জীবনের গল্প পর্ব-৩৫ শেষ পর্ব

0
3059

__________জীবনের গল্প__________
লেখক: ShoheL Rana
________পর্ব:-৩৫(শেষ পর্ব)________

দুপুরের দিকেই চলে গেছে চাঁদনিরা। রাজ নিজে স্টেশনে গিয়ে ওদের গাড়িতে তুলে দিয়ে এসেছে। ফেরার সময় বাংলা ম্যাডামকে চোখে পড়েছিল। তবে সামনে যায়নি রাজ। ম্যাডাম ছাতা মাথায় দিয়ে ঐদিনের মতো স্কুল থেকে ফিরে যাচ্ছিল। এই কয়দিনে যেন আরও বেশি বুড়ি হয়ে গেছে ম্যাডাম। দূর থেকেই দেখে বোঝা যায় ম্যাডামের কপালে ভাজ পড়েছে। সময় কত দ্রুতই না চলে যায়। এই তো কদিন আগেও রাজ মুগ্ধ হতো ম্যাডামের রূপ দেখে। মাঝখানে কেটে গেল দশটি বছর!
ঘরে এসে কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ঘরটা। মনি জিজ্ঞেস করে,
-কী? ওরা চলে গেছে বলে খারাপ লাগছে?
-না।’ হাসার চেষ্টা করলো রাজ।
-থাক, বুঝতে পেরেছি। জানি খুব মিস করছো চাঁদনিকে।
-দাদু কোথায়?’ প্রসঙ্গ পাল্টালো রাজ।
-ক্ষেতের দিকে গেছে।
-আচ্ছা। আমিও যাচ্ছি ওদিকে।
-আমিও একটু ওপাড়ার দিকে যাবো। একসাথে যেতে পারি?
-ওপাড়ায় কী কাজ তোমার?
-একটা জামা ডেলিভারি করতে যাবো।
-সেলাইছো তুমি?’
-হুমম…
-যাও। রেডি হয়ে এসো।’
মনি ভেতরে গিয়ে একটুপর রেডি হয়ে এলো।
-চলো।’ বলে রাজকে সাথে নিয়ে বের হলো সে। রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কথা হচ্ছে ওদের। রাজ বললো,
-যখন আসাদ আমাকে ছুরি মেরে পালিয়ে যায়, তখন তো খুব উত্তেজিত হয়ে গিয়েছিলে। ‘তুই তুই’ করে বলেছিলে। এখন আবার ‘তুমি’ হয়ে গেলাম যে?
-এ..এ…এমনি…’ ইতস্তত করলো মনি।
-একটা জিনিস কী জানো?
-কী?’
-চাঁদনি কয়েকদিনেই বুঝে গেছে জিনিসটা, অথচ আমি তোমার সাথে অনেক বছর বেড়ে উঠেও বুঝতে পারিনি।
-কোন জিনিসটা?’
-আমাকে যে তুমি ভালোবাসো এটা…’ মনির হাত ধরে দাঁড়িয়ে পড়লো রাজ। কয়েকমুহূর্ত চেয়ে থাকে মনি রাজের চোখের দিকে। হঠাৎ নিজেকে সামলিয়ে আশেপাশে তাকায়। কণ্ঠটা নিচু করে বললো,
-হাত ছাড়ো। মানুষ দেখছে।’
মনির হাত ছেড়ে দিলো রাজ। মনি বললো,
-চাঁদনি ভুল বুঝছে। তোমার প্রতি আমি একটু বেশি কেয়ার করি, কিন্তু ওটা ভালোবাসা না। ঐ যে দাদু, যাও তুমি।’ ক্ষেতের দিকে ইশারা করে দাদুকে দেখিয়ে দিলো মনি। রাজ রাস্তা থেকে ক্ষেতের আইলে নামলো। তারপর আইল বেয়ে দাদুর দিকে যেতে লাগলো। আর মনি কী যেন ভাবতে ভাবতে হাঁটতে লাগলো নিজের পথে। মাঝেমাঝে ফিরে তাকাচ্ছে রাজের দিকে। হঠাৎ বুকের বাঁপাশটা চিনচিন করে উঠলো, ভেতরটা হু হু করে উঠলো। চোখ দুটো ভিজে আসতে চাইছে তার।
.
.
-দাদু, কী করো একা একা এখানে?’ দাদুর কাছে আসতে আসতে বললো রাজ।
-কে? রাজ? আয় এখানে…’ লাঠিতে ভর দিয়ে রাজের দিকে তাকায় দাদু।
-দাদু, তুমি চোখে ভালো করে দেখো না। তোমার এখানে আসা উচিত হয়নি।
-কী করবো দাদুভাই। মন তো মানে না। এই ক্ষেত আমার প্রাণ। ফসলের ঘ্রাণে আমি যেন বেঁচে উঠি নতুন করে। দেখতো দাদু ভাই, ফসলগুলো দেখতে কেমন হয়েছে?
-হুমম, সুন্দর হয়েছে। ধান বেরোবে কখন?
-আশ্বিন মাসের দিকে বেরোতে পারে।’ দাদুর মুখে হাসির রেখা দেখা গেল।
-নতুন ফসল যখন ঘরে তোলা হবে, তখন নতুন পিঠা বানাতে হবে দাদু।
-তা তো হবেই। কিন্তু দাদুভাই, তখন কি আর তোরা থাকবি এখানে?’ করুণ শোনালো দাদুর কণ্ঠ। রাজের চেহারাটা মলিন হতে শুরু করলো। দাদুকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য বললো,
-থাকবো দাদু। আমি আর বীথি তখন আবার বেড়াতে আসবো এখানে।
-তোরা আরও কয়েকদিন থেকে যাস দাদুভাই। কতদিন পর তোদের কাছে পেয়েছি। আর কিছুদিন তোদের দাদুর পাশে থাক। জীবনের শেষ দিনগুলোতে তোদের পাশে পেতে চাই একটু।
-দাদু এভাবে বলো না। আমাদের ছেড়ে কোথায় যাবা তুমি? আরও অনেক বছর বাঁচবা তুমি।’
রাজের কথা শুনে হাসলো দাদু। হাসলে দাদুকে একদম বাচ্চাদের মতো লাগে। দাদু বললো,
-মানুষের জীবনের বিশ্বাস নেই দাদুভাই। আজ আছি তো কাল নাই। বয়স তো আর কম হলো না। আশি পেরিয়ে গেছে।
-অনেকে দেড়শো বছর বাঁচে দাদু। ওসব কথা বাদ দাও।
-আমি যদি না থাকি দাদুভাই, তোরা এখানে চলে আসিস। এই ক্ষেতটা তোর বাবাকে দেখতে বলিস। আমার প্রিয় ক্ষেত। প্রতিবছর অনেক ফসল দেয়। সেই ফসল বিক্রি করে তোর দিদিমণিকে আগে প্রতিবছর নতুন শাড়ি কিনে দিতাম।
-এখন দাও না দাদু?
-এখন তোর দিদিমণি তো নিতেই চায় না। বলে, সংসারে খরচের টাকা লাগবে। এখন তো বুড়ো হয়ে গেছি, আগের মতো কামাই করতে পারি না।’
দাদুর কথাটা সুচের মতো বিধলো রাজের বুকে। মাঝেমাঝে তার খুব অভিমান হয় নিজের বাবা আর দুই চাচার উপর। কিন্তু কিছুই করার নেই। রাজ কণ্ঠটা করুণ করে বললো,
-দাদু, আমরা কি সবাই আবার একসাথে হতে পারি না?’
দাদু হেসে বললো,
-দাদু রে, জীবনকে যতোটা সহজ ভাবছিস, ততোটা সহজ নয়।’
দাদুর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে রাজ। দাদুর দীর্ঘশ্বাস জড়ানো কথাটা ভাবিয়ে তোলে তাকে কিছু সময়ের জন্য।
.
.
দাদুকে ঘরের দিকে কিছুটা এগিয়ে দিয়ে রাজ হাঁটতে চাইলো নদীর পাড়ের দিকে। কিন্তু মনিকে ফিরে আসতে দেখে থামলো সে। মনির জন্য অপেক্ষা করছে। মনি কাছে আসতেই বললো,
-তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।
-কেন?
-চলো আজ তুমি আর আমি নদীরপাড়ে ঘুরবো।
-না রাজ, তা হয় না। সবাই অন্য চোখে দেখবে।
-অন্য চোখে দেখবে কেন? আগে আমরা একসাথে কতো ঘুরেছি।
-সেই সময় কি আর আছে এখন? কতো কিছুই তো বদলে গেছে। বদলে গেছে মানুষগুলোও।
-কিন্তু, তুমি তো বদলাওনি। সেই আগের মতোই তো তোমার মনে এখনও আমি বিচরণ করি।
-প্লিজ চুপ করো রাজ। নদীর ধারে যেতে চাইছো, যাও…’
রাজ চলে যাচ্ছিল। পেছন থেকে মনি বললো,
-আসার পর থেকে একবারও সম্রাটের কথা মনে করেছো?’ করুণ কণ্ঠে বললো মনি। থমকে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে রাজ ওর দিকে। সত্যি একবারও সম্রাটের কথা মনে পড়েনি তার। অথচ একটা সময় সম্রাট তার খুব আপন ছিল।
মনিকে সাথে নিয়ে রাজ বাড়ির পেছনদিকে এলো। এখানেই সে তার প্রিয় পোষা পাখিটাকে কবর দিয়েছিল। সম্রাটের কবরের উপর একটা গোলাপ ফুলগাছ দাঁড়িয়ে আছে মাথা উঁচিয়ে।
-কে লাগিয়েছে এটা?’ জিজ্ঞেস করে রাজ।
-আমি। সম্রাটের স্মৃতি যাতে মুছে না যায়। ওর স্মৃতির সাথে যে তোমার স্মৃতিও জড়িয়ে আছে। কী করে ভুলে যাবো বলো এতো সব স্মৃতি?’ বলেই রাজের দিকে তাকায় মনি। রাজের চোখের দিকে তার দৃষ্টি আটকে যায়। রাজের চোখ দুটো তখন জ্বলজ্বল করছিল। হঠাৎ মনিকে তার ভক্তি করতে ইচ্ছে করছে।
.
.
গভীর রাতেও বুড়ো বুড়ির চোখে ঘুম নেই। পাশাপাশি শুয়ে আছেন আশরাফ সাহেব আর পদ্মাবতী। পয়ষট্টি বছরের সংসার জীবনেও দুজনের ভালোবাসা এখনও সেই আগের মতোই আছে, একটুও কমেনি। আশরাফ সাহেবের ডান হাতের বাহুতে মাথা রেখে শুয়েছেন পদ্মাবতী। আশরাফ সাহেব স্ত্রীকে বললেন,
-কয়েকটা দিন খুব ভালোভাবে কেটেছে তাই না পদ্ম? মনে হয়েছে আমাদের সেই আগের সংসার। সবাই মিলেমিশে হাসিখুশিতে কেটেছে।
-হুমম, সব আমাদের রাজের জন্য।
-কাল থেকে তো আবার আলাদা হতে হবে। বাজার-সাজার কিছু আছে? কাল কী রান্না করবা?
-ফজরের নামাজ পড়ে মাছ পান কি না দেইখেন। চিংড়ি মাছ পেলে নিয়েন। আলু দিয়ে রাঁধবো। রাজ খেতে ভালোবাসে।
-রাজ তো তোমার হাতের সব রান্না খেতেই ভালোবাসে ছোটবেলা থেকে।
-আমাদের সেই রাজ কি এখন আছে? এখন কত্ত বড় হয়েছে। এখন বউয়ের হাতের রান্না পছন্দ করবে। মেয়েটা খুব ভালো, তাই না আমানের বাপ?
-হুমম, আমাদের রাজের সাথে মানাবে ভালো। আমার মতো আমাদের রাজেরও পছন্দ ঠিক আছে, কী বলো পদ্ম?’ কথাটি বলেই হাসে বুড়ো। আর বুড়ির মুখটা অন্ধকারে লাল হয়ে উঠে লজ্জায়। আশরাফ সাহেব স্ত্রীর মাথায় হাত বুলাতে থাকে। একসময় ঘুমিয়ে পড়ে দুজনে।
.
.
ভোরের আলো ফুটতেই গাছে গাছে পাখিরা ডেকে উঠে। দূর থেকে ঘুঘু পাখির ডাক শোনা যায়। পদ্মাবতী ভাত রাঁধার জন্য চাউল ধুতে এলেন পুকুরে। ওখানে রায়হানের বউ রেশমাও ছিল। শাশুড়িকে দেখে রেশমা বলে উঠে,
-আপনার ছেলে বলেছে আপনাদের আলাদা না খেতে। আমাদের সাথেই খাবেন আপনারা।’
আসার সময়ও মন খারাপ ছিল পদ্মাবতীর। ছোট বউয়ের কথা শুনে মনটা ভালো হয়ে গেল তাঁর। খুশি হয়ে বললো,
-সত্যি বলছো ছোট বউ? দাঁড়াও তোমার শ্বশুরকে মাছ কিনতে নিষেধ করে আসি।’ বলেই আর দেরি করলেন না, ঘরের দিকে ছুটলেন পদ্মাবতী। উঠোনে স্বামীকে পেয়ে বললেন,
-শুনছেন আমাদের রায়হান বলেছে আমরা যেন ওদের সাথেই খায়, আপনাকে আর মাছ কিনতে যেতে হবে না।’
আশরাফ সাহেবের মনটাও ভালো হয়ে উঠে তখন। মৃদু হেসে বললেন,
-আচ্ছা, আমি একটু ক্ষেতের দিকে যাই তাহলে। দেখি গরু ছাগল লেগেছে কি না ক্ষেতে…’ লাঠিতে ভর দিয়ে রাস্তার দিকে হাঁটতে লাগলেন আশরাফ সাহেব। রাস্তায় তখন লোকজন যে যার মতো কাজে যাচ্ছে।

.
.
সূর্যের আলোটা ধীরে ধীরে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। জানালা দিয়ে সূর্যের আলো এসে পড়েছে মনির ঘরে। মনি তখন কাজ করছিল তার সেলাই মেশিনে। পাশে বসে বীথি তার কাছ থেকে কাজ শিখছিল। সূর্যের আলোটা মুখে এসে পড়ায় মনি বীথিকে বললো,
-বীথি, জানালার পর্দাটা টেনে দে তো…’
বীথি উঠে জানালার পর্দা টেনে দিলো। রাজকে তখন ভেতরে আসতে দেখা গেল। বীথির উদ্দেশ্যে বললো,
-কী রে, কী করছিস?’
-মনির কাছে সেলাই কাজ শিখছি।
-হুমম, শিখে নে। আর শোন, বাবা ফোন করেছিল একটু আগে। জিজ্ঞেস করলো কবে ফিরে যাবো। তোর কি যাওয়ার ইচ্ছে আছে?’
রাজের কথাটা শুনেই মনির মনোযোগ উঠে গেল কাজ থেকে। মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। তবে কিছু বললো না। চেয়ে রইলো দুই ভাইবোনের দিকে। বীথির জবাব শোনার জন্য অপেক্ষা করলো। বীথি বললো,
-আর কয়েকদিন থাকি না ভাইয়া?’
-আচ্ছা ঠিক আছে। আমিও বাবাকে এই কথা বলেছি।
-ওহ। ভাইয়া শোন, তোকে একটা কথা বলার ছিল।
-কী কথা?
-যে ছেলেটার জন্য আমি এতদিন অপেক্ষা করে ছিলাম, তার খোঁজ পেয়েছি।
-সত্যি? তোকে চিনতে পেরেছে।’ রাজের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।
-হুমম, চিনতে পেরেছে। কিন্তু ও আমার জন্য অপেক্ষা করেনি। বিয়ে করে নিয়েছে।
-কী বলছিস?’ মুখ থেকে হাসিটা মুছে গেল রাজের। বোনের কাঁধে হাত রেখে আবার বললো,
-কষ্ট নিস না। মনে কর ও তোর কপালে নেই।
-কষ্ট তো একটু পাচ্ছি ভাইয়া। বাবাকে বলিস, তার পছন্দের পাত্রকে বিয়ে করতে আমার আর আপত্তি নেই।’
বোনের কথাটাতে কতো যে কষ্ট মেশানো ছিল রাজের বুঝতে কষ্ট হলো না। বীথির কাঁধে হাত চাপড়ে আলতো কণ্ঠে সে বললো,
-সব ঠিক হয়ে যাবে।’ বলেই সে বের হওয়ার জন্য পা বাড়ালো। মনি থামালো তাকে,
-রাজ…
-হুমম…’ মনির দিকে ঘুরলো রাজ।
-তোমার জন্য একটা রুমাল বানিয়েছি, নিবা তুমি?
-দাও…’
মনি একটা রুমাল বের করে রাজের হাতে দিলো। রাজ কিছুক্ষণ রুমালটা দেখে বললো,
-এটা যদি আজীবন আমি যত্ন করে রেখে দিই, তোমার কোনো আপত্তি আছে?’
দুদিকে মাথা নাড়ে মনি। রাজ বেরিয়ে যায় রুমালটা নিয়ে। মনি আবার বসে পড়ে সেলাই মেশিনে কাজ করতে। পা দিয়ে মেশিন চালাতে চালাতে মনি বীথিকে জিজ্ঞেস করে,
-তোরা যদি চলে যাস মনে পড়বে আমাদের কথা?
-হুমম, খুব মনে পড়বে। খুব কষ্ট হবে।
-চলে যাওয়ার পর আর কখনও কি আসবি এদিকে?’
-আসবো। একবার এসেছি। এখন থেকে সময় সুযোগ পেলেই চলে আসবো আমি আর রাজ ভাইয়া।’
মেশিন থামিয়ে মনি চেয়ে থাকে বীথির দিকে। মুখে কষ্টমাখা হাসি লেগে আছে তার।
.
.
♥পঁচিশ♥
নদীর ধারে গালে হাত দিয়ে বসেছিল রাজ। ফোন আসে তখন সাদিয়ার। সেই যে ঝড়ের দিনে সাদিয়া ওকে গাড়িতে করে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল, তারপর থেকে আর কথা হয়নি ওর সাথে। রাজ ফোন রিসিভ করতেই সাদিয়া জিজ্ঞেস করলো,
-কেমন আছো?
-ভালো, তুমি কেমন আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ! তোমাকে একটা খবর জানাতে ফোন দিছি, আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে।
-ওহ্। এতো খুশির সংবাদ। বিয়ে কবে?
-আগামী পরশু। তুমি আসবা কিন্তু বিয়েতে।
-আচ্ছা আসবো। তা হঠাৎ বিয়ে করে নিচ্ছো যে?
-বিয়ের কথা তো অনেকদিন ধরেই চলছে। আমি রাজি ছিলাম না।
-পাত্র কি পছন্দ হয়েছে?
-বাবা মার পছন্দ।
-আর তোমার?
-নিজের পছন্দের পাত্র সবার কপালে কি জুটে বলো? বাদ দাও ওসব কথা। তুমি আসবা কিন্তু, অবশ্যই আসবা। না আসলে কিন্তু কষ্ট পাবো অনেক।
-আসবো। আচ্ছা একটু রাখো, আমার ছোটবোন ফোন দিয়েছে।’
-আচ্ছা।’ বলেই ফোন রেখে দিলো সাদিয়া। রাজ তখন বীথির ফোন রিসিভ করলো। বীথিকে তখন উত্তেজিত শুনালো। উত্তেজিত হয়ে সে বললো,
-ভাইয়া ভাইয়া ঘরে আয় তাড়াতাড়ি।
-কী হয়েছে?
-দাদু বেহুশ হয়ে পড়েছে। কথা বলছে না।
-আচ্ছা আসছি।’ বলেই রাজ উঠে দাঁড়ালো ফোন কেটে। তারপর ছুটলো ঘরের দিকে।
ঘরে এসেই দেখে দাদুর হুশ ফিরেছে। বীথিকে জিজ্ঞেস করে রাজ,
-কী হয়েছে দাদুর?’
বীথির কাছেই তখন জানতে পারে, দাদু ক্ষেতে গেছিল। ওখানেই নাকি মাথা ঘোরে পড়ে যায়। দেখতে পেয়ে ধরাধরি করে কয়েকজন লোক দাদুকে ঘরে নিয়ে আসে। পরে মাথায় পানি ঢেলে হুশ ফেরানো হয় তাঁর।
দাদুর পাশে গিয়ে বিছানায় বসে রাজ। দাদু পা গুটিয়ে রাজকে জায়গা দেয়। রাজ একটু রাগ দেখিয়ে বলে,
-দাদু সবসময় ঐ ক্ষেতে তোমার কাজ কী বলো তো?’
দাদু হাসে। নাতিকে আরেকটু কাছে টেনে বলে,
-আরে সামান্য একটু মাথা ঘোরে পড়ে গেছি, আর কিছু না।
-এটা সামান্য। না দাদু, তুমি আর যখন তখন বের হবে না।’
আশরাফ সাহেব চুপ করে থাকে। রায়হান ডাক্তার নিয়ে এসে ঘরে ঢুকে তখন। ডাক্তার আশরাফ সাহেবকে চেক করে প্রেশারের ওষুধ দেন।
.
.
রাতের অস্পষ্ট আলোতে দাঁড়িয়ে কথা বলছে রাজ আর মনি। দূরে কুপির আলো জ্বলতে দেখা গেল। জেলেরা কুপি জ্বালিয়ে মাছ ধরছে। রাস্তার এ পাশে কয়েকজনকে কুপি জ্বালিয়ে কাঁকড়া ধরতে দেখা গেল। রাজ আর মনি দাঁড়িয়ে আছে তুলা গাছের নিচে। মনির দেয়া রুমালটা হাতে নিয়ে রাজ জিজ্ঞেস করলো,
-রুমালের ফুলটা কি নিজেই নকশা করেছো?
-হুমম…’ মুখের ভেতর শব্দ করে মনি।
-অনেক সুন্দর হয়েছে। জানি এখনও সেই আগের মতোই আমাকে ভালোবাসো। সেই ভালোবাসার দোহায় দিয়ে তোমাকে একটা কথা বলতে চাই, রাখবা?’
মনি চুপ থাকে। রাজ আবার বলে,
-এভাবে প্লিজ নিজের জীবন নষ্ট করো না। সাদা শাড়িটাতে মানায় না তোমাকে।
-নিজের রঙিন জীবন তো কবেই শেষ হয়ে গেছে। এখন না মানালেও সাদা জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেছে।
-এভাবে বলো না প্লিজ। তুমি সেই কিশোর বয়সেই যদি একবার মুখ ফুটে বলতে, আমি হয়তো তোমাকেই ভালোবাসতাম।
-প্লিজ রাজ, চুপ করো। ভালো লাগছে না এসব।
-সেই যে আমার ছোঁয়া পেতে তুমি মাতাল থাকতে, আমার স্পর্শে তোমার সারা শরীর কেঁপে উঠতো, তোমার অনুভূতিগুলো আমার বোঝার ক্ষমতা ছিল না। চাঁদনির প্রেমে যখন পড়ি, তখন তোমার লক্ষণগুলো চাঁদনির মাঝে খুঁজে পাই। ততোদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
-চুপ করো তুমি।’ উত্তেজিত হয়ে উঠে মনি। তারপর চলে যেতে চাইলে ওর হাত ধরে ফেলে রাজ। মনি ওকে ধাক্কা দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
-কেন বারবার আমাকে পুরনো কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিস? কেন বারবার কষ্ট দিস আমাকে? সেই ছোটবেলা থেকেই কষ্ট দিয়ে আসছিস? কেন কেন কেন? একটু কি শান্তি দিতে পারিস না আমাকে?’ মনির আবেগ বেড়ে যায় হঠাৎ। রাজ চুপ করে থাকে। মনি চোখ মুছে ফুঁপিয়ে উঠে বলে,
-ধীরে ধীরে যখন সব কষ্ট মানিয়ে নিতে শিখছি, তখন তুই আবার এলি। কেন এসেছিস তুই আবার? আমার কষ্ট দেখতে? সাদা শাড়িতে আমাকে কেমন লাগে দেখতে? খুব সুন্দর লাগে আমায়। এই সাদা শাড়িটাই আমার একমাত্র আপন এখন। আর কেউ না, কেউ না।’
-মনি তুই শান্ত হ প্লিজ। আমি কি কখনও তোকে কষ্ট দিতে পারি বল?
-না পারিস না, তুই আমাকে কষ্ট দিতে চাস না। কিন্তু অজান্তেই তুই কষ্ট দিয়ে ফেলিস আমাকে। যা আমি সহ্য করতে পারি না। কষ্ট হয় আমার খুব।’ কাঁদতে থাকে মনি। কিছুক্ষণ কান্না করে নিজেকে সামলালো সে। তারপর চোখ মুখ মুছে বললো,
-শেষ বারের মতো একটা কথা রাখবি রাজ?’
-কী কথা?
-তুই কাল চলে যা। আর কখনও আসিস না। তোকে যতোবার দেখি শুধু আগের কথাগুলো মনে পড়ে। আমি থাকতে পারি না। প্লিজ তুই চলে যা।’ কাঁদতে কাঁদতে ঘরের দিকে দৌড়ে যায় মনি। স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রাজ। মনির কষ্ট তাকে ভাবিয়ে তুলে হঠাৎ। মনিকে তো সে সুখ দিতে পারেনি, অন্তত কষ্ট দেবে না আর। সকালটা হোক, তারপর বীথিকে নিয়ে চলে যাবে সে। ভালো থাকুক অন্তত মনি।
.
.
সকালে চলে যাওয়ার কথা থাকলেও আর যাওয়া হলো না রাজের। দাদুর অবস্থা হঠাৎ খারাপ হয়ে উঠে। কেমন জানি করছে দাদু। কথা বলতে পারছে না। নিশ্বাস বেড়ে গেছে। বুকটা বারবার উঠানামা করছে। রায়হান ছুটে যায় আবার ডাক্তার আনতে। সবাই উত্তেজিত হয়ে উঠে তখন। পদ্মাবতী আর মনির মাকে বেশি উত্তেজিত দেখালো। পাড়া থেকে লোকজন দেখতে আসছে আশরাফ সাহেবকে। অনেকে মন্তব্য করছে উনি আর বাঁচবেন না। আশরাফ সাহেব ইশারায় কাছে আসতে বললেন রাজকে। তারপর কী যেন বললেন মুখের ভেতর বোঝা গেল না। রাজ দাদুর মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-দাদু কী বলছো?’
আশরাফ সাহেব আবারও কী যেন বলে হাতের ইশারা করলেন। এবার একটা শব্দ অস্পষ্ট হলেও বোঝা গেল। আমান। আশরাফ সাহেব তার বড় ছেলে আর ছেলের বউকে দেখতে চায়।
রাজ তার বাবার নাম্বারে ফোন করলো। বাবা ফোন রিসিভ করতেই বললো,
-বাবা, তোমরা শীঘ্রই এখানে চলে এসো। দাদু কেমন জানি করছে। ছটফট করছে। মানুষজন বলাবলি করছে আর হয়তো বাঁচবেন না দাদু।’
ফোনের ওপাশে তখন রাজের বাবার উত্তেজিত কণ্ঠ শোনা গেল। রাজ ফোন রেখে দিলো। রায়হান ডাক্তার নিয়ে হাজির হলো। ডাক্তার আবারও আশরাফ সাহেবকে চেকআপ করে বললেন,
-উনাকে এই মুহূর্তেই শহরের হাসপাতালে নিয়ে যান।’
ডাক্তারের কথা শেষ হতেই বাইরে ছুটে গেল জামাল। রাস্তায় একটা সি.এন.জি দাঁড় করিয়ে যাত্রী সব নামিয়ে দেয়। তারপর ঘরের দিকে মুখ করে চিৎকার করে বলে,
-বাবাকে নিয়ে এসো…’
কিছুক্ষণ পর কয়েকজন ধরাধরি করে আশরাফ সাহেবকে বের করে আনেন ঘর থেকে। তারপর সি.এন.জিতে তুলে। জামাল, রায়হান আর রাজও উঠে সি.এন.জিতে। তারপর ছাড়া হয় সি.এন.জি। ঘর থেকে পদ্মাবতীর কান্নার আওয়াজ আসে। অনেকদিন আগে রাজরা যখন গ্রাম ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, ঠিক এইরকম কান্নার আওয়াজ শুনতে পেয়েছিল তারা দাদির। রাজ ফোনটা বের করে বাবাকে ফোন দেয়। তারপর দাদুকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার কথা জানিয়ে দেয়।
.
.
আমান সাহেব আর আয়েশা বেগম একটা সি.এন.জি ভাড়া করে উঠলেন। দ্রুত চালাতে বললো ড্রাইভারকে। আমান সাহেবের হাঁত পা কাঁপছে। বাবার সাথে শেষবারের মতো কথা বলতে পারবে তো? নাকি তার আগেই…? না না, আর ভাবতে পারলো না আমান সাহেব। ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে তাগাদা দিলো,
-একটু জোরে চালান ভাই, একটু জোরে চালান।’
পাশ থেকে আয়েশা বেগম স্বামীকে সান্ত্বনা দেয়ার সুরে বললো,
-তুমি একটু শান্ত হও। দেখবে ঠিক হয়ে গেছে। কোন হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে ওরা কিছু বলছে?
-কাছাকাছি তো একটাই হাসপাতাল আছে।
-সেটাও তো কম কাছে না।
-হুমম… আমার খুব ভয় করছে আয়েশা। যদি কিছু হয়ে যায় বাবার? আমার উপর অনেক অভিমান জমে আছে বাবার।
-কিচ্ছু হবে না। ধৈর্য ধরো তুমি।
-বাবা একবার ভালো হয়ে উঠুক। তারপর আমরা আর দূরে থাকবো না। একসাথে থাকবো সবাই।
-সিদ্ধান্তটা যদি আরও আগে নিতে তুমি, কতোই না ভালো হতো…’
রাজের ফোন আসে। ফোন রিসিভ করেই আমান সাহেব উত্তেজিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-হ্যাঁ রাজ, কী অবস্থা এখন তোর দাদুর?’
-দাদু আর নেই বাবা। মারা গেছে।’ কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো রাজ। তার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেল আমান সাহেব। মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হলো না।
.
.
হাসপাতালে যাওয়ার অর্ধেক পথেই মারা যান আশরাফ সাহেব। তারপর আর হাসপাতাল পর্যন্ত যাওয়ার প্রয়োজন পড়েনি। অর্ধেক পথ থেকেই ফিরে আসে ওরা লাশ নিয়ে। আশরাফ সাহেবের মৃত্যু সংবাদটা আগেই ফোন করে বাসায় জানিয়ে দেয় রায়হান। তখন পুরো বাড়িটা কান্নায় ভেসে যায়। মসজিদের মাইকে বলে দেয়া হয় মৃত্যু সংবাদটা। ছেলে বুড়ো সবাই তখন ভিড় জমায় আশরাফ সাহেবের বাড়িতে এসে। লাশ নিয়ে তখনও পৌঁছেনি ওরা। কিন্তু স্বজনদের কান্নায় ভারী হয়ে উঠছিল তখন বাতাস। যখন লাশ নিয়ে গাড়ি পৌঁছে, কান্নার আওয়াজটা আরও বেড়ে যায়। মেয়েমানুষগুলোকে কিছুতেই আটকানো যাচ্ছে না। লাশের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইছে ওরা। কান্না করতে করতে পদ্মাবতী বেহুশ হয়ে পড়ে কয়েকজন তার মাথায় পানি ঢেলে হুশ ফেরায়।
বিছানায় চিত করে শুয়ানো হয় আশরাফ সাহেবের লাশটাকে। লাশের উপর চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। পাশে জ্বালানো হয় আগরবাতি। আর কয়েকজন লাশের পাশে বসে কুরআন শরীফ পাঠ করতে লাগলো। ভেতরে যে যাকে পারে জড়িয়ে ধরে কান্না করছে। কেউ ভাবেনি হঠাৎ এভাবে চলে যাবেন লোকটা। আগের দিনেও ভালো ছিলেন, চলাফেরা করেছেন সুস্থ লোকের মতো।
আমান সাহেবরা এসে পৌঁছলে কান্নার আওয়াজটা আরও বেড়ে যায়। পদ্মাবতী ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বিলাপ ধরলেন,
-ও বাপরে, এতদিন কোথায় ছিলি বাপ? এতদিন পর আসতে পারলি? তোর বাপটা তোকে একটু দেখে যেতে পারলো না, একটু কথা বলে যেতে পারলো না।’
মাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় হাত বুলাতে লাগলো আমান সাহেব। চোখ দুটো ভিজে আসছে তার। পদ্মাবতী ছেলেকে বাবার লাশ দেখাতে নিয়ে এলেন। লাশের উপর থেকে চাদর সরাতেই আশরাফ সাহেবের চেহারাটা ভেসে উঠলো। এখনও যেন হাসছে লোকটা। মনে হচ্ছে যেন ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি লেগে আছে তার। তার মৃত্যুতে যে ছেলেটা ঘরে ফিরেছে, হয়তো এতেই তিনি খুশি। বাবার লাশের পাশে কিছুক্ষণ বসে চোখ মুছলেন আমান সাহেব। আয়েশা বেগম একবার লাশ দেখে ভেতরে গিয়ে কাঁদতে লাগলো মনির মাকে জড়িয়ে ধরে।
.
.
সেদিন আর লাশ দাফন করা হয়নি। দূর থেকে আত্মীয়স্বজন আসতে থাকে শেষবারের মতো আশরাফ সাহেবের লাশটা একবার দেখতে। ছোট মেয়ে ফাতেমা আসে সন্ধ্যার দিকে। এসেই লুটিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে লাশের পাশে। কয়েকজন মিলে থাকে টেনে নিয়ে যায় একপাশে। বোঝাতে চেষ্টা করে ওকে, লাশের পাশে এভাবে কাঁদতে নেই।
কান্নাকাটির এই মুহূর্তে রাজের কাছে ফোন আসে সাদিয়ার। ফোন রিসিভ করে চুপ থাকে রাজ কয়েকমুহূর্ত। ওপাশ থেকে সাদিয়া বলে,
-রাজ, কাল আমার বিয়ে। তুমি আসবা না?
-আমি আসতে পারবো না সাদিয়া।’ আবেগঘন কণ্ঠে বললো রাজ।
-কেন?
-আমার দাদু মারা গেছে। কাল দাদুকে দাফন করা হবে।
-ইন্না-লিল্লাহি…. রাজেউন। আল্লাহ তোমার দাদুকে জান্নাতবাসী করুক।
-বিয়ের জন্য শুভকামনা রইলো।
-থ্যাংকস। আমাদের মনে হয় আর দেখা হবে না কখনও।
-কেন?
-বিয়ের পর আমাকে নিয়ে বিদেশ চলে যাবে আমার বর।’
রাজ চুপ করে থাকে। ওপাশে সাদিয়ার ফুঁপানোর শব্দ বুঝতে পারে সে। হয়তো কান্না করছে সাদিয়া। কয়েকমুহূর্ত চুপ থেকে সে বললো,
-ভালো থেকো তুমি। আর মনে রেখো আমাকে।’ গলাটা কেঁপে উঠলো সাদিয়ার। রাজ বললো,
-হুমম, তুমিও ভালো থেকো।
-বিদায়।
-হুমম…’
বিদায় বললেও ফোন কাটলো না ওরা কেউ। আরও কিছুক্ষণ এভাবে চুপ থাকার পর রাজ ফোনটা রেখে দিলো। দাদুর মৃত্যু সংবাদটা এখনও জানানো হয়নি চাঁদনিকে। চাঁদনির নাম্বারে ফোন দিলো রাজ। দাদুর মৃত্যু সংবাদটা শুনে খুব কষ্ট পেল চাঁদনি। করুণ কণ্ঠে সে বললো,
-আমি আরও দাদুর ব্যাপারে একজন চোখের ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি আজ। দাদু সবাইকে ছেড়ে এভাবে চলে গেল?
-হুমম। খুব কষ্ট হচ্ছে দাদুর জন্য। তুমি আসবা দাদুকে শেষবারের মতো দেখতে? কাল জুমার নামাজের পর দাদুর জানাজা হবে।
-হুমম, আসবো আমি।
-আচ্ছা এসো, রাখি এখন।’ ফোন রেখে দিলো রাজ।
.
.
পরদিন সকালের দিকে রাজের নাম্বারে ফোন আসে চাকরির নিয়োগের ব্যাপারে। গ্রামে আসার আগে রাজ ওখানে সিভি জমা দিয়ে ইন্টারভিউ দিয়েছিল। ওখান থেকে ফোন করে বলে, আগামীকাল সকাল নয়টায় চাকরিতে জয়েন করতে। আসতে পারবে না জানিয়ে রাজ ফোন রেখে দেয়।
জুমার নামাজের আগে লাশকে গোসল করিয়ে খাটিয়ায় তোলা হয়। তারপর কাফন পরানো হয়। লাশ যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন কান্নার শব্দে ভারী হয়ে উঠে চারপাশ। মনি আর বীথি একপাশে কান্না করছিল। খাটিয়া উঠাতে দেখে ছুটে আসে ওরা। রিতা আর চাঁদনিসহ আরও কয়েকজন মিলে ওদের দুজনকে টেনে ধরে। রিতা এসেছে একটু আগে। লাশটা ভালো করে দেখতেও পারেনি সে।
‘আশহাদু আল্লাহ ইলাহা….’ পড়তে পড়তে লোকজন লাশ নিয়ে ধীরে ধীরে চলে যাচ্ছিল। পদ্মাবতী ছুটে আসে লাশের পিছু পিছু। কয়েকজন মহিলা তাকে আটকায়। রেশমা আর ইয়াসমিনকেও শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে দেখা যায় একপাশে। আয়েশা বেগম কাঁদছে দুই ননদের সাথে। লাশ ধীরে ধীরে নিয়ে যাওয়া হলো মসজিদের কাছে।
জুমার নামাজ শেষেই আশরাফ সাহেবের জানাজার নামাজ হয়। জানাজার নামাজে অনেক লোক লোক শরিক হয়। তারপর কবরস্থানে নিয়ে যাওয়া হয় লাশ। কবরটা সকালেই খুঁড়ে রাখা হয়ে হয়েছিল। কয়েকজন মিলে আশরাফ সাহেবের লাশটা কবরে নামায়। তারপর উপরে বাঁশ দিয়ে ঢেকে তার উপর ধীরে ধীরে মাটি ফেলা হয়। মাটি দেয়া শেষ হলে কবরটা বাঁশের বেড়া দিয়ে ঘিরে দেয়া হয়। সবশেষে সবাই দুহাত তুলে মোনাজাত ধরে আশরাফ সাহেবের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে।
মোনাজাত শেষে লোকজন ধীরে ধীরে চলে যায়। রাজের পা কিছুতেই যেতে চায় না দাদুর কবেরর পাশ থেকে। শায়লা ফুপির কবরটাও চোখে পড়লো তার। ওর কবরের পাশেই দাদুর কবর দেয়া হয়েছে। শায়লা ফুফির কবরটা পুরনো হয়ে গেছে। কবরের উপর একটা বড় গাছ দেখা গেল। একদিন হয়তো এরকম একটা গাছ মাথা তুলে দাঁড়াবে দাদুর কবরের উপরও। ছায়া দেবে দাদুর কবরকে। ফিরে যাওয়ার জন্য ধীরে ধীরে পা ফেলে রাজ। পেছনে পড়ে থাকে দাদুর কবরটা। ভাবতে অবাক লাগে, দুদিন আগেও লোকটা সবার সাথে হাসিখুশিতে কথা বলেছিল। আজ উনি মৃত। অন্ধকার ঘরে একা শুয়ে আছেন। পয়ষট্টি বছর যার পাশে শুয়ে কাটিয়েছে দাদু, তাকে ছেড়ে তিনি কীভাবে থাকবেন ঐ ঘরে? একদিন দাদিও হয়তো চলে যাবেন দাদুর কাছে। এভাবে সুখ দুঃখ নিয়ে চলতে থাকবে জীবনের গল্প।
.
.
(সমাপ্ত)
.
.
(উপন্যাসটি আমার মৃত দাদুকে উৎসর্গ করলাম। গতবছর আজকের এই দিনে তিনি সবাইকে ছেড়ে চলে গেলেন। গল্পের আশরাফ আর পদ্মাবতী হলো মূলত আমার দাদা-দাদি।)

গল্পটি কেমন লেগেছে, সবার অনুভূতি লিখি রিভিউ দিন

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here