“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৪৪
(নূর নাফিসা)
.
.
নতুন জায়গায় নতুন অনুভূতি নিয়ে পদার্পণ করলো শারমায়া। এয়ারপোর্টে পৌঁছতেই দেখা পেয়েছে চাচাশ্বশুর মীজানুর রহমানের। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সুব্যবস্থা থাকলেও চাচাশ্বশুরের বাসা নিকটে হওয়ায় সেখানেই থাকবে এটা আগে থেকেই নিশ্চিত করে নিয়েছে আশরাফ স্যার। এয়ারপোর্ট থাকাকালীনই ভাইয়ের কাছে কল করে কনফার্ম করে দিয়েছে চাচ্চু। শারমায়ার সাথেও একটু কথা বলেছে আশরাফ স্যার। তাদের বাসায় পৌছানোর পর পরিচিত হয়েছে চাচী ও চাচাতো ভাইবোনের সাথে। জুথিকা মেয়েটা বড়, বয়স দশ বছর। ছোট ভাই সোয়াদ, বয়স সাড়ে চার বছর। দুইটা বাচ্চাই দেখতে খুব কিউট। শারমায়ার আনইজি লাগছিলো কিন্তু চাচী, তানহা এতো আন্তরিকতার সাথে কথা বলছে অনায়াসে ভালো লাগার মতো। কিন্তু তার পক্ষে ইজি হতে যে সময় লাগবে সেটা বেশ ভালোই উপলব্ধি করতে পারছে শারমায়া। চাচীর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর চাচী তাকে তার রুম দেখিয়ে দিলো। শারমায়া ফ্রেশ হয়ে এলে চাচ্চু তার ফোনে নতুন সিম এক্টিভ করে দিয়ে বললো বাসায় কথা বলতে। শারমায়া বাবা মা ও সাফওয়ানার সাথে কথা বলে কেঁদে উঠলো। তাকে সামাল দিলো চাচী। কান্না করায় কিছুক্ষণ কথা বলার সুযোগ দিয়ে চাচী ফোন নিয়ে গেলেন এককভাবে তার পরিবারের সাথে কথা বলার জন্য। কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে দেখলেন শারমায়া নিশ্চুপ চোখের পানি ফেলছে। তিনি পাশে এসে বসে বললেন,
“এভাবে কান্না করলে কিন্তু আর কথাই বলতে পারবে না। জয় আমার আদরের ছেলে, জানো তো? আর মিসেস জয়কে যেমন আদর করবো তেমন শাসনে রাখবো সেই অধিকার কিন্তু আমার আছে। একদম কান্না করবে না। তুমি বেড়াতে এসেছো এখানে। বেড়াতে এলে কেউ কান্না করে বোকা মেয়ে? রুমটা পছন্দ হয়েছে?”
শারমায়া চোখ মুছে মাথা নেড়ে বললো,
“হুম, খুব সুন্দর।”
“আর আমি কেমন?”
শারমায়া মুখের হাসি প্রশস্ত করে বললো,
“আপনি অনেক বেশি সুন্দরী।”
“একদম আপনি করে বলবে না। মাইর দিবো। জয় চাচীমা ডাকে আর তুমি করে বলে। মনে থাকবে?”
শারমায়া মাথা নাড়লে তিনি বললেন,
“তোমাকে আমার কতটা পছন্দ হয়েছে তুমি জানো? আমার ভাইটার পছন্দ আছে মাশাআল্লাহ। তোমার ছবি যখন প্রথম দেখলাম, আমি ভাইয়াকে বলেছি সোয়াদের বউ যেন ভাইয়াই পছন্দ করে দেয়। তোমার ছবি দেখার পর আমি কতটা এক্সাইটেড ছিলাম তোমাকে দেখার জন্য। কিন্তু সুযোগ হলো না দেশে যাওয়ার। আর কি ভাগ্য দেখো, তুমিই আমার কাছে চলে এসেছো। কদিন আগে আমি জয়কে বললাম তোমার সাথে ভিডিও কলে কথা বলবো। ফাজিলটা কি বলেছে জানো? বলে, ‘চাচীমা, তোমার বউমা তো আমার সাথেই ভিডিও কলে কথা বলে না, তোমার সাথে কিভাবে বলবে! আর কিছুদিন পর তো তোমাদের কাছে আসছেই, এতো অস্থির হইয়ো না। এতে কিন্তু আমার অস্থিরতা বাড়ছে চলে আসার জন্য।”
শারমায়া দৃষ্টি নিচের দিকে রেখে মুচকি হাসলো। তানহা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“ছেলেটা কিন্তু প্রচন্ডরকম ভালোবাসে তোমাকে। আমার সাথে যখন কথা বলে সিক্সটি পার্সেন্ট তোমার ব্যাপারে গল্প করে। আমি কিন্তু তোমার আচার-আচরণের ব্যাপারে অনেকটা জানি। আর তোমার চাচ্চু তো তার ফ্রেন্ড। কেউ বলবেই না তারা চাচা ভাতিজা। ম্যারিড লাইফের কত বানী টানী শিখিয়ে দেয়। ছেলেটা আমার লজ্জায় পড়ে বলে নোট করে রাখতে। যখন বউ সংসারে উঠবে তখন নোট মুখুস্ত করে নিবে। দেখো, গল্প করতে করতে রুমের কথা বলতে ভুলেই গেলাম। এটা কিন্তু জয়ের রুম। সে নিজে ওয়ালে এই পেইন্টিং করেছে। নিজের রুম নিজেই গুছিয়ে রাখতো সবসময়। সে চলে যাওয়ার পর আমি একটু ঝেড়ে মুছে রাখি। এখন তোমার পালা। এই টেবিল, ট্রলি, কাভার্ড সব তার। তুমি নিশ্চিন্তে ইউজ করতে পারো। মেবি তার অল্প কিছু পোশাক আছে কাভার্ডে। আজ কিছু করতে হবে না। কাল লাগেজ খুলে নিজের মতো গুছিয়ে নিয়ো সব। পঁচনশীল কিছু থাকলে বের করে নিতে পারো। এখানে ঠান্ডা কেমন?”
“লাগছে মোটামুটি।”
“ক’দিন পর বুঝবে ঠেলা। এসো বাসাটা ঘুরে দেখো, ভালো লাগবে। এরপর খাওয়াদাওয়া করে লম্বাটে একটা ঘুম দিবে। একেবারে সকালে উঠবে। সন্ধ্যার পর বা রাতে যদি সজাগ হয়ে যাও ফ্রুটস খেয়ে আবার ঘুমিয়ে থাকবে। আমি ফ্রুটস রেখে যাবো। আর হ্যাঁ, মনে করবে তুমি নিজের বাসায় আছো। যখন যা ইচ্ছে নিজ হাতে নিয়ে খাবে, ঘুরবে ফিরবে একদমই নিজের মতো। আমার বলার অপেক্ষায় বসে থাকবে না। তারপরও যদি, যদি…কোনোকিছুতে আনকম্ফোর্টেবল ফিল করো তাহলে অবশ্যই আমাকে ইনফর্ম করবে। ওকে?”
শারমায়া মাথা নেড়ে ইতিবাচক জবাব দিলো। তানহা বললো,
“উহুম, শুধু মাথা নাড়লে চলবে না। আমি কিন্তু জানি তোমার স্বভাব সম্পর্কে। ফুললি চেঞ্জ হতে হবে।”
শারমায়া মুচকি হেসে বললো,
“ওকে।”
অতঃপর চাচীমার সাথে ঘুরে ঘুরে বাড়িটা দেখতে লাগলো। খুবই সুন্দরভাবে সজ্জিত। প্রত্যেকের রুম আলাদা। যার যার প্রয়োজনীয় জিনিস তার তার রুমে রাখা। তাদের ঘরে ওল্ড ফ্যাশন ডিজাইনের কিছু জিনিস আছে যা শারমায়ার মন কেড়েছে। যেমন, চাচাচাচীর রুমের টেবিল ল্যাম্পটা চমৎকার লেগেছে। জোভানের রুমের ভায়োলেন্ট আর্টটাও দারুণ।
পরদিন সকালে জুথিকার সাথে কথা হলো। মেয়েটা মায়ের মতোই বেশ মিশুক। শারমায়াকে ভাবি মনি বলে সম্বোধন করছে। জুথিকা যখন রুমে বসে শারমায়ার সাথে কথা বলছিলো, সোয়াদ বারবার দরজার সামনে এসে উঁকি দিয়ে চলে যাচ্ছে। চতুর্থবার এলে শারমায়া তাকে ভেতরে আসার জন্য ডাকলো। আর পিচ্চিটা লজ্জা পেয়ে দৌড়ে চলে গেলো। তানহা তাদের নাস্তা করার জন্য ডাকলে সবাই একসাথে নাস্তা করলো। জুথিকা স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। শারমায়া রুমে এসে দেখলো জোভানের নম্বর থেকে কল এসেছে। মুহুর্তেই যেন মনটা খারাপ হয়ে গেলো। সে ফোন পাশে রেখেই অন্যভুবনে ধ্যানমগ্ন হয়ে গেলো। আবারও ফোন বেজে উঠলো। ঝাপসা চোখে ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো জোভানই। শারমায়া চোখ মুছে দীর্ঘ নিশ্বাস টানলো নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টায়। অতঃপর ফোন রিসিভ করে সালাম দিলো। জোভান খুব শান্ত গলায় সালামের জবাব দিলো। শারমায়া চুপ করে আছে। জোভানও অল্প সময় নিরবতা পালন করে বললো,
“কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ। আপনি কেমন আছেন?”
“আলহামদুলিল্লাহ।”
“বাসার সবাই কেমন আছে?”
শূন্যতার মাঝেও আনন্দ হচ্ছে শারমায়া তার সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলার চেষ্টা করছে। ভেবেছিলো, অভিমান নিয়েই বুঝি বসে থাকবে। কিন্তু না, তার বউটা তা করেনি। যদিও তার গলা কিছুটা ধাধিয়ে আসছে তবুও জোভান বুঝতে পারছে শারমায়া চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকার। সেই প্রশান্তির ছায়া নিয়ে জোভান জবাব দিলো,
“আলহামদুলিল্লাহ, সবাই ভালো আছে। ব্রেকফাস্ট করেছো, তুমি?”
“হুম, মাত্র করে এলাম।”
“কেমন লেগেছে চাচ্চুর বাসা?”
“ভালো।”
“চাচ্চু, চাচীমা কেমন?”
“খুব বেশি ভালো।”
“একদমই কিন্তু ফ্রেন্ডলি উনারা৷ উনাদের সাথে ইজি থাকবে। জুথিকার সাথে কথা হয়েছে?”
“হুম।”
“দেখবে, সে-ও তোমার ফ্রেন্ড হয়ে যাবে।”
“হুম, খুব সুন্দরভাবে কথা বলে।”
“সোয়াদের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে?”
“উহুম। ডেকেছিলাম, আসেনি। লজ্জা পেয়ে পালিয়েছে।”
“সে দূরেই থাক। তার সাথে ফ্রেন্ড হওয়ার চেষ্টা করো না। এটা বদের হাড্ডি। সময় সুযোগে প্রচন্ড মাইর দেয়। তার হাতে মাইর খেলে কান্না করে দিবে। কিছু বলতেও পারবে না, সইতেও পারবে না।”
“সে তো একদমই ভদ্র।”
“উহুম, ভদ্র শয়তান। সেই ছোট থেকেই জুথিকা মেয়েটাকে আস্ত রাখে না। এখন তো একটু বড় হয়েছে, শক্তিও বেড়েছে। তুমি তার কাছ থেকে সাবধানে থেকো।”
চোখের কোণে এসে যাওয়া পানি মুছে শারমায়া ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
“ভয় দেখাচ্ছেন?”
“ভয় কেন দেখাবো। আসলেই ডেঞ্জারাস। মাত্রাতিরিক্ত দুষ্টুমি করে।”
“অফিস যান না ঠিকমতো?”
“হুম, যাই তো।”
“মন ভালো আছে?”
“এখন বেশ ভালো আছে। তুমি চাইলে সবসময় ভালো থাকবে। জাস্ট তোমার মাইন্ড সবসময় ফ্রেশ রাখবে। তুমি বেড়াতে গিয়েছো। এনজয় করো। সুযোগ তো আর সবসময় থাকে না। হ্যাভ ফান এন্ড অলওয়েজ বি হ্যাপি, ডিয়ার।”
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে কল কেটে দিলো। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে শারমায়া বাইরের পরিবেশ দেখতে লাগলো। চারিপাশ বেশ সচ্ছলতায় ঘেরা। মনকে সতেজ ও শান্ত করে দেওয়ার মতো উপযুক্ত পরিবেশ। কাপড়চোপড় গোছানোর কথা মনে হতেই সে লাগেজ খুললো। খাবারদাবার গতকালই বের করেছিলো। সে কাপড়চোপড় একে একে খাটে রাখলো। অতঃপর কাভার্ড খুলে দুইটা টিশার্ট ও ইংল্যান্ড ফ্ল্যাগের লোগোযুক্ত একটা জার্সি ঝুলতে দেখলো। ড্রয়ার খুলে পেলো ব্ল্যাক এন্ড অফহোয়াইট দুইটা কোয়ার্টার প্যান্ট। সে এখানে কিভাবে চলতো বুঝতে বাকি নেই। ড্রয়িংরুমে চাচ্চুর সাথে ও তার পরিবারের সাথে কিছু ছবিও ঝুলানো আছে। শারমায়া মৃদু হেসে জোভানের কাপড়চোপড় একপাশে গুছিয়ে রেখে নিজের কাপড়চোপড় রাখলো। টেবিলে বেশ কিছু ইংলিশ নোবেল বুক রাখা আছে। সামনের দিকটা কিছুটা এলোমেলো থাকায় শারমায়া তা গুছিয়ে রেখে নিজের নোটবুক গুলো রাখলো একপাশে। পরদিন ছুটির দিন হওয়ায় তারা একত্রে ঘুরতে বেরিয়েছে। বেশ ভালোই লেগেছে শারমায়ার। এরপর থেকে শুরু হলো তার শিক্ষাজীবনের নতুন অধ্যায়। সপ্তাহে চারদিন ক্লাস করবে, জুথিকার স্কুলপথে চাচ্চু তাকে নামিয়ে দিবে। ক্লাস শেষ করে চাচ্চু ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে না পাঠানো পর্যন্ত ক্যাম্পাসের লাইব্রেরিতে সে সময় কাটাবে। এভাবেই চলতে থাকবে নতুন অধ্যায়।