#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি💞💞
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্র-৫৫
★ সকাল ৮-৩০
নূর চোখ খুলে আজকেও নিজেকে আদিত্যের খোলা বুকে পেল। আদিত্য নূরকে আষ্টেপৃষ্টে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। নূর মাথা তুলে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো ৮-৩০ বেজে গেছে। ইশশ আজকেও দেরি হয়ে গেছে? নূরের মনে পরলো আজতো ও ওর শশুর বাড়িতে আছে। ছিঃ ছিঃ সবাই কি ভাববে? বাড়ির বউ এতো দেরি করে ঘুম থেকে ওঠে? কথাটা ভেবে নূর তড়িঘড়ি করে উঠতে নিলেই আদিত্য আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমো ঘুমো কন্ঠে বললো।
…..প্রাণপাখী এতো নড়াচড়া করছো কেন? ঘুমাতে দাওনা।
….তুমি ঘুমালে ঘুমাও। আমাকে যেতে দেও প্লিজ? দেখ এতো দেরি হয়ে গেছে। বাসার সবাই কি ভাববে?
….কেউ কিছু ভাববে না। আর ভাবলেও আই ডোন্ট কেয়ার। এখন চুপচাপ আমার বুকের মাঝে থাকো। আর আমাকে ঘুমাতে দেও।
নূর পরে গেছে এক মহামুশকিলে। ওদিকে বাসার সবার সামনে লজ্জায় পরার চিন্তা হচ্ছে, আর এদিকে আদিত্যের সাথেও পেরে উঠছে না। অগত্যা শুয়েই রইলো।
কিছুক্ষণ পর আদিত্যর ভারি নিঃশ্বাসের শব্দে নূর বুঝতে পারলো আদিত্য ঘুমিয়ে পরেছে। নূর অনেক কষ্টে আস্তে আস্তে আদিত্যের হাত সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে এলো। নূর একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে, তাড়াতাড়ি করে ওয়াশরুমে যেয়ে শাওয়ার নিয়ে বের হলো। নূর একা শাড়ী পরতে পারে না, তাই আপাতত একটা থ্রি পিচ পরে রেডি হয়ে নিল।
নূর সিড়ি বেয়ে নিচে এসে দেখলো সবাই এখানে বসে আছে। কেউ ডাইনিং টেবিলে তো কেউ সোফায় বসে আছে। নূরের ভীষণ লজ্জা লাগছে এভাবে দেরি করে আসায়। নাজানি সবাই কি ভাববে?
নূরকে নিচে আসতে দেখে আবিরের মা হাসি মুখে নূরের কাছে এগিয়ে এসে বললো।
….গুড মমনিং ডাটার ইন লাউ।
চাচীর কথায় নূর থতমত খেয়ে গেল। কি বলছেন উনি কিছুই বুঝতে পারছে না নূর। নূর মনে মনে ভাবছে, উনি কি ডাটা আর লাউয়ের কোনো সবজি রান্না করতে বলছে?
সানা সোফায় বসে থাকা অবস্থায় বলে উঠলো।
….চাচী ওটা ডাটার ইন লাউ না, ডটার ইন ল বলে।
সানা নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
….ডোন্ট ওয়ারি ভাবি আমাদের চাচীর ফেমাস ইংলিশ এমনই। ধীরে ধীরে তোমারও অভ্যাস হয়ে যাবে।
সানার কথায় নূর মুচকি হাসলো।
আবির হেসে উঠে বললো।
…মা তুমি ভাবিকে সকাল সকাল সবজির দোকান বানিয়ে ফেললে?
আবিরের মা আবার বলে উঠলো।
…..হ্যাঁ হ্যাঁ ওটাই। যাইহোক ইউ কাম সিটিং চেয়ার এন্ড ইটিং নাশতা।
নূর মুচকি হেসে সামনে এগিয়ে যেতে নিলেই, ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসে থাকা আদিত্যের ফুপু তাচ্ছিল্যের সুরে বললো।
….হ্যাঁ হ্যাঁ আসো আসো, নবাব নন্দিনী এসেছে তাকে সবাই ফুল দিয়ে বরন করো।
আদিত্যর ফুপুর কথা শুনে নূরের পা ওখানেই থেমে গেল। ওর মুখটা মলিন হয়ে গেলো।
আদিত্যর বাবা তার বড়ো বোনের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
….কি বলছিস এসব আপা?
আদিত্যের ফুপু ঝাঝাল কন্ঠে বলে উঠলো।
….তো আর কি বলবো? বাড়ির বউরা সবার আগে উঠে বাসার সবার জন্য নাশতা তৈরি করে। আর এই মহারাণী কিনা এতো বেলা করে ঘুম থেকে উঠে এখন নাচতে নাচতে নাস্তা করতে আসছে। হুহ্। বলি কোন বড়লোকের বেটি তুমি?
…..আপা কি বলছিস এসব? এবাড়িতে আজ ওর প্রথম দিন। হয়তো বুঝতে পারেনি। আর তাছাড়া বাড়ির কাজ করার জন্য এতো কাজের লোক থাকতে ওকে কেন কাজ করতে হবে?
…তুই চুপ করতো। আমি বুঝিনা তোরা কি দেখে এই মেয়েটাকে আমাদের মতো এতো বড়ো নামি-দামি বংশের বউ করে আনলি? শুনেছি ওঁকে নাকি ওর পরিবারের লোকই দেখতে পারে না। তাহলে তোরা কি দেখে আনলি। আমি যদি বিয়ের দিন আসতাম, তাহলে এই বিয়ে কখনোই হতে দিতাম না। আবার শুনেছি বিয়ের আগের দিন কারা নাকি তুলে নিয়ে গিয়েছিল? ছিঃ ছিঃ এতকিছুর পরেও তোরা এই নষ্টা মেয়েটাকে এবাড়ির বউ করে আনলি?
নূরের মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছে না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে শুধু চোখের পানি ফেলছে।
ফুপুর কথা শুনে আবির আর সানাও রাগে ফেটে যাচ্ছে। আবির চোখ মুখ শক্ত করে কিছু বলতে যাবে তখনই ওর মা চোখের ইশারায় মানা করলো। কারণ সে চায়না আবির রাগের বসে ফুপুর সাথে বেয়াদবি করুক।
আদিত্যের বাবা এবার শক্ত গলায় বলে উঠলো।
….অনেক হয়েছে আপা। কি সব আজেবাজে কথা বলছিস? নূর আমার মেয়ের মতো। তাই ওর সম্পর্কে আর কোনো উল্টো পাল্টা কথা শুনবো না আমি।
আদিত্যর বাবা নূরকে কথার হাত থেকে বাঁচানোর জন্য নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
….তুমি যাও মা, আদিত্যকে ডেকে আনো। তারপর একসাথে নাশতা করে নেও।
নূর কিছু বলতে পারছে না। গলার ভেতর সব দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। নূর মাথা নিচু করেই নাড়িয়ে হ্যাঁ বুঝালো। তারপর কোনরকমে ওখান থেকে চলে গেলো।
নূর চলে যেতেই আদিত্যর ফুপু বলে উঠলো।
….হ্যাঁ হ্যাঁ লায় দিয়ে দিয়ে মাথায় তোল। তারপর যেদিন এই মেয়ের আসল রুপ দেখবি সেদিন আমার কথা মনে পড়বে। তোকে কতবার বললাম আমার বড়ো মেয়ে নিরা আদিত্যাকে পছন্দ করে, ওঁকে বিয়ে করতে চায়।নিরা আমেরিকা থেকে ফিরেই আদিত্যকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু তুই তো শুনলই না। কোথায় এই মেয়ে আর কোথায় আমার নিরা। সব দিক দিয়েই আমার নিরা এই অপয়া মেয়ের থেকে অনেক ভালো। ইশশ আমার মেয়েটা যখন শুনবে যে আদিত্যর বিয়ে হয়ে গেছে। নাজানি কি করবে?
…..আপা তোমাকে আমি আগেই বলেছি। আদিত্য নিরাকে বিয়ে করতে চায় না। আর আমি আমার ছেলেমেয়েদের ওপর কখনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেই না। ওদের খুশিতেই আমার খুশী। তাই এসব কথা বাদ দেও প্লিজ। আর প্লিজ আদিত্যর সামনে কোনো রকম সিনক্রিয়েট করোনা। তুমি তো জানোই ও কেমন রাগী? রাগ উঠে গেলে ওকে কন্ট্রোল করা মুশকিল হয়ে যায়। আর নূরের ব্যাপারে ও একটু বেশিই সেনসেটিভ।
….তুই কি আমাকে তোর ছেলের ভয় দেখাচ্ছিস?এবাড়িতে এখন আমার এই সম্মান বাকি আছে?
আদিত্যের বাবা বুঝতে পারছে এর সাথে কথা বলে কোনো লাভ হবে না। তাই সে নিজেই ওখান থেকে উঠে গেলো।
নূর রুমে এসে জানালার সামনে যেয়ে মুখের ওপর হাত চেপে ধরে নীরবে কাঁদতে লাগলো। যাতে আদিত্য টের না পায়। নূর কাঁদতে চাচ্ছে না,তবুও কেন যেন ওর চোখের পানি আটকাতেই পারছে না। দোষ তো ওর নিজেরই। ঠিকই তো বলেছেন উনি। বাড়ির বউ হয়ে এতবেলা করে ওঠা আমার ঠিক হয়নি।
আদিত্যর ঘুম ভেঙে গেছে। আদিত্য চোখ খুলে দেখলো, নূর বিছানায় নেই। সামনে তাকিয়ে দেখলো নূর জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নূর উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকায় আদিত্য শুধু নূরের পিঠ দেখতে পাচ্ছে।
আদিত্য মুচকি হেসে আস্তে করে উঠে নূরের কাছে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
আচমকা আদিত্য আসায় নূর একটু চমকে গেল। নিচের দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি করে চোখের পানি মুছে নিল। মুখে জোরপূর্বক হাসি আনার চেষ্টা করলো।
আদিত্য নূরের চুলে নাক ডুবিয়ে দিয়ে চুলের ঘ্রাণ নিল। তারপর ঘুমো ঘুমো নেশা ভরা কন্ঠে বললো।
…..গুড মর্নিং সোনা বউ।আমাকে একা রেখে উঠে গেলে কেন? আমি মানা করেছিলাম না? আমি কিন্তু রাগ করেছি। এখন ফটাফট মর্নিং কিস দিয়ে আমার রাগ ভাঙিয়ে দাও।
নূর নিচের দিকে তাকিয়ে বললো।
….তো তোমার জন্য কফি নিয়ে আসছি।
কথাটা বলে নূর যেতে নিলেই আদিত্য নূরের হাত টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বললো।
…..কফি সফি পরে হবে আগে আমার মিষ্টি চাই। আর এভাবে মাথা নিচু করে রেখেছ কেন?
কথাটা বলে আদিত্য দুই হাতে নূরের মুখটা আগলে ধরে উপরে তুলতে তুলতে বললো।
….কাম অন গিভ মি মাই সুইট কি,,,,,
আর বলতে পারলো না আদিত্য। নূরের দিকে তাকাতেই ওর বুকের ভেতর ধক্ করে উঠলো। নূরের চোখ মুখ কেমন ফুলে লাল হয়ে গেছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে নূর কান্না করেছে। আদিত্য উত্তেজিত হয়ে বলে উঠলো।
…..হেই প্রাণপাখী কি হয়েছে তোমার? কাঁদছ কেন? শরীর খারাপ করেছে? বডি পেইন করছে? দাঁড়াও আমি এখুনি পেইন কিলার বের করে দিচ্ছি। তুমি খেয়ে নেও কেমন?
নূর যে ভয়টা পাচ্ছিলো সেটাই হলো। আদিত্য বুঝে গেছে। এখন কি করবে ও। নূর কোনরকমে আমতা আমতা করে বললো।
….কি কিছু হয়নি আমার। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছ।
…. কি কিছু হয় নি? চোখ মুখ ফুলে লাল হয়ে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে তুমি কান্না করেছ। কি হয়েছে বলো আমাকে?
….সত্যিই বলছি কিছুই হয় নি। এ এটা হয়তো বেশিক্ষণ ঘুমিয়ে থাকার কারণে এমন হয়েছে। এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে।
আদিত্য চোয়াল শক্ত করে বললো।
…..ডোন্ট ট্রাই টু ফুল মি নূর। ইউ নো দ্যাট আই হেট লাইস।
আদিত্য কিছু একটা ভেবে বললো।
….এক মিনিট কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?
আদিত্যের কথায় নূর চমকে তাকালো আদিত্যের দিকে। তারপর আমতা আমতা করে বললো।
….না না কেউ কিছু বলেনি। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছ।
….নূর আমার রাগ বারিও না। সত্যি করে বল কেউ কিছু বলেছে তোমাকে?
নূর ভালোই বুঝতে পারছে যে আদিত্য রেগে গেছে। কারণ রেগে গেলেই শুধু আদিত্য ওকে নূর বলে ডাকে। তবুও নূর চায় না আদিত্য সত্যিটা জানুক। ও চায় না ওর জন্য পরিবারে অশান্তি হোক। তাই আবারও বলে উঠলো।
….কি এক কথা নিয়ে পরে আছ। বললাম তো কিছু হয় নি। ছাড়ো না এসব এখন প্লিজ?
….বুঝতে পেরেছি তুমি এভাবে বলবে না। ঠিক আছে।
কথাটা বলেই আদিত্য জোরে জোরে সানার নাম ধরে ডাকতে লাগলো।
একটু পরেই সানা ওখানে এসে বললো
….কি হয়েছে ভাইয়া? এভাবে ডাকছিস কেন?
আদিত্য সানার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
…..সানা বাসায় কেউ কিছু বলেছে নূরকে?
নূর সানার দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় বলতে নিষেধ করলো।
কিন্তু সানা সেটা না মেনে বলে উঠলো।
…সরি ভাবি আমি তোমার কথা মানতে পারছি না।
তারপর আদিত্যর দিকে তাকিয়ে বললো।
…হ্যাঁ ভাইয়া বলেছে। এবং অনেক খারাপ কথা বলেছে।
আদিত্য দাঁতে দাঁত চেপে বললো।
…কে কি বলেছে? সব খুলে বল।
সানা আদিত্যকে সব খুলে বললো। সব শুনে আদিত্য রাগে চোখ মুখ লাল করে হাত শক্ত করে মুঠ করে ফেললো। সানার দিকে তাকিয়ে বললো।
….তুই যা আমি আসছি।
সানা মাথা ঝাকিয়ে চলে গেলো।
আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে বললো।
….তোমাকে বলেছি না কেউ কিছু বললে আমাকে বলবে? তাহলে আমার কাছে কেন লুকাচ্ছিলে। উনার সাহস কি করে হলো তোমাকে এসব কথা বলার? আমি এখুনি দেখছি উনাকে।
কথাটা বলেই আদিত্য রেগে ওখান থেকে যেতে নিলেই নূর আদিত্যের হাত টেনে ধরে বিনতির সুরে বললো।
….প্লিজ তুমি এখন রাগারাগি করোনা। উনি আমাদের গুরুজন। আমাদের কিছু বলতেই পারে। তাই বলে তুমি তার সাথে রাগারাগি করলে সেটা বেয়াদবি হবে। উনি মনে কষ্ট পাবেন। আর উনি কষ্ট পেলে বাবারও মন খারাপ হবে। প্লিজ বোঝার চেষ্টা করো।
আদিত্য রাগী স্বরে বলে উঠলো।
….আই ডোন্ট কেয়ার এবাউট এনিথিং। তোমার চোখে যে পানি আনবে সে যেই হোক না কেন, তাকে আমি কিছুতেই ছাড়বো না।
আদিত্য ঝটকা দিয়ে নূরের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে নেয়। নূর দৌড়ে যেয়ে আদিত্যকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো।
…..শান্ত হও প্লিজ। আমার কথাটা শোন।
….নূর ছাড় আমাকে।
….না কিছুতেই ছাড়বো না। আগে তুমি শান্ত হও। দেখ আমি চাই না বিয়ের দ্বিতীয় দিনই আমার জন্য এবাড়িতে কোনো অশান্তি হোক। তাহলে আমি নিজেকেই অপরাধী ভাববো। প্লিজ শান্ত হও।
আদিত্য নূরের কথায় ভ্রুক্ষেপ না করে রাগী স্বরে বলে উঠলো।
….তোমার কোনো দোষ নেই নূর। তাই শুধু শুধু এসব কথা বলে আমাকে আরো রাগিও না। এখন ছাড়, যেতে দেও আমাকে।
….না ছাড়বো না।
….নূর ছাড় বলছি।
…কিছুতেই না।
আদিত্য এবার রাগের বসে জোর করে নূরের হাত দুটো এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিল। নূর টাল সামলাতে না পেরে নিচে পরে গেলো। নিচে পরার সময় নূরের এক হাত খাটের কোণার সাথে বাড়ি লাগে। নূর ব্যাথায় হালকা ককিয়ে উঠে।
…,আহহ
নূরের আর্তনাদ শুনে আদিত্য চমকে উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখে, নূর ব্যাথা পাওয়া হাতটা আরেক হাত দিয়ে ধরে চোখ খিচে বন্ধ বসে আছে। আদিত্য দৌড়ে যেয়ে নূরের সামনে বসে দুই হাত দিয়ে নূরের মুখটা আগলে ধরে উত্তেজিত হয়ে বললো।
…..কি হয়েছে প্রাণপাখী? কোথায় লেগেছে? আই এ্যাম সো সরি প্রাণপাখি। সো সরি।
আদিত্য নূরের ব্যাথা পাওয়া হাতটা নিজের হাতে নিয়ে পাগলের মতো বললো।
….ইশশশ কতো লাল হয়ে গেছে। আমার জন্য আমার প্রাণপাখীটা ব্যাথা পেল। আমার নিজেকে মেরে ফেলতে ইচ্ছে করছে। আই এ্যাম সো সরি, সো সরি। তুমি কেন আমাকে আটকাতে গেলে? কতো ব্যাথা পেয়ে গেলে। এখন আমি কি করবো?
আদিত্যের এমন পাগলামি দেখে নূর দুই হাত দিয়ে আদিত্যের মুখটা আগলে ধরে আদিত্যকে শান্ত করার জন্য বলে উঠলো।
….হুশশ শুশ, শান্ত হও প্লিজ। দেখ আমার কিছু হয় নি। আমি ঠিক আছি।
….কিচ্ছু ঠিক নেই। দেখ তুমি কতো ব্যাথা পেয়েছ। সব আমার জন্য হয়েছে। আমি খুব খরাপ হাসব্যান্ড। বিয়ের দ্বিতীয় দিনই নিজের বউকে আঘাত দিয়ে ফেললাম।
নূর হালকা শাসনের সুরে বললো।
….একদম আমার হাসব্যান্ড কে খারাপ বলবে না। আমার হাসব্যান্ড দুনিয়ার বেস্ট হাসব্যান্ড।
আদিত্য নূরের দিকে মায়া ভরা চোখে তাকিয়ে নূরকে জড়িয়ে ধরলো।
একটু পরে আদিত্য কিছুটা শান্ত হয়ে নূরের হাতে অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দিচ্ছে। নূর নরম স্বরে বললো।
….তুমি প্রমিজ করছো তো যে, তুমি ফুপিকে কিছু বলবে না?
আদিত্য নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
….তুমি চাও আমি ফুপিকে কিছু না বলি তাইতো? ওঁকে ফাইন তাই হবে। আই প্রমিজ আমি ফুপিকে কিছু বলবো না। নাও হ্যাপি?
নূর মুচকি হেসে আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে বললো।
…অনেক হ্যাপি।
আদিত্য নূরকে জড়িয়ে ধরে কিছু একটা ভেবে বাঁকা হাসি দিল।
——-
আদিত্য ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ পরে নূরকে নিয়ে নিচে আসতে লাগলো। সিড়ির কাছে এসে আদিত্য হঠাৎ নূরকে কোলে তুলে নিল। আচমকা এমন হওয়ায় নূর একটু থতমত খেয়ে গেল। আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
…কি করছ তুমি? নিচে সবাই বসে আছে। ফুপিও ওখানে বসে আছে সবাই কি ভাববে? নামাও প্লিজ।
আদিত্য বলে উঠলো।
…আমি তোমার কথা রেখেছি না? এখন তুমিও আমার কথা রাখবে। আমি যাই করিনা কেন, আমাকে বাঁধা দিবেনা।
কথাটা বলে আদিত্য নূরকে কোলে নিয়ে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো। নূর আর কি করবে ও জানে আদিত্যের সাথে ও পারবে না। তাই চুপ করে রইলো।
ওদের দেখে আবির আর সানা মিটিমিটি হাসছে। আদিত্যের ফুপু ওদের এভাবে দেখে চোখ বড়ো বড়ো করে ফেললো। আদিত্য সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নূরকে নিয়ে সোজা ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে বসিয়ে দিল। তারপর নিজেও ওর পাশে বসে পড়লো। নূর লজ্জায় কাচুমাচু হয়ে বসে রইলো।
এসব দেখে আদিত্যের ফুপু বলে উঠলো।
….এসব কি হচ্ছে? ছিছিছি ছিঃ লজ্জা শরম কি তোরা বেঁচে কিনে খেয়েছিস?
আদিত্য ওর ফুপুর কথার কোনো ভ্রুক্ষেপই করছে না। মনে হচ্ছে যেন এখানে আদিত্য আর নূর ছাড়া অন্য কেউই নেই। আদিত্য ওর ফুপুকে পুরোপুরি ইগনোর করে দিয়ে, প্লেটে নাশতা বেরে নিল। তারপর চামচে করে খাবার নিয়ে নূরের মুখের সামনে ধরে আদুরে গলায় বললো।
….নেও প্রানপাখী খেয়ে নেও। কত বেলা হয়ে গেছে এখনো না খেয়ে বসে আছ কেন? তুমি জানোনা তোমার খাবার দাবারের ব্যাপারে অনিয়ম আমার একদম পছন্দ না?
নূর বেচারি পরে গেছে এক মহা মুশকিলে। লজ্জায় এখানে বসতেও পারছে না, আবার আদিত্যের ভয়ে উঠেও যেতে পারছে না। নূর আদিত্যের দিকে তাকিয়ে ভীতু স্বরে বললো।
…আ আমি একাই খেয়ে নিচ্ছি । ত তোমার খাওয়াতে হবে না।
….কেন? তুমি হাত দিয়ে কেন খাবে? আমি যখন বলেছি তখন আমার বউকে আমিই খাওয়াবো বুজেছ? এখন কথা না বলে খেয়ে নেও।
নূর আর উপায় না পেয়ে আদিত্যের হাতেই খাবার খেতে লাগলো।
এসব দেখে আবির আর সানার হাসি আটকে রাখা কঠিন হয়ে গেছে। ওরা ভালোই বুঝতে পারছে যে আদিত্য এসব ফুপুকে জব্দ করার জন্য করছে।
এদিকে আদিত্যের ফুপু এসব দেখে রেগে গিয়ে বলে উঠলো।
….আদিত্য কি হচ্ছে এসব? আমি যে এখানে বসে আছি সেটা কি তোর চোখে পরছে না। এই বেশরম মেয়ের পাল্লায় পড়ে তুই নিজেও বেশরম হয়ে গেছিস?
কথাটা শোনার সাথেই আদিত্যের পায়ের রক্ত মাথায় উঠে গেলো। রাগে কপালের রগ ফুলে উঠলো। নূরের খুব ভয় লাগছে। নাজানি আদিত্য রেগে গিয়ে কি কান্ড করে বসে?
আদিত্য নিজের হাত শক্ত করে মুঠ করে চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ কন্ট্রোল করার চেষ্টা করলো। কারণ ও নূরকে কথা দিয়েছে যে ওর ফুপিকে কিছু বলবে না। আদিত্য ওর ফুপুর কথার উত্তর না নূরের দিকে তাকিয়ে শান্ত সুরে বললো।
….কি হলো তুমি খাওয়া বন্ধ করলে কেন? কে কি বললো, সেটা শুনে তুমি মন খারাপ করে চুপ করে থাকবে কেন? তোমার মুখ আছে না? তুমি জবাব দিতে পারো না?শোন তুমি এবাড়ির বউ। এবাড়িটা তোমার। তাই কেউ এসে তোমাকে অপমান করে যাবে, তুমি সেটা চুপচাপ শুনবেনা বুজেছ? তুমিও তার মুখের ওপর জবাব দিয়ে দিবে।
আদিত্যের ফুপু বলে উঠলো।
…. কি বলতে চাচ্ছিস তুই? এই বেশরম মেয়েটা নিশ্চয় তোর কান ভরেছে তাইনা?
আদিত্যর চরম রাগ হলেও ও ওর ফুপুর দিকে একবারও তাকাচ্ছে না। ফুপুকে পুরোপুরি ইগনোর করে দিয়ে নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
……কেউ যখন তোমাকে বলবে, তুমি ঘুম থেকে দেরি দিয়ে উঠলে কেন? তুমি তখন বলবে যে, এটা আমার বাড়ি। আমার যখন মন চাইবে তখন ঘুম থেকে উঠব। এতে কেউ কিছু বলতে পারবে না। কেউ যখন তোমাকে নষ্টা মেয়ে বলবে। তখন তুমি তাকে বলবে যে, নষ্টা মেয়ে তাদের বলে যারা ছোট ছোট কাপড় চোপড় পড়ে ঘুরে বেড়ায়। ক্লাবে যেয়ে মদ খেয়ে মাতাল হয়ে পড়ে থাকে। হাজারটা ছেলেদের সাথে ফিজিক্যাল রিলেশন করে বেড়ায়। আর শেষমেশ সমাজে নিজের স্টাটাস আপডেট করার জন্য নিজের মামাতো ভাইকে বিয়ে করার ফন্দি আঁটে। তাদের বলে নষ্টা মেয়ে।
আদিত্যের ফুপু ভালোই বুঝতে পারছে যে, আদিত্য ওনার মেয়ে নিরার কথাই বলছে। আদিত্যের ফুপু রেগে উঠে বললো।
…….অনেক হয়েছে আদিত্য। তুই কিন্তু আমাকে অপমান করছিস? এই সামান্য মেয়ের জন্য তুই আমাকে অপমান করছিস?
আদিত্য আবারও ওর ফুপুকে ইগনোর করে দিয়ে নূরের দিকে তাকিয়ে বললো।
……শোন যে তোমাকে অপমান করবে তোমার সম্মান করবে না। সেও এবাড়িতে অপমানই পাবে। কারণ তুমি কোনো সামান্য মেয়ে না। তুমি সাদমান শাহরিয়ার আদিত্যর বউ, তুমি আমার জান,আমার গর্ব। তাই তোমাকে কেউ কষ্ট দিলে আমি তাকে কখনোই ছেড়ে দেব না। কখনোই না। তোমাকে একটা উদাহরণ দেখাই। তোমার মনে আছে নবীন বরণ উৎসবের কথা? সেদিন তোমার সাথে ওইসব এ্যানি করিয়েছিল।
আদিত্যের কথায় নূর চমকে গেল।
…..হ্যাঁ ঠিকই শুনেছ। এ্যানিই এসব করিয়েছিল। এবং তার জন্য আমি তাকে কি শাস্তি দিয়ছি জানো?
নূর মাথা নাড়ালো, মানে সে জানে না।
আদিত্য আবিরের দিকে তাকিয়ে বললো।
…..আবির ওই ভিডিও টা দেখাতো তোর ভাবিকে।
আবির মাথা ঝাকিয়ে বললো।
…..হ্যাঁ হ্যাঁ ভাই এখুনি দেখাচ্ছি।
আদিত্য কিছু একটা ভেবে বললো।
….এক কাজ কর। টিভিতে ইউটিউব থেকে দেখা। তাহলে আমরা সবাই দেখতে পারবো।
আবির মাথা ঝাকিয়ে টিভিতে ভিডিও টা চালু করে দিল।
ভিডিও দেখে নূর হতভম্ব হয়ে গেলো।
আদিত্য বলে উঠলো।
….তোমার সাথে যে খারাপ ব্যবহার করবে, আমি তার হাল এমনই করবো।
এসব দেখে আদিত্যের ফুপুর এবার ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে। মুখ দিয়ে আর কোনো কথায় বের হচ্ছে না। আদিত্যের রাগ সম্বন্ধে তার জানা আছে।
একটু পরে নাশতা শেষে আদিত্য আবারও নূরকে কোলে তুলে নিল। তারপর সিড়ি বেয়ে উপরের দিকে যেতে লাগলো। আবির ওদের দেখে শিস বাজিয়ে উঠলো।
নূর আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
…..এসব কি হলো নিচে?
…..কি হবে? তুমি যা দেখলে তাই হলো।
….তুমি কিন্তু আমাকে প্রমিজ করেছিলে?
….হ্যাঁ তো আমি প্রমিজ রেখেছি। তুমি বলেছিলে আমি যেন ফুপিকে কিছু না বলি। তো দেখ আমি আমার কথা রেখেছি । আমি ফুপিকে কিছুই বলিনি। যা বলার তোমাকেই বলেছি। এখন এতে যদি কারোর খারাপ লাগে তাতে আমার কি করার আছে বলো?
নূরের বুঝতে বাকি নেই যে,এই লোকের সাথে ও কখনোই পারবে না।
আদিত্য দুষ্টু হেসে আবার বললো।
….এসব কথা বাদ দেও। তুমি কিন্তু আজকে আমার মর্নিং কিস দাওনি। তাই রুমে যেয়ে আগে আমার পাওনা বুঝিয়ে দেবে।
আদিত্যের কথায় নূর লজ্জায় আদিত্যের বুকে মুখ গুঁজে নিল।
চলবে…..
(ইদানিং একটা কাজে ব্যস্ত আছি। গল্প দেওয়ায় হয়তো অনিয়ম হতে পারে। কিছু মনে করবেন না।
ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন)