ফাগুন প্রেম পর্বঃ ৬৩

0
615

#ফাগুন_প্রেম
পর্ব: ৬৩
লেখনীতে: Bornali Suhana
💛
💛
উনার এই হাড় জোড়া দেয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিলো না৷ তাই বাধ্য হয়েই আমাদের উনার পায়ের পাতা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে। ডাক্তারের কথা শুনে শারমিন বেগম মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পড়েন। বর্ণালীর মায়ের চিৎকারে আশেপাশের রুমের যত রোগী ছিলো, তাদের পরিবারের যতজন সদস্য ছিলো সবাই বেরিয়ে আসে। মায়ের এমন আহাজারিতে হাসপাতাল কাঁপছে।
“বর্ণরে আমি বেঁচে থাকতে কেন তোর এমন অবস্থা দেখতে হলো! আল্লাহ আমায় নিয়ে তোকে কেন সুস্থ করে দিলো না! আল্লাহ তুমি আমার নিষ্পাপ মেয়েটার সাথে কেন এমন করলে? আমার ইবাদতে কি কম রয়ে গিয়েছিলো আল্লাহ! আমার ফুলের টুকরো মেয়েটার কেন এমন ক্ষতি হলো! আল্লাহ!!!”
কারো চোখের জল বাঁধ মানছে না। মানবেই বা কীভাবে এমন একটা পরিস্থিতিতে পড়তে হবে কেউ ভাবেও নি। যারা কোন আত্মীয়ও না তাদের চোখেও জল। কিন্তু এই জল বেশিক্ষণের জন্য না। সবাই কিছুক্ষণ পর যার যার কেবিনে চলে যায়। শারমিন বেগমের কান্নার শব্দটা ধীরে ধীরে কমে আসে। ঈশার বুকে মাথাটা ছেড়ে দেন তিনি। সম্পূর্ণ শরীরের ভার ছেড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ইভান পিছ পা হতে লাগে, পিঠ দেয়ালের সাথে গিয়ে ঠেকে। ধীরে ধীরে ফ্লোরে বসে পড়ে। পা জোড়া ভাঁজ করে বুকের সাথে লাগিয়ে দু’হাতের ভেতর আটকে মুখ হাঁটুর উপর রাখে। জেনি ইভানের পাশে গিয়ে বসে কাঁধে হাত রাখে। ইভান মাথা তুলে তাকায় না। জেনি বুঝতে পারে ওর সম্পূর্ণ শরীর কাঁপছে। গরম হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে। জেনি কয়েকবার তাকে ডাকে কিন্তু কোন সাড়া পায় না। নিরাশ হয়ে সেও চুপ করে পাশে বসে থাকে। সজিব শক্ত হয়ে বসেছিলো অনেকক্ষণ, মা জ্ঞান হারাতেই ছুটে এসে মাকে নিয়ে কোলে করে কেবিনে নিয়ে যায়। ডাক্তার তাঁকে স্যালাইন দিয়ে দেয়। হাবিব হাসানের সিগারেট নিভে ছাই ফ্লোরে পড়ছে। ওয়ার্ড বয় তাঁর কাছে গিয়ে বললো,
-স্যার হাসপাতালের ভেতর ধুমপান নিষেধ।
হাবিব হাসান সিগারেটের দিকে একবার তাকান তারপর ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন। আবারো আগের জায়গায় বসে পা ঝাঁকাতে লাগলেন। সাহারা ইসলাম আইসিইউ এর দরজার কাছে গেলেন। দরজার ছোট গ্লাস দিয়ে বর্ণালীকে দেখার চেষ্টা করতেই ইভান চট করে উঠে পথ আগলে দাঁড়ায়। মাথা দু’দিকে নেড়ে বললো,
-না মা, তোমার ওকে দেখার অধিকার নেই। কি দেখছো ও বেঁচে আছে কিনা? ও বেঁচে আছে মা আর বেঁচে থাকবে কিন্তু জীবিত লাশ হয়ে বেঁচে থাকবে। তুমি যে ওর শরীরের একটা অংশ কেড়ে নিলে মা। আমার বাসন্তী উঠে প্রশ্ন করলে আমি কি জবাব দেবো মা? কি জবাব দেবো? ও কি এমন ক্ষতি করেছিলো মা? ভালোবাসা কি কোন পাপ মা? নাকি ও আমার বড় হয়ে জন্ম নিয়েছে এটা পাপ? আমরা তো কোন পাপ করিনি মা। কিসের ভিত্তিতে তুমি বললে সে আমাদের বাড়ির বউ হতে পারবে না? কোন সমাজ আছে যেখানে বলে ছোট-বড় বিয়ে করা যায় না? কোন ধর্মে কি বলা হয়েছে যে, বড়-ছোট বিয়ে করা যাবে না? তাহলে কেন মা? কেন? কেন এমন করলে? আজ তোমার ভুলের জন্য মা শুধু তোমার ভুলের জন্য ওকে সারাজীবন এভাবে থাকতে হবে। ইভান কাঁদতে কাঁদতে দরজার কাছেই নীচে বসে পড়ে। সাহারা ইসলামের চোখ দিয়ে জল টপটপ করে ঝরে পড়ছে। পা পেছনে নিয়ে নেন। ফারহান আহমেদের দিকে তাকিয়ে উনার দিকে এগিয়ে যান৷ ফারহান আহমেদ চোখ ফিরিয়ে নেন অন্যদিকে।
.
.
একেকজন একেক জায়গায় বসে আছেন। কারো মুখেই কোন কথা নেই। ঈশা সবাইকে খাওয়াতে চায় কিন্তু কেউ খায় না। সজিবের ফোনের টোন বেজে উঠে, স্ক্রিনে তাকাতেই দেখে অপরিচিত একটা নাম্বার। ঈশা ওর মোবাইলের টাইম দেখে রাত ২টা বাজে। এতো রাতে কে কল দিলো! অবাক না হয়ে পারেনা ও।অজান্তেই মনের মাঝে প্রশ্ন আসে। কে কল দিলো?
সাহারা ইসলামকে শারমিন বেগমের পাশে রেখে সজিবের পেছনে যায়। ব্যালকনিতে গিয়ে ফোন রিসিভ করতেই সজিবের কানে যে কণ্ঠ আসে তা ওর ভেতরটাকে নাড়িয়ে দেয়।
-তুই?
– হ্যাঁ আমি।
-কোথায় তুই? কোন খবর নেই কেন তোর?
-বর্ণের কি হয়েছে সজিব?
সজিব কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। অনেকক্ষণ নিজেকে শক্ত করে রেখেছিলো আর পারলো না। রুমুর কাছে সে বরাবরই কোন কিছুই লোকাতে পারেনা। সে না বললেও রুমু বুঝে নেয়। একমাত্র ওর সাথেই কষ্টটা শেয়ার করতে পারে৷ রুমু বুঝে গেছে কোন একটা খারাপ খবর আছে।
-সজিব বল বলছি আমার জানের কিছু হলে আমি কাউকে ছাড়বো না। কি হয়েছে ওর? ও ঠিক আছে তো?
রুমু কেঁদে কেঁদে চিৎকার করে করে কথা বলছে। সজিব কিছু একটা ভাঙার শব্দ পায়। রুমু কিছু একটা ছুঁড়ে ফেলেছে।
-কি হলো? বলবি তুই? সজিব।
-রুমু, আ…..আমাদের বর্ণের ডান পায়ের পাতা কেটে ফেলে দিতে হয়েছে।
কথাটা বলতে সজিবের গলা ধরে এসেছিলো। রুমু কথাটা শোনা মাত্র ফোনটা কান থেকে পড়ে যায়। সজিব অনেকক্ষণ হ্যালো হ্যালো করে কিন্তু কোন উত্তর পায় না। কল কেটে চোখের জল মুছে পেছনে মুড়তেই ঈশাকে দেখে। ও কাছে যেতেই সজিব তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। কেউ একজনের কাঁধে মাথা রেখে কান্না করাটা ওর খুব বেশি প্রয়োজন ছিলো ঈশা সেই মানুষ যার কাঁধে মাথা রেখে কান্নাটা আর ধরে রাখতে পারলো না। সজিবের চোখের জল ঈশার কাঁধ বেয়ে পড়ছে। চোখ খিঁচে বন্ধ করে ঈশা কান্না করছে। সজিবের কান্নার শব্দের কাছে ওর কান্নার শব্দ চেপে গেছে। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সজিবের পিঠে। সজিবের কান্না থেমে গেছে। ঈশা ওকে ছাড়িয়ে সোজা করে দাঁড় করায়। ওড়না দিয়ে সজিবের চোখ-মুখ মুছে দেয়।
-রুমু কল দিয়েছিলো।
-রুমু! ওকে বলেছো? ও কীভাবে জানলো?
-রুমুর ভাইকে আমি বলেছিলাম হয়তো সেখান থেকেই জেনেছে।
– ও কি আসছে?
-জানিনা, ফোনে আওয়াজ আসছিলো না।
-রুমু ওখানে একা নিজেকে কীভাবে সামলাচ্ছে আল্লাহ জানে!
ঈশা চোখ থেকে জল পড়ার আগেই মুছে ফেলে। সজিব ওকে শক্ত করে বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে। সজিবের বুকে মাথা রেখে টি-শার্ট খামচে ধরে ঠোঁট কামড়ে কেঁদে দেয় ঈশা, সজিবও কাঁদছে। ঈশা ওর বুক থেকে মাথা তুলে সজিবের কপালে, দু’চোখের উপর, দু’গালে ঠোঁট দিয়ে ছুঁয়ে দেয়। সজিব চোখ বন্ধ করে ঈশার স্পর্শ অনুভব করছে। দু’গালে হাত রেখে কপালে কপাল ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ঈশা। সজিবের হাত ঈশার কোমড়ে রাখা। সজিব ওকে ছেড়ে দিতে গেলে ঈশা ওর টি-শার্ট ধরে আবারো কাছে টেনে নেয়। আলতো করে সজিবের ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। নিশ্বাস থমকে গেছে দুজনের। সজিবের হাত ঈশার কোমড় আরো শক্ত করে চেপে ধরে। ঈশা ব্যথা পাচ্ছে কিন্তু সজিবকে এই মুহুর্তে শান্ত করতে হবে। কোন শব্দ না করে তার বুকে মাথাটা এলিয়ে দেয়।
.
.
ইভান বর্ণালীর একটা হাত বুকের সাথে চেপে ধরে বসে আছে। ওকে কেবিনে পাঠানো হয়েছে। এখনও ঘুমে বর্ণালী, একবারের জন্যও চোখ খুলে নি। ইভান ওর হাতে বারবার চুমু খাচ্ছে। চোখের জল ওর হাত বেয়ে পড়ছে। সাহস হচ্ছে না একটাবার বর্ণালীর পায়ের উপর থেকে কাঁথাটা সরিয়ে দেখতে। অনেকক্ষণ ধরে এভাবেই চুপচাপ বসে আছে। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। হাত কাঁপছে ইভানের, প্রচন্ড ঘামছে। হাত দিয়ে মুখ মুছে কোন শব্দ না করে বর্ণালীর পায়ের পাশে চেয়ার টেনে বসে। কাঁথায় একবার হাত দিচ্ছে তো আবার সরিয়ে নিচ্ছে। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা নিশ্বাস নিয়ে সাহস সঞ্চয় করে পায়ের উপর থেকে কাঁথাটা সরায়। ব্যান্ডেজ করা কিছুই দেখা যাচ্ছে না। ব্যান্ডেজের উপর আলতো করে চুমু খায় ইভান। ওর পা জড়িয়ে ধরে মাথা রাখে পায়ের পাশে।
-তোমার বসন্তপথিক তোমায় অনেক বেশি ভালোবাসে বাসন্তী। তোমায় সৌন্দর্য দেখে ভালোবাসেনি সে। তুমি যেমনই আমার তোমায় তেমনই চাই। আমার তুমিটা থাকলেই হলো বাসন্তী আমার আর কিচ্ছু চাই না, কিচ্ছু না। আমি তোমায় হারাতে দেবো না কখনোই।
ইভানের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে অনবরত। বর্ণালীর পা জড়িয়ে ধরে চুপটি মেরে শুয়ে আছে। তার বাসন্তীকে সে কখনোই ছাড়বে না, কোন কিছুর মূল্যেই না। ভালোবাসার জন্য যা করতে হয় তাই করবে সে। প্রয়োজনে সে সারাজীবন তার বাসন্তীকে কোলে করে নিয়ে বেড়াবে তবুও ছাড়বে না।
#______চলবে…………

Previous
https://www.facebook.com/103632171307142/posts/133544828315876/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here