সেই সন্ধ্যা পর্ব-১০

0
1869

#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_১০
.
-“আর কতদিন এভাবে কষ্ট পাবে আমার ছেলেটা? এবার তো অন্তত একটু শান্তি দাও ওকে! একটু সুখ দাও ওর কপালে। কেন আমার ছেলেকে এত কষ্ট দিচ্ছ তুমি আল্লাহ্?”

সকাল ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিচে যেয়ে সোজা ওর পাপার কোলে শুয়ে পরলো। আরিফুল ইসলাম পেপার সরিয়ে হাসলেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-“কি হয়েছে আমার মায়ের?”
-“ভালো লাগছে না। খিদে পেয়েছে।”
-“কি খাবে বলো! আমি এখুনি আনিয়ে দিচ্ছি।”
-“উমম…. বার্গার খাব।”
-“আচ্ছা ঠিকাছে।”

আরিফুল ইসলাম একজন গার্ডকে ডেকে বার্গার আনতে বললেন। সকাল এই ফাঁকে উঠে গিয়ে ফ্রিজ খুলে কোল্ড ড্রিংক্স নিতে গিয়ে দেখে একটা কোল্ড ড্রিংক্সও নেই। সকাল আরিফুল ইসলামের সামনে যেয়ে ন্যাকা কান্না করে বললো,
-“পাপা!”
-“কি হয়েছে মা? এইতো এখুনি তোমার বার্গার আনতে পাঠাচ্ছি ওকে।”
-“ফ্রিজে একটা কোল্ড ড্রিংক্সও নেই। আমার সব কোল্ড ড্রিংক্স শেষ হয়ে গেছে। এখন কি খাব আমি?”
-“মা এখন রাগ করে তো লাভ নেই। আপাতত তুমি ফ্রুট জুস খাও। আমি বার্গারের সাথে কোল্ড ড্রিংক্সও নিয়ে আসতে বলে দিচ্ছি।”
সকাল মুখ লটকিয়ে বললো,
-“আচ্ছা।”

গাড়িতে বসে একটু আগে গার্ডের এনে দেয়া বার্গার চিবুচ্ছে সকাল। মেডিকেলে যাওয়ার একদমই মুড ছিল না ওর। কিন্তু একটা ক্লাস মিস গেলে অনেক প্রবলেম হয়ে যাবে। তাই চলে এসেছে। মাঝরাস্তা থেকে আফিকেও গাড়িতে উঠিয়ে নিলো। একটা প্যাকেট ওর দিকে এগিয়ে দিল খাওয়ার জন্য। আফি প্যাকেট খুলে দেখে ওর ভেতরে সাব-স্যান্ডউইচ রাখা। আর কি লাগে আফির! ও খুশিতে সকালের গালে একটা পাপ্পি দিয়ে সাব-স্যান্ডউইচ খেতে লাগলো। গাড়ি এসে কলেজের সামনে থামতেই সকাল গাড়ি থেকে বেরিয়ে প্যাকেট গুলো ডাস্টবিনে ফেলে দিল। টিস্যু পেপার দিয়ে হাত মুছতে মুছতে আফির সাথে কথা বলতে বলতে ক্লাসের দিকে যাচ্ছিল। এমন সময় স্নিগ্ধ এসে ওদের সামনে দাঁড়ালো।
স্নিগ্ধকে দেখে মুচকি হাসলো সকাল। স্নিগ্ধ ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি খেয়েছো?”
সকাল থতমত খেয়ে গেল স্নিগ্ধর প্রশ্নে। চোখ গুলো ছোট ছোট করে বললো,
-“বার্গার। কেন?”
-“তোমাকে কি আমি সাধেই পিচ্চি বলি! খাবারটাও খেতে শিখো নি ঠিক মতো। মেওনিজ লেগে আছে মুখে।”
সকাল চোখ দু’টো ট্যারা করে নিজের মুখের চারপাশে দেখার ব্যর্থ চেষ্টা চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করলো,
-“কোথায়?”
-“ঠোঁটের ডান সাইডের একটু নিচে।”

সকাল জিহ্ব বের করে ঠোঁটের পাশে স্লাইড করলো কিন্তু পেলো না মেওনিজ। সকালের কান্ড দেখে স্নিগ্ধ মনে মনে হাসতে লাগলো। ফোন বের করে ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করে সকালের সামনে ধরতেই সকাল মেওনিজটা জিহ্ব দিয়ে খেয়ে নিলো। তারপর টিস্যু দিয়ে মুছলো জায়গাটা। মৃদু হেসে স্নিগ্ধ সকালকে ক্লাসে যেতে বললো। আজ স্নিগ্ধর কোনো ক্লাস নেই বলে ও হসপিটালে চলে গেল।
সকাল আর আফি ক্লাসে বসে কথা বলছিল। তখনি একটি ছেলে এসে ওদের বেঞ্চের সামনে দাঁড়ালো। আফি আর সকাল ভ্রু কুঁচকে তাকালো ছেলেটির দিকে। ছেলেটিকে ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত ভালো মতো পর্যবেক্ষণ করলো ওরা।

ছেলেটিকে দেখে ওদের মনে হচ্ছে ফু দিলেই ছেলেটি উড়ে যাবে। অবশ্য এতটাও চিকন না ছেলেটা। চিকনের ভেতরে মিডিয়াম। গায়ের রঙটা শ্যামলা। মাথার চুল গুলো দেখতে একদম ম্যাগি নুডলস-এর মতো। চেহারায় একটু মায়া মায়া ভাব আছে। ঠোঁট দু’টো গোলাপিও না আবার একেবারে কালোও না। এর মাঝামাঝি। এই ছেলে যে সিগারেট খায় তা ঠোঁট দু’টো দেখলেই বুঝা যায়। প্রথম দেখাতেই মোটামুটি ভালো লাগার মতোই ছেলেটি।
সকাল গলা ঝেরে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি চাই?”
-“পরিচয় চাই।”
-“মানে?”
-“মানে হলো তোমরা ক্লাসে আসছো তো অনেকদিন ধরেই। কিন্তু তোমাদের আমি কারও সাথে কথা বলতে দেখি নি। তাই তোমাদের পরিচয়ও জানি না।”
-“ওহ আচ্ছা। আমি সকাল। আর ও আফিফা। বাট আমি আফি বলে ডাকি।”
-“ওহ! আমি পরশ।”
সকাল কনফিউজড হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কিসের পরশ?”
-“ভালোবাসার পরশ বলতে পারো।”
-“হাহাহা…. ভেরি ফানি।”
আফি বললো,
-“আপনার চুল গুলো কেউ নুডলস ভেবে সিদ্ধ করে খায় নি?”
-“একদম আমার চুল নিয়ে কিছু বলবে না। এই চুল আমার চার্ম বুঝেছো মিস ফিফা ওয়ার্ল্ড কাপ।”
-“এক্সকিউজ মি! মাই নেম ইজ নট ফিফা। মাই নেম ইজ আফিফা। ইউ ক্যান কল মি আফি। বাট ডোন্ট কল মি ফিফা।”
-“তাহলেও তুমিও আমার চুল নিয়ে কিছু বলবে না গট ইট!”
-“হুহ্!”
-“হোয়াট এভার! সো্ সকাল আমরা কি ফ্রেন্ডস্ হতে পারি?”
-“ইয়াহ সিয়র। বাট ওয়ান কন্ডিশন।”
-“কি?”
-“আমার বেস্টির সাথেও ফ্রেন্ডশিপ করতে হবে।”
-“আমার কোনো সমস্যা নেই।”
পরশের কথা শুনে আফি বলে উঠলো,
-“কিন্তু আমার অনেক সমস্যা আছে।”
-“তা তোমাকে দেখলেই বুঝা যায়। আঙ্কেল-আন্টিকে বলো তোমাকে যেন ডক্টর দেখায়। তাহলে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে তুমি।”
আফি রেগে গিয়ে বললো,
-“হেই! হোয়াট ডু ইউ মিন বায় দ্যাট?”
-“আমার কি দোষ? তুমিই তো বললে তোমার অনেক সমস্যা আছে। আমি শুধু স্যলিউশন বললাম।”
-“ইডিয়ট! সকাল আমি ওর সাথে ফ্রেন্ডশিপ করব না।”
-“অ্যাজ ইয়র উইশ।”
সকাল ওদের ঝগড়া দেখে মিটিমিটি হাসছে। পরশের কথা শুনে হাসি থামিয়ে সকাল বললো,
-“না আফির সাথে ফ্রেন্ডশিপ না করলে আমিও ফ্রেন্ডশিপ করব না।”
-“ক্যায়া মুসিবাত হে ইয়্যার! আচ্ছা ঠিকাছে। আফি ম্যাডাম ক্যান ইউ বি মাই ফ্রেন্ড? প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!”
আফি ভাব দেখিয়ে মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো। তা দেখে পরশ ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“এত ভাব নেয়ার কি আছে? চুপচাপ ফ্রেন্ডশিপ করে নাও আমার সাথে। নাহলে তোমাকে মেরে গুম করে দিব।”
পরশের কথা শুনে চোখ বড় বড় করে তাকালো আফি। সকাল হাসতে হাসতে বললো,
-“সিরিয়াসলি পরশ তুমি অনেক ফ্রেন্ডলি টাইপের।”
-“আমি এমনি। যাকে একবার পছন্দ হয় তার পেছন সহজে ছাড়ি না।”
-“ওয়েল তোমার সাথে ফ্রেন্ডশিপ করাই যায়। সো্ ফ্রেন্ডস্?”
-“আবার জিগায়।”
গাল ফুলিয়ে আফি বললো,
-“আমি ওর সাথে ফ্রেন্ডশিপ করব না।”
সকাল ঠোঁট উল্টে কাঁদো কাঁদো চেহারা বানিয়ে বললো,
-“প্লিজ জান্টুস আমার জন্য অন্তত ওর সাথে ফ্রেন্ডশিপটা কর। প্লিজ! নাহলে কিন্তু সকাল কান্না করে দিবে।”
আফি রাগি চোখে সকালের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল একদম করবি না আমাকে।”
-“ঠিকাছে কালকে থেকে আমার সাথে কথা বলবি না তুই। গেলাম আমি কলেজ থেকে।”
-“সকাল! আজিব তো! আচ্ছা ঠিকাছে আমি এই লাঙ্গুরের সাথে ফ্রেন্ডশিপ করছি। কিন্তু শুধু তোর জন্য। কোনো প্রকার বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু আমি এই লাঙ্গুরের আঙুর বানিয়ে বাজারে বিক্রি করে দিব বলে দিলাম।”
-“আচ্ছা ঠিকাছে দিস।”
পরশ ভ্রু নাচিয়ে আফিকে জিজ্ঞেস করলো,
-“লাঙ্গুর কাকে বলো তুমি?”
আফি মুখ বাঁকিয়ে বললো,
-“আপনাকে! আর কাকে বলবো?”
-“তুমি কি ট্যাবলেট।”
-“এই এই আমি ট্যাবলেট?”
-“নাহ! তুমি তো পটকা মাছ।”
-“সকাল আমি এই বান্দরের লগে করুম না ফ্রেন্ডশিপ।”
সকাল ন্যাকা কান্না কাঁদতে লাগলো। আফি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সকালের দিকে।
-“প্লিজ দোস্ত রাজি হয়ে যা না। এমন করিস কেন?”
-“যা মন চায় কর তুই।”

আফি রাগে গজগজ করতে লাগলো। এদিকে পরশ আর সকাল রাজ্যের গল্প জুড়ে দিল। আফি ওদের দিকে একটু পর পর চোখ গরম করে তাকাচ্ছে আবার ফোন চালাচ্ছে। মূলত ওর বিরক্ত লাগছে পরশকে।
সকাল নিজের মতো বকবক করছে আবার নিজেই হেসে উঠছে সেসব কথা বলে। পরশ এক ধ্যানে সকালের হাসির দিকে তাকিয়ে আছে। সকালের হাসির শব্দ যেন পরশের বুকে গিয়ে লাগছে। গালে হাত দিয়ে বসে সকালের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ক্লাসে টিচার ঢুকতেই ওরা চুপ হয়ে গেল।
ক্লাস শেষে সকাল, আফি আর পরশ একসাথে ক্যানটিনে গিয়ে বসলো। ক্যানটিনের ছেলেটাকে তিনটা কফি দিয়ে যেতে বললো পরশ। সকাল জিজ্ঞেস করলো,
-“তোমার পরিবারে কে কে আছে?”
-“মা-বাবা, বড় ভাই আর আমি। একটা বড় বোন আছে। কিন্তু তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। আর বড় ভাইয়া বাইরের দেশে জব করে।”
-“ওউ আচ্ছা।”
-“হ্যা। তোমার ফ্যামিলিতে কে কে আছে?”
-“মাম্মা-পাপা, আমি আর ভাইয়া। কিন্তু ভাইয়া আমাদের সাথে থাকে না। ও সিঙ্গাপুরে থাকে।”
-“তার মানে তুমিও আমার মতো একা?”
-“হুমম।”
-“নট ব্যাড। আচ্ছা পরী তোমার ফ্রেন্ড এমন প্যাঁচার মতো মুখ বানিয়ে বসে আছে কেন?”
-“পরী কে?”
-“তুমি।”
-“কিন্তু আমার নাম তো সকাল।”
-“বাট আমি তোমাকে পরী বলে ডাকবো। কারন তুমি দেখতে ঠিক পরীর মতোই সুন্দর।”
-“পাম মারো কেন?”
-“তুমি ফুলেছো?”
-“না তো!”
-“তাহলে আমি আমি পাম কিভাবে মারলাম?”
-“ঠু স্মার্ট।”
-“না সিরিয়াসলি তোমার সৌন্দর্য্য একদম চোখ ধাঁধানো।”
-“আমার মাম্মা-পাপা বলে আমি না’কি দেখতে একদম দীদার মতো হয়েছি। তিনি না’কি খুবই সুন্দর ছিলেন। তার সময়ে তার ওপর না’কি অনেক ছেলেরা লাইন মারতো।”
-“সত্যি!”
-“হ্যা। সেই সৌন্দর্যেই তো দীদা আমার দাদুকে পটিয়ে নিয়েছিল।”
-“হাহাহা…. তা তুমি কাকে পটাবে?”
-“দেখি কাকে পটানো যায়।”

কথাটা বলেই সকাল খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। পরশ মুগ্ধ নয়নে সেই হাসি দেখে মনে মনে বললো, “পটানোর কি দরকার! শুধু একবার হ্যা তো বলো আমি একপায়ে রাজি তোমাকে নিজের করে নিতে।” সকাল আফির দিকে তাকিয়ে থতমত খেয়ে গেল। আফি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। সকাল জোর পূর্বক হাসি দেয়ার চেষ্টা করে বললো,
-“একটা বাচ্চা মেয়ের দিকে এভাবে তাকাস কেন রে পাঁজি মেয়ে?”
-“তুই বাচ্চা মেয়ে? প্লিজ ইয়্যার তোর কথাটা শুনে মনে হচ্ছে তুই বোবাকে গান গাইতে বলছিস।”
-“মানে? আমি বাচ্চা মেয়ে এই কথার সাথে বোবার গান গাওয়ার কি হলো?”
-“প্লিজ তুই আমার মাথা খাওয়া শুরু করিস না এখন। ওই যে ঢেরশের মাথা খাচ্ছিলি না! ওইটাই খা।”
পরশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আফির দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ঢেড়শ কে? হ্যা!”
-“আমি কিন্তু কারও নাম উল্লেখ করি নি। সো কেউ যদি কথাটা নিজের গায়ে নেয় তাহলে আমার কিছু করার নেই।”
-“লিসেন ফিফা….
-“আফিফা!”
-“তুমি আফিফা হও আর ইফিফা হও তাতে আমার কিছু যায় আসে না। কিন্তু তুমি আমার নাম বিকৃত করলে তোমার খবর আছে।”
-“আর তুমি যে আমার নাম বিকৃত করছো সেই বেলা কিছু না তাই না?”
-“তুমি আমাকে রেসপেক্ট করো। তাহলে আমিও তোমাকে রেসপেক্ট করবো।”
-“ঠ্যাকা পরে নাই।”
-“ওকে তাহলে ফিফা বলেই ডাকবো।”
-“আআহ! সকাল আমি বাসায় গেলাম। থাক তুই।”
-“আরে জান্টুস দাঁড়া! যাহ চলে গেল?”

সকাল ঠোঁট উল্টে ফেললো আফির চলে যাওয়া দেখে। পরশ হাসলো সকালের ফেস রিয়্যাকশন দেখে। সকাল গাল ফুলিয়ে বললো,
-“পরশ আমিও বাসায় গেলাম।”
-“এত তাড়াতাড়ি?”
-“হ্যা। আমি প্রতিদিন বাসায় তাড়াতাড়িই যাই।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে। চলো তোমাকে বাইরে পর্যন্ত এগিয়ে দিই।”
-“আচ্ছা চলো।”

পরশ সকালকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিল। সকাল গাড়িতে উঠে টাটা দিয়ে চলে গেল। পরশ মুচকি হাত দিয়ে নিজের চুল গুলো উপরে উঠাতে উঠাতে বললো,
-“তোমাকে আমার ভীষণ মনে ধরেছে পরী।”

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here