“হালাল প্রেম” পর্ব- ৫৫

“হালাল প্রেম”
পর্ব- ৫৫
(নূর নাফিসা)
.
.
শেষ বিকেলে তারা কমিউনিটি সেন্টার ত্যাগ করে শারমায়াদের বাসায় হাজির। সাথে এসেছে ইফাজ, মিরাজ ও সাদাতসহ জোভানের পাঁচজন বন্ধু। শারমায়া কোনো বরণের আশায় দাঁড়িয়ে নেই। সে “আম্মু” বলে হাক ছেড়ে প্রায় দৌড়ে ঘরে প্রবেশ করে মায়ের রুমে এসে মাকে জড়িয়ে ধরেছে। যেনো কতদিন দেখে না তার মাকে! সাফওয়ানা এসে বললো,
“আপু, এটা কি করলে! নতুন বউ, বরণ ছাড়াই ঘরে চলে এলে!”
শারমায়া চোখ মুছে বললো,
“সর! কিসের নতুন বউ! প্রায় পাঁচ বছরের পুরোনো। আর আমার ঘরে আমি আসবো আবার কিসের বরণ!”
“এতোসব বুঝি না আমি। এতো এরেঞ্জমেন্ট করলাম, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ছাড়ছি না। ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে, এসো। আম্মু, এসো তারাতাড়ি। আমি চাচীকে ডেকে দিচ্ছি।”
শারমায়াকে আবার দরজার বাইরে পাঠিয়ে দিলো সাফওয়ানা। আলপনার মাঝে দাঁড়িয়ে আছে তারা। একদিকে জোভানের বন্ধুরা, অন্যদিকে সাফওয়ানা ও তার কাজিনরা! দুইপক্ষের চাপা কান ঝালাপালা করে ফেলছে! শারমায়া হাত দ্বারা দুই কান চেপে রেখেছে। জোভান ইশারা করে তার বন্ধুদের থামতে বলছে, কিন্তু তারা উল্টো জোভানকে থামিয়ে নিজেদের চাপা ঝাড়ছে। ওদিকে, খালামনি, শারমায়ার মা সাফওয়ানাদের থামতে বলছে কিন্তু তারা গুরুজনদের কাছে রিকুয়েষ্ট করে চুপ থাকতে বলছে যাতে তাদের আনন্দ নষ্ট না করে দেয়। অবশেষে জয় হলো সাফওয়ানা টিম। তা-ও কেবল জোভানের জন্য। চাপার জোর বেশি ছিলো জোভানের বন্ধুদের। হুট করেই জোভান মুঠোহাত বাড়িয়ে সাফওয়ানার হাতে ধরিয়ে দিলো সম্মানী। আর হেরে গেলো বিপরীত পক্ষ। বিপরীত পক্ষের সকলেই তার উপর রাগান্বিত। মিরাজ বিড়বিড় করে বললো,
“জামাই আদর শেষ করে শ্বশুর বাড়ি থেকে বের হও, এরপর বুঝো ঠেলা।”
জোভান মুচকি হাসলো শুধু। অতঃপর চললো বরণ পর্ব। প্রথমে বরণ করতে বলা হলো খালামনিকে। খালামনি জোভানের মুখে মিষ্টি দিলো, তারপর চিনি, তারপর পানি। জোভান একদমই অল্প অল্প করে মুখে নিলো। অতঃপর শারমায়ার মুখে মিষ্টি দেওয়ার পর চিনি দিলে শারমায়া “ওয়াক থু!” শব্দযোগে একপাশে ফেলে দিয়ে বললো,
“হয় চিনি দিতে নাহয় লবন-ই দিতে। দুইটা একসাথে কেন দিলে? মুখটাই বাজে বানিয়ে দিলে।”
খালামনি বললো,
“কি! চিনিতে লবণ?”
চাচী বললো,
“এগুলো কে করেছে! সাফওয়ানার কাজ না?”
সাফওয়ানাসহ তার কাজিনগুলো হেসে উঠলো। শারমিন রেগেমেগে তাকালো শুধু। কিন্তু কিছু বললো না। খালামনি পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,
“নে পানি খা। নোনা স্বাদ চলে যাবে।”
পানি মুখে দিতেই শারমায়ার মুখ কাচুমাচু হয়ে গেলো। সে পিছু ফিরে ফ্ল্যাটের কোণে পানি ফেলে দিয়ে বললো,
“লবণের কারখানা!”
অতঃপর জোভানের দিকে তাকিয়ে দেখলো মুখ চেপে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে জোভান। তার মুখে জমা রেখেছে বুঝাই যাচ্ছে। শারমিন গ্লাস হাতে নিয়ে সাফওয়ানার দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“ফাজলামোর একটা সীমা থাকা দরকার।”
সাফওয়ানা হেসে মায়ের হাত থেকে গ্লাস নিতে নিতে বললো,
“ভাইয়া তো ঠিকই খেয়ে নিয়েছে। তোমার মেয়ে পারলো না কেন?”
খালামনি জবাব দিলো,
“তোর বিয়েতে বরণ করার সময় মরিচের গুঁড়ো দিবো পানিতে।”
“শুধু মরিচের গুঁড়ো কেন, ইটের গুঁড়ো সহ দিয়ো। তোমাদের জামাইকেই তো খাওয়াইবা। আমার কি?”
সকলেই হেসে উঠলো। জোভানের বন্ধুদের মধ্যে একজন বললো,
“সাথে চুলকানির ট্যাবলেট।”
“ওকে, সমস্যা নাই।”
সাফওয়ানা হাসতে হাসতে পানি পরিবর্তন করে নিয়ে এলো। জোভানকে দেওয়া হলো কুলি করার জন্য। জোভান পানি মুখে নিয়ে গিলে ফেললো। অতঃপর শুধু মিষ্টি খায়িয়ে চাচী, মামী, মা ও ভাবিরা বরণ পর্ব শেষ করলো। শারমায়া নিজের রুমে প্রবেশ করতে গিয়ে দেখলো রুমের দরজা বন্ধ। সাফওয়ানাকে খুলতে বললেও খুললো না। কারণ জানতে চাইলে সাফওয়ানা বললো সারপ্রাইজ আছে। কি সারপ্রাইজ তা দেখার জন্য সীমিত অপেক্ষায় রইলো। পরক্ষণে মেহমানরা সব চলে গেলো। কাউকেই ডিনার করে যাওয়া পর্যন্ত রাখতে পারলো না। কেবল জোভানের বন্ধুরা কয়েক মিনিট আড্ডা দিয়েছে। কিন্তু কিছু খাওয়াতে পারলো না। শীঘ্রই আবার আসবে সেই প্রতিশ্রুতি দিয়ে তারা চলে গেছে। আর বাকিরা বরণ পর্বের পর সাথে সাথেই চলে গেছে। শারমায়া খালামনিকে খালুজি, ভাইয়া, ভাবির সাথে যেতে দেয়নি। জোর করে রেখে দিয়েছে। সে দুদিন থাকবে এখানে, আর দুদিনই খালামনিকে থাকতে হবে। এটা তার আবদার। জোভান ফুয়াদ ভাইয়ার সাথে কথা বলতে লাগলে এইফাঁকে শারমায়া ফারিয়ার সাথে দেখা করতে চলে গেলো। বাবুকে কোলে নিয়ে আপুর সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে আবার ফিরে এলো। এসে দেখলো সাফওয়ানা, জোভান আর নুহাশ টিভি দেখছে আর কথা বলছে। সে সাফওয়ানাকে বললো,
“সাফু, অনেক হয়েছে। দরজা খুলে দে। আমার রুমে যাওয়া প্রয়োজন।”
“খাওয়াদাওয়া শেষ করো। পরে দিবো।”
শারমায়া জোভানের পাশে বসে বললো,
“চেঞ্জ করবে না?”
জোভান মাথা দু’দিকে নাড়লো এবং বললো,
“নেক্সট উইকে আমরা সমুদ্রসৈকতে যাবো। তারপর সীতাকুণ্ডে। হুম?”
“সীতাকুণ্ডে শীতকালে ভালো লাগবে।”
“ইনশাআল্লাহ, শীতকালে আবার যাবো। এখন শীতকালের অপেক্ষায় বসে থাকলে তো চলবে না। এটা সাফওয়ানার চয়েজ। আমরা যাচ্ছি তাহলে।”
“ওকে। নেক্সট উইক আসুক আগে।”
“কাল সন্ধ্যায় রাজধানীতে যাবো।”
“আবার রাজধানীতে কেন?”
“ফুচকা খেতে।”
“ফুচকা আমাদের বাসার নিচেই পাওয়া যায়।”
জোভান হতাশ হয়ে তার দিকে তাকাতেই সাফওয়ানা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বললো,
“বাসার নিচে যাওয়ার কি প্রয়োজন? ভাইয়া, আপুই তো বানাতে পারে। ঘরেই খাওয়া যাবে।”
জোভান শারমায়ার পিছনে হাত রেখে তাকে নিজের সাথে চেপে ধরে বললো,
“হুম, বড় ভাগ্য করে সঞ্চয়িতা বউ পেয়েছি যে। এতো সঞ্চয় করে করবে কি শুনি?”
“সঞ্চয়িতা বউ? ছাড়ো, যেখানে খুশি যাও। আমি আর বাঁধা দিচ্ছি না।”
“তুমি যাবে না?”
“না।”
“রাগ করো কেন? আমি জানতে চাইলাম শুধু, সঞ্চয় করে কি করবে।”
“একটা গাঁধা কিনে সেটার উপর তোমাকে চড়াবো।”
জোভান শরীর কাপিয়ে হেসে বললো,
“তারপর সেই গাঁধার পিঠে চড়ে দুজন হানিমুনে যাবো।”
শারমায়ার হাসি পেলেও সে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে এলো। ওদিকে সাফওয়ানা হেসে কুটিকুটি,
“বাহ! গাঁধার পিঠে চড়ে হানিমুন! জিনিয়াস কাপল!”
শারমায়া ইচ্ছে করেই চেঞ্জ করেনি, কারণ সে আজ বউ সাজ মুছে ফেলতে চায় না। জোভান হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হলেও শারমায়া কেবল হাত ধুয়ে এভাবেই ডিনার করলো। ডিনারের পর সাফওয়ানা রুমের চাবি দিয়ে দিলো। শারমায়া লাগেজ নিয়ে এসে দরজা খুলে দেখলো রুম অন্ধকার! বাইরে থেকে আগত আবছা আলোতে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে সুইচ অন করে অবাক! তখন সারপ্রাইজের কথা শুনে সীমিত অপেক্ষায় থাকলেও এখন চরমভাবে সারপ্রাইজড! সে সাথে সাথেই লাইট অফ করে ফেললো। দৌড়ে গিয়ে এখনই সাফওয়ানাকে একটা কুট্টুস চুমু দিয়ে আসতে ইচ্ছে করছে। ভীষণ আনন্দ লাগছে ফুলে সজ্জিত বিছানা দেখে৷ ভাবতেই পারেনি সাফওয়ানা এতো সুন্দর সারপ্রাইজ রেডি রেখেছে! সে ততক্ষণ পর্যন্ত একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইলো যতক্ষণ পর্যন্ত না জোভান এসেছে। জোভান ডিনারের পর সাখাওয়াত সাহেবের সাথে কথা বলছিলো। কথা শেষে রুমের দিকে এসে অন্ধকার দেখে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ডাকলো,
“শারমায়া?”
“এসো, আমি রুমেই আছি।”
জোভান রুমে প্রবেশ করতে করতে বললো,
“অন্ধকার কেন?”
শারমায়া জবাব না দিয়ে এগিয়ে এসে দরজা লাগিয়ে দিলো। অতঃপর বললো,
“ফোনের টর্চ অন করো।”
জোভান ফোন হাতে নিয়ে টর্চ অন করলে শারমায়া ফোন নিয়ে নিলো। অতঃপর রুমের লাইট অন করতেই জোভানও অবাক হয়ে তাকালো! শারমায়া বললো,
“সারপ্রাইজড?”
জোভান অবাক-খুশি দৃষ্টি নিয়ে শারমায়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভীষণ! তোমার প্ল্যান ছিলো?”
“উহুম। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। সাফওয়ানাই করেছে।”
“সাফওয়ানার তো স্পেশাল গিফট পাওয়া দরকার স্পেশাল সারপ্রাইজের জন্য। আপাতত দেনা থাকুক। কি বলো?”
কথার সাথে সাথে জোভান হুট করেই শারমায়াকে পাজা কোলে তুলে নিলো। শারমায়া লজ্জায় চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। জোভান বললো,
“ঘুমিয়ে পড়লে নাকি জ্ঞান হারালে? কোনটা? তোমাকে নিয়ে তো আবার ভয় হয়।”
শারমায়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠে তার গলা জড়িয়ে ধরে বললো,
“চেঞ্জ করবে না?”
“আগে জানলে শেরওয়ানিটাই পরে আসতাম। আমাদের তো বাসর রাতে সেল্ফি তোলা হয়নি। আজ দ্বিতীয় সুযোগ ছিলো।”
“ইশ! সেল্ফি তোলার কি এতো প্রয়োজন?”
“ভবিষ্যৎতে বাচ্চাকাচ্চাদের দেখাবো না!”
“অসভ্য! ফটোশুট হয়েছে সেটা কি যথেষ্ট নয়?”
“সেলফি আর ফটোশুটে তফাত আছে না? ফটোশুটে প্রকাশ পাবে সকলের সামনে জোরপূর্বক একটা মিচকে হাসি দিয়ে কার্টুন সাজা! সেল্ফি তো কেবল আমার সামনে তোমার লজ্জামাখা রূপটা প্রকাশ করবে।”
“চুপ! নামাও আমাকে।”
“কেন, সমস্যা কি?”
“কষ্ট হচ্ছে না?”
“কিছু কিছু কষ্ট মিষ্টি হয়।”
“হয়েছে, মিষ্টি বেশি খেলে আবার রোগাক্রান্ত হয়।”
জোভান মুচকি হেসে তার কপালে উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে খাটে নামিয়ে দিলো। শারমায়া বললো,
“বিয়ের দিন সিড়ি দিয়ে উঠতে প্রচুর কষ্ট হয়েছিলো না?”
“তা তো একটু হয়েছেই। সারাদিন খাওয়া হয়নি ঠিকমতো। শক্তির অভাবে ছিলাম বড্ড। মনে মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো। ইচ্ছে করছিলো প্রশ্নটা করেই ফেলি। কি জানো?”
“হুম?”
“শারমায়া, তুমি কত কেজি?”
শারমায়া খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বললো,
“তোমার ফ্রেন্ড সার্কেল তোমার-আমার উপর হেসে পঁচিয়ে গলিয়ে ফেলতো। আসলেই অনেক মোটা হয়ে গেছি। ছয়-সাত কেজি বেড়ে গেছি। স্বাস্থ্য কমাতে হবে।”
“একদম না। এটা পারফেক্ট। আর দু-এক কেজি বাড়লেও সমস্যা নেই। টুকটুকিরা এলে আরেকটু মোটা হয়ে যাবে আশাকরি।”
শারমায়া নিশ্চুপ হয়ে কাথার ভাজ ছাড়াতে লাগলো। জোভান বললো,
“বউ, তুমি কি লজ্জা পেলে? আমিও দেখে নিতে চাই তোমার লজ্জা কতদূর পৌঁছায়।”

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here