…. আসে বসন্ত ফুল বনে সাজে বনভূমি সুন্দরী
চরণে পায়েলা রুমুঝুমু মধুপ উঠিছে গুঞ্জরি।
দুলে আলোছায়া বন-দুকূল
ওড়ে প্রজাপতি কলকা ফুল
কর্ণে অতসী স্বর্ণ-দুল
আলোক-লতার সাতনরি।।
সোনার গোধূলি নামিয়া আয়
আমার রূপালি ফুল-শোভায়
আমার সজল আঁখি-পাতায়
আয় রামধনু রঙ ধরি’।
কবি, তোর ফুলমালী কেমন
ফাগুনে শুষ্ক পুষ্প-বন
বরিবি বঁধুরে এলে চ্যমন
আহা……রিক্ত হাতে কি ফুল ভরি’।।
আসে বসন্ত ফুল বনে সাজে বনভূমি সুন্দরী
চরণে পায়েলা রুমুঝুমু মধুপ উঠিছে গুঞ্জরি
আহা….আসে বসন্ত ফুল বনে সাজে বনভূমি সুন্দরী
চরণে পায়েলা রুমুঝুমু মধুপ উঠিছে গুঞ্জরি।
`
গান শুনতে এতোটাই মগ্ন ছিলাম যে আশেপাশে কি হয়ে যাচ্ছে সেদিকে আমার কোন খেয়ালই নেই। কারো ধাক্কায় বুঝতে পারি আমি অডিটোরিয়ামের দরজা থেকে কিছু দূরে দাঁড়িয়ে আছি। লোকটি সরি বলে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো। পরক্ষণেই এই কন্ঠের অধিকারিণীকে দেখার লোভ জেগে উঠে। আমার পা আমার অজান্তেই অডিটোরিয়ামের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু একি গানটা আমি আর শুনতে পাচ্ছি না কেন! এবার আর দেরী না করে দৌড় দিলাম। কিন্তু এসে দেখি স্টেজে সারি বেঁধে কয়েকটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বেশভূষা দেখে মনে হচ্ছে এখন নাচবে। আমি স্টেজের সরাসরি দাঁড়িয়ে আছি। আমার চোখ এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো কিন্তু এমন কাউকেই দেখছিনা যে গান গাইতে পারে। আবার মনে হচ্ছে এতো মানুষের মাঝে তো যে কেউই গান গাইতে পারে কিন্তু আমি কিভাবে চিনবো! হঠাৎ পেছন থেকে কেউ একজন আমায় উদ্দেশ্য করে বললো,
-“এক্সকিউজ মি, ওইখানে সিট আছে আপনি বসতে পারেন।”
পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলাম একটা মেয়ে। তার কথার আওয়াজ আমার কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না। আমি তো তাকে দেখতে ব্যাস্ত। এতো সুন্দর কোন মেয়ে হয় নাকি? ঠিক যেনো বনলতা সেন!
শুনেছিলাম বসন্ত মানেই পূর্ণতা, ফাগুন এলে নাকি মনে রঙ ধরে। আজকে এই বাসন্তীকে দেখে মনে হচ্ছে যেনো ও আমার জীবনকে পূর্ণ করে দিতেই এসেছে। প্রকৃতি যেনো ইশারা করছে ওর হাত ধরেই হেঁটে যাবো জীবনের বাকীটা পথ।
তাহলে কি এই ফাগুনে আমার মনেও রঙ ধরা দিবে?
আমার মনেও কি উঁকি দিচ্ছে ফাগুন প্রেম!
-“এই যে শুনছেন?”
মেয়েটা আমার চোখের সামনে তুড়ি মেরে জিজ্ঞেস করতেই আমার ঘোর ভাঙে। পা থেকে মাথা পর্যন্ত ওকে ভালোভাবে দেখছি। আলতা রাঙা পায় দুই বেল্টের জুতো পড়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেখানে সবাই বাসন্তি রঙের শাড়ি আর খোঁপায় দিয়েছে গাঁদা ফুল সেখানে এই বাসন্তী পড়ে আছে সাদা রঙের শাড়ি, হলদে রঙের ব্লাউজ। চুলগুলো একদিকে সিঁথি কেটে খোঁপা বেঁধে তার মাঝে গুজে রেখেছে দুধ সাদা আর হলুদ রঙের কাঁঠালিচাঁপা ফুল। খুব সাধারণের মাঝেও সে আজ অসাধারণ৷ সবার চেয়ে অনন্য। নজরকাঁড়া সৌন্দর্য তার মাঝে। গোলগাল মুখ আর উচ্চতা খুব হলে ৫ফুট ২ইঞ্চি হবে। ঠিক দুধে আলতা গায়ের বরণ। চোখে টেনে গাঢ় করে কাজল লাগানো। ঠোঁটে গোলাপিবর্ণ লিপস্টিক আর মুখে হালকা মেকাপ করা এর চেয়ে বেশি কিছুই নয়। মেকাপের সৌন্দর্য্য যেনো বাসন্তীর নিজস্ব সৌন্দর্য্যের কাছে হার মেনেছে।
-“বোবা নাকি? কথা বলতে পারেন না?”
আবারো বাসন্তীর কথায় আমার ঘোর ভাঙে।
`💛
-“”বসন্ত এসেছে তুমিও এলে বদনে সাদা শাড়ি,
দু’হাতে রুপালী চুড়ি।
খোপায় জড়িয়ে কাঁঠালিচাঁপা ফুল,
কানে তেমনি দুল।
ঠোঁটে আলতো গোলাপ ফুলের আভাস,
পা দুটো যেন রক্তিম পলাশ।
রূপের প্রদীপ জ্বেলে হয়েছো অনন্য,
আজ মনে লয় জম্ম আমার শুধু তোমারই জন্য।
দুরন্ত আমি ফাগুনের রঙ গায়ে মাখি,
আঁখি ভরে দেখি বাঁকা ঠোঁটে প্রাঞ্জলতার হাসি।
চপল হৃদয়ে যতনে এঁকেছি ভালোবাসার ফ্রেম।
ওগো বাসন্তী,
তুমি যে আমার অবেলায় দেখা প্রথম ফাগুন প্রেম।””
`
-“মানে?”
-“ভালোবাসি।”
-“কি যা-তা বলছেন?”
-“যা-তা নয় হৃদয়ের কথা।”
-“হু! মানে কি? আপনি কে?”
-“বসন্তপথিক।”
-“আচ্ছা! ভালোই কবি কবি টাইপের কথা বলেন দেখছি। আপনি কি এই কলেজের স্টুডেন্ট?”
-“জ্বি হ্যাঁ। আর তুমি বললে কবিই ভালো। তা আমার কথার কোন জবাব দিলেনা?”
-“আপনি কি কোন প্রশ্ন করেছেন?”
-“প্রশ্ন করিনি এটাকে প্রপোজ বলতে পারো।”
-“আপনি যে আমাকে একটু দেখেই না চেনে, না বুঝে প্রপোজ করে বসলেন জানেন আমি কে?”
-“উহু। জানিনা বলেই তো বাসন্তী নাম দিয়েছি তোমার। তবে এখন বললে জেনে নিবো তুমি কে। তার আগে আমার প্রপোজালের জবাবটা দাও।”
-“আমি কখন থেকে আপনাকে আপনি করে বলছি আর আপনি কিনা আমাকে তুমি করে বলছেন? আর কি সব ফালতু প্রপোজ লাগিয়ে রেখেছেন হু?”
-“এই দেখো কোন ফালতু প্রপোজ না। আমার প্রপোজের ইনসাল্ট করবে না। আমি এই প্রথম কোন মেয়েকে প্রপোজ করেছি। আর হ্যাঁ আমার কোন সমস্যা নেই। তুমিও আমাকে তুমি করে বলতে পারো।”
কথাটা বলেই ইভান গাল ভরে হাসি দিলো। বাসন্তী কেমন চোখ কুচকে তাকালো। বাসন্তী আনমনে ভেবে যাচ্ছে ছেলেটা কে! আর এভাবেই বা কেন কথা বলছে!
-“ইস এভাবে তাকিও না আমি তো মরেই যাবো।”
-“আপনি যদি জানেন আমি কে তাহলে হয়তো এখানে দাঁড়ানোর সাহসটাও করবেন না।”
ইভান একটু অবাক চোখে ব্রু নাচিয়ে বললো,
-“আচ্ছা তা কে তুমি? বলো না প্লিজ প্লিজ প্লিজ বলো। আমিও দেখবো কে এখানে দাঁড়িয়ে থাকে আর কে যায়।”
কথাটা শেষ করতেই খেয়াল করলো পেছন থেকে একটা মেয়ে চেচিয়ে বার বার কাকে যেনো ডাকছে।
-“এই আবির, আবির এদিকে আয় তাড়াতাড়ি।”
ইভান একবার চারপাশে চোখ বুলিয়ে তারপর বললো,
-“এই যে এইখানে আবির কে এতো ডাকছে তবুও সাড়া দিচ্ছেন না?”
বাসন্তী রাগে মাথায় এক পাশে ডান হাতের দু’আঙুল দিয়ে ধরে দাঁত কটমট করছে।
-“এই আবির কথা কানে যায় না? কতক্ষণ ধরে ডাকছি তোকে?”
মেয়েটা বাসন্তীকে ধাক্কা দিয়ে কথাটা বললো। আমি তো চমকে উঠি! এটা কেমন মিরাক্কেল! এমনও হতে পারে নাকি!
-“তোমার নাম আবির?”
ইভান তার বাসন্তীর নাম শুনে অবাকের সপ্তম আকাশে পৌঁছে গেছে। এতোক্ষণ যার সাথে ও কথা বলছে যার নাম সে বাসন্তী দিয়েছে তার নাম আবির? ইভান হো হো করে হেসে দিলো। বাসন্তী এবার আরো বেশি রেগে গেলো। ওর চোখ-মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। কিন্তু তবুও মেয়েটা অনেক শান্ত হয়ে আছে।
-“হাহাহা আবির? এটা তো ছেলেদের নাম এই তোমার নাম আবির কে রেখেছে হুম? আর কোন নাম পেলো না? আর কোন ভালো নাম নেই তোমার?”
আবির রাগে এবার লাল বর্ণ ধারণ করেছে। দাঁত খিঁচিয়ে বললো,
-“এই তোকে না কতদিন বলেছি আমাকে আবির বলে ডাকবি না। বর্ণালী বা সোহানা বলেও তো ডাকতে পারিস। এভাবে যে কারো সামনে কেন লজ্জায় ফেলিস বলতো?”
-“আচ্ছা বাবা সরি এবার তো চল বোন আমার।”
-“ওহ তার মানে তোমার নাম বর্ণালী সোহানা?”
-“আরে না না ওর নাম বর্ণালী আবির সোহানা।”
মেয়েটা কথাটা পাশ থেকে বলে উঠলো। বর্ণালী চোখ কুচকে বন্ধ করে আবার খোলে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে মেয়েটার মাথায় একটা চাপড় দিয়ে দিলো। ইভান এসব দেখে হেসে যাচ্ছে একা একাই। এবার ইভান বলে উঠলো,
-“ওহ নাইস নেইম। আর আপনার নাম?”
-“আমি ইসরাত রুমানা। রুমু বলে ডাকতে পারেন। আর আপনি?”
-“আমি ইভান আহমেদ আ….আ….বির।”
ইভান আবির নামটা একটু টেনে বললো। বর্ণালী ওর নাম শুনে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার নামও কেন আবির হতে গেলো? এতোটুকু পুচকে একটা ছেলে আমার সাথে মজা নিচ্ছে!
-“রুমু এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে চল অনেক কাজ বাকি আছে এখনো। নাহলে প্রিন্সিপাল স্যার রেগে যাবেন।”
-“হ্যাঁ হ্যাঁ চল। আচ্ছা আসি ইভু পড়ে কথা হবে।”
-” ঠিক আছে রুমু বাই।”
ইভান দাঁড়িয়ে ওদের চলে যাওয়া দেখছে। হুট করেই খেয়াল হলো আরে দেখা হবে কিভাবে ওর সম্পর্কে তো কিছুই জানিনা। শুধুমাত্র নাম ছাড়া।
-“এই বাসন্তী তুমি কোন ডিপার্টমেন্টের সেটা তো বলে যাও।”
কথাটা বলতেই বর্ণালী পেছন ফিরে বললো,
-“আমি কে তা কালকে খুব ভালো করেই জানতে পারবেন।”
রুমুর হাত ধরে টেনে রাগে গজ গজ করে বর্ণালী এখান থেকে চলে গেলো। আর ইভান পেছনে একা একাই হাসছে।
কে এই বাসন্তী? কি তার পরিচয়?
ভাবতে ভাবতেই ইভান বর্ণালীর পিছু পিছু ছুটে গেলো কিন্তু দেখা পেলো না। তাই আবারো অডিটোরিয়ামে এসে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। হয়তো আরেকটা বার তার বাসন্তীকে দেখার আশায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই নাচ শেষ হয়ে এলো।
বর্ণালী নূপুর পায়ে রুমঝুম শব্দ করে এদিক সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। নাচ শেষ হতেই স্টেজে মাইক হাতে নিয়ে উপস্থাপনা করতে গেলো। নিজেকে কিছুটা নার্ভাস লাগছে। ইভান ছেলেটা কেমন হেসে হেসে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। এতটুকু ছেলে আর আমার সাথে এভাবে কথা বললো? আমাকে কি খুব বাচ্চা মেয়ে লাগে নাকি? না না মোটেও না। ইভানের বসে থাকা সফল হয়েছে। তার বাসন্তীকে আরেকটাবার দেখতে পেলো। মনে মনে ভেবে নিয়েছে যতক্ষণ না অনুষ্টান শেষ হচ্ছে ততক্ষণ সে উঠছেনা। ইভান পায়ের উপর পা তুলে চেয়ারে একটু কাত হয়ে বসে আছে আর ভাবছে প্রথম দেখায় কি আসলেই ভালোবাসা হয়?
হ্যাঁ হয়ই তো নাহলে বাসন্তীর প্রতি তার এই টানটা কি?
হ্যাঁ এটাই প্রেমে পড়ার প্রথম ধাপ মনে হয়। আগে তো কখনো প্রেমে পড়েনি তাই বুজতেও পারছেনা। কিন্তু তার প্রেমে অনেক মেয়েই পড়েছে।
সেও কম কিসে?
কয়েকদিন ঘুরেছে, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেছে কিন্তু প্রেম পর্যন্ত কখনোই আগায়নি। তবে আজ বাসন্তীকে দেখে তার মনে প্রেম উঁকি দিচ্ছে। তাইতো সাতপাঁচ না ভেবে সাথে সাথে প্রপোজ করেই বসলো। পরে না আবার হারিয়ে যায়। আজ অবশ্য প্রপোজ করার মতো দিন। প্রথমত আজ পহেলা ফাল্গুন মানে বসন্ত উৎসব তার উপর আজকে ১৪ই ফেব্রুয়ারি যাকে বলে ভালোবাসা দিবস।
#_____চলবে……..