সুপ্ত ভালোবাসা❤পর্ব-৩০

0
1434

#সুপ্ত_ভালোবাসা

#পর্ব_৩০

#Tahmina_Akther

রুমের দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করতেই হিয়াকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো অভিক।অভিমানী সুরে বলে উঠলো,

-কিছু পুরুষের কপাল না সোনায় বাঁধাই করা আর আমার কপাল হচ্ছে ফুৃঁটা। যেখানে অন্য পুরুষ বৌয়ের নরম হাতের পরশে সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে আর আমি কি না বৌয়ের মুখখানা অব্দি ঘুম থেকে জেগে দেখতে পারি না।

-সবসময় উল্টাপাল্টা কথা বলো তুমি। আজ কত তারিখ মনে আছে?জলদি ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নাও আজ হসপিটালে যেতে হবে।

-আরে আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। আল্লাহ আজ কতদিন পর হাতটা বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবে।তাড়াতাড়ি আমাকে ফ্রেশ হতে সাহায্যে করো।

অভিকের ছটফটানি দেখে হেসে ফেললো হিয়া।ওয়াসরুমে যেয়ে অভিককে গোসল করিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিলো।এরপর, হিয়াও গোসল করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো।রুমে আসতেই দেখতে পেলো অভিক আর সাদাফ বসে বসে কি যেন আলাপ করছে।

-কি রে সাদাফ আজ এত সকালে এই ঘরে। তোকে তো সকাল ১১টার আগে দেখাই যায় না?

-এমনিতেই আজ কেন যেন ঘুম ভেঙে গেলো। রুম থেকে বের হয়ে এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম। রুমের দরজা খোলা ছিল দেখি কি অভিক ভাই নিজে নিজে প্যান্ট পরিধান করার চেষ্টা করছিলো। হাজার চেষ্টা করলেও তো পারবে না তাই অভিক ভাইকে এখানে এসে সামান্য সাহায্যে করলাম। দেখছো না প্যান্ট পরে বসে আছে তুমি কখন আসবে আর তাকে শার্ট পরিয়ে দিবে। আচ্ছা, তাহলে আমি এখন যাই আপু পরে দেখা হবে।

বলেই রুম ত্যাগ করলো সাদাফ। সাদাফ যাওয়ার পর রুমের দরজা আটকে হিয়া হালকা হেসে অভিককে উদ্দেশ্য করে বললো,

-তোমার অবস্থা এখন দু’বছরের বাচ্চাদের মতো। কেউ গোসল করিয়ে দিলো করবে,কাপড় চেঞ্জ করিয়ে দিলে করবে আবার কেউ খাইয়ে দিলে খাবে।

-আমার এই সব কাজ করতে কি তোমার বিরক্ত লাগছে ফুল?

-আমি কিন্তু একবারও সেই কথা বলি নি। এমনিতেই মজা করছি তোমার সঙ্গে। আজ থেকে না পারো দু’চারদিন পর থেকে আবার নিজের কাজ নিজেই করতে পারবে।এখন বলো পাঞ্জাবি, নাকি শার্ট পরবে?

-কালো শার্টটা নিয়ে এসো দেখছো না সাদাফ আমায় ব্লু জিন্স পরিয়ে দিয়েছে।

হিয়া মাথা নাড়িয়ে কাবার্ড থেকে কালো শার্ট এনে খাটের উপরে রেখে দিয়ে আস্তে করে অভিককে পরিয়ে দিলো।শার্ট পড়ানো শেষ হতেই এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিলো।
হিয়া অভিকের থেকে খানিকটা দূরে সরে দাঁড়ালো এরপর ওর মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে মনে মনে শুধু একটি শব্দ উচ্চারণ করলো,

-মাশাআল্লাহ।

অভিককে সাথে নিয়ে চললো নিচের ডাইনিং টেবিলে। সেখানে যেতেই দেখা গেলো বাড়ির সকলেই উপস্থিত। হিয়া একটি চেয়ার টেনে অভিককে বসিয়ে দিলো। এরপর, নাশতার প্লেট থেকে খাবার নিয়ে অভিককে খাইয়ে দিচ্ছে। সবাই একপলক হিয়া-অভিকের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।কারন, এই একমাসে প্রতিদিনকার রোজ ঘটনার একটি।
হিয়াকে দেখলে কে বলবে যে, সে একসময় আহানকে ভালোবাসতো তাকে ভুলে সে আর অন্য কারোর জীবনের সাথে বাঁধা পরতে চায় নি আর সেখানে বয়সে ছোট অভিককে বিয়ে করতে তার ছিলো এক রাজ্যের অপারগতা।

-হিয়া আমি কি আসবো সাথে?
অভিকের বাবা বলে উঠলেন।

-না ছোট আব্বু।আমি মেনেজ করে নিবো শুধু ড্রাইভার কাকাকে কল দিয়ে বলুন আজ একটু তাড়াতাড়ি চলে আসতে।

– আচ্ছা, বলছি।

-অভিক,

হিয়ার বাবা অভিককে ডাকলেন

-জি বড় আব্বু।

-তোমার ফুপি কল করে ছিলো আমার কাছে। তার শরীরটা নাকি ইদানীং ভালো যাচ্ছে না। সে চাইছে আমরা সকলে যেন তাকে গিয়ে দেখে আসি।

-কিন্তু, বড় আব্বু আমরা সবাই তো আর একসাথে যেতে পারবো না।

-হুম সেটাই তো ভাবছি। আচ্ছা দেখি কি করা যায়? চাকরিতে কখন থেকে যাওয়া শুরু করবে নাকি রিজাইন করবে?

-ভাবছি আজই রিজান লেটার জমা করে দিবো। ব্যবসায় মন দিতে চাচ্ছি এখন। আব্বু আমার সিদ্ধান্ত কি খারাপ হবে?

-না খারাপ হবে না। নিজেদের ব্যবসা দেখা শোনা করবি এতে খারাপের কি আছে।তাছাড়া, তোর বড় আব্বুর শরীর তেমনটা ভালো নয় আর আমিও চাকরি আর ব্যবসা দুটো একসাথে সামলাতে পারছি না। তুই যদি ব্যবসার হাল ধরিস তাহলে আমরা দু’ভাই নিশ্চিন্ত হবো।
আমি উঠছি তাহলে আজ আবার এক মন্ত্রীর মিটিংয়ের দায়িত্ব পরেছে আমার উপর। ইনশাআল্লাহ সন্ধ্যায় দেখা হবে।

বলে চলে গেলেন অভিকের বাবা।অভিককে খাইয়ে দিচ্ছিলো হিয়া এমন সময় ওর মুখের কাছে কে যেন খাবার তুলে ধরলো।হিয়া উপরে তাকিয়ে দেখলো ওর চাচী মানে অভিকের মা। হিয়া হালকা হেসে খেয়ো নিলো। হিয়ার মা এই দৃশ্য দেখে মন পুলকিত হলো।মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া চাইলেন যেন তার মেয়েকে সদা সুখে রাখেন।

—————-

হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে এলো হিয়া আর অভিক। অভিক হাতটা হালকা ভাবে নড়াচড়া করতে পারছে। ধীরে ধীরে আগের মতো হাত নড়াতে পারবে। হসপিটাল থেকে বেড়িয়ে গাড়ির কাছে যেতেই অভিক বলে উঠলো,

-চাচা, আপনি গাড়ি নিয়ে বাড়িতে চলে যান। আমরা পরে বাড়িতে ফিরবো।

চাচা কি বুঝলেন কে জানে? তিনি হেসে গাড়ির স্টার্ট করে চলে গেলেন। আর আমি রেগে অভিকের তাকিয়ে আছি,

– কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আজ কতদিন পর বন্দিদশা থেকে মুক্ত হলাম তাই আজ তোমায় নিয়ে সারাদিন ঘুরবো। তুমি কিন্তু না করতে পারবে না, ওকে?

-হুম, না করবো না ঠিক আছে। কিন্তু বাড়িতে কল করে বলো আমাদের বাড়ি ফিরতে দেরি হবে।

-আমি আসার সময় মা’কে বলে এসেছি। অতএব, নো চিন্তা ডু ফূর্তি।

রিকশা ডেকে আমাকে উঠিয়ে আমার পাশে অভিক চেপে বসলো।

শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত পর্যন্ত ঘুরে ফিরেছি আজ। দুপুরে এক রেষ্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করেছিলাম।

এখন গোধুলীর শেষ বেলা।সূর্য আস্তে আস্তে টলে পড়ছে পশ্চিমের আকাশে।সূর্যের শেষ বিকেলের আলোয় চারপাশে হলুদ আভায় পরিপূর্ণ। হলুদ আলোতে অভিকের ফর্সা শরীর থেকে যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে।ও কাকে যেন কল করে আসতে বলছে?

আমরা এখন বসে আছি ফুচকার স্টলে। চারপাশের কিছু মেয়ে খাওয়া বাদ দিয়ে অভিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে আছে আর আমি এগুলো দেখে মনের সুখে গান গাইছি মনে মনে।কারণ, অভিক নামক মানুষটি এখন সম্পুর্ন আমার সেখানে সারাজীবন তাকিয়ে থাকলেও কোনো লাভ হবে না।

অভিক আমার পাশের চেয়ারটায় বসতেই কে যেন অভিকের গলা জড়িয়ে ধরলো।ও মাই গড, সব বন্ধুরা চলে এসেছে! অভিক তাহলে ওদেরকে বারবার কল করে বলছিলো তাড়াতাড়ি আসার জন্য।
তিয়ানা-আবির এবং মিরা-জ্যাক তারা কিন্তু এখন নবদম্পতি। তিয়ানা আর আবিরের বিয়ে হয়েছে আজ ১৫ দিন। মিরা আর জ্যাকের বিয়ে হয়েছে আজ চারদিন। মিরা বা তিয়ানার পরিবারের সকলেই রাজি ছিলো বিয়েতে।

মিরা সকলের উদ্দেশ্য বলে উঠলো ,

-দোস্ত, আমাদের আর কখনো একসাথে বসে আড্ডা দেয়া হবে না। আমি বাংলাদেশে আছি আর একসপ্তাহের জন্য। এরপর চলে যাবো কানাডায় জ্যাকের সাথে।
বেশ কাঁদোকাঁদো সুরে কথাগুলো বললো মিরা।

প্রিয় বন্ধুর চলে যাবার কথা শুনে আবির, তিয়ানা, সাঈদ এবং অভিকের বেশ খারাপ যেন কেঁদে ফেললে বাঁচে!

ঠিক এইরকম একটা পরিস্থিতিতে কি বলা যায় বুঝতে পারছিলাম না। তবুও বললাম,

-মিরা, এতে মন খারাপের কিছু নেই। এখন ডিজিটাল যুগ ভিডিও কলে যখন তখন আমাদের সাথে কথা বলতে পারবে। আর যখন তোমার কথা আমাদের বেশি মনে পড়বে তখন কেউ না কেউ গিয়ে তোমায় দেখে আসবে নয়তো তুমি চলে আসবে আমাদের দেখতে।

-হিয়া তো ঠিকই বলছে তুই শুধু শুধু আমাদের সেন্টি খাওয়ালি ফকিন্নি।
আবির কথাগুলো বলতেই সকলে ফিক করে হেসে ফেললাম ।

বন্ধুদের এই দলটি আবারও হাসিখুশিতে মেতে উঠলো।সবাই ফুচকা নামক বস্তুটিকে সাবার করে ফেললাম। নবদম্পত্তিরা যার যার সংসারের কিছু বিবরণ তুলে ধরলো। কেউ তার স্বামী নামে বিচার দিচ্ছে তো কেউ বলছে তার বৌ তাকে ভালোইবাসে না ইত্যাদি।

ওদের এতসব কথা শুনে বেচার সাঈদ বলে উঠলো,

-আমি যে তোদের গ্রুপের একমাত্র সিঙ্গেল তোদের কি মনে থাকে না। তোদের এই সংসারের আলাপ শুনে এখন আমার নিজের হারিয়ে যাওয়া বৌ’টার কথা বেশ মনে পরছে। এখন আমি কি করবো?

আরো একদফা হাসির রোল পড়ে গেলো। মিরা তো সাঈদকে বলেই ফেললো,

-তাহলে বিয়ে করে ফেল। নয়তো, তোকে আমাদের বিবাহিত গ্রুপের মাঝে মিসকিনের মতো লাগে।

আড্ডার শেষের দিকে আমি জ্যাককে বললাম,
যেন মিরাকে সর্বোচ্চ সুখে রাখে।
জ্যাক মিরাকে একহাতে জরিয়ে বললো,

-আই লাভ মাই কুইন। সি ইজ মাই ফার্স্ট এন্ড লাস্ট লাভ।ডোন্ট ওয়ারি সি ওইল বি হ্যাপি উইথ মি। বিকজ আই লাভ মাই মিরা মোর দেন মাই লাইফ ।
বলে সকলের সামনেই মিরার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো আমাদের ভিনদেশী জ্যাক।

এরইমাঝে সাঈদ বলে উঠলো,

-দেখলি অভিক জ্যাক তোর আর হিয়ার নাম ঠিকভাবে উচ্চারণ করতে পারে না কিন্তু নিজের লাভ কুইনের নাম কি সুন্দর করে বলে ফেললো।

ব্যস সকলের সে কি হাসি! জ্যাক এবার হয়তো আমাদের কিছু কথা বুঝতে পেরেছে সেও আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগলো।

আমাদের বন্ধু মহলের প্রানবন্ত হাসিগুলো আশেপাশের কিছু মানুষের হয়তো ভালো লাগছিলো আবার কারো হয়তো বিরক্ত লাগছিলো আর কেউ বা ফিরে ফিরে দেখছিলো।কিন্তু, এই বিষয়ে আমাদের কারোরই ভ্রুক্ষেপ নেই।

অতঃপর বিদায়ের ঘন্টা বেজে গেলো।একে অপরের থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হলাম আমি আর অভিক।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here