#ভালোবাসার_চেয়েও_বেশি 💞💞
#লেখিকা-Mehruma Nurr
#পর্ব-৭২
★আদিত্যরা সেই বাইক ওয়ালার বাসার সামনে গাড়ি থামালো। বাইকের নাম্বার থেকে সব ইনফরমেশন বের করেছে ওরা। গাড়ি থামতেই আদিত্য দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে বাসার দরজায় এসে বেল বাজালো। আবির আর তাসিরও ওর পিছে পিছে এসে দাঁড়াল।
একটু পরে একজন মহিলা এসে দরজাটা খুলে দিল। দরজা খুলতেই আদিত্য অস্থির হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
….নূর কোথায়? বলুন কোথায় আমার নূর?
মহিলাটি আদিত্যের কথা বুঝতে না পেরে বলে উঠলো।
….কে নূর? আর আপনারা কে?কি চাই এখানে?
…নূর কোথায় আগে তাই বলুন? কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন ওকে? নূর, নূর,
বলে ডাকতে ডাকতে আদিত্য বাসার ভেতরে ঢুকে এদিক ওদিক তাকিয়ে নূরের নাম ধরে ডাকতে লাগলো। আবির আর তাসিরও ওর পেছনে পেছনে ঢুকলো।
মহিলাটি এসব দেখে হকচকিয়ে উঠে বললো।
…আরে আরে কোথায় চলে আসছেন আপনারা? চেনা নেই জানা নেই এভাবে কেউ কারোর বাসায় ঢুকে পড়ে? এটা কোন ধরনের ব্যবহার?
আদিত্য মহিলাটির সামনে এসে কড়া গলায় বলে উঠলো।
….দেখুন ভালোই ভালোই বলে দিন আমার নূর কোথায়? নাহলে কিন্তু আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না।
….আরে ভাই কি নূর নূর করছেন? কে নূর? কিসের নূর? আমরা কোনো নূরকে চিনি না। আপনারা এখন যান এখান থেকে।
….আচ্ছা আপনি নূরকে চিনেন না?তাহলে আমার নূরের পেনডেন্ট আপনার গলায় কিভাবে এলো।
মহিলাটি ভ্রু কুঁচকে বললো।
….পেনডেন্ট? কিসের পেনডেন্ট?
আদিত্য এক আঙুল তুলে মহিলাটির গলার দিকে ইশারা করে বললো।
….এইযে আপনার গলায় যে পড়ে আছেন। এইটার কথা বলছি। এটা আমার নূর মানে আমার ওয়াইফের পেনডেন্ট। আপনার কাছে কিভাবে এলো?
….মানে? আপনার ওয়াইফের কেন হতে যাবে? এটাতো আমার পেনডেন্ট।
তাসির এবার আদিত্যর হাত ধরে একটু সরে গিয়ে আস্তে করে বললো।
….কি করছিস তুই? একটা পেনডেন্টের ওপর ভিত্তি করে তুই এখানে চলে এসেছিস? আরে একইরকমের পেনডেন্ট তো অনেকের কাছেই থাকতে পারে।
আদিত্য বলে উঠলো।
….তোর কি আমাকে ইডিয়ট মনে হয়? এমনি এমনি আমি চলে এসেছি? আরে এই পেনডেন্ট আমি স্পেশাল অর্ডার দিয়ে বানিয়েছিলাম নূরের জন্য। ওটাতে আমার আর নূরের নামের ফাস্ট লেটার দেওয়া আছে। এখন তুই বল আমি এমনি এমনি বলছি?
আদিত্য আবার ওই মহিলাটির কাছে এসে বলল।
…দেখুন আবারও বলছি ভালোয় ভালোয় বলে দিন নূর কোথায়? আর এই পেনডেন্ট কোথায় পেয়েছেন? নাহলে কিন্তু আমি পুলিশ ডাকতে বাধ্য হবো?
….দেখুন আপনি কিন্তু এবার দাদাগিরি করছেন? আরে পাগল নাকি আপনি? এক কথা একবারে বুঝেন না? বললাম তো আমি কোনো নূরকে চিনি না। আর এই লকেট টাও আমার। আপনার ওয়াইফের না।
আদিত্যের এবার রাগ আরও বেরে যাচ্ছে। তাসির ব্যাপার টা বুঝতে পেরে আদিত্যের কাছে এগিয়ে এসে বললো।
….দাঁড়া আমি কথা বলছি।
তাসির মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বললো।
….আচ্ছা ঠিক আছে, মানলাম এটা আপনার। তাহলে বলুন এটা কোথা থেকে কিনেছেন? এর কোনো মানি রিসিট নিশ্চয় আছে? সেটা আমাদের দেখিয়ে দিন আমরা চুপচাপ চলে যাবো।
….কেন? আপনাকে দেখাতে যাবো কেন? আমি যেখান থেকে খুশী সেখান থেকে কিনি তাতে আপনাদের কি?
আদিত্য এবার রাগী কন্ঠে বললো।
….বুঝেছি আপনি এভাবে মানবেন না। আবির পুলিশকে ফোন কর। পুলিশ এসেই সব বের করে নিবে।
মহিলাটি এবার ঘাবড়ে যেয়ে তার স্বামীকে ডাকতে লাগলো। একটু পরে ভেতর থেকে মহিলাটির স্বামী বেড়িয়ে এলো। আদিত্য দের দেখে লোকটি ভ্রু কুঁচকে বললো।
….কি হচ্ছে এখানে আর আপনারা কারা?
মহিলাটি ওর স্বামীর কাছে এসে বলল।
….দেখনা এরা বাসার ভেতর ঢুকে গুন্ডামী করছে। বলছে আমি নাকি ওনার বউয়ের পেনডেন্ট চুরি করেছি। আরও কি কি যেন বলছে।
আদিত্য লোকটির কাছে এগিয়ে এসে বললো।
….ভালো হয়েছে আপনি এসেছেন। এখন ফটাফট বলুন আমার নূর কোথায়? এই পেনডেন্ট আপনারা কোথায় পেয়েছেন? নাহলে কিন্তু আপনার জন্য পুলিশও লাগবে না আমি একাই যথেষ্ট। তাড়াতাড়ি বলুন।
লোকটি বলে উঠলো।
….আরে কি বলছেন এসব? কে নূর? আমিতো কিছুই বুঝতে পারছি না।
আদিত্য রাগে কটমট করে তাসিরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো।
…দেখ আমি আর নিতে পারছি না। আমি কিন্তু কিছু করে বসবো?
তাসির আদিত্যের কাঁধে হাত দিয়ে বললো।
….রিলাক্স আমি কথা বলছি।
তাসির লোকটির সামনে যেয়ে নরম সুরে বললো।
….দেখুন ভাই আসলে আমার এই বন্ধুর ওয়াইফ আজ পাঁচ মাস হলো নিখোঁজ। আমরা সবাই পাগলের মতো খুঁজছি তাকে। আপনার বউয়ের গলায় যে পেনডেন্ট দেখছি এটা ওর ওয়াইফের। তাই আমরা একটা আশার আলো দেখতে পেয়েছি। প্লিজ বলুন না আপনারা এই পেনডেন্ট কোথায় পেয়েছেন। আপনারা সত্যি কথা বললে আমাদের অনেক উপকার হবে। আমরা প্রমিজ করছি আমরা আপনাদের কিছুই করবো না। তবে আপনি যদি না বলেন তাহলে আপনার সাথে কি হবে তার গ্যারান্টি নিতে পারবো না।
আসল ব্যাপার টা বুঝতে পেরে লোকটি মাথা ঝাকিয়ে বললো।
…..ঠিক আছে আমি বলছি। আসলে এই পেনডেন্ট টা আমি পাচ মাস আগে টাঙ্গাইলের একটা ছোট্ট গ্রাম থেকে কিনেছিলাম।
আদিত্য উত্তেজিত হয়ে বললো।
…..টাঙ্গাইল? টাঙ্গাইলের কোথায়? আর কার কাছ থেকে কিনেছেন আপনি?
…..টাঙ্গাইলের একটা ছোট্ট হসপিটাল থেকে। ওখানে একটা লোকের কাছ থেকে কিনেছিলাম এটা।
….হ হসপিটাল? কোন হসপিটাল? আর ওই লোকটা এই পেনডেন্ট কোথায় পেল?প্লিজ সব খুলে বলুন।
…..আসলে আমি একজন এসিস্ট্যান্ট ডক্টর। আর ওটা একটা এনজিও চালিত হসপিটাল। ওই গ্রামের গরীব দুঃখী মানুষের জন্য। ওখানে ডক্টররা যেয়ে ফ্রী চিকিৎসা দিয়ে থাকে। আমিও পাঁচ মাস আগে গিয়েছিলাম। তখনই একটা লোক এই পেনডেন্ট টা বিক্রি করার জন্য এর ওর জিজ্ঞেস করছিল। আমি দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম যে এটা ডায়মন্ডের। স্বল্প মূল্যে পাওয়ায় আমিও কিনে নিয়েছিলাম।
আদিত্য উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
…..কে ওই লোকটা? আর এই পেনডেন্ট টা সে কোথায় পেল?
….দেখুন এতকিছু আমি জানি না। লোকটা দেখতে গরীব লাগছিল। মনে হয় ওখান কার কোনো জেলে হবে। কারণ ওই গ্রামের বেশির ভাগ লোকই জেলে।
তাসির বলে উঠলো।
….আপনি প্লিজ আমাদের ওই গ্রাম আর হসপিটালের ঠিকানাটা দিতে পারবেন?
লোকটি মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….ঠিক আছে আমি আপনাদের কাগজে সব ডিটেইলস লিখে দিচ্ছি।
লোকটা কাগজে ঠিকানা লিখে ওদের দিয়ে দিল। আদিত্য যেন একটা আশার আলো দেখতে পেল। এবার হয়তো ও ওর প্রাণপাখীকে খুঁজে পাবে।
একটু পরেই ওরা বেরিয়ে যেতে নিলেই আদিত্য লোকটির দিকে তাকিয়ে বললো।
……দেখুন এই পেনডেন্ট টা আমার ওয়াইফের। এটা আমাকে দিয়ে দিন প্লিজ। আপনি যে টাকা দিয়ে কিনেছেন আমি আপনাকে তার ডাবল টাকা দিয়ে দেব। তবুও আমাকে এটা দিয়ে দিন।
লোকটি মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….ঠিক আছে নিয়ে যান।
মহিলাটি পেনডেন্ট টা খুলে আদিত্যের হাতে দিয়ে দিল। আদিত্য পেনডেন্ট টা হাতে নিয়ে ছলছল চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর সবাই টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো।
আদিত্যর মনে হচ্ছে যেন রাস্তা শেষই হচ্ছে না। কখন ও পৌছাবে, আর কখন ওর প্রাণপাখীকে খুঁজে পাবে? মনে মনে শুধু আল্লাহর কাছে দোয়া চাইছে যে, এবার যেন ও ওর প্রাণপাখীকে খুঁজে পায়। এবার যেন ওকে নিরাশ হতে না হয়।
প্রায় দেড় ঘন্টা পর ওরা টাঙ্গাইলের ওই গ্রামে পৌছায়। ওরা প্রথমে সেই হসপিটালে যায়। হসপিটালের রিসিপশনে যেয়ে ওরা নূরের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
….আপনাদের এখানে কি এই মেয়েটাকে দেখেছেন কখনো?
রিসিপশনের মেয়েটি বললো।
….সার আমিতো এখানে নতুন, তাই আমি বলতে পারবো না। আপনি পূরণ স্টাফ যারা আছে তাদের কাছে জিজ্ঞেস করুন। তারা হয়তো বলতে পারবে।
ওরা তিনজন হসপিটালের সব স্টাফদের নূরের ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করতে লাগলো। হঠাৎ একটা সিনিয়র নার্স বললো।
….হ্যাঁ আমি ওনাকে দেখেছিলাম।
কথাটা শোনার সাথেই খুশিতে যেন আদিত্য আত্মহারা হয়ে গেল। আদিত্য উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো ।
….দেখেছেন আপনি? কোথায় দেখেছেন দয়া করে বলুনা না?
….জ্বি পাঁচ মাস আগে কিছু জেলেরা মিলে ওনাকে এখানে নিয়ে এসেছিল। উনি অজ্ঞান অবস্থায় ছিলেন। উনার অবস্থা তখন অনেক ক্রিটিকাল ছিল।
কথাটা শুনে আদিত্যের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। সব খুশী একমুহূর্তেই গায়েব হয়ে গেল। কেমন অনূভুতি শূন্য হয়ে গেল। নিজের শরীরের ভারসাম্য ধরে রাখতে না পেরে পরে যেতে নিলেই আবির আর তাসির ওকে ধরে ফেললো। ওরা দুজনও অনেক ভয় পেয়ে গেছে। নূরের কিছু হয়ে গেলে যে আদিত্যকেও আর বাঁচানো যাবে না। আবির বলে উঠলো।
…. নিজেকে সামলা ভাই। ভাবি নিশ্চয় ঠিক আছে দেখিস।
তাসির নার্সটির দিকে তাকিয়ে বললো।
….আপনি ঠিক করে খুলে বলুন সবকিছু।
নার্সটি বলে উঠলো।
….পাঁচ মাস আগে কিছু জেলেরা ওনাকে এখানে নিয়ে এসেছিল। ডক্টর দেখে বলেছিল ওনার ইমিডিয়েটলি অপারেশনের দরকার, নাহলে ওনাকে বাঁচান যাবে না। তাই ওনাকে শহরের কোনো হসপিটালে নিয়ে যেতে বলেছিল। কারণ আমাদের এখানে অপারেশন এর ব্যবস্থা নেই। ডক্টরের কথামতো ওনারা নিয়ে গিয়েছিল। তারপর কি হয়েছিল সেটা বলতে পারবো না।
আদিত্যর মুখ দিয়ে কোনো কথাই বের হচ্ছে না।ভয়ে ওর অন্তর আত্মা শুকিয়ে আসছে। ওর প্রাণপাখীর কিছু হয়নিতো?ও ঠিক আছে তো?এসব ভেবে আদিত্যের পুরো শরীর অবশ হয়ে আসছে। আদিত্য আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলোনা ধপ করে নিচে বসে পড়লো। আবির আর তাসির ওকে ধরে ফেললো। আদিত্য ওদের দিকে তাকিয়ে অস্বাভাবিক ভাবে বলতে লাগলো।
….আ আমার নূরের কিছু হয়নি তাইনা? ও ও একদম ঠিক আছে তাইনা বল?
তাসির ওকে শান্তনা দিয়ে বললো।
…হ্যাঁ হ্যাঁ আমাদের নূরের কিছু হয়নি ও একদম ঠিক আছে। দেখ তুই এভাবে ভেঙে পড়লে কিভাবে চলবে বল? তুই নিজেই তো বলিস যে নূর বেঁচে আছে বলেই তোর নিঃশ্বাস চলছে। তাহলে এখন তুই বিশ্বাস হারাচ্ছিস কেন?
আদিত্য একটা ঢোক গিলে নিজেকে একটু শক্ত করে বললো।
…..হ্যাঁ হ্যাঁ তুই ঠিকই বলেছিস। আমার নূর একদম ঠিক আছে, কিছু হয়নি ওর?
আদিত্য উঠে দাঁড়িয়ে নার্সটিকে জিজ্ঞেস করলো।
….সিস্টার আপনাদের এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে? তাহলে আমরা আমরা সেদিনকার ভিডিও ফুটেজ দেখে লোকগুলোকে বের করতে পারতাম।
….জ্বি না সার। আমাদের এখানে সিসিটিভি ক্যামেরা নেই। এটা একটা ছোট হসপিটাল। এখানে ওসব ফ্যাসিলিটি নেই।
….ওকে, আপনি প্লিজ বলতে পারবেন ওই লোকগুলোকে কোথায় পাওয়া যাবে, যারা নূরকে এখানে নিয়ে এসেছিলো?
….এক্স্যাকলি তো বলতে পারবো না। তবে এখানে একটা জেলে পাড়া আছে। লোকগুলো হয়তো ওখানকারই। আপনারা ওখানে খোঁজ নিয়ে দেখতে পারেন।
….জ্বি থ্যাংক ইউ সোও মাচ সিস্টার।
আদিত্যরা আর একমুহূর্তও দেরি না করে জেলে পাড়ার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লো। জেলে পাড়ায় এসে ওরা সবাইকে নূরের ছবি দেখিয়ে ওর কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো। অনেকক্ষণ খোঁজার পর একটা দশ বারো বছরের বাচ্চা ছেলে নূরের ছবি দেখে বলে উঠলো।
….আরে এটাতো ওই পাগলি মেয়েটা।
আদিত্য চমকে উঠে বললো।
….পা পাগলি? তু তুমি চেন ওকে? কোথায় ও?
….হ্যাঁ চিনিত। ওই করিম জেলের বাড়িতে থাকে। সবসময় পাগলের মতো চুপচাপ শুধু নদীর ধারে বসে থাকে।
আদিত্যর যেন খুশিতে পাগল হয়ে যাওয়ার উপক্রম। ফাইনালি ও ওর প্রাণপাখীর দেখা পেতে চলেছে। খুশিতে ওর চোখে পানি চলে এলো। আদিত্য ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বললো।
….তু তুমি আমাকে ওর কাছে নিয়ে যেতে পারবে প্লিজ?
…..হ্যাঁ হ্যাঁ আসুন আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি আপনাকে। এখনো হয়তো ওই নদীর কিনারেই বসে আছে।
আদিত্য ছেলেটির পেছনে পেছনে যেতে লাগলো। বুকের ভেতর অনেক জোরে জোরে ধুকপুক করছে ওর। সত্যিই কি এবার পেয়ে যাবে ও ওর নূর ওর প্রাণপাখীকে?
আবির আর তাসিরও ওদের পেছনে যেতে লাগলো। ওরাও মনে মনে আল্লাহর কাছে দোয়া করছে, যেন এবার ওরা নূরকে পেয়ে যায়। তবেই আদিত্য নতুন জীবন ফিরে পাবে।
ছেলেটি ওদের একটা বাগানের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আদিত্য যতো এগিয়ে যাচ্ছে ওর বুকের ধুকধুকি যেন ততই বেড়ে যাচ্ছে। ওর মন বলছে নূর ওর কাছেই কোথাও আছে। বাগান পেড়িয়ে বাইরে আসতেই। সেই ছলেটি হাত উঠিয়ে কিছুটা দূরে নদীর কিনারে দেখিয়ে বললো।
….ওইযে দেখুন বসে আছে ও।
ছেলেটির কথামতো আদিত্য ওইদিকে তাকিয়ে দেখলো, নূর নদীর কিনারায় হাঁটু ভাজ করে হাঁটুর ওপর থুতনি রেখে উদাসীন হয়ে বসে আছে। উল্টো দিকে বসে থাকায় পেছন থেকে শুধু ওর পিঠ দেখা যাচ্ছে। পড়নে একটা পুরাণ সুতি কাপড়। বাতাসে চুলগুলো উড়ছে। আদিত্য যেন ওখানেই থমকে গেল। সামনে যাওয়ার সাহস পাচ্ছে না ও। হাত পা কাঁপা শুরু করে দিল। তাসির আদিত্যের কাঁধে হাত দিয়ে আদিত্যকে হালকা ঝাকি দিল। আদিত্য তাসিরের দিকে ছলছল চোখে তাকিয়ে হাত উঠিয়ে নূরের দিকে দেখিয়ে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো।
….তা তাসির দেখ আমার নূর, আমার প্রাণপাখী।
তাসিরও ছলছল চোখে মুচকি হেসে মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….হ্যাঁ আদি তোর নূর। যা তোর নূরের কাছে।
আদিত্য কোনরকমে কাঁপা কাঁপা পায়ে নূরের দিকে এগুলো। বুকের ভেতর প্রচুর ধুকপুক করছে, হাত পা কাঁপছে। বাতাসে নূরের শরীরের ঘ্রাণ ভেসে আসছে। আদিত্য চোখ বন্ধ করে নাক টেনে ঘ্রাণটা নিজের ভেতর নিল। চোখ দুটো দিয়ে আনন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আদিত্য যত নূরের কাছে যাচ্ছে ততই ওর বুকের ধুকধুকানি আরও বেড়ে। হাত পা যেন অসার হয়ে আসছে।
আদিত্য নূরের পাশে এসে দাঁড়াল। তারপর ধপ করে নূরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো। পাশে কারোর বসার শব্দে নূর আদিত্যের দিকে ঘুরে তাকালো। সাথে সাথে আদিত্যের শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা শীতল বাতাস বয়ে গেল। আজ কতদিন পর ও ওর প্রাণপাখীকে দেখছে। আদিত্যের মনে হচ্ছে ওর ভেতর নতুন জীবন ফিরে এসেছে। আদিত্য মায়া ভরা অশ্রু চোখে নূরের দিকে তাকিয়ে ওর কাঁপা কাঁপা হাতটা নূরের দিকে উঠাতে লাগলো। কেন যেন ওর খুব ভয় লাগছে। প্রতিবার স্বপ্নের মতো এবারও ছুতেই হারিয়ে যাবে নাতো নূর। আদিত্য একটা ঢোক গিলে কাঁপা কাঁপা হাতটা নূরের গালে রাখল। সাথে সাথে আদিত্য চোখ বন্ধ করে কেঁদে উঠলো। হ্যাঁ ও পেয়েছে, পেয়েছে ওর প্রাণপাখীকে।
আদিত্য এবার নূরকে আষ্টেপৃষ্টে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। এমন ভাবে জড়িয়ে ধরেছে যেন কলিজার ভেতর ঢুকিয়ে নিতে পারলেই শান্তি। আদিত্য দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে পাগলের মতো সারা মুখে চুমু খেতে লাগলো। তারপর আবারও নূরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললো।
…..কোথায় চলে গিয়েছিলে প্রাণপাখী আমাকে ছেড়ে? কোথায় কোথায় না খুজেছি তোমাকে? জানো তোমাকে ছাড়া আমার কি অবস্থা হয়েছিল। আর কয়দিন তোমাকে না দেখতে পারলে হয়তো আমি মরেই যেতাম।
ওদের দেখে আবির আর তাসিরের চোখেও পানি চলে এলো। ওরা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাল যে শেষমেশ আদিত্য ওর নূরকে পেয়ে গেছে।
আদিত্য এখনো নূরকে জড়িয়ে ধরে আছে। হঠাৎ নূর আদিত্যকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। আচমকা এমন হওয়ায় আদিত্য ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পেছন দিকে হেলে পড়লো। নূরের এহেন কাজে আদিত্য বড়সড় একটা ধাক্কা খেল। আদিত্য ঠিক হয়ে বসে নূরের দিকে হাত বাড়াতে নিলে নূর ভীতু ফেস করে পেছন দিকে পিছিয়ে গেল। আদিত্যের বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। নূর এমন করছে কেন? কি হয়েছে ওর?
আদিত্য দুই হাতে নূরের মুখটা ধরে বললো।
….কি হয়েছে প্রাণপাখী? তুমি এমন করছ কেন? বুঝতে পেরেছি তুমি এখনো আমার ওপর রেগে আছ তাইনা? আই এ্যাম সরি প্রাণপাখী। আই প্রমিজ আমি আর কখনো তোমাকে ছেড়ে যাবো না প্রাণপাখী। এবারতো আমাকে মাফ করে দাও প্লিজ?
নূর আবারও আদিত্যর বুকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো।
….কে আপনি?
কথাটা শোনার সাথেই আদিত্য স্তব্ধ হয়ে গেল। নিজের কানকেই যেন বিশ্বাস হচ্ছে না ওর।কি বলছে এসব নূর? আমার প্রাণপাখী আমাকে চিনতে পারছে না? না না এ হতে পারে না। আদিত্য উঠে দাঁড়িয়ে বললো।
….কি বলছ এসব প্রাণপাখী? তু তুমি আমাকে চিনতে পারছ না? আমি জানি তুমি রাগ করে এসব বলছ তাইনা। সরি বললাম তো প্রাণপাখী, আর কতো রাগ করে থাকবে? আচ্ছা ঠিক আছে এইদেখ আমি কান ধরছি , এবারতো মাফ করে দাও?
আবির আর তাসিরও এবার ওদের কাছে এগিয়ে এলো। নূর ওদের থেকেও দূরে সরে যেতে লাগলো। আদিত্য উঠে দাঁড়িয়ে তাসিরের দিকে তাকিয়ে বললো।
…দেখনা তাসির নূর এখনো আমার ওপর রেগে আছে। বলছে আমাকে নাকি চেনে না। তোরা বলনা ওকে আমাকে মাফ করে দিতে।
হঠাৎ ওখানে একটা মধ্যবয়সী লোক এসে বললো।
….আপনারা চিনেন এই মেয়েকে?
লোকটা আসতেই নূর লোকটার পেছনে যেয়ে পলালো। আদিত্য ভ্রু কুঁচকে বললো।
….চিনি মানে, এই মেয়েটা আমার স্ত্রী। কিন্তু আপনি কে?আর নূরকে কিভাবে চেনেন?
লোকটি খুশী হয়ে বললো।
….সত্যিই? তুমি ওর স্বামী? যাক শেষমেশ ওর পরিবারকে পাওয়া গেল।
….মানে?
….বলছি সব। আসলে পাঁচ মাস আগে আমরা মাছ ধরতে গেলে। এই মেয়েটি আমাদের জালে আটকে যায়। প্রথমে আমরা সবাই অনেক ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। পরে দেখলাম মেয়েটার নিঃশ্বাস চলছে। তাই আমরা ওকে আমাদের গ্রামের হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। ওখানে ডাক্তার বললো, ওর নাকি অপারেশন করতে হবে। তাই ওকে বড়ো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু এই অপারেশনের জন্য অনেক টাকার দরকার ছিল। আর আমদের মতো গরীব মানুষ এতো টাকা কই পাবো? তাই ওর গলায় থাকা লকেটটা বিক্রি করে দিলাম। সেই টাকা দিয়ে ওর অপারেশন করা হলো। অপারেশনের তিনদিন পর ওর জ্ঞান ফিরে এলো। কিন্তু জ্ঞান ফিরে আসার পর যখন আমরা ওর নাম ঠিকানা জানতে চাইলাম, তখন ও কিছুই বলতে পারলো না। এমনকি নিজের নামটাও বলতে পারলো না। পরে ডাক্তার বললো, ওর মাথায় কোনকিছুর আঘাত পাওয়ায় ও নিজের সব স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে। পুরনো কোনকিছুই মনে নেই ওর। তখন থেকে আমাদের সাথেই থাকে ও। কোনো কথা বলে না চুপচাপ শুধু এখানে বসে থাকে।
সবকিছু শুনে আদিত্যের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়লো। এতকিছু হয়ে গেছে ওর প্রাণপাখীর সাথে আর ও জানেই না?
তাসির বলে উঠলো।
….আমরা তো টিভিতে পত্রিকায় সবজায়গায় নূরের নিখোঁজের বিজ্ঞপ্তি দিয়েছি। আপনারা সেগুলো দেখেননি?
…বাবা আমরা হলাম গরীব মানুষ। মাছ ধরে খাই। এসব টিভি পত্রিকা কোথায় পাবো আমরা? আমরা তো শুধু এই আশায় ছিলাম যে মেয়েটার যেন সবকিছু মনে পড়ে যায়। কিন্তু সেটা আর হয়না। হ্যাঁ তবে হঠাৎ মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে একটা নাম বলতো।
….কি নাম?
….আদিত্য। হ্যাঁ আদিত্য বলতো। আমারা যখন জিজ্ঞেস করাতাম, আদিত্য কে? তখন ও বলতো, কি জানি? জানি না,তবে এই নামটা খালি আমার বারবার মনে পরে। মনে হয় হৃদয়ের খুব কাছের এই নামটা।
আদিত্য মায়া ভরা চোখে নূরের দিকে তাকালো। না ওর নূর ওকে পুরোপুরি ভুলে যায় নি। হয়তো ওর মাইন্ড ভুলে গেছে, কিন্তু এতকিছুর পরেও ওর মন এখনো আমাকে ভোলেনি।
আদিত্য নূরের কাছে এগিয়ে যেয়ে বললো।
….নূর এইদেখ আমি, আমি তোমার আদিত্য। তোমার রাজকুমার, তোমার স্বামী, তোমার আদিত্য। তুমি যে নাম নেও আমি সেই আদিত্য।
নূর এবার বিস্ময়কর চোখে তাকিয়ে আদিত্যের দিকে এগিয়ে আসলো। ধীরে ধীরে আদিত্যের গালে হাত রেখে বললো।
….আদিত্য?
আদিত্য নূরের হাতের ওপর হাত রেখে অশ্রু চোখে তাকিয়ে মুখে হাসি নিয়ে মাথা ঝাকিয়ে বললো।
….হ্যাঁ আদিত্য তোমার আদিত্য।
হঠাৎ নূরের কি যেন হয়ে গেল। মাথায় প্রচুর যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেল। নূর দুই হাতে মাথা চেপে ধরে কাতরাতে লাগলো। এটা আদিত্য প্রচুর ঘাবড়ে গেল। নূরকে ধরে উত্তেজিত হয়ে বললো
….নূর কি হলো তোমার নূর?
নূর জ্ঞান হারিয়ে পরে গেল। আদিত্যর বুক কেঁপে উঠল ভয়ে। আদিত্য নূরের গালে হালকা চাপড় দিয়ে বলতে লাগলো।
….নূর , নূর চোখ খোল কথা বল প্লিজ? কি হলো তোমার?
তাসির বলে উঠলো।
….আদি আমাদের দেড়ি করা যাবে না। তাড়াতাড়ি নূরকে হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে।
আদিত্য মাথা ঝাকিয়ে তাড়াতাড়ি নূরকে কোলে নিয়ে গাড়ির কাছে যেয়ে গাড়িতে শুইয়ে দিল ওকে।যাওয়ার আগে আদিত্য ওই লোকটার কাছে এসে হাত জোর করে বললো।
…..আপনি আমার উপর যে উপকার করেছেন তার প্রতিদান আমার জীবন দিলেও শোধ হবে না। আপনাকে ধন্যবাদ বলে ছোট করতে চাই না।শুধু বলবো আপনার যখন ইচ্ছে যেকোনো দরকারে আমার কাছে আসতে পারেন। আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও আপনার উপকার করার চেষ্টা করবো।
…এসবের দরকার নেই বাবা। তোমরা ভালো থাকো এতেই আমরা খুশী।
তারপর আদিত্যরা নূরকে নিয়ে চলে গেল।
চলবে…..
(গল্পে গ্রামটা কাল্পনিক। তাই এটা নিয়ে কেও প্রশ্ন করবেন না প্লিজ।
আর একটা কথা। আমি একজন বিবাহিত নারী। আমার সংসারের আরও অনেক কাজ থাকে। আমার জন্য একদিনে এক পর্ব দেওয়ায় অনেক কষ্টের। তাই বাড়তি পর্ব চেয়ে কেউ লজ্জিত করবেন না। আমি জানি আপনারা গল্পটা পছন্দ করেন তাই বেশি করে পেতে চান। তবে আমার বিষয়টাও একটু বোঝার চেষ্টা করবেন প্লিজ।
ভুল ত্রুএি ক্ষমার চোখে দেখবেন)