“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৩৫
(নূর নাফিসা)
.
.
এখন তার শরীর খুব ঠান্ডা। বুঝাই যাচ্ছে কিছুক্ষণ আগে শাওয়ার নিয়েছে। জোভান তাকে পরম আবেশে জড়িয়ে নিয়েছে। এই মুহূর্তে তার প্রতি আসক্ত হওয়ার পূর্বেই শারমায়া তাকে বললো,
“দেখি ছাড়ুন। আব্বু বাসায় আছে আর আপনি এখানে এসে বসে আছেন।”
“প্রথমত আমি বসে নেই। দ্বিতীয়ত আংকেল বাসায় থাকলে কি আমার এ রুমে আসা নিষেধ?”
“আমি বলেছি সেটা? আপনি তো আসেন না তাই বললাম।”
জোভান মুচকি হেসে বললো,
“আংকেলের সাথে সঙ্গী বসিয়ে রেখে এসেছি। কথা বলছে তারা।”
“স্যার এসেছে?”
“উহুম। ইফাজকে নিয়ে এসেছি সাথে।”
“আসবেন, আগে বললেন না যে?”
“আমিই জানতাম নাকি! কাজকর্ম শেষে গোসল সারতেই মা হাতে প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে পাঠিয়ে দিলো। আসবোই যখন রাস্তায় কল করে কি লাভ। ভাবলাম সারপ্রাইজ দিয়ে দেই। হওনি সারপ্রাইজড?”
শারমায়া মুচকি হেসে তার হাতের বাঁধন ছাড়িয়ে বললো,
“ড্রয়িংরুমে যান। আমি খাবারের ব্যবস্থা করি।”
“খাবার! ওকে, হালকা খাবার দিয়ো। পেট ভরাই আছে।”
“গরুর মাংস আর ভুনাখিচুড়ি।”
“সুইটহার্ট, না।”
“চুপ। কোনো কথা না।”
“খাবারের পরিবর্তে একটু ভালোবাসা দাও।”
“ড্রয়িংরুমে যান।”
“ছি! ছি! ড্রয়িংরুমে! আমারই তো লজ্জা লাগবে!”
“আপনি অনেক অনেক অনেক খারাপ একটা লোক। গল্পগুজব করার জন্য আমি ড্রয়িংরুমে যেতে বলেছি।”
জোভান হালকা কেশে বললো,
“আমি একটু বেশিই বুঝি তাই না?”
“আপনি সব ঠিকঠাক বুঝেও ইচ্ছে করে এমন করেন আমার সাথে।”
জোভান শরীর কাপিয়ে হেসে আবার শারমায়াকে দু’হাতের বন্ধনে আবদ্ধ করে বললো,
“মনে পড়ে, বিয়ের দিন তিনবার আলহামদুলিল্লাহ কবুল বলেছিলে? তিনবার ‘অনেক’ না বলে এখন ‘ভালোবাসি’ বললেই তো মানিয়ে যেতো। আজ তো ঈদের দিন। বলে দাও।”
“ইশ! যান তো।”
“কত সাবধানে সুযোগ বুঝে তোমার নিকট চলে এলাম, এভাবেই চলে যাবো? একটু একটু একটু হলেও ভালোবাসো।”
শারমায়া লজ্জায় যেন রঙিন হয়ে যাচ্ছে। বহুদিন পর সেই অস্থিরতা আবার ঝেকে বসেছে তাকে। কিন্তু তখন তো তার অবস্থা দেখে সে পালিয়ে যেতো, আজ যে জোভান নাছোড়বান্দা হয়ে আছে! তার কাছ থেকে রক্ষা পেতে শারমায়া হুট করেই তাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ রেখে দ্রুত বলে ফেললো,
“ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক, ঈদ মোবারক। আজ তো ঈদের দিন। আজ এ পর্যন্তই থাক। আর কিছু বলতে বললে আমি রাগ করবো।”
জোভান তার কাণ্ডে আবারও শরীর কাপিয়ে হেসে উঠলো এবং বললো,
“টুকটুকির আম্মু, তুমি অনেক চালাক। দুষ্টুও বটে। আমাদের বিয়ের পর ইফাজ মিরাজ তোমাকে প্রথম দেখার পর যখন আমাকে তোমার গল্প বলেছিলো আমার একটুও বিশ্বাস হয়নি তুমি এতো দুষ্টু। আস্তে আস্তে অনেকবার নতুন তুমির সাথে পরিচিত হচ্ছি আর বারবারই নতুন করে প্রেমে পড়ে যাচ্ছি আমি। এভাবে সবসময়ই নতুন নতুন পরিচয় দিয়ে যাবে আমার কাছে।”
কথা শেষ করে মাথায় চুমু দিলো জোভান। লজ্জা কাটাতে এবার শারমায়া জোভানকে বের হওয়ার জন্য ঠেলতে লাগলে জোভান বললো,
“তুমি দরজা খুলে আগে বের হও। তখন তো এদিকে কেউ ছিলো না। এখন যদি আমাকে দরজা খুলতে দেখে কি ভাববে বলো তো!”
“ইশ! দরজা বন্ধ করার সময় মনে ছিলো না কেন?”
বিড়বিড় করতে করতে শারমায়া দরজা খুলে বেরিয়ে এলো পিছু পিছু জোভান। ইফাজের সাথে দেখা করে কিচেনে এসে খাবার গুছিয়ে দিতে মায়ের সাথে একটু কাজ করলো। অতঃপর সবাই একসাথে খাওয়াদাওয়া করলো। শ্বশুর কর্তৃক জামাই আদর ভালোই উপভোগ করছে জোভান। পেট ভরা সত্ত্বেও বেশি খেতে হলো তাকে। শারমায়া তার অবস্থা দেখে মুখ চেপে হাসছিলো শুধু। তারা বেরিয়ে যাওয়ার সময় শাখাওয়াত সাহেব তাদের সাথেই বের হলেন জোভানের বাড়ি যাওয়ার জন্য। শারমিন বলেছিলেন জোভানের কাছে দিয়ে দিতে কিন্তু তিনি দিলেন না। কেননা কুরবানির মাংস নিয়ে তিনি নিজেই যাবেন বেয়াই বাড়িতে।
সপ্তাহখানেক পর শারমায়ার বাবা মা, চাচাচাচী ফারিয়াকে পছন্দ করা পাত্রপক্ষের বাড়ি দেখতে গিয়েছেন। দুপুরের সময়টা শারমায়ার খুব বোরিং লাগছে। সাফওয়ানা ঘুমাচ্ছে কিন্তু তার ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না। কেমন যেন অস্থিরতা কাজ করছে। কারো সাথে গল্পগুজব করলে হয়তো ভালো লাগতো। ফারিয়া আপুও বাসায় নেই। একবার ভাবলো জোভানকে কল করবে কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠার পর অনেক্ক্ষণ কথা হয়েছে তাই আর এখন বিরক্ত করার কথা ভাবলো না। জোভান অফিসে, সুতরাং এখন ব্যস্ত হবে হয়তো। কিছুক্ষণ সময় টিভি দেখে, কিছুক্ষণ অনলাইনে লুডু খেলে সময় পাড় করলো। বিকেলের শেষ দিকে তারা চলে এলো। শারমায়া তার মায়ের পিছু পিছু ঘুরঘুর করতে করতে বললো,
“আব্বু কোথায়?”
“কি যেন প্রয়োজনে বাজারে নেমে গেছে।”
“ওহ! তা পাত্রবাড়ি কেমন দেখলে, আম্মু?”
“ভালোই তো।”
“বিয়ে পাকাপাকি হওয়ার সম্ভাবনা আছে নাকি?”
“আমি কি জানি। তোর চাচীকে গিয়ে জিজ্ঞেস কর।”
“তোমার যে কথা! উনি কি আমার ছোট চাচী যে সবক্ষেত্রে আমি উনার সাথে ফ্রি আর বড় বোনের বিয়ের ব্যাপারে চাচীকে জিজ্ঞেস করবো? তাছাড়া তুমি যদি না ই জানবে, গিয়েছো কেন?”
“দেখার জন্য।”
“চাচা চাচীর ডিসিশন শোনোনি? সেটা বলো।”
শারমিন মৃদু হেসে বললেন,
“পছন্দ হয়েছে সবারই। সম্ভাবনা আছে তবে কনফার্ম না। ছেলেপক্ষ যদি এগিয়ে আসে তাহলে বলা যাবে।”
“যাক, তবুও আলহামদুলিল্লাহ।”
“আসরের নামাজ পড়েছিস?”
“হুম।”
“রান্নার ব্যবস্থা কর। আমি নামাজ পড়ে আসছি।”
শারমিন নামাজ পড়ছে, শারমায়া চুলায় ভাত বসিয়ে সবজি কাটতে লাগলো। এরই মাঝে মনে হলো ফ্রিজ থেকে মাছ নামিয়ে ভেজানোর কথা। সে বটি একপাশে রেখে ফ্রিজ থেকে মাছের প্যাকেট হাতে নিলো। এমনি সাফওয়ানা এসে বললো,
“আপু, ভাইয়া নাকি বাইক এক্সিডেন্ট করেছে।”
এক্সিডেন্টের কথা শুনতেই শারমায়ার দেহের লোম শিউরে উঠলো! হাত থেকে মাছের প্যাকেটও পরে গেলো পায়ের উপর। ব্যাথা পেয়ে পা সরিয়ে নিয়েছে ঠিকই কিন্তু চোখে চিকচিক করছে অন্য ব্যাথার জল। শারমিন দ্রুতপায়ে কিচেনে এসে চুলার দিকে যেতে যেতে বললো,
“শারমায়া, জোভান নাকি মোটরসাইকেল থেকে পড়ে গেছে। দ্রুত রেডি হয়ে নে। হসপিটাল যাবো। কাণ্ডটা একবার দেখ, সেই সকাল দশটা এগারোটার দিকে নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে আর খবর পাই এই সন্ধ্যা বেলা। কে জানে কতটা ব্যাথা পেয়েছে ছেলেটা। আল্লাহ জানে আর কত বিপদ যে লেখা আছে ভাগ্যে।”
অতঃপর চুলা অফ করে দিয়ে ফ্লোর থেকে মাছের প্যাকেট আবার ফ্রিজে তুলে রাখলেন শারমিন। শারমায়া ওড়নার কোণায় চোখের সেই চিকচিক ভাব দূর করে আবার চুলা অন করে বললো,
“আমি যাবো না।”
“কেন?”
“কেন যাবো?”
এমন উক্তিতে শারমিন চিন্তিত দৃষ্টিতে দু-তিন সেকেন্ড মেয়ের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে বললেন,
“কেন মানে? দেখতে যাবি না?”
“না। সামান্য এক্সিডেন্ট হয়েছে, দেখার কি আছে? মরে তো আর যায়নি যে তাকে দেখতে যেতে হবে।”
সাথে সাথেই শারমিন সজোরে থাপ্পড় বসিয়ে দিয়ে বললেন,
“অমানুষ জন্ম দিয়েছি আমি? তোর মতো মানুষ জন্ম না নিলে কি এমন হয়। এই অলক্ষুণে, ছেলেটা মরে গেলে তুই খুশি হতি?”
শারমায়ার মাথায় ঠুসি দিয়ে তিনি বকতে বকতে বেরিয়ে গেলেন। কম কষ্টে মেয়েকে অলক্ষুণে বলে যাননি তিনি। শারমায়ার আচরণে সাফওয়ানাও বিরক্ত হয়ে বললো,
“ছি, আপু! তোমার মুখে আটকালো না এমন কিছু?”
শারমায়া স্থির দাঁড়িয়ে আছে। ওদিকে সাফওয়ানাও ছুটলো মায়ের পিছু পিছু। দুতিন মিনিটের মধ্যেই শারমিন তৈরি হয়ে সাফওয়ানাকে সাথে নিয়ে ফ্ল্যাট থেকে বের হতে লাগলেন। বের হওয়ার সময় শারমায়ার বাবাকে কল করে বলতে লাগলেন,
“এখনো কোথায় তুমি? গাড়ি নিয়ে এসো। আমরা রেডি, নিচে নামছি। না, তোমার মেয়ে যাবে না। পাষাণী জন্ম দিয়ে ভুল করে ফেলেছি আমি। আগে জানলে এতো কষ্টে লালনপালন না করে মুখে বুলি ফোটার আগেই মাটি চাপা দিয়ে দিতাম।”