“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৫৩
(নূর নাফিসা)
.
.
“কেন করলে এমন?”
অবশেষে শারমায়ার সুযোগ হলো জবাবদিহিতার। সে জোভানের নিকটে এসে গা ঘেঁষে দাঁড়ালো। জোভানের শরীরে প্রবাহিত পানি দ্বারা সে-ও ভিজছে। জোভান তার দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে উত্তরের আশায়। শারমায়া তার দৃষ্টিতে দৃষ্টি রেখে বলতে লাগলো,
“লাইফে ফার্স্টটাইম আমি অনেক অপমানিত হয়েছি। তোমাকে ছাড়া আমার এক মুহূর্তও চলছিলো না। সারাক্ষণ মাথায় থাকতে তুমি, চোখে ভাসতো তোমার চেহারা, মনে সাড়া দিতো তোমার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো। সবসময় আমি তুমিময় হয়ে ছিলাম। বইয়ের পাতা খুললেও তোমাতে হারিয়ে যেতাম। ফলশ্রুতিতে ফার্স্ট টেস্ট এতো খারাপ হয় যে, আমার লাইফে এমন খারাপ রেজাল্ট হয়নি কখনো। সকলের লাস্ট তো ছিলামই তা-ও জঘন্যরকম! এতোটা খারাপ রেজাল্টের কারণে ইন্সটিটিউটে আমাকে অপমান করা হয়েছে। আমার মাধ্যমে আমার টিচারকে অপমান করা হয়েছে, আমার ফ্যামিলিকে অপমান করা হয়েছে। এমন মেধা নিয়ে আমি স্কলারশিপে সেখানে গেলাম কিভাবে, আমি তো স্কলারশিপের যোগ্যই না, আমাকে কি জাল নোটিশে পাঠানো হয়েছে, আমার পরিবার কি ব্যবস্থাপকদের টাকা খায়িয়ে আমাকে সেখানে পাঠিয়েছে? এধরণের কথাবার্তা শুনিয়েছে। আমি সেখানেই কান্না করে দেই। বাসায়ও ফিরি মুড অফ রেখে। রুমের দরজা বন্ধ করে প্রচন্ড কান্না করি। কাউকে জানাই না কিছু। তুমি ফোন দিলে তোমার সাথে মিসবিহেভ করি। মনে বড় আশা রেখে বাবা-মা, স্যার আমাকে সেখানে পাঠিয়েছে। আর তাদের প্রত্যাশিত ফলাফল যদি না নিয়ে আসতে পারি তাহলে সেখানে গেলামই কেন? উনারা কতটা হতাশাগ্রস্ত হবে ভাবতেই পারছিলাম না আমি। গিয়েছিই যখন, মিশন সাকসেস করে তারপরই ফিরবো সেদিনই এই পণ করে ফেলি। আর আমার দুর্বলতা তোমার প্রতি। তোমাকে ইগনোর না করলে আমার মিশন সাকসেস সম্ভব হতো না। তুমিও তো চাইবে না আমি শূন্য হাতে ফিরে আসি। তাই না, বলো? শূন্য ফলাফলের প্রত্যাশায় তো পাঠাওনি তোমরা।”
কথার সাথে সাথে শারমায়ার চোখে বৃষ্টি ঝরে যাচ্ছে অনবরত। জোভানের মাথায় আছড়ে পড়া পানি ছিটকে আসছে তার মুখমন্ডলে। জোভান বললো,
“আমি এতো এতোবার জানতে চাইলাম, তিনদিন পর্যন্ত তোমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করলাম তুমি একবার আমাকে বলতে পারতে কারণটা। আমি প্রতিদিন তোমার সাথে কথা না বলে সপ্তাহে একদিন বলতাম, নয়তো মাসে একদিন বলতাম। তাতেও যদি সমস্যা হতো ফোন না দিয়ে সেখানে গিয়ে তোমার সাথে সরাসরি দেখা সাক্ষাৎ করে চলে আসতাম। আমি তো প্ল্যান করে রেখেছিলাম, পাঁচ-ছয় মাস পরপর হুট করেই গিয়ে তোমাকে সারপ্রাইজ দিবো। পরপর দুইটা দেশে ভ্রমণ করলাম, কিন্তু তোমার কারণে ইংল্যান্ড যাওয়া হলো না।”
“আমি জানি, তোমাকে জানালে তুমি আমাকে বুঝাবে, অন্যকোনোভাবে ইন্সপায়ার করবে, যেভাবেই হোক আমাকে পড়াশোনার দিকে মনযোগী করার চেষ্টা করবে। কিন্তু এটাও জানি, সেই ইন্সপায়ারের কারণে আমার ভালোবাসাটা তোমার প্রতি আরও বাড়বে এবং তোমাকে আরও গেঁথে রাখবো মনে। পড়াশোনায় মন বসবেই না, তাই বাধ্য হয়েছি কারণ না জানিয়ে এভাবে দূরে ঠেলে দিতে। বিশ্বাস করো, আমি অনেক ডিপ্রেশনে ভুগছিলাম। সেদিন অপমানের তাড়নায় মরে যেতে ইচ্ছে করছিলো।”
“চুপ! এসব বলে না।”
এবার জোভান দুহাত উঠিয়ে শারমায়ার পিঠে রাখলো এবং কপালে ভেজা ঠোঁটে চুমু একে দিলো। শারমায়া যেন মুহুর্তেই অভিমানের পাহাড় টপকে সুখের রাজ্যে পদার্পণ করলো। জোভান আবার তার দিকে তাকিয়ে বললো,
“টুকটুকির আম্মু, তুমি এতো পঁচা কেন? এতো ব্যাথা কেন দাও আমাকে? যাকে আমি বুকে ঠাঁই দিয়ে রেখেছি, সে কেন পায়ে পড়ে আমাকে এতো কষ্ট দিবে?”
শারমায়া তার বুকে মাথা রেখে ধাধানো গলায় বললো,
“তুমি আমার কথা শুনতেই চাইছিলে না। তাই বাধ্য হয়েছি।”
জোভান নিজের সাথে তাকে সজোরে চেপে ধরে বললো,
“এভাবে একবার জড়িয়ে ধরতেও তো পারতে।”
শারমায়া মাথা তুলে কিছুটা অবাক দৃষ্টিতেই তাকালো তার দিকে। অতঃপর বললো,
“সাহস হচ্ছিলো না।”
“ভয় পাও তুমি আমাকে? তাহলে তো একটুও ভালোবাসো না আমাকে।”
শারমায়া আবার তার বুকে মাথা রেখে নিজের হাতের বাধন আরও শক্ত করে জড়িয়ে বললো,
“অনেক অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি তোমাকে। অপরাধবোধের কারণে এগিয়ে যেতে পারছিলাম না আমি।”
অতি আনন্দে শারমায়া শব্দযোগে কেঁদে উঠলো। তার কান্না কমে এলে জোভান বললো,
“তুমি জানো, তুমি দেশে ফেরার পূর্ব পর্যন্ত আমি অপেক্ষায় ছিলাম। পুরো চারটা বছর অপেক্ষা করলাম, তুমি কল করলে না। তুমি যদি চারবছর পরেও কল করতে, ভেবে নিতাম আমার উপর করা অজানা রাগ বুঝি ঝরে পড়েছে। তাহলে আর এখানে ফেরার পরবর্তী দিনগুলোও এমন হতো না। কিন্তু কল করলেই না। এমনকি জানালে না পর্যন্ত, তুমি আসছো। জানি না যে তা নয়, তুমি তো জানিয়ে আমাকে এক্সাইটেড করে তুলতে পারতে যে, অবশেষে তুমি আমার কাছে ফিরে আসছো।”
এতোটা অপেক্ষা সে হতাশায় রূপান্তর করে দিয়েছে ভাবতেই বুক ফেটে যাচ্ছে। শারমায়া কান্নার সাথে বললো,
“আই লাভ ইউ সো মাচ।”
জোভান তার মাথায় চুমু একে দিলো। আরও কিছুক্ষণ কেঁদে শারমায়া বললো,
“ক্ষমা করেছো আমাকে?”
জোভান আবারও চুমু একে দিলো মাথায়। শারমায়া তার দিকে তাকিয়ে বললো,
“করবে না ক্ষমা?”
জোভান বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“কিসের ক্ষমা? এমনিতেই সন্ধ্যায় রাগিয়ে দিয়েছো। তখন ইচ্ছে করছিলো তোমাকে দুইটা থাপ্পড় দিয়ে উঠাই।”
“তো দিতে।”
জোভান ব্রু কুচকে তাকিয়ে তার দুই গালে দুইটা কামড় বসিয়ে দিয়ে বললো,
“তোমাকে মেরে আমি জ্বলে পুড়ে মরবো? এতোই ঠেকা আমার?”
শারমায়া এক হাতে এক গাল ধরে বললো,
“ওফ্ফ! এখন আমি দেই?”
জোভান গাল পেতে দিলে শারমায়া ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটিয়ে ভেজা গালে চুমু একে দিলো। বিপরীতে জোভান তার ডান গালে আবারও কামড় বসিয়ে দিলো এবং আবারও নিজের গাল পেতে দিলো যাতে শারমায়া কামড় বসিয়ে দেয়। এবারও শারমায়া চুমু একে দিলো। জোভানের ঠোঁটে হাসির রেখা প্রকাশিত হলো। সে পরম আবেশে জড়িয়ে ধরে শারমায়াকেসহ ঘুরে দাঁড়ালো যাতে শারমায়া পুরোপুরি ভিজতে পারে। কেননা সে অর্ধেক ভিজে আছে, আর এতে সর্দি লাগতে পারে। ভিজেছেই যেহেতু, গোসল সেরে ফেলুক। রাতে ভিজে শরীর ঠান্ডা হয়ে এসেছে। ঝর্ণা অফ করে জোভান শারমায়ার মাথা মুছে দিলো। অতঃপর নিজের টিশার্ট খুলতে খুলতে বললো,
“শাড়ি চেঞ্জ করে তোয়ালে প্যাচিয়ে বের হও।”
শারমায়া “অস্তাগফিরুল্লাহ” বলে লজ্জা নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসতে গেলে জোভান হেসে বললো,
“এই, রুম ভিজে যাবে তো।”
“ভিজুক, আমি মুছে দিবো ফ্লোর।”
শারমায়া লাগেজ থেকে সালোয়ারকামিজ সেট হাতে নিলো। জোভানের ফোনের ব্যাটারি লো থাকায় শব্দ পেয়ে ফোন হাতে নিলো। তখন তো তার জন্য ফোন চার্জও দিতে পারেনি। শারমায়া চার্জার কানেক্ট করে অপেক্ষা করলো। জোভান তোয়ালে প্যাচিয়ে বেরিয়ে এসেছে। চোখে মুখে দুষ্টুমি ফুটে আছে। শারমায়া লজ্জিত দৃষ্টি নিচে নামিয়ে পাশ কাটিয়ে ঝটপট বাথরুমে চলে গেলো চেঞ্জ করতে। চেঞ্জ করার পর বাথরুমে দাঁড়িয়ে আরও কিছুক্ষণ নিঃশব্দে কাঁদলো। এটা জয়ের কান্না। অভিমানের পাহাড়ের চূড়া পর্যন্ত পৌছানোর আনন্দে তার কান্না আসছে। সে নিশ্চিত ছিলো, ঘটনা জানার পর জোভান অভিমান নিয়ে বসে থাকবে না। কেননা সে চমৎকার হৃদয়বান ব্যক্তি। নিজেকে স্বাভাবিক করে বেরিয়ে আসতে আসতে মহান আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো শারমায়া। আল্লাহ সহায় হয়েছে বলেই তার দ্বারা সম্ভব হলো।
জোভান অন্যমনস্ক হয়ে লম্বালম্বিভাবে শুয়ে আছে। এখন কোনো টিশার্ট নেই তার দেহে। বহুদিন পর কি তাহলে আজ তার উন্মুক্ত বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে পারবে? ভাবতেই তরঙ্গ সঞ্চার হলো শারমায়ার মনে। অতঃপর মনে পড়লো ইংল্যান্ডের কথা, সেখানে সারাক্ষণ কোয়ার্টার প্যান্ট পরে থাকতো। নিজ বাসায় কি ফুলপ্যান্ট পরহিতা ভদ্রলোক নাকি? জোভান ধ্যান ভঙ্গ করে শারমায়ার দিকে তাকালো। এখন তার দৃষ্টি অতি স্বাভাবিক, কোনো হাসি-আনন্দ বা বিষন্নতার ছাপ নেই। শারমায়া দৃষ্টি নত করে খাটের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবতে লাগলো, জোভান এভাবে তার দিকে তাকিয়ে কি ভাবছে? এই নিরবতা ভাঙতে কি বলবে ভেবে না পেয়ে শারমায়া বললো,
“লাইট অফ করে দিবো?”
জোভান দু’দিকে মাথা নাড়িয়ে নিষেধ করলো। শারমায়া কাঁথা টেনে বালিশে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। জোভান উঠে গিয়ে আলমারি খুলে কিছু নিলো এবং খাটে ফিরে এলো। অতঃপর শারমায়াকে তুলে বসিয়ে খাটে একটা বক্স রেখে হাতে থাকা অন্য বক্সটি খুললো। ডায়ামন্ডের নোজ পিন বের করে শারমায়ার হাতে দিলো। শারমায়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো হাতের দিকে। লোকটা এতো অভিমান জমা রেখেও তার গিফট দেওয়ার কথা ভুলেনি। এটা তো গত রাতে দেওয়ার কথা ছিলো। সব বরবাদ করে দিলো নিজ হাতে। ভাবতেই চোখ ভিজে উঠলো। জোভান তার মুখ উপরে তুলে ভেজা চোখ দেখে ব্রু কুচকে তাকালো। শারমায়া অন্যহাতে চোখ মুছে চোখের পাতা বন্ধ করলে জোভান মায়ের দেওয়া গোল্ডেন নোজ পিনটা খুলে নিজের উপহারটা পরিয়ে দিতে গেলে শারমায়া বাঁধা দিলো। অতঃপর চোখ খুলে বললো,
“এক মিনিট।”
“কি?”
শারমায়া জবাব না দিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে এলো। অতঃপর ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে ফুলের ঝার নিয়ে জোভানের কাছে দিলো। তাজা ফুল নেতিয়ে পড়েছে অনেকটা। তবে গন্ধ রয়ে গেছে। শারমায়া এটা আগে টানাতে বললে জোভান বললো,
“এটা এখানে কি করে?”
শারমায়া মুচকি হেসে বললো,
“সকালে খুলে যত্ন করে রেখে দিয়েছি।”
জোভান হাসলো এবং বললো,
“তোমাদের বাসায় নিয়ে যাবে বলে?”
“সেকেন্ড ওয়েডিং নাইট শেষ হয়নি বলে।”
“তো বউ সেজে আসো।”
“আচ্ছা।”
শারমায়া আবার বিছানা ছেড়ে নামতে গেলে জোভান মুচকি হেসে তার হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“বসো এখানে। ক’টা বাজে দেখেছো? বউ সাজতে গেলে রাত পাড় করে দিবে। আপাতত থাকুক। কাল রিসিপশনে তো সাজবেই।”
জোভান ঝারটা আটকে দিলো। পরক্ষণে নোজ পিন পরিয়ে বললো,
“এতোদিন তো সবার ভালোবাসা মাখলে, এবার আমারটা মাখো।”
অতঃপর অন্য বক্স খুলে রিং বের করে মধ্যমা আঙুলে পরিয়ে দিয়ে ঠোঁটে মুচকি হাসির রেখা ফুটিয়ে বললো,
“আমার গিফটটাও তারাতাড়ি এনে দিয়ো।”
শারমায়ার মুখে ফুটে উঠলো লজ্জাময়ী হাসি। মৃদু স্বরে উচ্চারিত হলো, “ইনশাআল্লাহ।” অবশেষে কাটলো অপেক্ষারত রাত। বিনিময় হলো সুখ-দুঃখ, অনুভূত হলো হাসি কান্না, নাশ ঘটলো মান অভিমানের। পরপর দুই দিনের নির্ঘুম চোখ, শেষ রাতে মিলে এলো শান্তির নীড়ে।
অথচ খুললো কর্কশ কণ্ঠের হাকে। দরজায় থাপ্পড় দিয়ে ডেকে যাচ্ছে জেভা। জোভান সাড়া দিলে জেভা ধারুম শব্দে দরজায় থাপ্পড় দিয়ে বললো,
“ওই ওঠ! কতবার ডেকে গেছি! বাসর রাতেও তো এতোক্ষণ ঘুমাসনি। এখন এতো ঘুম আসে কোত্থেকে চোখে? দিন রাত কি আর আসবে না নাকি? পার্লারের মহিলা এসে বসে আছে, এখনো তারা ঘুমায়!”
জোভান শারমায়ার দিকে তাকাতেই শারমায়া লজ্জায় জোভানের বুকে মুখ লুকিয়ে বললো,
“ছি! আপু কি বলে গেলো এটা!”