#সুপ্ত_ভালোবাসা
#পর্ব_২৯
#Tahmina_Akther
-হ্যালো আভিক, হাউ আর ইউ? ও মাই গড ইয়া! ইউ আর সো মাচ প্রিটি।
বলেই কেউ একজন হিয়াকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করছিলো তবে সে বিফল হলো কারণ আমাদের অভিক তার হিয়াকে কাছে টেনে নিলো।
হিয়া অবাক হয়ে কথা বলার মালিকটির দিকে তাকিয়ে আছে কারণ, বিদেশি এক ছেলে যাকে কি না হিয়া চিনে না কিন্তু ওকে চিনে কিভাবে?
হয়তো অভিকের সাথে এই ভিনদেশির পরিচয় আছে!
-এই মিরা ছাগলনি,এই মিরা এই দিকে আয় তুই।
অভিক বেশ জোরে চিল্লিয়ে ডাকলো মিরাকে।মিরা তৎক্ষনাৎ দৌড়ে এসে দেখলো অভিক আর হিয়ার সাথে আরও একজন দাঁড়িয়ে আছে।সেদিকে নজর না দিয়ে অভিককে বললো,
-কি হয়েছে দোস্ত এভাবে জোরে ডাকছিস কেন? কিছু লাগবে? আন্টিকে ডাকবো?
-আমার কিছুই লাগবে না তোর এই বিদেশি ছাগলটাকে নিয়ে যেয়ে বাংলাদেশী ঘাস খাওয়া তাহলে ওই ধবলদের মতো বাঙালি মেয়েদের যখন তখন জরিয়ে ধরতে আসবে না।
-কি বলিস তুই? এই ছাগলটা আবার কে?
বলেই মিরা ছেলেটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালো কিছু বলার জন্য কিন্তু কিছুই বলতেই পারলো না। ওর চোখের নোনাপানি গুলো টলমল করছে বেরিয়ে আসার জন্য। চোখের পানিগুলো বের হবার আগেই ছেলেটি মিরাকে “মাই কুইন” বলে আষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে ধরলো। মিরাও জরিয়ে ধরলো।
ওদের দু’জনের কাহিনি দেখে হিয়ার চক্ষু চরাক গাছে মানে কি এতক্ষণ অভিক কি বললো আর মিরা বা কি করছে!
-মিরা তোর এই ছাগলের লগে কান্নাকাটি শেষ হলে ওরে ছাড় কেউ দেখলে কেলেংকারী হিয়া যাইবো।
অভিকের কথা শুনে মিরা আলাদা হয়ে গেলো ভিনদেশী ছেলেটির কাছ থেকে।
ছেলেটির দিকে তাকিয়ে এক চিলতে হাসি দিয়ে হিয়াকে উদ্দেশ্য করে বললো,
-হিয়া ও হচ্ছে জ্যাক প্যাটিনসন ওরফে মোহাম্মদ জ্যাক ।
জ্যাককে উদ্দেশ্য করে বললো,
-জ্যাক, সি ইজ হিয়া এন্ড হি ইজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড অভিক।
-হাই আভিক
বলেই অভিকের সাথে হাত মিলালো জ্যাক।
এরপর, হিয়ার দিকে তাকিয়ে জ্যাক বললো,
-ইয়া, ইউ আর সো লাকি বিকজ ইউ হ্যাভ এ মোস্ট লাভিং পার্সন। আই হ্যাভ গিফট পর ইউ প্লিজ একসেপ্ট দিজ।
বলেই আমার দিকে একটি বক্স এগিয়ে দিলো।আমি প্রথমে নিতে চাই নি পরে অভিক ইশারা করলো যেন আমি এই গিফট বক্সটা নেই। অতঃপর, হাতে নিয়ে বক্সটি খুলতেই দেখলাম একটি ডায়মন্ডের আংটি যা A শেইপের।আংটির
কারুকাজ বেশ চমৎকার লেগেছে আমার কাছে।
এরইমাঝে তিয়ানা আর আবির ভাই চেলে এলেন। সবার সাথে কুশলাদি বিনিময় করলো। ওদের চারজনের সাথে জ্যাকের কথোপকথন শুনে মনে হলো এরা একে অপরকে বেশি সময় ধরে চিনে।
নানু সাথে করে পার্লারের দুটো মেয়েকে আমার রুমে নিয়ে এলেন।অতঃপর, তিয়ানা আর মিরা বাদে সকল ছেলেরা আমার রুম ত্যাগ করলো।
আমাকে সাজানো কার্যক্রম শুরু হলো।
তিয়ানা আমার আয়নার প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে বলছে,
-হিয়া,জানো জ্যাক আমাদের মিরার ভিনদেশী প্রেমিক, স্থানীয় কানাডিয়ান। বাবা মা’র একমাত্র সন্তান। একবার আমাদের কলেজ থেকে কক্সবাজারে শিক্ষা সফরের জন্য যায়। ওখানে গিয়ে জ্যাকের সাথে আমাদের মিরার বেশ বড় রকমের ঝগড়া হয়। কারণ, জ্যাক আমাদের মিরাকে পাব্লিক প্লেসে হাতে কিস করেছিলো ব্যস অমনি আমাদের মিরা ওর গাল এক থাপ্পড়ে লাল করে ফেলেছিলো।সেই ইন্সিডেন্ট আসলে কাকতালীয় ভাবে ঘটেছে কারন জ্যাকেদের দেশীয় কালচারে এইসব পানি ভাত। ওদের যে কাউকে ভালো লাগলে কিস করাটা ওদের ভালোলাগার বহিঃপ্রকাশ।
জ্যাক কিভাবে যেন আমাদের মিরার ফেসবুক আইডি আমাদের কোন সহপাঠীর থেকে সংগ্রহ করে আর ওকে মেসেঞ্জারে নক করে বিভিন্ন ভাবে কনভিন্স করে। ওকে বুঝিয়ে বলে,যে সে বুঝতে পারে নি আমাদের দেশের নারীরা স্বভাবগত ভাবে কিছুটা রক্ষণশীল।আর আমাদের মিরার আস্তে আস্তে ওর প্রতি রাগ কমে যায়। প্রথম কয়েকমাস বন্ধুত্ব থাকলেও পরে এই সম্পর্ক কিছুটা প্রেমে পরিণত হয়।
-কিন্তু, জ্যাকের ধর্ম নিশ্চয়ই মুসলিম নয়? আর সেখানে ওদের যতই প্রেম ভালোবাসা থাকুক বিফলে যাবে।কারণ, না জ্যাকের বাবা-মা মিরাকে মেনে নিবে না মিরার বাবা-মা জ্যাককে মেনে নিবে।
হিয়া মিরাকে উদ্দেশ্য করে বললো।
-সেটাই তো, প্রথমে আমিও জ্যাককে বলেছিলাম কিন্তু সে আমার কথা শুনে কি করেছে জানো? সে আজ দু’মাস হলো কালেমা শাহ দাহ পাঠ করে মুসলিম ধর্মে রুপান্তরিত হয়েছে।সাথে তার পরিবারের সকলে।
সে আজ বেশ কিছুদিন ধরে বলছিলো বাংলাদেশ আসবে আমার আব্বু আম্মুকে আমাদের সম্পর্কে কথা জানাতে। কিন্তু, আজ যে আসবে সেটা বলে নি। কথায় কথায় একদিন তোমাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়েছিলাম আর আজ দেখো পাগলটা এই বাড়িতে চলে এসেছে।
আমার শুধু এখন একটাই চিন্তা বাবা-মা যদি জ্যাককে না মেনে নেয় তখন কি হবে?
বলেই হু হু করে কেঁদে উঠলো মিরা। তিয়ানা উঠে গিয়ে মিরাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। হিয়া মিরাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,
-আমার বিশ্বাস তুমি যদি জ্যাকের কথা তোমার বাবা-মাকে বলো, কিভাবে সে তোমার জন্য তোমার ধর্মকে ভালোবেসে আপন করেছে আশা করি তারা মেনে নিবে।এখন কান্না বন্ধ করো তো। এই দেখো তোমার চোখের পানি দেখে আমার চোখ দিয়ে পানি পরার জন্য আন্দোলন করছে।যদি পানি বেরিয়ে যায় তাহলে মেকাপ ঘেটে সব নষ্ট হয়ে আমাকে কটকটি রানির মতো দেখা যাবে।
হিয়া বেশ মজার সুরে কথাগুলো বলতেই হেসে ফেললো কান্নারত মিরা আর তিয়ানাও।
—————
-জ্যাক, মাই নেম ইজ অভিক নট আভিক, ওকে?
-ইয়েস ইয়েস ইউর নেম ইজ আভিক।
জ্যাকের কথা শুনে অভিক কাঁদবে নাকি হাসবে বুঝতে পারছে না। আবির আর সাঈদ তো হেসে কুটি কুটি। অভিক রেগে গিয়ে আবির আর সাঈদের দিকে কয়েকটা বালিশ ছুড়ে দিলো।ওরা যেন এতে আরও মজা পেলো ওদের হাসি থামছে না। আবির কোনোরকমে হাসি থামিয়ে বললো,
-তোকে বললো আভিক তাও ঠিক আছে কিন্তু তোর বৌকে তো ডিরেক্ট হিয়া থেকে ইয়া বানিয়ে দিয়েছে। তোদের এই নাম গুলো না আকিকা করে আবার রেখে দিস সেই সুন্দর লাগে নাম গুলো। ইয়া আর আভিক।
আবারও সেই হাসি সাঈদের আর আবিরের। এইদিকে জ্যাক ওদের কোনো কথা বুঝতে পারছে না ঠিকই তবে মজার কিছু নিয়ে যে হাসাহাসি হচ্ছে তা ভালোভাবে বুঝতে পেরেছে।
মনে মনে বেশ চিন্তিতবোধ করছে জ্যাক যদি মিরার বাবা-মা রাজি না হয় তখন কি হবে ভেবে ওর অন্তঃসারশূন্য হয়ে যাচ্ছে।
—————
বেশ জাঁকজমকপূর্ণ ভাবেই জামান ম্যানশনে অভিক-হিয়ার রিসেপশনের আয়োজন করা হয়েছে। চারদিকে অর্কিড,লাল,সাদা গোলাপ দিয়ে সাজানো।একপাশে খাবারের বুফে সেট করা অন্যদিকে ফটোসেশানের জন্য হরেক রকমের আর্টিফিসিয়েল ফুল দিয়ে স্টেজ সাজানো হয়েছে। এর সামনে রয়েছে সারিবদ্ধ ভাবে বসার জন্য গোল টেবিল আর চেয়ার।
স্টেইজে বসে আছে অভিক, তার কিছু সংখ্যক কাজিন আর ওর বন্ধুরা। বেশ হাসি তামাশা চলছে এই দলটির মুখ্য সদস্য অভিককে নিয়ে।অভিকের অবশ্য এইসবে তেমন ধ্যান নেই তার মনে শুধু এখন একটি চরিত্রের বিচরণ। সেই চরিত্র তার অর্ধাঙ্গিনী, তার একজীবনের ভালোবাসা হিয়া, তার কল্পনার জগতের একছত্র অধিপত্যে ফুল।
এমন সময় কিছু বাচ্চাদের হৈ হুল্লোড় শোনা গেলো তারা বলছে,
– বৌ এসেছে বৌ এসেছে।
সেই হৈ হুল্লোড় দিকে সকলের আর্কষণ সৃষ্টি হয়েছে। হঠাৎ, এই ভিড় কমে গিয়ে দু দলে বিভক্ত হয়ে দুপাশে দাঁড়িয়ে নববধূকে আসার জায়গা করে দিলো ।
বেবি পিংক কালারের লেহেঙ্গায়, কানে স্টোনের দুল,গলায় নেকলেস, মাথায় টিকলি, চুলগুলো কার্ল করা কিছু চুল সামনে এনে রেখেছে সর্বশেষ মাথায় আধ ঘোমটা দেয়া হিয়াকে সবমিলিয়ে আজ আগুন সুন্দরি লাগছে। যার রুপের ঝলকে আজ হয়তো আমাদের অভিক সাহেব ঝলসে যাবেন।
অভিক তার প্রিয়তমাকে দেখতে পেয়ে আস্তে করে নেমে পড়লো স্টেজ থেকে এরপর এগিয়ে গিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো তার ফুলের কাছে।অভিকের এগিয়ে দেয়া হাতের দিকে তাকিয়ে হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো।
হিয়ার হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে ধীরে ধীরে স্টেজের দিকে এগিয়ে চললো।হিয়াকে স্টেজে রাখা সোফায় বসিয়ে দিয়ে ওর পাশে বসে পড়লো অভিক।এরইমাঝে ওদের কাজিনদের মধ্যে একজনের ওয়াইফ বলে উঠলো,
-আমাদের কষ্ট অভিক কমিয়ে দিলো।নয়তো ওর বৌকে আমাদের গিয়ে এগিয়ে আনতে হতো। তাই না রে অভিক।
ব্যস অমনি হাসির রোল পড়ে গেলো।হিয়া লজ্জায় কারো দিকে চোখ তুলে তাকানোর জো নেই।কিন্তু, অভিক আজ নির্দ্বিধায় তার ফুলের দিকে তাকিয়ে আছে।কি চমৎকার এই দৃশ্য তার ফুল লজ্জাবতী গাছের ন্যায় নুইয়ে পরেছে সকলের লজ্জামাখা কথা থেকে রেহায় পাবার জন্য!
ঝামেলাহীন ভাবেই শেষ হলো রিসেপশন।দীর্ঘসময় ধরে অভিকের এখানে উপস্থিত থাকা সম্ভব ছিল না তাই খুব দ্রুতই সমাপ্তি হয় অনুষ্ঠান। আস্তে আস্তে বাড়ির মেহমান যাওয়া শুরু করেছে।
মিরা-জ্যাক এবং আবির-তিয়ানা অভিক আর হিয়ার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলো। আর যাওয়ার আগে বলে গেছে যেন ওদের জন্য দোয়া করে। তাদের বাবা-মা যেন তাদের সম্পর্ক সাদরে গ্রহণ করে। অভিক আর হিয়া ওদের শুভকামনা জানিয়ে বলে, যদি কোনো প্রকারের সাহায্যের প্রয়োজন হয় যেন ওদের জানায়।
—————-
অভিক-হিয়ার বিয়ের আজ একমাস পূর্ণ হতে চললো।তাদের সম্পর্ক ঠিক আগের জায়গায় আছে কোনো উন্নতি হয়নি তবে আগের মতো সেই জড়তা-সংকোচ নেই।
হিয়া আগের থেকে অভিকের প্রতি দূর্বল হয়ে পড়েছে হয়তো ভালোবাসে অভিককে কিন্তু বলতে পারছে না।ওই যে মেয়ে মানুষ বুক ফাঁটে তবুও মুখ ফোঁটে না। আর আমাদের অভিকের তার ফুলের প্রতি দুষ্টমিষ্ট ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ তো আছেই। কখনো বুকে জড়িয়ে বা কখনো হঠাৎ করে গালে গাল ছুঁয়ে আবার কখনো ঘুমের ঘোরে তার ফুলের কপালে চুমু দিয়ে।
বাড়ির পরিবেশ ঠিক সেই আগের মতো হয়ে গেছে কোলাহল মুক্ত। অভিকের নানু চলে গেছেন আজ এক সপ্তাহ হলো।আজ অভিকের হাতের প্লাস্টার খোলার হবে। তাই সকাল থেকে বেশ ব্যস্ত হিয়া সকলের জন্য নাস্তা তৈরি করে জরি খালার সাহায্যে টেবিলে সব গুছিয়ে রেখে চললো অভিকের কাছে।যাওয়ার সময় ওর মা এবং শ্বাশুড়িকে ডেকে বলে গেলো, নাস্তা তৈরি হয়ে গেছে যেন খেয়ে নেয় সবাই মিলে।
রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করতেই হিয়াকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো অভিক।অভিমানী সুরে বলে উঠলো,
#চলবে