#বিবর্ণ_জলধর
#লেখা: ইফরাত মিলি
#পর্ব: ২৩
_____________
রাতের তমসা কাটিয়ে ফুঁটেছে সকালের আলো। ধীরে ধীরে রোদের তেজ বেড়ে চলছে। ঔষধের রেশ কাটিয়ে মিহিকের নিদ্রা ভাঙলো সকাল আটটায়। প্রথমে কিছু একটা ঘাপলা ঠেকলো তার কাছে। যখনই মনে হলো সে ফ্লোরের বিছানায় নেই সঙ্গে সঙ্গে ধরফরিয়ে উঠলো। তাকিয়ে দেখলো সে খাটে। মিহিকের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খেয়ে উঠলো। কীভাবে সম্ভব? এখানে কী করে এলো?
শ্রাবণ ওয়ার্ডোব থেকে ফাইল বের করছিল । মিহিক উঠেছে টের পেয়ে বিছানায় তাকালো। মিহিক বিস্ময়ে আছে মুখ দেখেই বোঝা গেল। সে কিছুটা নিকটে এসে শুধালো,
“স্যরি! আপনি নিষেধ করার পরও গতরাতে আপনার বিনা অনুমতিতে আপনাকে স্পর্শ করেছিলাম। আপনি যদি জেদ না করে আমার কথা শুনতেন তাহলে আমাকে এটা করতে হতো না। ইদানিং আপনার জেদ সহ্য হয় না আমার।”
মিহিক বিহ্বল তাকিয়ে রয়। বুঝতে পারে তার নিদ্রাকালীন সময়ে শ্রাবণ তাকে নিচ থেকে খাটে এনে শুইয়েছে। না চাইতেও একটু লজ্জা পায় সে। চোখ নত হয়ে আসে।
“আজ থেকে খাট আপনার, আর ফ্লোর আমার। চুক্তি করে ফেলেছি আমি। চুক্তি ভঙ্গ করার চেষ্টা করবেন না।” সাবধান করলো শ্রাবণ।
মিহিক দ্বিরুক্তি করে না। শ্রাবণ আবার বললো,
“আর স্লিপিং পিল খেয়ে দেরি করে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ কাযা করা উচিত হয়নি আপনার। রাগ এমনি দেখান, ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমাতে হবে কেন?”
মিহিক এবার মুখ খুললো,
“আপনাকে কে বললো আমি রাগ করে ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছি?”
“আপনার রাগ বলেছে। ইদানিং আপনার রাগের সাথে কথা হয় আমার।”
মিহিক ক্ষেপে গিয়ে বললো,
“আপনার এটা করা একদম উচিত হয়নি।”
“কোনটা?”
“এই যে ফ্লোর থেকে খাটে স্থানান্তর করেছেন।”
শ্রাবণ প্রত্যুত্তর দিলো না। ফাইল হাতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা থেকে এক পা দূরত্বে থেমে হঠাৎ বললো,
“আপনি তো ফ্লোর বিছানায় দিব্যি শান্তিতে ঘুমান, তাহলে গত রাতে আমি কেন একটুও ঘুমাতে পারলাম না? আপনি কি আমাকে বদ দোয়া দিয়েছেন ঘুমানো নিয়ে?”
মিহিকের কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। শ্রাবণ না তাকিয়েও বুঝলো মিহিকের মুখে এখন রাগের আবির্ভাব ঘটেছে। তাই বললো,
“এত রাগ-জেদ ভালো নয়। রাগ-জেদ কমিয়ে আমার সাথে ভালো আচরণ করার চেষ্টা করুন। সেটাই ভালো হবে।”
শ্রাবণ আর না দাঁড়িয়ে চলে গেল। পিছনে ফেলে গেল একটি দ্বিধান্বিত মন।
________________
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যায় পড়তে চলেছে। বাইরে বৃষ্টি চলছে একাধারে। নোয়ানা, তিন্নি আটকা পড়েছে কবির সাহেবের বাড়িতে। বিকেলে এসেছিল। লায়লা খানম আসতে বলেছিলেন। হবু বউ মা’র পরিচয়-টরিচয় করিয়ে দিলেন ওদের সাথে। সিনথির মা-বাবা বাসায় ছিল না, সকালে বড়ো ভাইয়ের বাসায় গিয়েছে। সিনথির এমনিই আগ্রহ ছিল না তাদের সাথে যাওয়ার, আর নোয়ানাকে দেখার জন্যও রয়ে গেছে। পুরো সময়টা সিনথি নোয়ানাকে খুঁটিয়ে-নাটিয়ে দেখেছে।
ব্যাপারটা নোয়ানার চোখ এড়ায়নি। মেয়েটা এমন করে দেখছিল কেন তাকে? মন জানান দিলো আষাঢ় কিছু গন্ডগোল করেছে। এই ত্যাদড় ছেলেটা সত্যি একটা ত্যাদড়। হবু বউয়ের কাছে কী বলেছে তার সমন্ধে? মেয়েটা এমন করে দেখলো কেন তাকে?
অপেক্ষার পরও যখন বৃষ্টি থামলো না, নোয়ানা আর তিন্নি তখন কবির সাহেবদের বাড়ি থেকে দুটো ছাতা নিয়ে বাড়ি ফিরলো। ততক্ষণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আজানও পড়ে গেছে।
আষাঢ় সারা বিকেল বাড়ি ছিল না। নোয়ানা আসবে সেটা তো জানতো না সে। বাইরে ঘোরাঘুরি করছিল কারিবকে নিয়ে। বাড়ি ফিরতে কবির সাহেব মসজিদে যাওয়ার আহ্বান করলেন। আষাঢ় বাবার কথা ফেলতে পারে না। একই সাথে ভাই, বাবা, কারিবের সাথে নামাজ পড়ে এলো মসজিদে।
রুমের লাইট অফ করে রুম অন্ধকার করে রেখে গিয়েছিল। লাইট অন করে সিনথিকে রুমের ভিতর দেখে পিলে চমকে উঠলো।
“তুমি?”
সৌন্দর্যে দ্বিগুণ সৌন্দর্য ঢেলে সিনথি হেসে বললো,
“আমার হবু বরের রুম এটা। এখানে আসা-যাওয়ার আলাদা একটা অধিকার আছে না আমার?”
“আসা-যাওয়ার কী দরকার? পার্মানেন্ট থাকা শুরু করো এখানে। দখল করে নাও আমার রুম।”
“পারলে সেটাই করতাম। আধা ভাগ করে নিতাম রুমটা। কিন্তু সেটা করার জন্য আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। আমাদের বিয়ে না হওয়া অবধি।”
“বিয়ের চিন্তা বাদ দাও। বিয়ে করবো না তোমায়।”
আষাঢ় দেয়ালের কাছ থেকে সরে খাটের উপর এসে বসলো।
সিনথি বললো,
“তোমার রিয়েল লাভের সাথে দেখা হলো আজ।”
আষাঢ় তার গার্লফ্রেন্ড লিন্ডাকে একটা ম্যাসেজ পাঠাতে নিয়েছিল, সিনথির কথায় থমকে গিয়ে তাকালো তার দিকে।
সিনথি হাসলো আর বললো,
“নোয়ানা। তোমার ভাবির বোন। মনটা তার কাছে বন্ধক রেখেছো, তাই না?”
“কীভাবে জানতে পারলে?”
“তুমিই তো বলেছিলে ধীরে ধীরে টের পাবো। তো সেভাবেই টের পেলাম।”
“কখন দেখা হলো? কীভাবে হলো?”
“বাড়িতে এসেছিল।”
আষাঢ় বিরক্তিকর শব্দ করে বললো,
“বাড়িতে এসেছিল সেটা তুমি এখন জানাচ্ছ? যখন বুঝতে পেরেছো ও আমার রিয়েল লাভ, তাহলে ও থাকতে কেন ফোন করে ডাকোনি? ওর সাথে এমনিতেই খুব একটা দেখা সাক্ষাৎ হয় না, আজ বাড়িতে দেখা হয়ে যেত। কিন্তু তুমি সুযোগটা করে দিলে না।”
সিনথি আবারও হেসে ফেলেলো।
“তুমি আসলেই অনন্য আষাঢ়।”
“সব মেয়েরাই এটা বলে। শুনতে ভালো লাগে, কিন্তু তোমার মুখে শুনতে বিরক্ত লাগলো।”
“কী দেখলে তুমি নোয়ানার মাঝে? আমাকে বলো তো। আমি এমন কিছু দেখতে পেলাম না যার কারণে তুমি ওর জন্য আমাকে রিজেক্ট করবে!”
“ওর মাঝে অনেক কিছু আছে, যেটা তোমার মাঝে নেই। বিষাদ নেই তোমার মাঝে।”
“হোয়াট?” প্রশ্নটা করতে করতে সিনথির ভ্রু কুঁচকানো ভাবটা গাঢ় হলো।
“বিষণ্ন ঘেরা মুখ আমার একটু বেশিই প্রিয়। মেয়েদের হাস্যজ্জ্বল মুখও কম প্রিয় না। তবে বিষণ্ন ঘেরা মুখ বেশি পছন্দ করি। তোমার চেহারায় সেটা নেই। তোমার চেহারায় যা আছে তা হলো বিরক্তি। তোমার মুখ দেখলে আমি বিরক্ত হই। তুমি আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে, কিন্তু আফসোস! তোমার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ কাজ করে না। তোমার প্রতি বিরক্ত লাগে আমার।”
আষাঢ়ের কথায় সিনথি কষ্ট পেয়েছে এমন কিছু ফুঁটে উঠলো না তার মাঝে। সে নির্লিপ্তকার চেয়ার ছেড়ে আষাঢ়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। আষাঢ়ের পরিপাটি চুল হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিতে দিতে বললো,
“বিরক্তিতে ডুবিয়ে মারবো তোমাকে। হাত-পা ভেঙে দেবো যাতে সাঁতার কেটে উপরে না উঠতে পারো। তীরে ওঠা তো দূরের কথা। নোয়ানাকে ভুলে যাও। বিয়ে আমার সাথে হবে, ওকে মনে রেখে লাভ কী? নেই কোনো লাভ। ভুলে যাও ওকে।”
আষাঢ় সিনথির হাতটা ছিটকিয়ে মাথা থেকে সরিয়ে দিয়ে রাগী চক্ষুতে বললো,
“গেট লস্ট।”
_______________
একটু আগে বৃষ্টি থেমে আবার শুরু হয়েছে। বৃষ্টি পছন্দ নয় মিহিকের। একটু ভিজলে জ্বর আসবে নিশ্চিত। তবুও জানালা খুলে হাত বাড়িয়ে আছে বাইরে। অজস্র বৃষ্টি কণিকা ছুঁয়ে দিচ্ছে নিজ পরশে। শীতল অনুভূতি। মিহিকের অনুভূতিগুলোও হিম শীতল। এত শীতল অনুভূতি তার আর কোনো কালে ছিল না। কিন্তু শ্রাবণের প্রতি তার অনুভূতি এমনই। একটা কালো অভিমানের পর্দা আবার ঢেকে রেখেছে অনুভূতিগুলোকে। তার হৃদয়ে শ্রাবণ নামের বারি ধারা ঝরে। হৃদয় জমিন ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়। তবুও সেই কাঙ্ক্ষিত মানুষটি হৃদয়ের খবর নেয় না একবার। লোকটা কবে বুঝবে তাকে? অপেক্ষা, ধৈর্য আর ভালো লাগে না মিহিকের। আরও কিছু সময় বৃষ্টিতে হাত বাড়িয়ে রেখে, হাত গুটিয়ে আনলো সে। শ্রাবণ এই সময়ে রুমে নেই। কোথায় গিয়েছে কে জানে। রুমকির সাথে কথা বলছে নিশ্চয়ই। বৃষ্টি তো, ছাদে নেই এখন। লাইব্রেরি রুমে হয়তো কথা বলার পালা সারছে। মিহিক জানালা বন্ধ করে দিলো। হাত ভালোভাবেই ভিজেছে। মুছে নিলো। রাত্ৰ এখন এগারোটা। ডিনারের কার্য ন’টাতেই সম্পন্ন হয়েছে। মিহিক খাটে এসে বসলো। বিছানায় হাত বুলাতে বুলাতে অভিমান ভরাট কণ্ঠে বললো,
“আমি চাই না এই বিছানা। যে বিছানায় এক সাথে থাকা হবে না, সে বিছানার দরকার নেই আমার।”
মিহিক উঠে গেল। ক্লোজেট থেকে তোষক আর বেডশিট বের করলো। বৃষ্টি হওয়ার কারণে শীত পড়েছে। কম্বল আছে, ইচ্ছা করেই বের করলো না। হাতের তোষকটা ছুঁড়ে ফেললো ফ্লোরে। ঠিক করে তার উপর চাদর বিছাতে লাগলো। দরজা খোলার শব্দ হলো ঠিক তখনই। শ্রাবণের প্রবেশ ঘটলো। সে এতক্ষণ লাইব্রেরি রুমে ছিল। রুমকি সারাদিনে একটা কল দেয়নি। রাগ করে আছে বলে নিজে একবার কল দিয়েছিল। কিন্তু রুমকির ফোন বন্ধ পেল। রুমে এসে মিহিককে এমন করতে দেখে বললো,
“আপনি আবার কী শুরু করেছেন?”
“আমার যা ইচ্ছা আমি তাই শুরু করবো। আপনার কী তাতে?” মিহিক না থেমে উত্তর দিলো।
শ্রাবণের রাগ হলো। মিহিকের কাছে এসে ফ্লোর থেকে তোষকটা গুটিয়ে দুই হাতে নিয়ে বললো,
“আমার বিছানা আমি নিজে ঠিক করতে পারি।”
শ্রাবণ ভালো করে জানে মিহিক তার জন্য বিছানা ঠিক করে দিচ্ছে না, নিজের জন্য করছে। তবুও অহেতুক কথাটার ব্যবহার করলো।
মিহিক নিজের অভিমানিনী চোখ না লুকিয়ে বললো,
“আমি ঘুমাবো না আপনার বিছানায়।”
তাৎক্ষণিক শ্রাবণের রাগ আরও বাড়লো। হাতের তোষক ফেলে দিয়ে, এক পা সামনে এগিয়ে এসে চাপা আক্রোশে বললো,
“কেন ঘুমাবেন না? এত জেদ কেন আপনার? আমার বিছানায় ঘুমালে কি আপনার সৌন্দর্য কমবে? অসুন্দর হয়ে যাবেন আপনি? কাল তো ঘুমিয়েছেন, কিছু ক্ষতি হয়েছে আপনার?”
মিহিকও জেদি। সেও এক পা সামনে এগিয়ে এসে বললো,
“হ্যাঁ ক্ষতি হয়েছে। অনেক বড়ো ক্ষতি হয়েছে আমার। সে ক্ষতি তো আর আপনার দেখার চোখ নেই।”
“তাহলে তো আজও ক্ষতি হবে আপনার। ফ্লোরে বিছানা করে শোবেন, সে বিছানায় তো কাল ঘুমিয়েছি আমি। এটাতে ঘুমালে আপনার ক্ষতি হবে না?”
“হবে হয়তো। তাও আপনার বিছানায় ঘুমানোর থেকে কম যন্ত্রণাদায়ক হবে।”
শ্রাবণ মিহিকের দুই হাতের বাহু শক্ত করে চেপে ধরে, রক্তচক্ষুতে বললো,
“এত জেদ দেখাবেন না মিহিক। আপনার জেদ দেখতে দেখতে আমিও জেদি হয়ে উঠছি। আপনি যেমন খাটে ঘুমাবেন না বলে জেদ ধরতে পারেন, তেমনি আমিও জেদ ধরতে পারি আপনি খাটে ঘুমাবেন।”
মিহিকও স্থির তাকিয়ে আছে। দু চোখে রাগ।
“আপনি…”
কিছু বলতে চাইলে শ্রাবণ আর সেই সুযোগ দিলো না তাকে। হুট করে মিহিককে পাঁজা কোলে তুলে নিলো সে।
অকস্মাৎ এই ঘটনায় মিহিক নিজের বাক হারালো। বিস্ময়ে বিহ্বল সে। বিস্ময়াবিষ্ট অক্ষি পরম বিস্ময়ে দেখছে শ্রাবণকে। শ্রাবণ সেই চোখে তাকিয়ে থেকে বললো,
“ফেলে দেবো ফ্লোরে? মাথা ফাটিয়ে দেবো? দেবো?”
মিহিক নির্বাক। দু চোখে শুধু বিস্ময়, অবিশ্বাসের ঘোর।
শ্রাবণ হাসলো। মিহিককে নিয়ে গিয়ে সেদিনের মতো খাটে শুইয়ে দিলো। মিহিক একটা শব্দ উচ্চারণ করতে পারলো না। গলা দুর্বল, মস্তিষ্কে কথা জমা নেই। সে নিশ্চল।
শ্রাবণ বললো,
“আর কখনো যদি দেখেছি নিচে ঘুমানোর চেষ্টা করেছেন, তবে সত্যি সত্যি ফ্লোরে ফেলে দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেবো। মনে রাখবেন।”
শ্রাবণ সরে গেল সামনে থেকে। মিহিক স্তব্ধ। কী হলো এটা? এই মুহূর্তে একটা সিদ্ধান্ত নিলো সে, আজ থেকে সে এই খাটেই ঘুমাবে।
_________________
“সিনথিয়া মেয়েটা কেমন?”
“খারাপ না, ভালোই।”
“কিন্তু তোমার বলার ধরণটা খারাপ। ‘খারাপ না’ মানে কী বোঝালে? ওর মোটামুটি প্রশংসা করছো তুমি?”
“আমি সেরকমটা বোঝাইনি।” স্পষ্ট উত্তর দিলো আষাঢ়।
কবির সাহেব বললেন,
“আমি চাইছি সিনথিয়ার সাথেই তোমার বিয়েটা হোক।”
আষাঢ় বুক সেলফের কাছ থেকে পিছন ঘুরে বাবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“বিয়ে নিয়ে আমি এই মুহূর্তে ভাবতে চাইছি না আব্বু। দেখাশোনাটা এখন হলেও বিয়েটা যেন কয়েক বছর পরে ফিক্সড হয়।”
“হ্যাঁ, মেয়ের বাবাদের তো ঠ্যাকা পড়েছে তোমার জন্য মেয়ের বিয়ে না দিয়ে রেখে দেবে।”
“রাখবে না কেন? ও মেয়ের কি বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে? বয়স পার হয়ে গেলেও তখনই বিয়ে করবো।”
“আমি কোনো কথা শুনতে চাইছি না। তুমি বাংলাদেশ থাকতেই বিয়েটা হবে।”
আষাঢ় চুপসে গেল। বাবাকে মান্য করে সে, বাবার উপর এখন কথা বলা অনুচিত মনে হলো। কিছুক্ষণ নীরব তাকিয়ে থেকে চলে গেল সে। যে বই খোঁজাখুঁজি করলো সে বই আর নেওয়া হলো না।
কবির সাহেব জানালার কাছে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকা কারিবের উদ্দেশ্যে বললো,
“আষাঢ়ের মতিগতি কী বলো তো? তুমি তো সব সময় ওর সাথে থাকো, কী করবে ও? বিয়েটা করবে তো?”
কারিব উত্তরহীন। সে জানে আষাঢ় কিছুতেই এ বিয়ে করবে না। কিন্তু সেটা কবির সাহেবকে কী করে বলে? মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে বললো,
“আশা করছি করবে।”
করিডোর দিয়ে যাওয়ার সময় রুপালির সাথে দেখা হয়ে গেল আষাঢ়ের। রুপালির হাতে চায়ের ট্রে। লাইব্রেরি রুমে কবির সাহেবের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। মাঝ পথে আষাঢ় তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“হেই রুপালি দাদি, আর কখনো যদি তোমাকে আমার রুম অথবা কারিবের রুমে আড়ি পাততে দেখেছি, তবে চুলের আগা ঘ্যাঁচ করে কেটে দেবো।”
রুপালি বিরক্ত মিশ্রিত কণ্ঠে বললো,
“হুনো আষাঢ়, তোমারে হাজার-লক্ষ্য বার কইছি আমারে রুপালি দাদি বলে ডাকবা না। কখন আমি তোমার আর কারিবের রুমে আড়ি পাতি? কোনো প্রমাণ আছে তোমার কাছে?”
রুপালি জোরের সাথে কথা বললেও তার ভিতরটা দুরুদুরু। সে তো মাঝে মধ্যে আড়ি পেতে থাকে কারিব আর আষাঢ়ের রুমে। ওরা কী বিষয়ে কথা বলে জানতে চায়। কিন্তু সেটা আষাঢ় টের পেল কীভাবে?
“আমাদের উপর নজর রাখা বন্ধ করো রুপালি দাদি। যদি চুলের প্রতি মায়া থাকে তাহলে আরকি।”
আষাঢ় অধরে বাঁকা হাসি ধরে চলে গেল। রুপালি পিছনে দাঁড়িয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,
“খচ্চর পোলা!”
_________________
উত্তপ্ত দুপুর। রোদের তেজ তুমুল। একটু পরপর যে বাতাস আসে তাও খুব উষ্ণ। নোয়ানা রাস্তার পাশ ধরে হাঁটছে। গরমে তার মুখ মন্ডলে ঘাম ঝরছে। একটা ছাতা ছায়া হয়ে তার মাথার উপর থেকে রোদ আড়াল করে রেখেছে। আর ছাতাটা তার মাথায় ধরে রেখেছে আষাঢ়। হুট করে কোত্থেকে যেন এসে আষাঢ় সঙ্গ নিয়েছে তার। বলা বাহুল্য যে নোয়ানা এতে বিরক্ত। আষাঢ়কে কম বলেনি চলে যেতে, কিন্তু আষাঢ় যাবে না। সাথে সাথে হাঁটছে। গরমে তার অবস্থাও খারাপ। শার্ট ভিজে যাচ্ছে ঘামে।
“আপনি আমার সম্পর্কে কী বলেছেন আপনার হবু বউকে?”
অনেকক্ষণ নীরব থাকার পর বললো নোয়ানা।
“কী বলেছি?”
“কাল আপনার হবু বউ ওভাবে দেখলো কেন আমাকে?”
“কীভাবে দেখছিল?”
“পর্যবেক্ষণ দৃষ্টিতে।”
“বোধহয় সিনথিয়া তোমার প্রেমে-ট্রেমে পড়ে গেছে।”
নোয়ানা থেমে গিয়ে বললো,
“কী?”
আষাঢ় হেসে বললো,
“মজা করলাম।”
“চলে যান।”
“তুমি এত নিষ্ঠুর! আমি তো এত নিষ্ঠুর হতে পারি না তোমার সাথে। মার্কেটের ভিতর থেকে তোমাকে দেখেছি রোদের ভিতর হেঁটে যাচ্ছ। আমার মায়া হলো দেখে একটা ছাতা কিনে নিয়ে এলাম তোমার জন্য। আর তুমি এই ব্যবহার উপহার দিচ্ছ? ছাতাটা নিজের মাথায় না ধরে রেখে তোমার মাথায় ধরে রেখেছি, সেটাও তো একটু দেখো। এমনিতেই শ্যাম বর্ণের মানুষ আমি, রোদে পুড়ে কালো হয়ে যাচ্ছি মায়া হচ্ছে না তোমার?”
নোয়ানা ছাতাটা আষাঢ়ের দিকে ঠেলে দিয়ে বললো,
“নিজের রূপবতী চেহারা ঢেকে রাখুন। কালো করছেন কেন? মেয়ে পটাতে সমস্যা হবে তো।”
“কথাটা কি মায়া করে বললে? না কি রাগ করে?”
“আপনার প্রতি মায়া হবে কেন, আর রাগই বা হবে কেন? বিরক্তি থেকে বলেছি।”
“কালকে আমিও সিনথিয়াকে বলে দিয়েছি, তার চেহারা দেখে আমি বিরক্ত হই।”
“আপনি বাড়াবাড়ি করছেন। সিনথিয়াকে বিয়ে করা আপনার উচিত কাজ হবে।”
“আমি কখন বললাম আমি এই উচিত কাজটা করবো না? সিনথিয়াকে বিয়ে করবো না বলেছি আমি? না কি তুমি ধরে নিয়েছিলে আমি বিয়ে করবো না সিনথিয়াকে?”
নোয়ানা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তবে স্পষ্ট জবাব দিলো,
“সিনথিয়াকে যখন বিয়ে করবেন তখন ওরকম করে বলেছেন কেন তাকে?”
“সেটা তো আমার আর আমার হবু বউয়ের ব্যাপার। তবে তোমাকে নিয়ে আমি খুব চিন্তিত। তুমি তো আমাকে ছাড়া থাকতে পারবে না। সিনথিয়ার সাথে আমার বিয়ে হয়ে গেলে তোমার কী হবে? সতীনের সংসার যে করবে সেটাও তো বোধহয় সম্ভব হবে না তোমার দ্বারা।”
নোয়ানা রাগে কিড়মিড় করে বললো,
“আপনার এরকম কথাবার্তা সবচেয়ে বেশি অসহ্যকর!”
“আর তোমার এরকম করে বলাটা আরও বেশি মুগ্ধকর।”
নোয়ানার বেশ বিরক্ত লাগছে। বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর তড়িৎ গতিতে পা বাড়ালো।
আষাঢ় পিছন থেকে বললো,
“আরে, ছাতা তো নিয়ে যাও। আমি রোদে পুড়ে কালো হয়ে গেলে মানতে পারবো, কিন্তু আমার টিউলিপ ফুল রোদে পুড়ে কালো হলে মানবো না। এই টিউলিপ!”
(চলবে)