#সেই_সন্ধ্যা
#সুমাইয়া_সিদ্দিকা_আদ্রিতা
#পর্ব_৫২
.
স্নিগ্ধ সকালের রুমে ঢুকে দেখে সকাল মূর্তির মতো দেয়ালে হেলান দিয়ে ফ্লোরে বসে বাইরে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধর বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো সকালের অবস্থা দেখে। মেয়েটার অবস্থা পুরো বিধ্বস্ত লাগছে। স্নিগ্ধ গিয়ে সকালের পাশে বসে পড়লো। কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে সকাল পাশে তাকিয়ে স্নিগ্ধকে দেখে অনেক অবাক হলো। স্নিগ্ধ হালকা হেসে সকালের এলোমেলো চুলগুলো এক হাত দিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে দু’গালে হাত রেখে গভীর এক চুমু খেলো সকালের কপালে। আবেশে চোখ বুঁজে নিলো সকাল। স্নিগ্ধ কোনো কথা না বলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো ওকে। সকাল স্নিগ্ধর বুকে মাথা রেখে বুঝার চেষ্টা করছে যে স্নিগ্ধ এখানে কি করছে। ওর তো নীলামের সাথে থাকার কথা।
-“আপনি এখানে কেন ডাক্তার সাহেব?”
-“কেন আসতে পারি না?”
-“তা নয়। আপনি তো ব্যস্ত মানুষ। আপনি যে এখানে এসেছেন, আপনার কাজের কোনো ক্ষতি হবে না? তাই জিজ্ঞেস করলাম আর কি!”
-“স্যরি মিস বিকাল। আমি জানি তোমার মনে অনেক অনেক অভিমান জমা হয়েছে আমাকে নিয়ে। আমি সেগুলো সব ক্লিয়ার করে দিব। একটা সুযোগ দাও আমাকে বলার।”
-“(….)”
-“কিন্তু তার আগে নিজের দিকে তাকিয়ে দেখো তো! কি অবস্থা করেছো নিজের! তোমাকে এইভাবে মানায় না মিস বিকাল। চলো উঠো এখন। আগে ফ্রেস হয়ে গোসল করে আসো। এরপর খাবার খেতে হবে। তারপর সব বলবো তোমাকে।”
সকাল শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধর দিকে। আজ প্রায় এক সপ্তাহ পর দেখছে স্নিগ্ধকে নিজের সামনে। স্নিগ্ধর এই কেয়ারগুলো খুব মিস করেছে এতদিন। হুট করে কি যেন হলো সকালের। স্নিগ্ধর গালে হাত রেখে দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। মুচকি হেসে চোখ বুঁজে নিলো স্নিগ্ধ। সকাল একটু উঁচু হয়ে স্নিগ্ধর গালে টুপ করে একটা চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। গালে হাত দিয়ে হেসে ফেললো স্নিগ্ধ। সকালের দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই স্নিগ্ধকে হাত ধরে টেনে ওঠালো। স্নিগ্ধ সকালের নাক টেনে দিল। তারপর সকালকে গোসলে পাঠালো।
ঘন্টাখানেক পর ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজে পাশে তাকিয়েই হা হয়ে গেল স্নিগ্ধ। সাদা রঙের লং কামিজে কি অপরূপ লাগছে সকালকে। যেন সাদা রঙটা ওর জন্যই তৈরি। স্নিগ্ধর সব থেকে পছন্দের হলো সকালের ঘন কালো লম্বা চুলগুলো। যা হাঁটু ছাড়িয়ে নিচে চলে গেছে। সকালের হালকা কাশির শব্দে স্নিগ্ধর ঘোর ভাঙলো। ও বিছানা ছেড়ে উঠে এসে সকালকে ধরে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে দিল। সকাল কোনো কথা না বলে চুপচাপ তাকিয়ে রইলো আয়নার দিকে। সেখানে স্নিগ্ধকে দেখা যাচ্ছে। সকালের হাত থেকে তাওয়াল নিয়ে সুন্দর করে চুলগুলো মুছে দিতে লাগলো স্নিগ্ধ। চুল মুছে দিয়ে তাওয়াল বেলকনিতে মেলে রেখে এসে সকালকে নিয়ে সোফায় বসলো। সামনের টেবিলেই খাবার সাজানো রয়েছে।
-“খেয়ে নাও তাড়াতাড়ি। তুমি গতকাল থেকে কিছুই খাওনি। তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে তো এমনভাবে চললে। এখন কোনো কথা বলে খেয়ে নাও।”
-“খাবো না ডাক্তার সাহেব। ভালো লাগছে না খেতে।”
-“ভালো লাগছে না বললে তো হবে না, খেতে হবে।”
-“(….)”
সকাল চুপ করে খাবারের দিকে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধ বুঝতে পারছে সকাল তার বাবার ব্যাপারটা এখনো মেনে নিতে পারে নি। এটাই তো স্বাভাবিক। ও নিজেও তো বিশ্বাস করতে পারছে না যে আরিফুল ইসলাম এতটা জঘন্য ছিলেন। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্লেটে ভাত নিয়ে তার ভেতর তরকারি নিয়ে মাখিয়ে একলোকমা সকালের মুখের সামনে ধরলো। সকাল চোখ তুলে খাবারের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে স্নিগ্ধর দিকে তাকালো। স্নিগ্ধর মুখের মুচকি হাসিটা দেখে এক মুহূর্তের জন্য সবকিছু ভুলে গেল সকাল।
-“আমি খাইয়ে দিচ্ছি। এবার লক্ষ্মী মেয়ের মতো খেয়ে নাও তো।”
-“হুম। কিন্তু বেশি খাবো না।”
-“আচ্ছা ঠিক আছে।”
সকাল খেতে খেতে স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
-“আপনি খেয়েছেন?”
-“(….)”
-“আপনিও খান। তা না হলে কিন্তু আমি আর খাবো না।”
-“ব্ল্যাকমেইল করছো?”
-“যা ভাবেন আপনি।”
হাসলো স্নিগ্ধ। সকালকে খাইয়ে দেয়ার মাঝে মাঝে নিজেও খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষ হতেই হাত ধুয়ে সকালকে নিয়ে ছাদে চলে আসলো। দোলনায় পাশাপাশি বসলো দু’জন। স্নিগ্ধ একহাতে সকালকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে সকালের হাত ধরলো।
-“আমি জানি তুমি অনেক অভিমান করেছো। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার কথাগুলো শোনার পর তোমার যদি মনে হয় আমাকে শাস্তি দেওয়া উচিৎ, তবে তুমি আমাকে যে-কোনো শাস্তি দিতে পারো। আমি মাথা পেতে নিবো। ঠিক আছে!”
-“হুম।”
-“নীলাম সম্পর্কে আমার কাজিন হয়। আমি বরাবরই পড়াশোনায় একটু বেশি মনোযোগী ছিলাম যার কারণে কখনো মেয়েদের সাথে আমার ঠিক বনিবনা হয়ে ওঠেনি। আখি আলাদা ছিল। আখি যখন ছোট ছিল তখন মা ওকে অনাথ আশ্রম থেকে বাড়িতে নিয়ে আসে। ও আর আমি সমবয়সী ছিলাম। ওকে নিজের আপন বোনই ভাবতাম। আমার একমাত্র বন্ধু ও-ই ছিল। যখন ডাক্তারি পড়ছিলাম তখন আমার নীলামের সাথে পরিচয়। ওরা এখানে থাকতো না। আমি ডাক্তারি পড়ার সময় ওরা এখানে চলে আসে। আর তখনি নীলামের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়। প্রথম দেখা হওয়ার পরও ওর প্রতি তেমন কোনো অনুভূতি তৈরি হয়নি আমার। আমি যতটা পারতাম ওকে এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতাম। কিন্তু ও আমার পেছন ছাড়তো না। একপ্রকার জোর করেই আমার ঘাড়ে ঝুলে পড়েছিল বলতে পারো। কিন্তু ওর চঞ্চলতা আর পাগলামিতে ও ঠিক আমার মন জয় করে নিয়েছিল। একসময় আমিও ওর প্রেমে পড়ে যাই। আমাদের রিলেশনের ব্যাপারটা পরিবারের সবাই জানতো। বিয়ের কথাবার্তা চলছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন খবর পাই যে অফিসে যাওয়ার সময় না-কি ওর গাড়ির অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আর গাড়িটা খাদে পড়ে গেছে। খাদটা অনেক বেশি গভীর ছিল। পুলিশ আর উদ্ধারকর্মীরা মিলেও না-কি ওর লাশটা খুঁজে পায়নি। ওদের মতামত ছিল লাশটা হয়তো খাদের গভীরে পড়েছে তাই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি পুরোপুরিভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। সেদিন প্রচুর কেঁদেছিলাম আমি। ভালোবাসতাম যে ওকে তাই। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে ও আর বেঁচে নেই। আমার রুমে থাকা ওর ছবিটার সামনে দাঁড়িয়ে প্রতিদিন কথা বলতাম। আস্তে আস্তে নিজেকে একা করে ফেলেছিলাম। জীবিত থেকেও নিজেকে মৃত বানিয়ে ফেলেছিলাম। দুই বছরের সম্পর্ক ছিল আমাদের। কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক।”
এতটুকু বলে থামলো স্নিগ্ধ। ও খেয়াল করলো ওর হাতের ভেতরে এতক্ষণ সকালের যেই হাতটা শক্ত করা ধরা ছিল সেই হাতটা সকাল ছেড়ে দিয়েছে। এখন শুধু স্নিগ্ধ একাই ধরে আছে ওর হাত। মুচকি হেসে সকালের হাত উঠিয়ে হাতে চুমু দিয়ে শক্ত করে ধরলো হাতটা।
-“তারপর একদিন হুট করে তোমার সাথে দেখা হলো আমার। প্রথম যেদিন তোমাকে দেখলাম, সেদিন তোমার চেহারা সম্পূর্ণ রক্তে মাখামাখি হয়ে ছিল। তোমার বাঁচার সম্ভাবনাও কম ছিল। তুমি গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলে। তোমার চিকিৎসা করার পর যখন তোমার মুখের রক্তগুলো পরিষ্কার করা হয় তখন আমি এক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল যেন কোনো পরীকে দেখছি আমি। নীলামের পর ওই প্রথম কোনো মেয়েকে দেখে ধাক্কা খেয়েছিলাম আমি। তোমার নজর দেখেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম তুমি আমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছো। হসপিটালে যে ক’দিন ছিলে তোমার দুষ্টুমি দেখে আমি নিজেও প্রচুর হাসতাম। কিন্তু তা তোমার অগোচরে। তারপর যেদিন তুমি আমাকে ইনিয়েবিনিয়ে ভালো লাগার ব্যাপারটা জানাতে চাইছিলে সেদিন আমি তোমাকে আটকে দিই। এর কারণ আমি ভেবেছিলাম তুমি বাচ্চা মানুষ। তাছাড়া ওই বয়সটাই এমন ছিল। আবেগের বয়স, ভালো লাগার বয়স। তাই আমি তোমাকে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু উল্টো তুমি আমাকে ভুল বুঝলে।”
একটু থেমে আরেকটু নিবিড়ভাবে সকালকে জড়িয়ে ধরে আবারও বলা শুরু করলো স্নিগ্ধ।
-“দুই বছর পর আবারও তোমার সাথে দেখা হলো আমার। তখন বুঝতে পারলাম যে তুমি এখনো আমাতেই আটকে আছো। ভালো লেগেছিল ব্যাপারটা আমার। কোনো কথা না বলে, দেখা সাক্ষাৎ না করে, খোঁজ খবর না রেখেও যে কাউকে টানা দুইটা বছর ধরে পছন্দ করা যায় তা তোমাকে না দেখলে জানতাম না। তোমার পাগলামি, তোমার বাচ্চামো, তোমার দুষ্টুমি, তোমার হাসি, তোমার হাত নাড়িয়ে কথা বলার ধরন সবকিছু আমাকে মুগ্ধ করে তুলেছে। তোমাকে দেখে আমি নতুন করে বাঁচার অনুপ্রেরণা পেয়েছি। নতুন করে তোমাকে ভালোবাসার অধিকার পেয়েছি। আমি দূর্বল হয়ে গিয়েছি তোমার প্রতি। আমি নীলামের ওপর যতটুকু দূর্বল ছিলাম, তার থেকেও বেশি আমি তোমার উপর দূর্বল হয়ে পড়েছি। এতটাই দূর্বল হয়ে পড়েছি তোমার উপর যে তোমাকে হারাতেও ভীষণ ভয় হয় এখন। মনে হয় তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও তাহলে তো এবার আমি আর বাঁচবোই না। কিন্তু সেদিন যখন হুট করে নীলামকে নিজের সামনে দেখলাম তখন নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি আমি। একজনকে মৃত ভাবার পর তাকে হুট করে নিজের সামনে জীবিত দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলে যে কেউ আবেগে আপ্লূত হয়ে যাবে এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই। আমার ক্ষেত্রেও সেটাই হয়েছে। কিন্তু আমি তোমাকেও ভুলিনি। হসপিটালে যাওয়ার পর নীলামের অবস্থা অনেক বেশি খারাপ ছিল। ওকে এত বছর ধরে ড্রাগস দেওয়ায় ওর ব্রেইন রেসপন্স করতে চাইছিল না। আর ওই হসপিটালে আমার থেকে বেশি অভিজ্ঞ ডাক্তার আর কেউ ছিল না। তাই আমি নিজেই বাধ্য হয়েছিলাম ওর খেয়াল রাখতে। অপারেশনের পরও ওর জ্ঞান ফিরছিল না বলে চিন্তিত ছিলাম আমি। কিন্তু এতকিছুর ভেতরেও আমি অন্যান্য ডাক্তারদের কাছ থেকে তোমার খবর ঠিকই নিয়েছি। নীলামকে আমি একসময় কথা দিয়েছিলাম যে আমি ওর সকল বিপদে-আপদে ওর পাশে থাকবো। আমি শুধু সেই দায়িত্বটাই পালন করছিলাম। এর বেশি আর কিছুই ওর সাথে আমার নেই এখন। আমি যখন তোমাকে কথা দিয়েছি যে এই স্নিগ্ধ এখন থেকে শুধু তোমার, তখন এই স্নিগ্ধ শুধু তোমারই থাকবে। তোমার ডাক্তার সাহেব কখনো নিজের কথার খেলাপ করে না মিস বিকাল।”
সকালের মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠলো। এতদিনে ওর বুকের ভেতরে থাকা পাথরটা সরে গেল। ঝরে গেল স্নিগ্ধর উপর থাকা অভিমানগুলো। এবার সকাল নিজেও শক্ত করে ধরলো স্নিগ্ধর হাতটা। স্নিগ্ধ হেসে চুমু খেলো সকালের মাথায়। মৃদু কণ্ঠে বললো,
-“ভালোবাসি মিস বিকাল।”
চট করে স্নিগ্ধর বুক থেকে সরে এসে অবাক হয়ে স্নিগ্ধর দিকে তাকালো সকাল। এইমাত্র কি ও ঠিক শুনেছে! ওকে ভালোবাসি বলেছে স্নিগ্ধ? সকালের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে হাসলো স্নিগ্ধ। সকালের গালে দু’হাত রেখে আবারও বললো,
-“ঠিকই শুনেছো। ভালোবাসি তোমাকে। অনেক বেশি ভালোবাসি। আজকে যদি কথাটা না বলতে পারতাম তাহলে আমার বুকের ভেতরের ছটফটানি শান্ত হতো না। আমি দুঃখিত এতদিন তোমাকে এত এত কষ্ট দেওয়ার জন্য। কথা দিচ্ছি এরপর থেকে সজ্ঞানে থাকতে অন্তত কোনো কষ্ট পেতে দিব না তোমাকে।”
ছলছল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সকাল স্নিগ্ধর দিকে। যেন আজ সব পেয়ে গেছে ও। অবশেষে! অবশেষে নিজের ভালোবাসার মানুষটার মুখ থেকে ভালোবাসি শুনেছে। এই সময়টা যে কতটা মধুর লাগছে তা বলার মতো নয়। অপেক্ষা জিনিসটা বড্ড কঠিন। অপেক্ষা করার মতো ধৈর্য্যশক্তি সবার থাকে না। যাদের থাকে তারা অবশ্যই নিজের মন মতো ফল পায়। যেমন সকাল নিজের ধৈর্য্যশক্তির পরীক্ষা দিয়ে স্নিগ্ধকে জিতে নিয়েছে আজ। দুটো ঢোক গিলে কোনো কথা না বলে শক্ত করে স্নিগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ গুঁজে কেঁদে দিল। স্নিগ্ধ কিছু বললো না। ও জানে এই কান্না খুশির কান্না। ও নিজেও দু’হাতে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সকালকে। ওর চোখের কোণেও পানি রয়েছে। এখন আর কোনো ভয় নেই। ওর সকাল এখন ওরই আছে আর ওরই থাকবে।
ছাদের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে একধ্যানে তাকিয়ে আছে অনুভব। বুকের ভেতরটা হাহাকার করছে। কিন্তু কিছু করার নেই ওর। হুট করে নিজের অজান্তেই যাকে ভালোবেসেছিল তাকে অন্য কারো বুকে দেখে সহ্য হচ্ছে না ওর। কিন্তু ও যাকে ভালোবাসে সে তো ভালোবাসে স্নিগ্ধ নামের ছেলেটিকে। বর্তমানে সে তার বুকেই আছে। অনুভবের চোখ দুটো লাল হতে লাগলো। কান্না আটকানোর ব্যর্থ চেষ্টা না করে সেখান থেকে সরে ছাদের অন্যপাশে চলে গেল ও। যে করেই হোক ওকে ভুলতে হবে সকালকে। কারণ সকাল যে এখন অন্যকারো।
নীলামের কেবিনের ভেতরে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধ। সকালের সাথে কথা বলে সবকিছু ঠিকঠাক করে ফেলেছে প্রায় দেড় সপ্তাহ আগে। সামনের মাসেই ওদের বিয়ে। হাতে আছে আর মাত্র কিছুদিন। এর আগেই ও নীলামকে সবকিছু বুঝিয়ে বলতে চায়। ও চায়না নীলাম নিজের মনে কোনো ভুল ধারণা পুষে রাখুক। ও নিজের জীবনে অনেক আগেই মুভ অন করে ফেলেছে। এখন নীলামকেও মুভ অন করতে হবে। আর তার জন্য আজ ওর সাথে কথা বলা খুব প্রয়োজন।
-“কখন থেকে দেখছি দাঁড়িয়ে আছো চুপচাপ। কি হয়েছে স্নিগ্ধ?”
-“আমি তোমার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। আই মিন কিছু কথা ক্লিয়ার করতে চাই।”
-“কি কথা?”
-“দেখো নীলাম তোমার আর আমার ভেতরে যা ছিল সব অতীত। আমি নিজের বর্তমানটাকে সকালের সাথে সাজিয়ে ফেলেছি। কিছুদিন পরে আমাদের বিয়ে। আমি চাইছি না কোনো পুরনো সম্পর্কের কথা মনে রেখে তুমি এভাবেই থেমে থাকো। আমি যেমন অতীত ভেবে উড়িয়ে দিতে পেরেছি, ঠিক একইভাবে তুমি আমাদের পুরনো কথাগুলো অতীত ভেবে উড়িয়ে দাও। হ্যা তুমি আমার প্রথম ভালোবাসা ছিলে। আর তাই কখনো আমি তোমাকে ভুলতে পারবো না। আমার মনের কোণে এক সুপ্ত স্থানে কোথাও হয়তো লুকায়িত থাকবে তুমি। কিন্তু দয়া করে আমার সাথে নিজের ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখো না। আমি এখন সকালকে ভালোবাসি। আমার জীবনটা আমি ওর সাথেই রাঙাতে চাই। তুমিও নতুন কাউকে নিয়ে সুখী হও। আশা করি তুমি আমাকে বুঝবে। আর যদি অবুঝ হয়ে কিছু উল্টো-পাল্টা করার চেষ্টা করো, তাহলে মনে রাখবে এই স্নিগ্ধ একবার কাউকে ঘৃণা করতে শুরু করলে তার কিন্তু মরা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না।”
-“(….)”
নীলাম কিছু বলতে পারলো না। শুধু অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে রইলো স্নিগ্ধর দিকে। স্নিগ্ধ এতটা কঠোর হয়ে গেছে? এটা কোন স্নিগ্ধ? এই স্নিগ্ধকে চিনতে পারছে না নীলাম। স্নিগ্ধ আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। বাইরে এসে বড় বড় করে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিলো। ওর চোখেও পানি টলটল করছে। আজ এতটা কঠোর না হলে নীলাম থেকে কখনো নিজের পিছু ছাড়াতে পাড়তো না স্নিগ্ধ। যতই হোক একসময় ভালোবেসেছিল নীলামকে। তাই কঠোর কথা শুনিয়ে এখন নিজেই কষ্ট পাচ্ছে। তবে স্নিগ্ধ এই ক্ষণিকের কষ্টকে প্রাধান্য দিল না। সে চলতে লাগলো সকালের সাথে নিজের ভবিষ্যৎ গড়তে।
ছাদে পাটি বিছিয়ে তার উপর বসে আছে সকাল। ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে শুয়ে ছোট বাচ্চাদের মতো সকালের ওড়নার আঁচলে গিট বাঁধার চেষ্টা করছে স্নিগ্ধ। তা দেখে খিলখিল করে হাসছে সকাল। ওড়নায় গিট বাঁধা বাদ দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধ সকালের হাসির দিকে। সময় আসলেই বহমান। কীভাবে কীভাবে দেখতে দেখতে বিয়ের চারমাস পাড় হয়ে গেল তা বুঝতেই পারলো না ওরা। স্নিগ্ধকে নিজের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে লজ্জা পেয়ে চোখ নিচে নামিয়ে নিলো। প্রতিবারের মতো এবারও সকালের লজ্জামাখা মুখ দেখে মুগ্ধ হলো স্নিগ্ধ।
-“আচ্ছা আফি আর পরশের কাবিন হয়ে গেছে?”
-“নাহ! আগামী সপ্তাহে কাবিন হবে। পরশের বাবা-মা মানতে চাইছিল না। কিন্তু পরশ জোর করে রাজি করিয়েছে। বলেছে আফি প্রেগন্যান্ট ছিল। আর বাচ্চাটা ওর ছিল। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত একটা অঘটনের শিকারে বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছে। ব্যস! আর কি লাগে! এই কথা শোনার পর পরশের বাবা-মা না চাইতেও রাজি হতে বাধ্য হয়েছে।”
-“বাহ! এই নাহলে ছেলে!”
-“সত্যি আফি কত ভাগ্যবতী যে ও পরশের মতো এত ভালোবাসার একটা মানুষ পেয়েছে।”
-“আচ্ছা তাহলে তুমি কি! আমি কি তোমাকে ভালোবাসি না? না-কি আমি মানুষ না!”
-“আমি সেই রকমভাবে বলতে চাই নি।”
-“তো কি রকমভাবে বলতে চেয়েছো?”
-“উফফ… ডাক্তার সাহেব! কি শুরু করলেন আপনি?”
-“এখনো তো কিছুই শুরু করলাম না। করবো না-কি!”
স্নিগ্ধ চোখ মেরে কথাটা বলতেই লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো সকাল। এই লোকটা আজকাল বড্ড অসভ্য হয়ে গেছে। যখন যা মুখে আসবে তাই বলে দিবে। সকালের যে লজ্জা লাগে তা কি বুঝে না স্নিগ্ধ? স্নিগ্ধ সকালের চুল নিয়ে খেলা করতে লাগলো। কিছু একটা মনে পড়তেই স্নিগ্ধ বললো,
-“আচ্ছা অনুভব আমাদের বিয়ের দিন এত তাড়াতাড়ি চলে গেল কেন? না মানে বিয়েটা না দেখেই চলে গিয়েছিল বলে জিজ্ঞেস করলাম।”
-“ভাইয়ার কি যেন জরুরি কাজ পড়ে গিয়েছিল। তাই যেতে বাধ্য হয়েছে।”
-“ওহ আচ্ছা।”
এই বিষয়ে আর কোনো প্রশ্ন করলো না স্নিগ্ধ। কারণ ও জানে অনুভব জরুরি কাজের বাহানা দিয়েছে মাত্র। আসলে তো ও সকালকে অন্যকারো হতে দেখতে পারবে না বলে চলে গিয়েছিল। স্নিগ্ধ অনুভবের চোখে ভালোবাসা দেখেছে সকালের প্রতি। কিন্তু সেই ভালোবাসাটা অনুভব নিজের ভেতরেই রেখে দিয়েছে। স্নিগ্ধর খারাপ লাগছে বিষয়টা। কিন্তু কিছু করার নেই। এই মেয়েটার ভেতরে ওর জান বাস করে এখন। কোনোভাবেই ও হারাতে চায় না সকালকে।
-“নীলাম আপু কেমন আছে?”
-“হয়তো ভালোই আছে। আমার সাথে যোগাযোগ নেই তাই জানি না। মায়ের কাছ থেকে শুনলাম আগামী সপ্তাহে না-কি ওর মালেশিয়ার ফ্লাইট আছে। ও ওখানে চলে যাচ্ছে পার্মানেন্টলি।”
-“দেখা করবেন না!”
-“কি দরকার শুধু শুধু?”
-“এখনো ভালোবাসেন আপুকে?”
সকালের প্রশ্ন শুনে স্নিগ্ধ উঠে বসলো। দু’হাতে সকালের মুখ ধরে ওর চোখে চোখ রেখে বললো,
-“আমি শুধু তোমাকে ভালোবাসি মিস বিকাল।”
-“আমিও আপনাকে ভালোবাসি ডাক্তার সাহেব।”
ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে রইলো স্নিগ্ধ সকালের দিকে। সকাল নিজেও তাকিয়ে আছে স্নিগ্ধর চোখে চোখ রেখে। মুখটা আরও একটু উঁচু করে ধরে নিজের ওষ্ঠ দ্বারা ছুঁয়ে দিল সকালের অধরজোড়া। দু’হাতে স্নিগ্ধর পিঠ খামচে ধরলো সকাল। গভীর চুম্বন পর্ব শেষ করে সরে এলো স্নিগ্ধ। সকাল চোখ বন্ধ করে জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে। মুচকি হাসলো স্নিগ্ধ। সকালকে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“জানো এই সন্ধ্যার সময়টার সাথে আমার একটা কানেকশন আছে।”
-“কি রকম?”
-“এমনই এক সন্ধ্যায় নীলামের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল। এমনই এক সন্ধ্যায় ওর সাথে আমার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। এমনই এক সন্ধ্যায় ওকে হারিয়ে ফেলেছিলাম আমি। আবার এমনই এক সন্ধ্যায় তুমি আসলে আমার জীবনে। এমনই এক সন্ধ্যায় তোমায় দেখে প্রথমবার আমার হৃদস্পন্দন আমার অবাধ্য হয়েছিল। এমনই এক সন্ধ্যায় তুমি প্রথম আমার বুকের মাঝে ছিলে। এমনই এক সন্ধ্যায় তুমি আমাকে প্রথম ভালোবাসি বলেছিলে। এমনই এক সন্ধ্যায় তোমায় দেখে থমকে গিয়েছিলাম আমি। এমনই এক সন্ধ্যায় প্রথমবার তোমার গালে আমি নিজের ঠোঁট ছুঁইয়েছিলাম। এমনই এক সন্ধ্যায় আমার মন আমাকে জানান দিয়েছিল আমি তোমাতে আসক্ত আর তোমাকেই ভালোবাসি। আর অবশেষে এমনই এক সন্ধ্যায় আমি তোমাকে পুরোপুরিভাবে নিজের করে নিয়েছি তোমায় বিয়ে করে। সেই সন্ধ্যা গুলো একটাও ভোলার মতো নয়। প্রত্যেকটা সন্ধ্যা আমার স্মৃতির পাতায় সোনালী স্মৃতি হিসেবে জমা হয়ে আছে।”
-“পরবর্তী সন্ধ্যা গুলোতেও আমরা নিজেদের আরও অনেক স্মৃতি তৈরি করবো। আশা করি সেই সন্ধ্যা গুলোও আমাদের মনে দাগ কেটে থাকবে।”
-“হয়তো। কিন্তু যেই সন্ধ্যায় আমি তোমায় পেয়েছি সেই সন্ধ্যাকে কখনো ভুলতে পারবো না। কারণ তোমায় না পেলে হয়তো আমি আজও নিঃস্ব হয়েই থাকতাম।”
-“আর আপনাকে না পেলে আমি জানতেই পারতাম না আমাকেও কেউ এতটা ভালোবাসতে পারে।”
-“আজকে আবারও তোমাকে আমার ভালোবাসার চাদরে মুড়ে নিবো।”
সকাল লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নিজের জামা খামচে ধরলো। স্নিগ্ধ মুচকি হেসে সকালকে কোলে নিয়ে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে নামতে বললো,
-“তুমি লজ্জা পেতে থাকো। আমি লজ্জা ভাঙতে থাকবো। তবুও মনে হয় না তোমার লজ্জা যাবে। কিন্তু তোমাকে লজ্জা পেলেই বেশি মানায়।”
সকালের এত বেশি লজ্জা লাগলো কথাটা শুনে যে ও দু’হাতে স্নিগ্ধর গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে রইলো। লজ্জায় শরীর কাঁপতে লাগলো ওর। স্নিগ্ধ আরও বেশি হাসলো। বললো,
-“আবারও এমনি কোনো এক সন্ধ্যায় তুমি, আমি আর আমাদের সাথে থাকবে একজন নতুন অতিথি। অপেক্ষায় আছি সেই সন্ধ্যার।”
-“আপনি আসলেও অসভ্য।”
কথাটা বলেই স্নিগ্ধর কাঁধে একটা থাপ্পড় দিয়ে আবারও ওর বুকে মুখ গুঁজলো সকাল। হাসতে লাগলো স্নিগ্ধ। এভাবেই হয়তো একের পর এক সন্ধ্যা কেটে যাবে ওদের দুষ্টু মিষ্টি ভালোবাসার সংসারের সাক্ষী হয়ে।
বেঁচে থাকুক পৃথিবীর সকল ভালোবাসা।
…..সমাপ্ত…..
নোটঃ ধন্যবাদ আপনাদের সবাইকে পুরো গল্পটায় পাশে থাকার জন্য। অবশেষে “সেই সন্ধ্যা” গল্পটা শেষ করতে পারলাম। আপনাদের সকলকেও ধন্যবাদ, আপনারা এই গল্পকে অনেক ভালোবাসা দিয়েছেন তার জন্য। খুব শীঘ্রই নতুন গল্প নিয়ে আবারও ফিরে আসবো। সবাই ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন। আল্লাহ হাফেজ।