#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৪৮
.
ঘড়ির কাটায় সকাল ৯ টা বেজে ২৩ মিনিট। হন্তদন্ত হয়ে হসপিটালে আসলো স্নিগ্ধ। চিন্তায় এই শীতের ভেতরেও ওর কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে। হসপিটালের করিডোর দিয়ে দৌড়ে এসে নীলামের কেবিনে প্রবেশ করলো স্নিগ্ধ। কেবিনে ঢুকে নীলামকে জুস খেতে দেখে স্নিগ্ধ অনেক অবাক হলো। পাশের দেয়ালে হাত রেখে হাঁপাতে লাগলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শিহাবের দিকে তাকালো স্নিগ্ধ।
-“এসব কি শিহাব? তুমি না বলেছিলে তোমার আপু হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েছে!”
-“আমার কোনো দোষ নেই। নীলাম আপুই আমাকে বলেছিল যাতে তোমাকে ফোন দিয়ে বলি আপু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছে।”
স্নিগ্ধ অবাক হয়ে নীলামের দিকে তাকালো। নীলামের মুখে হাসি ফুটে আছে। মুহূর্তেই বেশ রেগে গেল স্নিগ্ধ। এরকম মজা তার একদমই পছন্দ নয়। ও তৈরি হচ্ছিল সকালের বাসায় যাওয়ার জন্য। ঠিক সেই মুহূর্তে শিহান ফোন পেয়ে ও সকালের বাসায় না গিয়ে এখানে ছুটে চলে এসেছে। আর এখানে এসে শুনে এসব মজা ছিল!
-“ফাজলামো করার একটা লিমিট থাকে নীলাম। এগুলো কি ধরনের ফাজলামো? তুমি জানো আমি কতটা চিন্তায় ছিলাম তোমার কথা ভেবে!”
-“আমি জানতাম স্নিগ্ধ, তুমি আমার অসুস্থতার কথা শুনলে ঠিকই সব ছেড়ে দৌড়ে আমার কাছে চলে আসবে। কিন্তু এই সামান্য কথাটা শিহাব বা মা কেউ বুঝতেই চাইছিল না।”
-“মানে?”
-“মা বলছিল তুমি না-কি আমাকে আর ভালোবাসো না। কোথাকার কোন সকাল নামের একটা মেয়েকে পছন্দ করা শুরু করেছো। আবার তার সাথে না-কি তোমার বাগদানও হয়ে গিয়েছে। আমি জানি তুমি আমাকে ভালোবাসো। আর আমাকে ছাড়া অন্য কারো কথা চিন্তাও করতে পারো না। তুমি ওই মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছো শুধু মাত্র ফুপিমনির কারণে। কিন্তু স্নিগ্ধ এখন তো আমি ফিরে এসেছি। এখন আর ওই মেয়েকে বিয়ে করার কোনো মানেই হয় না। ওই সকালের সাথে তুমি বিয়ে ভেঙে দিবে। আর আজ থেকে ঠিক একমাস পরে তোমার আর সকালের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল না! সেখানে সকালের জায়গায় তোমার আর আমার বিয়ে হবে। আমি জানি আমি না বললেও তুমি এই কাজগুলো করতে। কিন্তু তবুও! ভালোবাসি তো তোমাকে! তাই না বলে থাকতে পারলাম না কথাগুলো। কখনো আমাকে ছেড়ে যেওনা স্নিগ্ধ।”
নীলাম নিজের মনের ভেতরে একপ্রকার জেদ নিয়েই কথাগুলো বললো। স্নিগ্ধর পেছনে তাকিয়ে মনে মনে হাসলো সে। তারপর কোনো কিছু না ভেবেই হুট করে জড়িয়ে ধরলো স্নিগ্ধকে।
কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে স্নিগ্ধ আর নীলামের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলছে সকাল। প্রায় ঘন্টাখানেক আগেই এখানে এসেছে ও। শিহাবকে দিয়ে সকালের নম্বর জোগার করে নীলামই সকালকে কল দিয়ে ডেকেছিল কথা বলার জন্য। এখানে আসার পর ওকে বেশ ভালোভাবে নীলাম বুঝিয়েছে যে স্নিগ্ধ শুধু তার। স্নিগ্ধ আর নিজের গভীর প্রেমের বর্ণনা দিচ্ছিল নীলাম সকালকে। কষ্ট হলেও চুপচাপ সব শুনে গেছে সকাল। ইদানীং তার মনে হচ্ছে তার জন্ম হয়েছে শুধুই কষ্ট উপভোগ করার জন্য। নীলামের কথার পরিপ্রেক্ষিতে সকাল শুধু বলেছিল,
-“আপু আমি ডাক্তার সাহেবের মুখ থেকে শুনতে চাই উনি কি চায়। উনি যদি আমাকে বিয়ে করতে না চায় তাহলে আমি জোর করবো না। কিন্তু কথাটা উনার কাছ থেকেই শুনতে চাই আমি।”
সকালের জেদের কাছে হার মেনে নীলাম রাজি হয়। শিহাবকে বলে স্নিগ্ধকে ফোন দিয়ে মিথ্যে কথাটা বলতে। আর সকালকে কেবিনের বাইরে লুকিয়ে থাকতে বলে। সকাল চুপচাপ কেবিনের বাইরে এসে নিজের মুখ ঢেকে বসে থাকে। নীলাম কেবিনের ভেতরে বিছানায় বসে শিহাবকে কি করতে হবে তা বুঝিয়ে দেয়। শিহাবও মাথা নাড়িয়ে সায় জানায় নীলামের কথায়। এরপর স্নিগ্ধ কেবিনে ঢোকার পর নীলাম নিজের কথাগুলো বলে। আর সকাল বাইরে দাঁড়িয়ে সবটা দেখে চোখের পানি ফেলছে। ওর সব থেকে বেশি খারাপ লাগছে স্নিগ্ধ চুপ করে থাকায়। স্নিগ্ধর চুপ করে থাকাটাই বলে দিচ্ছে যে নীলামের সাথে একমত হচ্ছে স্নিগ্ধ।
দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধ। এটা হসপিটাল বিধায় কোনো সিনক্রিয়েট তৈরি করতে চাইছে না ও। তা-ও তীক্ষ্ণ গলায় বললো,
-“নীলাম আমি তোমাকে ভালোবাসি….
এইটুকু বলা মাত্রই স্নিগ্ধকে থামিয়ে দিল নীলাম। বিরক্ত হলো স্নিগ্ধ। নীলাম বললো,
-“আমি জানি তো তুমি আমায় ভালোবাসো। অনেক বেশি ভালোবাসো।”
এবার স্নিগ্ধর প্রচুর রাগ লাগছে। কপালের রগ ফুলে উঠছে ওর। সকাল কেবিনের সামনে থেকে সরে গেল। এই মুহূর্তে এর থেকে বেশি কিছু দেখার বা শোনার অবস্থায় সে নেই। পাশের বেঞ্চে বসে কিছুটা শব্দ করেই কেঁদে দিল সকাল। শিহাব এসে ওর সামনে দাঁড়িয়ে টিস্যু এগিয়ে দিল। কিন্তু সকাল সেটা নিলো না। শিহাব লোলুপ দৃষ্টিতে সকালের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“প্লিজ চলে যাও স্নিগ্ধ ভাইয়ের জীবন থেকে। শুনলেই তো ভাইয়া আমার নীলাম আপুকে ভালোবাসে। তোমাকে ভাইয়া ভালোবাসে না। শুধু মাত্র ফুপিমনির জোরাজুরির কারণে তোমাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে ভাইয়া। আমার আপুর সাথে স্নিগ্ধ ভাইয়ার সম্পর্কটা অনেক গভীর। ঠিক একজন স্বামীর সাথে তার স্ত্রীর যেরকম সম্পর্ক থাকে সেই রকম। এখন তুমি যদি জোর করে ভাইয়াকে বিয়ে করো তাহলে আমার আপুর কি হবে? কে বিয়ে করবে ওকে? এমনিতেই এতগুলো বছর আপু লাপাত্তা ছিল। চাইলে তুমি ভাইয়ার বাসায় যেয়ে ভাইয়ার রুম দেখতে পারো। ভাইয়া এখনো নীলাম আপুকে ভালোবাসে তার প্রমাণ হলো স্নিগ্ধ ভাইয়ার রুমে টাঙানো নীলাম আপুর ছবিটা।”
সকালের মনে পড়লো সেদিনের কথা যেদিন স্নিগ্ধর রুমে গিয়ে নিজে চেক করেছিল আসলেই নীলামের ছবি আছে কি-না। হ্যা তার স্পষ্ট মনে আছে সেখানে নীলামের একটা বিশাল ছবি টাঙানো ছিল। তাছাড়া একটু আগেই তো ওর সামনে স্নিগ্ধ নীলামকে জড়িয়ে ধরে ভালোবাসি বললো। তার মানে ও আসলেই স্নিগ্ধ আর নীলামের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি। হয়তো গতকাল স্নিগ্ধ ওকে এই কথা বলার জন্যই কল দিয়েছিল। সকাল কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালো। ওড়না দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো।
-“আমি শেষবারের মতো ডাক্তার সাহেবের সাথে কথা বলতে চাই।”
-“নাহ!” কিছুটা চেঁচিয়েই বলে উঠলো শিহাব। সকাল অবাক হয়ে শিহাবের দিকে তাকাতেই শিহাব জোরপূর্বক হেসে আমতা আমতা করে বললো,
-“না মানে কি দরকার দেখা করার? তুমি এমনিতেও কষ্ট পাচ্ছ। ভাইয়ার সামনে গেলে তোমার আরও কষ্ট হবে। তাছাড়া স্নিগ্ধ ভাইয়ার নিজের ভেতরে প্রচন্ড অপরাধবোধ কাজ করছে তোমাকে কীভাবে কথাগুলো বলবে এই ভেবে। তাই আমিই ভাইয়ার হয়ে তোমাকে বললাম। এখন তুমি যদি ভাইয়ার সামনে যাও তাহলে ভাইয়ার আরও বেশি অপরাধী মনে হবে নিজেকে।”
-“(….)”
সকালের চোখ থেকে আবারও অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ও শিহাবের কথায় মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে দূর থেকে একবার কেবিনের দিকে তাকালো। সেখানে দেখা যাচ্ছে স্নিগ্ধ নীলামের বাহুতে হাত রেখে কি যেন বলছে নীলামকে। সকাল আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না সেখানে। শিহাব প্যান্টের পকেটে হাত রেখে আস্তে আস্তে শিস বাজাতে লাগলো সকালের যাওয়ার পানে তাকিয়ে।
-“কি করছো কি নীলাম! এটা হসপিটাল।”
-“তো কি হয়েছে? বিনা অনুমতিতে কেবিনে কেউ প্রবেশ করবে না।”
-“সে যাই হোক। তোমাকে এখনি সবটা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিতে চাইছি।”
-“মানে?”
-“আমি… আমি সকালকে ভালোবাসি। তুমি আমার অতীত ছিলে নীলাম। আমার বর্তমান জুড়ে পুরোটাই সকাল রয়েছে। সত্যি কথা বলতে আমিও প্রথমে বিশ্বাস করতে চাই নি যে আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। ওর সাথে খারাপ ব্যবহার পর্যন্ত করেছি। কিন্তু ও একটা কথাও বলে নি। ও আমার ওপর কখনো রাগ দেখায়নি। যা দেখিয়েছে তার সম্পূর্ণটাই ছিল ভালোবাসা আর অভিমান। ও নিজের সবটা দিয়ে ভালোবেসেছে আমাকে। ও আমাকে পাগল করে তুলেছে ওর প্রতি।”
-“(….)”
-“ওর ছোট ছোট অভিমানগুলো ভাঙাতে আমার ভীষণ ভালো লাগে। ওকে যখন নিজের বুকের মাঝে আঁকড়ে ধরি, তখন মনে হয় আমার সমস্ত দুঃখ, কষ্ট, ক্লান্তি সব নিমিষেই দূর হয়ে গেছে। আমার বুকের অশান্ত ঢেউগুলো শান্ত হয়ে যায় ওর মুচকি হাসিতে। ওর বাচ্চামোগুলো আমার অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে। ওকে একপলক দেখলেই আমার হৃদস্পন্দন গুলো অবাধ্য হয়ে যায়। ওর কাজল কালো ডাগরআঁখি দুটিতে আমি নিজের সর্বনাশ অনেক আগেই দেখেছিলাম। কিন্তু এই কথাটা ওকে বলার মতো সঠিক সময় পাইনি আমি। ওর গোলাপি ঠোঁট দুটো দেখলেই আমার সবসময় মন চাইতো ওর ঠোঁট দুটো নিজের ঠোঁটের ভাঁজে নিয়ে অপরাধ করে ফেলতে। কিন্তু কখনো সেই স্পর্ধা দেখাইনি ও বাচ্চা বলে। আমি সবসময় ওকে বৈধভাবে পেতে চেয়েছি। ওর ভুবন ভোলানো হাসিতে আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। মোট কথা হলো সকাল আমার ভালো থাকার মেডিসিন। যাই হয়ে যাক না কেন, ওকে ছাড়া আমার চলবে না। এই স্নিগ্ধ তার শেষ নিঃশ্বাসটুকু সেদিনই তার সকালের নামে করে দিয়েছে, যেদিন জানতে পেরেছি আমি ওকে ভালোবেসে ফেলেছি।”
সকালের প্রতি নিজের অনুভূতিগুলো ব্যক্ত করার সময় স্নিগ্ধর চোখে-মুখে ছিল এক অন্যরকম উজ্জ্বলতা। ওর মুখে লেগে ছিল হাসি। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল সকালকে সম্পূর্ণভাবে নিজের সামনে কল্পনা করে কথাগুলো বলছে। নীলাম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। স্নিগ্ধ যখন তার প্রেমে পড়েছিল তখনো এতটা পাগলামি করতে দেখেনি ও স্নিগ্ধকে। কখনোই তার প্রতি এত বেশি মুগ্ধ হতে দেখেনি নীলাম স্নিগ্ধকে। তবে কি স্নিগ্ধ সকালকে যতটা ভালোবাসে ততটা ভালো ওকে কখনোই বাসেনি!
স্নিগ্ধ নীলামের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“জানি না তুমি কি ভাবছো। তবে আমি আশা করবো তুমি আমাকে বুঝবে। আমাদের ভেতরে যা ছিল তা পুরোনো হয়ে গেছে। সকালের প্রতি আমার যে অনুভূতিগুলো কাজ করে, তার পঞ্চাশ পার্সেন্টও তোমার প্রতি কখনো আসে নি। আমি গত কয়েকদিনে তা অনুভব করেছি। প্লিজ ভুলে যাও আমাকে। এতদিন যখন আমাকে ছাড়া ছিলে, তখন বাকি সময়টাও আমাকে ছাড়াই থাকতে পারবে তুমি। আমার থেকেও ভালো কাউকে পাবে তুমি। তাই আমার আশা ছেড়ে দাও। আর প্লিজ নিজের কোনো ক্ষতি করবে না। আসছি।”
স্নিগ্ধ নীলামের কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। হসপিটাল থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই স্নিগ্ধর এ্যাসিস্ট্যান্ট এসে বললো,
-“স্যার আজকে আপনার সারাদিন তো খুবই ব্যস্ততার মধ্যে কাটবে। পর পর তিনটা সার্জারি আছে। যা আজই করতে হবে। এছাড়াও কতগুলো ভিআইপি পেশেন্টের সাথে এ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে।”
-“এই শিডিউলটা কি কোনোভাবেই বদলানো যাবে না! না মানে আমার ব্যক্তিগত কিছু দরকারি কাজ ছিল।”
-“স্যার এগুলো গত পরশু দিনের শিডিউল। সেদিনও আপনি বলেছিলেন চেঞ্জ করে দিতে। তাই চেঞ্জ করে দিয়েছিলাম। কিন্তু আজ এগুলো চেঞ্জ করার কোনো উপায় নেই।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে চলো।”
স্নিগ্ধ চিন্তিত হয়ে নিজের কেবিনে চলে গেল।
নীলাম নিজের কেবিনে বিছানায় হাত মুঠো করে বসে আছে। চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে নিজের কান্না থামানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে ও। স্নিগ্ধর কথাগুলো শুনে নিজের কান্না ধরে রাখতে পারছে না নীলাম। সত্যি সত্যিই সকাল জিতে নিয়েছে স্নিগ্ধকে। দুই বছর রিলেশনশিপে থাকার পরও স্নিগ্ধ ওকে এতটা ভালোবাসতে পারে নি যতটা কয়েকমাসে সকালকে বেসে ফেলেছে। খুব কষ্ট হচ্ছে নীলামের। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। আজ ওর জেদ হেরে গেছে।
সারাদিন এত এত পরিশ্রম করে ক্লান্তি নিয়ে চেয়ারে বসে আছে স্নিগ্ধ। রাত দুটোর বেশি বাজছে। চেয়ার ছেড়ে উঠে স্টেথোস্কোপ আর অ্যাপ্রোনটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেল হসপিটাল থেকে। বাসায় এসে গোসল করে শুতে গেলেই আসমা বেগম রুমে ঢুকলেন প্লেটে করে খাবার নিয়ে। স্নিগ্ধ হাসলো এত রাতে মাকে দেখে। ও যে সারাদিনে কিছু মুখে দেয়নি তা না বললেও বুঝে গেছে ওর মা। সন্তানরা কিছু বলার আগেই সব বুঝে যায় মায়েরা। তাই তো পৃথিবীতে সকল মায়েদের স্থান উঁচুতে রাখা হয়েছে।
-“জানি সারাদিনে কিছুই খাসনি। তাই কথা না বাড়িয়ে লক্ষ্মী ছেলের মতো এসে পাশে বোস। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”
-“আচ্ছা।”
স্নিগ্ধকে খাইয়ে শেষ করে উঠে চলে গেলেন আসমা বেগম। পানি খেয়ে ফেনে সময় দেখে শুয়ে পরলো স্নিগ্ধ। আগামীকাল তার ছুটি। কালকের সারাটা দিন সে শুধু মাত্র সকালের জন্য বরাদ্দ করে রেখেছে। মুচকি হেসে চোখ বুঁজে নিলো ও।
স্নিগ্ধর ঘুম ভাঙলো আজানের শব্দে। কিছুক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে চোখ মেলে ফোনটা হাতে নিলো। সময় দেখেই ওর চোখ কপালে উঠে গেল। তার মানে এখন আসরের আজান দিচ্ছে! তড়িঘড়ি করে লাফ দিয়ে উঠে বসলো স্নিগ্ধ। কোনোমতে বিছানা গুছিয়ে তাওয়াল আর জামাকাপড় নিয়ে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে গেল ও। আজ এত দেরি কি করে হয়ে গেল ঘুম থেকে উঠতে সেটাই স্নিগ্ধ বুঝে উঠতে পারছে না। ফ্রেস হয়ে গোসল করে বেরিয়ে এসে তৈরি হয়ে ফোন টিপতে টিপতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে লাগলো। ফেন পকেটে ঢুকিয়ে আশেপাশে তাকাতেই আসমা বেগমকে চুপচাপ সোফায় বসে থাকতে দেখে সেদিকে এগিয়ে গেল স্নিগ্ধ।
-“কি হয়েছে মা? এত চুপচাপ কেন আজ!”
-“কোথাও যাচ্ছিস?”
-“হ্যা। আমি একটু তোমার বউমার সাথে দেখা করতে যাবে। মেয়েটাকে অনেকদিন হয়েছে দেখি না। মনটা বড্ড আনচান আনচান করছে।”
-“(….)”
-“আচ্ছা কি হয়েছে তোমার?”
আসমা বেগম কোনো কথা না বলে স্নিগ্ধর হাত ধরে কিছু একটা দিল হাতে। স্নিগ্ধ ভ্রু কুঁচকে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। পরক্ষণেই মায়ের দিকে তাকিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বললো,
-“এ..এই আংটি তো আমি সকালকে আমাদের বাগদানের সময় পড়িয়ে ছিলাম।”
-“হুম।”
-“তাহলে এটা তোমার কাছে কেন? এটা তো ওর হাতে থাকার কথা।”
-“(….)”
-“কি হলো মা কথা বলছো না কেন? বলো এটা তোমার কাছে কীভাবে এলো?”
-“(….)”
-“আচ্ছা তোমায় কিছু বলতে হবে না। আমি তোমার বউমার সাথে দেখা করে ওর কাছেই জিজ্ঞেস করে নিবো।”
স্নিগ্ধর রাগ লাগছে প্রচুর। ও হাত মুষ্টিবদ্ধ করে সোফা ছেড়ে উঠে দুই কদম এগোতেই আসমা বেগমের কথা শুনে থেমে গেল। বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি বললে?”
-“সকাল মা চলে গেছে।”
-“কোথায় চলে গেছে?”
-“কানাডা।”
-“কিসব আজেবাজে বকছো মা? ও কেন কানাডা চলে যাবে?”
-“এখনো যায় নি তবে যাচ্ছে। বিকেল সাড়ে পাঁচটায় ওর ফ্লাইট। এতক্ষণে হয়তো এয়ারপোর্টে চলে গেছে। গতকাল রাতে বাসার সবাইকে জানিয়েছে ও আর এখানে থাকতে চায় না। ওর চাচ্চুকে ব্যাপারটা জানানোর পর উনিই কয়েক ঘন্টার মধ্যে ওর পাসপোর্ট, ভিসা সব তৈরি করে দিয়েছেন। সকাল মা কানাডা তার চাচ্চুর কাছেই যাচ্ছে।”
-“এটা সম্ভব না মা। ও আমার বাগদত্তা। আমাকে এভাবে কিছু না বলে ও হুট করে চলে যেতে পারে না। আর কেনই বা চলে যাবে ও?”
-“তোর জন্য। কম তো কষ্ট পায় নি মেয়েটা তোর কাছ থেকে। কতগুলো ধাক্কা একসাথে খেয়েছে ও। এতদিন বাবা নামের যেই লোকটাকে ও এত ভালোবেসেছে এত সম্মান করেছে, কাল জানতে পারলো সেই লোকটা নারীপাচারকারী। তার ওপর তুই ওর একটা খোঁজও নিস নি। মেয়েটা প্রচুর ভেঙে পড়েছে। ও যাওয়ার আগে বাসায় এসেছিল। তুই তখন ঘুমোচ্ছিলি।”
-“(….)”
-“হাত থেকে আংটি খুলে আমার হাতে দিয়ে বলেছে, “আমি উনাকে সব বাঁধন সব সম্পর্ক থেকে মুক্ত করে দিলাম। আমি জানি উনি নীলাম আপুকে কতটা ভালোবাসে। আমি চাই না উনাদের মাঝে তৃতীয় ব্যক্তি হয়ে থাকতে। আমাদের যেই বিয়েটা হওয়ার কথা ছিল তা আর হচ্ছে না। বরং যেদিন আমাদের বিয়ের কথা ছিল সেদিন নীলাম আপুর সাথে উনার বিয়ে দিয়ে দিয়েন। উনারা সুখী হবে। আর এতদিন আমার সাথে বা আমার পরিবারের সাথে যা ছিল সব একটা দুঃস্বপ্ন ভেবে ভুলে যাবেন।” আমি ওর কথাগুলো শুনে ওকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম যে নীলামের সাথে তোর এখন তেমন কোনো সম্পর্ক নেই। নীলাম শুধু তোর দায়িত্ব। কিন্তু ও বিশ্বাস করে নি। ও বলেছে ও না-কি গতকাল নিজের চোখে দেখেছে তোকে আর নীলামকে একসাথে জড়িয়ে ধরা অবস্থায়। আর এ-ও শুনেছে যে তুই ওকে ভালোবাসি বলেছিস।”
-“(….)”
-“স্নিগ্ধ! কথা বলছিস না কেন তুই? আমাকে সত্যি করে বল, তুই কি আসলেই নীলামের সাথে সম্পর্কে আছিস এখনো?”
স্নিগ্ধ কোনো কথা না বলে দৌড়ে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে। পেছন থেকে ওর মা ওকে ডেকে চলেছে। স্নিগ্ধ গাড়িতে উঠে সময় দেখে নিলো। ৪ টা ৪৪ বাজে। ওর এখন কেমন লাগছে তা শুধু ও নিজেই জানে। গাড়ির গতি বাড়িয়ে দিল। উদ্দেশ্য এয়ারপোর্ট। চারপাশের সবকিছুই কেমন যেন ঝাপসা লাগছে ওর কাছে। একহাত দিয়ে চোখ মুছতেই অবাক হয়ে গেল স্নিগ্ধ। ওর অজান্তেই ওর চোখ থেকে পানি পড়ছে।
এয়ারপোর্টের সামনে গাড়ি থামিয়ে হন্তদন্ত হয়ে সকালকে খুঁজতে লাগলো স্নিগ্ধ। এখনি সকালকে না দেখতে পেলে যেন দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে এমন লাগছে। হঠাৎ ওর চোখ গেল কিছু দূরে একটা গাড়ির দিকে। সেখানে আখি আর পলক দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখেই ছুটে চলে গেল সেদিকে। আখির সামনে গিয়ে হাঁপাতে লাগলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে পলক আর আখি স্নিগ্ধর দিকে।
-“স্নিগ্ধ তুই এখানে!”
-“স..সকাল কোথায়?”
-“(….)”
-“কি হলো বল সকাল কোথায়?”
-“(….)”
-“আজব কথা কেন বলছিস না তুই?”
স্নিগ্ধ যে রেগে আছে তা বুঝতে পারছে পলক। ও স্নিগ্ধর কাঁধে হাত রেখে বললো, “সকাল চলে গেছে।”
কথাটা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই একটা বিমান উড়ে গেল উপর দিয়ে। পলক সেটার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এইটাই ছিল সকালের ফ্লাইট।”
-“(….)”
স্নিগ্ধ পাথরের মতো দাঁড়িয়ে প্লেনটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন কেউ এইমাত্র ওর কলিজাটা টেনে বের করে নিয়ে গেছে। নিঃশ্বাস নিতেও ভুলে গেছে। চোখ বেয়ে এক ফোঁটা দুই ফোঁটা করে জল গড়িয়ে পরতে লাগলো। পলক আর আখি স্নিগ্ধর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ওকে কাঁদতে দেখে। হাঁটু ভেঙে নিচে বসে পড়লো স্নিগ্ধ। চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পড়ছে।
চলবে….