__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
____________পর্ব:-০২____________
♥তিন♥
উঠোনে ধান শুকিয়ে ধানগুলো বস্তায় ভরছেন পদ্মাবতী আর আয়েশা বেগম মিলে। দুইদিন পর বিয়ে তাই তাড়াহুড়া করে ধানগুলো শুকিয়ে নিয়েছেন। পদ্মাবতীর দুই মেয়ে ব্যস্ত ছিল বাড়ির আঙ্গিনা পরিষ্কার করার কাজে। বাড়ির সামনে রাস্তার উপর কয়েকজন ডেকোরেশনের লোক বিয়ের গেইট বানাচ্ছিল। তার পাশে বাচ্চাকাচ্চারা উৎসুক দৃষ্টিতে তাদের কাজ দেখছিল। রাজ তার সমবয়সী কয়েকজন বাচ্চার দিকে তাকিয়ে বললো,
-দেখছিস আমাদের গেইট, কত সুন্দর!’
একটা বাচ্চা ছেলে বলে উঠলো,
-আমার ফুফির বিয়েতে এর চেয়ে আরও সুন্দর গেইট ছিল।’
কথাটা গায়ে লাগলো বীথির। সে গলা উঁচু করে বললো,
-তোদের গেইট আমাদেরটার চেয়ে ছোট ছিল। আমাদেরটা দুইতলা গেইট। কী সুন্দর দেখ!’
ছেলেটা আবার বললো,
-আমাদেরটার মতো হবে না।’
এবার মনিও থেমে থাকলো না। সে আরও গলা উঁচু করে বললো,
-এই তোদের গেইট আমরা দেখিনি মনে করছিস। আমাদেরটার কাছেও আসতে পারবে না তোদেরটা।’
এভাবে বাচ্চাদের ঝগড়াটা বাড়তে লাগলো। যখনই গেইটের পাশে একটা ট্যাক্সি এসে থামলো, তারপর তাদের ঝগড়াও থামলো। সবার আগ্রহ বেড়ে গেল ট্যাক্সি থেকে কে নামে দেখার জন্য। একটুপর একজন হুজুর ধরনের লোক এবং পাশে তার স্ত্রী ও একটা ছয় বছরের ছেলে নামলো। এদেরকে কখনও দেখেনি রাজ, বীথি এবং মনি। তিনজনের আগ্রহ এবার বেড়ে গেল নতুন অতিথিদের প্রতি। অতিথিরা যখন ট্যাক্সি বিদায় করে ঘরের দিকে পা বাড়ালো, ওরাও হাঁটলো পেছন পেছন।
অতিথিদের আসতে দেখে মনির মা কাজ থামিয়ে ছোটবোনকে বললো,
-ফাতেমা, দেখ কারা আসছে।’
ফাতেমা তাকালো ওদিকে।
-ও শায়লা আপু!’ খুশিতে চিৎকার করে সে দৌড় দিলো শায়লাদের রিসিভ করতে। তার পেছন পেছন এলো মনির মা। পদ্মাবতী এবং আয়েশা বেগমও কাজ থামিয়ে এগিয়ে এলো। শায়লা এসে সবার সাথে কোলাকুলি করলো। আয়েশা বেগমের সাথে কুলাকুলি করার সময় আয়েশা বেগম তাকে জিজ্ঞেস করলেন,
-আজ এতবছর পর আমাদের এদিকে পা পড়লো?’
শায়লা বললো,
-কী করবো ভাবী? সবাই মিলে তো হুজুরের সাথে বিয়ে দিয়েছো।’
এবার আয়েশা বেগম শায়লা স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
-কী হুজুর সাহেব, বউকে কি পাঞ্জাবির সাথে বেঁধে রাখতে হয়?’
হুজুর মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
-তা নয় ভাবী, ও আসতে চায় না।’
শায়লা প্রতিবাদ করে বললো,
-এ্যা! আমি আসতে চাই না? কোনদিন আমাকে বেড়াতে যেতে দিয়েছো তুমি?’
কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পদ্মাবতী বললেন,
-হয়েছে হয়েছে, আর তর্ক করো না। সবাই ভেতরে আসো।’
এরপর সবাইকে নিয়ে ঘরে ঢুকলেন পদ্মাবতী।
তারপর থেকে বিয়ের অতিথি আরও বাড়তে শুরু করলো। আশরাফ সাহেবের বড় বাড়ি, তাই কারও থাকতে অসুবিধে হলো না।
.
.
বাড়িভর্তি মেহমান দেখে জামালের খুব ভালো লাগছে। তার বিয়ে উপলক্ষে এসেছে সবাই, এটা ভেবে সে আনন্দ পাচ্ছে। তবে কেউ কেউ তাকে সামনে পেয়ে মশকারা করে বিয়ে নিয়ে, এতে তাকে লজ্জার সম্মুখীন হতে হয় সবার সামনে। তাই এসব থেকে বাঁচতে সে আলাদা একটা কক্ষে বসে হবু বউ নিয়ে চিন্তা করতে লাগলো ভেতর থেকে দরজা লক করে। একটুপর দরজায় ঠোকা লাগলো,
-কে?’ জিজ্ঞেস করলো জামাল।
-আমি। দরজা খুল।’ ওপাশে ফাতেমার গলা শোনা গেল। জামাল উঠে দরজা খুলে দিলো। ফাতেমা ট্রেতে করে কয়েক ধরনের নাস্তা নিয়ে এসে জামালের সামনে রাখলো। মেহমানরা এনেছে এসব নাস্তা। জামাল একটা জিলাপি ভেঙে মুখে দিলো। ফাতেমা তার পাশে বসে ফিসফিস করে বললো,
-জানিস কে এসেছে?’
-কে?’ অবাক দৃষ্টিতে তাকালো জামাল।
-শায়লা বু এসেছে…’
-শায়লা!’ যেন বিশ্বাস করতে পারলো না জামাল।
-হ্যাঁ শায়লা আপু। সবার আগে ওরাই এসেছে। দূর থেকে জার্নি করে এসেছে বলে একটু অসুস্থ হয়েছে ওরা, তাই ঘুমিয়েছিল।
-ও আচ্ছা…’
-শায়লা আপুকে ডাকবো?’
-না, তুই যা।’
ফাতেমা বেরিয়ে গেল। শায়লাকে না ডাকতে বললেও মনটা কেমন যেন করতে শুরু করলো তাকে একবার দেখার জন্য। নাস্তা রেখে দরজার বাইরে কয়েকবার উঁকি দিয়ে এলো সে শায়লাকে দেখা যায় কিনা। দেখতে না পেয়ে আবারও নাস্তায় মন দিলো। কিন্তু নাস্তা তার গলা দিয়ে নামলো না। কী যেন চিন্তা করতে লাগলো সে।
তার রুমের পাশ দিয়ে তখন আরেকটা ট্রেতে করে স্বামী-ছেলের জন্য শরবত-বিস্কিট নিয়ে যাচ্ছিল শায়লা। যাওয়ার সময় দরজার ফাক দিয়ে একবার উঁকি দিলো। ভাবনারত জামালকে কিছুক্ষণ দেখলো সে। তারপর চলে এলো। স্বামী আর ছেলের হাতে শরবত দিয়ে আবারও সে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল। যাওয়ার সময় আরেকবার জামালের রুমে উঁকি দিলো। জামালকে এখনও চিন্তিত দেখালো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে শায়লা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।
.
বাড়ির উঠোনে চাঁদের আলোয় খেলছিল বাচ্চারা সব। আশরাফ সাহেব পাড়ার কয়েকজন বুড়োর সাথে বিয়ে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলেন পাশে। মাঝেমাঝে তিনি বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড় শুনে একটা ধমক দেন। কিন্তু তাঁর ধমকে বাচ্চাদের খেলা থেমে থাকে না।
উঠোনোর চারদিকে দৌড়াতে দৌড়াতে বীথি চিৎকার করে বললো,
-এই দেখ, দেখ, আমি যেদিকে যায় চাঁদও সেদিকে যায়।’ ‘হি হি হি’ করে উঠে বীথি। খুশিতে ফেটে পড়ে সে। রাজ বলে উঠে,
-আমিও যেদিকে যায় চাঁদও সেদিকে যায়।’ বলেই সেও উঠোনের চারপাশে দৌড়াতে থাকে। এভাবে একজনের দেখাদেখিতে সবাই চাঁদ নিয়ে খুশিতে মেতে পড়ে। হৈ-হুল্লোড় আরও বেড়ে গেল তাদের। আশরাফ সাহেব আরও কয়েকবার ধমক দিয়েও থামাতে পারেননি তাদের। তবে মক্তবের হুজুর যখন বাড়ির উঠানে পা দিয়ে ডাক দিলেন,
-আশরাফ ভাই আছেন নাকি?’
বাচ্চারা যে যেদিকে পারে ছুটে পালিয়ে গেল হুজুরের গলা শুনে। আশরাফ সাহেব একটা চেয়ার এগিয়ে দিলেন হুজুরের দিকে। হুজুর চেয়ারে বসতে বসতে বললেন,
-বাড়িতে মেহমান ভরে গেছে দেখছি।
-হ্যাঁ হুজুর, বিয়ে বাড়ি বলে কথা।’ বললেন আশরাফ সাহেব।
-তাই তো দেখছি। ভালোই লাগছে বাড়িভর্তি মেহমান দেখে। বিয়েশাদী হয় আল্লাহর তরফ থেকে। এটা আল্লাহর একটা দান। কেউ তকদীরের বাইরে যেতে পারে না।
-ঠিক বলছেন হুজুর।
-তা বিয়েতে খানাপিনার কী ব্যবস্থা করলেন।
-ঘরের মহিষ জবাই করবো একটা, আর কিছু গরুর মাংস কিনে আনবো। দুটো ছাগলও কিনেছি ঐ যে গাছের সাথে বাঁধা আছে।’ ছাগল দুটো দেখিয়ে দিলেন আশরাফ সাহেব। ওদিকে একবার চোখ বুলিয়ে হুজুর বললেন,
-মাশাল্লাহ! মাশাল্লাহ! বলছিলাম কী আশরাফ ভাই, আমাদের মসজিদে কিছু এতিম ছেলে আছে, ওদের দিকে একটু খেয়াল রাখবেন খানাপিনায়।
-তা তো অবশ্যই। সব হুজুর আর মাদ্রাসার ছেলেকে নিয়ে আসবেন আপনি। এরা আল্লাহর কাছের লোক। এরা আসলে আমিও খুশি হবো। তো হুজুর রাতে খাইছেন? নাকি খাওয়া এখনও হয়নি?
-না না, আমি এশার নামাজ পড়েই খেয়ে নিয়েছি।
-ওহ, আমার এখানেও আবার খেতে বলছিলাম।
-না, না আশরাফ ভাই, বিয়েরদিন একেবারে পেটভরে খাবো।’
হুজুরের কথা শুনে সবাই ‘হা হা’ করে হেসে উঠলো।
.
.
রাত আরও বাড়তেই একসময় পুরো গ্রামটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সবাই ঘুমিয়ে গেছে। জামাল একা বসে আছে বাড়ির পেছনে পুকুরের পাড়ে। তাকিয়ে আছে সে পুকুরের জলের দিকে। আকাশের চাঁদটাকে মনে হচ্ছে যেন পানির উপর ভাসছে। এভাবে মধ্যরাতে পুকুরপাড়ে বসে আছে কেন জামাল জানে না। কীসের টানে ছুটে এসেছে? হালকা শীত লাগছে তার। হাটুতে মুখ ঠেসে দেহটাকে একটু মুড়িয়ে নিলো সে। প্রকৃতিটাকে এই মুহূর্ত বড় নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে। সামনে তাকালো সে। সামনে শুধু বিল আর বিল। অনেক দূরে আরেকটা গ্রাম। দূরের গ্রামটাকে মনে হলো কোনো নিঃসঙ্গ প্রাণী শত জনমের কষ্ট বুকে নিয়ে একাকী দাঁড়িয়ে আছে কারও অপেক্ষায়।
জামালের ছায়ার পাশে আরেকটা ছায়া এসে দাঁড়ালো। জামাল মাথা ঘুরিয়ে দেখলো শায়লা দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে একটা চাদর পেঁচিয়ে আছে। হয়তো শীত করছে তার। জামালের পাশে বসতে বসতে শায়লা বললো,
-জানতাম, এখানেই পাওয়া যাবে তোমাকে।’
জামাল কোনো জবাব দিলো না। শায়লা আবার জিজ্ঞেস করলো,
-শীত করছে না?’
এবারও উত্তর পাবে বলে আশা করেনি শায়লা। তারপরও জামাল উচ্চারণ করলো,
-না…’
এভাবে শায়লা এসে তার পাশে বসায় কেমন যেন অনুভূতি হতে লাগলো তার। বিরহের হাহাকার আর কাছে পাওয়ার প্রবল আগ্রহ মিশ্রিত এ অনুভূতি। এই অনুভূতি তার অচেনা। কখনও হয়নি এরকম। অথচ আগেও দুজন এরকম পাশে বসে গল্প করে কাটিয়ে দিয়েছে অগণিত রাত। তখন অনুভূতি ছিল শুধুই ভালো লাগার। সময়ের সাথে সাথে কি অনুভূতিগুলোও পাল্টে যায়?
-কেমন আছো?’ জিজ্ঞেস করলো শায়লা।
-ভালো। তুমি কেমন আছো?’ ম্লান হাসলো জামাল।
-এইতো আছি আলহামদুলিল্লাহ।
-তারপর কী অবস্থা? দিনকাল কেমন কাটছে? দীর্ঘ কয়েকবছর পর দেখা।
-আল্লাহর রহমতে সব ভালোই চলছে। হুমম… কয়েকবছর পরই দেখা। বিয়ের পর মনে হয় একবারই দেখা হয়েছে আমাদের যখন স্বামীকে নিয়ে প্রথম এখানে বেড়াতে এসেছিলাম।
-হ্যাঁ, ঐ একবারই তো এসেছিলে। আর তো আসোনি।
-আসলে তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি। আমি আসলে তুমি নিজেকে ঠিক রাখতে পারতে না, ভেঙে পড়তে তুমি।
-আমার কথা বাদ দাও, যারা তোমাকে বড় করেছে তাদের কথা ভেবেও তো আসতে পারতে। এই বাড়িতেই তুমি বড় হয়েছো, আর এই বাড়ির মানুষগুলোকেই ভুলে গিয়েছো?
-ভুলিনি। মাঝেমাঝে ভুলে থাকার অভিনয় করতে হয়। বাবা মা মারা যাওয়ার পর খালা খালুই আমাকে মানুষ করেছে। আর আমি কি না তাদের ছেলেকেই ভালোবেসে তাদের মনে কষ্ট দিয়েছিলাম। এজন্য খালু হয়তো এখনও আমার উপর নারাজ।
-না, বাবা এসব অনেক আগেই ভুলে গিয়েছে।
-ভুলে গেলে এই কয়বছরে আমাকেও তো একবার দেখতে যেতো। কই? এ বাড়ির কেউ তো দেখতে যাইনি আমাকে।’
জামাল কোনো উত্তর দিতে পারলো না শায়লার কথার। একটুপর শায়লা আবার বললো,
-বাদ দাও ওসব, যাকে বিয়ে করতে যাচ্ছো, তাকে পছন্দ তো?’
-হ্যাঁ, ওর চোখ দুটো তোমার মতো, তোমার মতোই মাথায় ঘন কালোচুল ওর।
-এইজন্যই বুঝি বিয়েতে রাজি হয়েছো?’ দুষ্টুমির হাসি হাসলো শায়লা।
-সত্যি বলতে কী, অনেকটা এই কারণেই…’
-হুমম বুঝতে পেরেছি।
-আগের চেয়ে মোটা হয়ে গেছো তুমি…’
-সবাই তাই বলে।’ হেসে উঠলো শায়লা। বড় অদ্ভুত আর রহস্যময়ী মেয়ে ও। হাজারও কষ্ট বুকে নিয়েও হাসতে পারে। নাকি এটাও অভিনয় তার? কষ্ট ভুলার অভিনয়! কাউকে বুঝতে দিতে চাই না তার কষ্টগুলো।
-তুমি এখানে এসেছো, তোমার স্বামী বুঝতে পারলে কী করবা?’ প্রশ্ন করলো জামাল।
-বুঝবে না। ও ঘুমাচ্ছে, ফজরের আযানের আগে ঘুম ভাঙবে না।’ পুকুরের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো শায়লা। কিছু মুহূর্ত নীরবে কেটে গেল। কী বলবে কেউ বুঝতে পারলো না। দীর্ঘ সময়ের দেয়ালটা সব ভাষাকে যেন বোবা করে দিয়েছে। অথচ একটা সময় ছিল, কথা বললেও ফুরোতো না।
হঠাৎ নীরবতা ভেঙে শায়লা বললো,
-একটা আবদার করতে পারি তোমার কাছে?
-করো…
-জানি না আবার কবে দেখা হয়। দেখা হলেও হয়তো সুযোগটা পাবো না। কারণ তখন তোমার বউ থাকবে পাশে। আজ রাতটাই হয়তো শেষ সুযোগ…’ নরম শুনালো শায়লার কণ্ঠ।
-কীসের সুযোগ?’ প্রশ্ন করলো জামাল।
-আমরা কি সেই আগের মতো আজ রাতটাতে নৌকা নিয়ে জলের বুকে ভাসতে পারি?’
জামাল কোনো জবাব দিলো না। কিছুক্ষণ পর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর হাঁটতে লাগলো বিলের দিকে। শায়লাও নীরবে অনুসরণ করলো তাকে।
ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে ছোট একটা খাল। ঐ খালে বাঁধা ছিল একটা নৌকা। জামাল নৌকায় উঠলো। তারপর হাতটা বাড়িয়ে দিলো শায়লাকে তোলার জন্য। শায়লা তার হাত ধরতেই হালকা কেঁপে উঠলো জামাল। শায়লার হাতটা এখনও আগের মতোই নরম! তাকে নৌকায় তুলে বৈঠা নিয়ে বসলো জামাল। তার বিপরীত পাশে চাদরটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে নিয়ে বসলো শায়লা। জলের বুকে বৈঠা চালালো জামাল। ভেসে চললো নৌকা দুজন ব্যর্থ প্রেমিককে বুকে নিয়ে। চুপচাপ সময় কাটতে লাগলো। কেউ কারও সাথে কথা বলছে না। কেবল পানিতে বৈঠা ফেলার শব্দ শোনা যাচ্ছে। আগের দিনগুলোর কথা মনে পড়ে গেল দুজনের। তখন নৌকা নিয়ে ভাসার সময় দুজনের কতো কথা হতো, সেইসব কথা এখন কেবল স্মৃতি। চাইলেও এখন আর ওভাবে সময় কাটাতে পারবে না এরা। তখন দুজনের মাঝে দূরত্বও থাকতো না। জামালের কোলে মাথা রেখেই ছইয়ের উপর বসতো শায়লা। বৈঠা টানার সময় মাঝেমাঝে জামাল শায়লার নরম মুখে হাত বুলিয়ে দিতো আদর করে। আর শায়লা মিষ্টি কণ্ঠে বলতো,
-রাত না পোহাতে আর কতো দেরি, পাঞ্জেরি?’
রাতটা তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যাক তা কেউ চাইতো না তারা। মাঝেমাঝে ভাবতো, চাঁদনী রাতের সময়টা যদি থামিয়ে দেয়া যেতো!
অতিরিক্ত কোনোকিছুই কাম্য নয়, তেমনি অতিরিক্ত ভালোবাসাও কাম্য না। তাই হয়তো দুজনের গন্তব্য আজ দুদিকে। ছোটবেলা থেকে একসাথে বড় হয়েছে দুজন। পাশাপাশি সময় কাটাতে কাটাতে দুজনের মাঝে মন দেয়া-নেয়াটা স্বাভাবিক। কিন্তু গ্রাম এলাকায় মেয়েদের বিয়েগুলো তখন একটু কম বয়সেই হতো। তাই যখন শায়লার বিয়ে ঠিক হয়, তখন জামাল ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক। তাছাড়া তাদের ভালোবাসা মেনেও নেননি আশরাফ সাহেব। একই পরিবারে বিয়ে হওয়াটা সমাজের লোক অন্য চোখে দেখবে। শায়লাও কষ্ট দিতে চাইনি আশরাফ সাহেবকে। যে তাকে ছোটবেলা থেকে আশ্রয় দিয়ে বড় করেছে, তাকে কষ্ট দেয়াটা উচিত বলে মনে হয়নি তার। তাই এক চাঁদনী রাতে, আকাশের চাঁদ, নদীর জল আর ভাসমান নৌকাকে সাক্ষী রেখে দুজন অশ্রুসিক্ত নয়নে আলাদা হয়ে যায় চিরতরে। তারপর এক হুজুরের সাথে শায়লার বিয়ে হয়ে যায়। জামাল অনেকদিন অস্বাভাবিক জীবন কাটায় এরপর। এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হাতে পারেনি সে। তাই আজ যখন ফাতেমার মুখে শায়লার নাম শুনলো, তখন বুকের ভেতর এক চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে সে।
অনেকক্ষণ নদীর বুকে নৌকা নিয়ে ভেসে দুজন ফিরতি পথ ধরলো। নৌকাতে দুজনের একটুও কথা হয়নি। শধু সময়টা একটু বেশি হয়ে গেছে বলে শায়লা বলেছিল,
-জামাল, এবার ফিরে চলো…’
কূলের পাশে নৌকা থামার আগে শায়লা নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। নীরবে কাঁদতে লাগলো। চোখ বেয়ে তার অশ্রু গড়িয়ে মিশতে লাগলো নদীর জলের সাথে। ফুঁপিয়ে উঠলো সে। কোনো বাধা দিলো না জামাল তাকে। কাঁদুক সে। কাঁদলে হয়তো মনটা হালকা হবে তার। কিন্তু জামালের মন কী করে হালকা হবে? পুরোনো ব্যথাগুলো তার বুকে নতুন করে জেগে উঠলো, পুরুষ বলে শায়লার মতো কেঁদে বুক ভাসাতে পারছে না সে।
.
.
♥চার♥
নতুন বউকে নিয়ে বরযাত্রীর গাড়ি এসে থামলো আশরাফ সাহেবের বাড়ির সামনে। বাচ্চাকাচ্চা, বয়স্ক সব লোক তখন বউয়ের গাড়ি ঘিরে দাঁড়ালো। বউকে যখন গাড়ি থেকে নামানো হলো বাচ্চাকাচ্চারা জোরে চিৎকার করে উঠলো আনন্দে। লোকের ভীড় ঠেলে কয়েকজন মুরব্বি নতুন বউকে কোলে নিয়ে ঘরে এনে বসালো। ঘোমটা পরা বউয়ের পাশে বসে মেয়ে-মহিলারা আনন্দ করতে লাগলো। কয়েকজন বৃদ্ধা বেসুরা গলায় গান ধরলো, আবার কয়েকজন গানের তালেতালে নাচতে লাগলো যেভাবে পারে। শায়লা এবং ফাতেমা দুজন বসে আছে বউয়ের দুপাশে। শায়লার কাঁধে মাথা রেখেছে নতুন বউ। সবার সাথে সাথে শায়লাও আনন্দ করতে লাগলো। তাকে দেখে কে বলবে, পরশু রাতেও এই মেয়েটা হারানোর ব্যথায় কেঁদে বুক ভাসিয়েছিল। এখন যে হাসছে, সবার সাথে আনন্দ করছে, তাই বলে এটা ভাবার প্রয়াস নেই যে কষ্টগুলো ভুলে গেছে সে। হাসির পর্দা সরালেই হয়তো কষ্টগুলো দেখা যাবে। কষ্টগুলো লুকিয়ে আছে হাসির আড়ালে। বেঁচে থাকার জন্য মাঝেমাঝে ভালো থাকার অভিনয় করতে হয়। পৃথিবীর প্রত্যেকেই কোনো না কোনো দিক দিয়ে অভিনেতা, অভিনেত্রী। কোলাহল কেটে গিয়ে আবার যখন নীরব মুহূর্ত একাকী ধরা দেবে, তখন হয়তো শায়লার কষ্টের উপর হাসির পর্দা থাকবে না।
.
.
বিয়েতে বউয়ের বোন হিসেবে দুজন এসেছে। একটা তার আপন ছোট বোন আরেকটা তার কাজিন। মেজ ভাবীর কাজিনটাকে দেখেই রায়হানের যতো খুশি। ভাবীকে যেদিন পাত্রী হিসেবে দেখতে যায় এরা, ঐদিন এই মেয়েটাই নজর কাড়ে তার। ঐদিন ভালো করে দেখার সুযোগ হয়নি, আজ যেভাবে পারে কথা বলবে সে, পরিচিত হবে। রাতের বেলায় সুযোগটা এসে গেল। বউয়ের ব্যাচের সাথে যখন বউয়ের বোন দুটোও খেতে বসে, রায়হান তখন ইচ্ছে করেই খাবারের তদারকি নেয়। সবার প্লেটে খাবার তুলে দেয়ার পর রায়হান যখন ভাবীর বোন দুটোকে খাবার তুলে দিতে যায়, তখন তার পছন্দের মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মন্তব্য করে,
-বেয়ান সাহেবা দুজনকে একটু বেশি করেই দিই।’ বলেই বড় একটা তরকারির বাটি দুবোনকে সাবাড় করে দিলো। তারপর বললো,
-কিছু লাগলে ডাক দিবেন।”
ভাবীর কাজিন রায়হানের দিকে না তাকিয়েই জবাব দিলো,
-যা দিয়েছেন, তাই যদি খেতে না পারি তাহলে বাকিটুকু আপনাকে খেতে হবে।’
-বেয়ান সাহেবা বললে তো খেতেই হবে।’ হেসে চলে এলো রায়হান। প্রথমবার কথা বলে ভালোই লাগলো। দ্বিতীয়বার কথা হয় রাতের বিছানা ঠিক করার সময়। রায়হান নিজেই বেয়ানদের জন্য বিছানা ঠিক করে দেয়। তার সাথে বেয়ান দুজনও হাত লাগায় কাজে। রায়হান তখন দুজনের নাম জিজ্ঞেস করে নেয়। ভাবীর আপন বোনটার নাম কাজল, আর কাজিনটার নাম ফারিয়া। ‘ফারিয়া’ নামটা বুকের সাথে গেঁথে নিলো সে। বিছানা ঠিক করার পর সে ওখানে বসেই বেয়ানদের সাথে আরেকটু গল্প করতে চাইলো, তখন পিচ্ছিগুলো এসে হাজির। রায়হানের হাত ধরে রাজ বললো,
-ছোট চাচ্চু, তুমি এখানে কী করছো? এদিকে আসো।’
রায়হান রাজকে ধমকের সুরে বললো,
-তোরা যা এখন, আমি আসছি।’
রাজ আরও এক ডিগ্রী গলা উঁচু করে বললো,
-এখন আসো তুমি, আব্বু ডাকছে তোমাকে।’
বড়ভাই ডাকছে শুনে রায়হান আর বসে থাকতে পারলো না। পিচ্ছিদের সাথে বেরিয়ে এলো। রাজকে জিজ্ঞেস করলো,
-কই তোর আব্বু?’
পিচ্ছি তিনটা একসাথে হেসে উঠলো তখন। রাজ হাসতে হাসতে বললো,
-তোমাকে ওখান থেকে বের করে আনার জন্য মিথ্যে বলেছি।’
রায়হানের মুখটা পাংশু হয়ে গেল। পিচ্ছি তিনটা হেসে গড়িয়ে পড়লো ওখানে। ছোট চাচ্চুর পাংশু চেহারা দেখে তারা এমন মজা পেয়েছে, যেন এরকম মজা কোনোদিন আর পায়নি তারা। রায়হান তাদেরকে একটা ধমক দিয়ে আবার বেয়ানদের রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভেতরে ঢুকতে গিয়েও ঢুকলো না। আবার কোন অজুহাতে ভেতরে যাবে সে? বাধ্য হয়ে ফিরে এলো সে। পিচ্ছি তিনটার উপর রাগ বাড়তে লাগলো তার।
.
.
পরদিন ফজরের আযানের সময় জামালের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত হয়ে বিছানা থেকে নামলো ইয়াসমিন। তারপর লাইট অন করে তাকালো সে স্বামীর দিকে। স্বামীকেও তার দিকে তাকাতে দেখে মৃদু হাসলো সে। কিছুটা লজ্জা পাচ্ছে সে। কী করে যে কথাটা জিজ্ঞেস করবে সে বুঝে উঠতে পারলো না। তবুও লজ্জার মাথা খেয়ে সে বললো,
-বাথরুমটা একটু দেখিয়ে দেবে আমায়?’
জামালও নামলো বিছানা থেকে স্ত্রীকে বাথরুম দেখিয়ে দিতে। রুম থেকে বের হতেই সামনে পড়লো শায়লা। শায়লা তখন ফজরের নামাজ পড়তে উঠেছে। জামাল শায়লাকে বললো,
-শায়লা, ওকে একটু বাথরুমটা দেখিয়ে দাও তো…’
শায়লা কিছু মুহূর্তের জন্য জামালের দিকে তাকিয়ে থাকলো। জামাল মুখ নিচু করে ফেললো। তখন শায়লা ইয়াসমিনের হাত ধরে বললো,
-চলো ভাবী…’
নীরবে হেঁটে চললো শায়লার সাথে ইয়াসমিন। কোনো কথা বললো না সে। শায়লাই প্রথম জিজ্ঞেস করলো,
-কী ভাবী, প্রথম রাতটা কেমন উপভোগ করলে? কেমন আদর পেলে আর কেমন আদর দিলে?’
লজ্জায় জবাব দিতে পারলো না ইয়াসমিন। শায়লা আবার বললো,
-শুধু কি একা গোসল করবা? তোমার প্রিয়তমের গোসল ফরজ হয়নি?’
ইয়াসমিন আরও বেশি লজ্জা পায়। কী বলবে সে বুঝতে পারে না। ছোট ননদ এসে তাকে সে যাত্রায় বাঁচিয়ে দেয়। সে এসে শায়লাকে বলে,
-উফ! শায়লা আপু, তুমিও না পারো লজ্জা দিতে। দেখো তো আমার নতুন ভাবিটা কীভাবে লজ্জা পাচ্ছে। ইয়াসমিন হেসে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালো ফাতেমার দিকে। তারপর বললো,
-ভালো হয়ছে তুমি এসেছো। আমি ভেবে পাচ্ছিলাম না শায়লা আপুর কথার কী জবাব দেবো।’
শায়লা আবার বললো,
-তারমানে আদর আজ বেশি দেয়া নেয়া হয়েছে। যাইহোক, ঐ যে ভাবী বাথরুম। ওখানে যাও, ওটা মহিলাদের বাথরুম। পুরুষদের বাথরুম আলাদা।’
-আচ্ছা।’ বলেই ইয়াসমিন ঢুকে গেল বাথরুমে।
.
.
দুপুর হতে হতেই বিয়েতে আসা সব অতিথিরা বিদায় নিয়েছে। শুধু শায়লারা এখনও যায়নি। কয়েকবছর পর এসেছে বলে পদ্মাবতী তাকে যেতে দেয়নি। আরও কয়েকদিন থাকবে সে।
দুপুরে খাবার খেয়ে মেয়েগুলো একটা রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। মাঝখানে বসেছে ইয়াসমিন। তাকে ঘিরে বসেছে শায়লা, ফাতেমা, কাজল আর ফারিয়া। তাদের রুমের সামনে ঘুরঘুর করছিল রায়হান। তারও ইচ্ছে হচ্ছে ভেতরে ঢুকে ওদের সাথে আড্ডা দেবে। আশেপাশে পিচ্ছিগুলো আছে কি না দেখে নিলো সে। উঠোনে খেলছে ওরা। যেকোনো মুহূর্তে এসে ডিস্টার্ব করতে পারে ওরা, তাই পূর্ব প্রস্তুতি নেয়া উচিত। ওদেরকে ডাকলো রায়হান। ওদের সাথে শায়লার ছেলেটাও ছিল। চারজনকে বিশটাকার একটা নোট দিয়ে বললো,
-এটা নিয়ে সবাই দোকানে গিয়ে কিছু খেয়ে আসো।’
টাকা পেয়ে বাচ্চারা খুশি। রায়হান তাদের কেন টাকা দিলো তা তাদের না জানলেও চলবে। দৌড়ে বেরিয়ে গেল তারা রাস্তায়। রায়হান এবার ঐ রুমের সামনে গিয়ে বললো,
-সব মেয়েগুলো দেখি এখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে।’
রায়হানকে দেখে শায়লা বললো,
-তুইও আয় আড্ডা দিতে।’
রায়হান তো এই সুযোগই খুঁজছিল। সেও ঢুকে ফারিয়ার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসলো। ফারিয়ার সাথে একবার চোখাচোখি হয়ে গেল তার…
.
.
(চলবে….)