অনুভবে তুই পর্ব-১৩

0
1948

#অনুভবে_তুই
#লেখনীতে-ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-১৩

ড্রইংরুমের সোফায় বসে আছে পাত্রপক্ষের পরিবার৷ বেশ আলাপ-আলোচনা এবং রসিকতা চলছে ইনায়াত সাহেব ও ইমতিয়াজ সাহেবের সাথে। আদ্রিশ, মিতালি-নিশিতা ওরাও আছে। মেয়েরা সবাই একপাশে নেহাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। নানান প্রকার মিষ্টান্ন এবং বিভিন্ন ফলফলাদি ও মুখরোচক নাস্তা সাজানো টি-টেবিলের ওপর। নেহাকে উজ্জ্বল রঙের একটি জামদানি শাড়ি পরানো হয়েছে। পাত্রপাত্রীকে দুই পরিবারের সবারই পছন্দ হয়েছে এবং আগে থেকেই সব খোঁজখবর নেওয়া হয়ে গিয়েছে বলে এনগেজমেন্ট করে রাখবে কি-না তারই আলাপচারিতা চলছে। বাবা-মা, চাচা-চাচী সবাই এই সম্পর্কে খুশি এবং রাজি বলে ফুফুর কথা মেনে নিজেও একবার পাত্রের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলতে রাজি হলো নেহা। পাত্রের নাম রিজভী। আদ্রিশের পরিচিত এবং তাঁদের মধ্যে খুব ভালো সম্পর্ক। রিজভী একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে বড় পদে চাকরি করে। ওর চিন্তাধারা, স্বভাব, আচার-আচরণ বেশ ভালোই লাগলো নেহার। তাই বিয়েতে আর অমত করলো না সে!

একপর্যায়ে রিজভীর সাথে আলাদা করে কথা বলতে দেওয়া হলো নেহাকে। বেশ সময় নিয়ে দু’জন কথা বলার পরে নেহা তার তিন বোনকে জিজ্ঞেস করল, ‘তোদের কী মনে হয়? বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়াটাই ঠিক?’

ইশা নেহার গায়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল, ‘ভাইয়াটাকে তো ভালোই মনে হলো। আমাদের সঙ্গেও বেশ নম্রভাবেই ব্যবহার করলো। তাই না ফিহা আপু?’

ফিহা ওর কথায় সায় জানিয়ে বলল, ‘হুম। তোমার পাশে মানাবে ওনাকে, দ্বি-মত করার কারণ দেখতে পাচ্ছি না। রোজা তুই কিছু বল!’

রোজা নিশ্চুপ হেসে বলল, ‘পারফেক্ট জুটি নেহা আপু। এই বিয়েতে অমত করা মানে হীরের টুকরো রিজেক্ট করা। তাছাড়া বাড়ির সবাই যেখানে মত দিয়েছে সেখানে ভয়টয় বা দ্বিধা করো না। ওদের ওপর পূর্ণ আস্থা থাকা উচিৎ।’

নেহা আলতো হাসলো। ওরা চারজন যখন পাত্র নিয়ে গভীর আলোচনায় ব্যস্ত ঠিক সেসময় দরজার ভারী পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন ইশার মা অর্থাৎ আদ্রিশের ফুফু সুহানা শেখ। ঘরে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই ওরা চুপ করে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। সুহানা শেখের ঠোঁটের কোণে এক টুকরো হাসি। মনে হচ্ছে ভাইয়ের মেয়ের বিয়ে ঠিক হওয়ায় বেজায় খুশি তিনি। আদ্রিশ আর নেহাকে তিনি অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই ভালোবাসেন। তাই ওদের ওপর তাঁর যেন একটু বেশিই দাবি। নেহাকে জড়িয়ে ধরে তিনি নিজের উৎফুল্লতা প্রকাশ করলেন। খুশি খুশি গলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘অবশেষে আমার মেয়েটারও বিয়ে হবে।’

নেহা লজ্জা পেল। মাথা নিচু করে নরম স্বরে বলল, ‘ফুপি, এখনো কিন্তু বিয়েটা হয় নি।’

‘হয় নি তাতে কী? হবে তো।’

কথা বলতে বলতে সুহানা শেখের নজর পড়লো খানিক দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ের ওপর। অদ্ভুত মায়ায় ঘেরা, টকটকে ফর্সা গায়ের রঙ মেয়েটির। মেয়েটার সঙ্গে তাঁর চোখাচোখি হতেই রোজা সৌজন্যেতামূলক হাসি দিলো। রোজার সঙ্গে এর আগে পরিচয় হয় নি সুহানার। ইদানীং এই বাসায় খুব কমই আসেন তিনি। নিজের সংসার সামলে দিনশেষে অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোথাও একটা যাওয়া হয় না তার। ভাইদের বাড়ি কাছে বলে মাঝেমধ্যে আসা-যাওয়া হয়। কিন্তু গত কয়েকমাস এতটাই ব্যস্ত আর অসুস্থ ছিলেন যে এমুখো আর হতে পারেন নি, যার ফলে রোজা নামক মেয়েটির সঙ্গে তার কোনো পরিচয় নেই। তবে ইশার মুখে অনেকবার রোজার নাম শুনে প্রথম দেখাতেই তিনি রোজাকে চিনে ফেললেন। মুহূর্তেই ভ্রু-কুঁচকে এলো তাঁর। থমথমে মুখে ফিহাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এটা কী তোর খালার মেয়েটা নাকি?’

ফিহা সায় জানিয়ে বলল, ‘হুম, ওর নাম-ই রোজা।’

সুহানা আগের মতোই মুখভঙ্গি করে বললেন, ‘দেখেই চিনতে পেরেছি। আমার মেয়ে ইশা তো ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। সারাদিন-ই ‘রোজা’ নামটা ওর ঠোঁটের আগায় থাকে। রোজা এটা করেছে, ওটা করেছে, রান্না ভালো, দেখতে সুন্দরী, পড়াশোনার দিক দিয়েও পিছিয়ে নেই এসব গল্পই আমার জানা।’

সুহানা শেখের কথা শুনে রোজা অস্বস্তিতে পড়ে গেল। ইশার হাসি হাসি চেহারাটাও কেমন মিলিয়ে গেল। নেহা হেসে বলল, ‘আমাদের রোজা সবদিক দিয়েই ফার্স্ট। সোনার টুকরো মেয়ে।’

সুহানা শেখ হাসলেন না। রোজা গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘ভালো আছেন আন্টি?’

সুহানা শেখ ভার গলায় উত্তর দিলেন, ”হা, ভালোই আছি৷ তা তুমি কেমন আছ?’

‘আলহামদুলিল্লাহ।’

‘ভালো তো থাকবেই, প্রথম প্রথম শহরে আসছো না!’

রোজা নিভলো। সুহানা শেখের কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে ওকে খুব একটা পছন্দ করেন নি তিনি। তাঁর কথার প্রতিত্ত্যুরে রোজা কোনো শব্দব্যয় করলো না। কাজের বুয়া এসে জানালো নেহাকে ড্রইংরুমে নিয়ে যেতে বলেছে ইনায়াত সাহেব। ফিহা আর ইশা ওকে নিয়ে গেল। রোজা বেরুতে নিলেই পেছন থেকে সুহানা শেখ ডাকলেন। রোজা ঘাড় ঘুরিয়ে ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু দরকার আন্টি?’

সুহানা শেখ রুক্ষ স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কোথায় যাচ্ছো?’

‘না মানে নিচে যাচ্ছিলাম আন্টি। আপনার কিছু লাগবে?’

‘আমার কিছু প্রয়োজন নেই। বাড়িটা তো তোমার না, আমারই। কিছু দরকার হলে আমি নিজেই নিতে পারবো।’

‘আমি তাহলে যাই?’

‘না। তুমি নিচে যাবে না। পরে দেখা যাবে হিতে বিপরীত হয়েছে।’

রোজা হতভম্ব হয়ে বলল, ‘মানে?’

সুহানা শেখের ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি। সেভাবেই মাথা নেড়ে তিনি ওকে আগাগোড়া পরখ করে কঠোর গলায় বললেন, ‘এমন একটা ভান করছো যেন কিছু বুঝতে পারছো না। নেহার আগের বিয়েটা তো অনেকটা তোমার কারণেই ভেঙেছে। তুমি দেখতে যা সুন্দরী, রুপ দিয়েই তো সবাইকে বশ করে ফেলো। এখন তোমাকে দেখলে পাত্রপক্ষ যদি তোমাকেই পছন্দ করে ফেলে? আমাদের নেহাটার কী হবে? তাই বলছি তুমি কোথাও যাবে না, এখানেই চুপ করে বসে থাকো।’

রোজার জন্য নেহার বিয়ে ভেঙেছিল? কি বলছেন সুহানা শেখ? শাখাওয়াত লোকটা যে প্রথম থেকেই বিয়েতে রাজি ছিলো না সেটা কী ওনি জানেন না? রোজা তাঁর ভুলটা ভাঙার জন্য কিছু বলতে উদ্যত হতেই সুহানা শেখ হাত ওঠিয়ে থামিয়ে দিলেন ওকে। তারপর ব্যতিব্যস্ত হয়ে নিচে যাওয়ার জন্য ওঠে দাঁড়ালেন। রোজা ভদ্রতাসূচক দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো। ওর বিস্মিত দৃষ্টিজোড়ায় হাজারো প্রশ্ন। সুহানা শেখ ওর সামনে এসে দাঁড়ালেন। গলা খাকারি দিয়ে বললেন, ‘তোমার জন্ম তো গ্রামে, তাই না? সবার চোখে গ্রামের মেয়েরা সহজসরল হয়, কিন্তু মোটেও তা নয়। ওরা একেকটা চিজ হয়। নিজের স্বার্থ পূরণ করা ছাড়া ওরা কারোর ভালো চায় না। তুমি আমার ভাইদের বাড়িতে পড়তে আসছো, থাকতে আসছো তাতে আমার সমস্যা নেই। কিন্তু তোমার কারণে আমার ভাইদের ছেলে-মেয়ের ক্ষতি হবে সেটা তো আমি মেনে নেব না। আর শুনো, রুপ দিয়ে মানুষকে সাময়িক সময়ের জন্য বশ করতে পারলেও সারাজীবন তা পারবে না। আমার আদ্রিশকে নাকি ইতোমধ্যেই নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে নিয়েছ? ভালোয় ভালোয় এসব বন্ধ করো। নয়তো কি হবে তোমার সাথে চিন্তাও করতে পারবে না। সোনা হয়ে হীরের টুকরোর দিকে হাত বাড়াতে যেও না।’

বলেই শাড়ির আঁচল পিঠের ওপর টেনে নিচে চলে গেলেন তিনি। রোজা অবাকের সপ্তম আকাশে পৌঁছে গেছে। দরজাটা কোনোমতে বন্ধ করে বিছানায় এসে ধপ করে বসে পড়লো। ঘোরটা যেন এখনো কাটছে না। সুহানা শেখ এসব কী বলে গেলেন ওকে? নেহার বিয়ে ওর জন্য ভেঙেছে? গ্রামের মেয়েরা চিজ আর স্বার্থপর হয়? রুপ দিয়ে সবাইকে বশ করে? রোজা আদ্রিশকে নিজের আয়ত্ত্বে নিয়ে নিয়েছে? মানে কী এসবের? ও তো কখনো আদ্রিশকে সুযোগ দেয় নি। আর এই মহিলা সব দোষ ওর ঘাড়ে চাপিয়ে দিলো? আর আদ্রিশ যে ওর প্রতি দুর্বল এটা ওনি কীভাবে জানলো? ও তো কাউকে বলে নি, সুহানা শেখের সাথে ওর তো আজ প্রথম দেখা। তাহলে কী আদ্রিশ নিজেই বলেছে? রোজা যে ওর প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে না, সেজন্য প্রতিশোধ নিতে চাচ্ছে? সবার কাছে ওকে খারাপ প্রমাণ করতে চায়? নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে চোখ ছাপিয়ে জল বেরিয়ে এলো রোজার।

——————————-

নিকষকৃষ্ণ আঁধারে ঢাকা শুক্লপক্ষের রজনী। হিম করা ঠান্ডা দোদুল্যমান হাওয়ায় বৃক্ষরাজি শনশন শব্দ তুলে বইছে। ফুলগন্ধি সুমিষ্ট বাতাসে চারদিক ভরে ওঠেছে। অর্ধবাঁকা একফালি চাঁদ ঝুলছে আকাশের ঠিক মধ্যস্থানে। দু-একটি তারা দ্যুতি ছড়াচ্ছে নিজেদের মতো করেই। নেহার এনগেজমেন্ট শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ। পাত্রপক্ষের লোকজন এখনো বিদায় হয় নি। সারাদিন মেহমানদারি করতে করতে উৎসের অবস্থা নাজেহাল। তার ওপর বিকেলে দরকারি একটা কাজে বেরিয়ে বাইক এক্সিডেন্টে পায়ের পাতায় বেশ জখম হয়েছে ওর। প্রাথমিক চিকিৎসা নিলেও বাসায় ফিরে আর কাউকে কিছু জানায় নি। ঘরভরা মেহমানদের রেখে নয়তো সবাই ওকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে যেত। বোনের এনগেজমেন্টের আনন্দটা নষ্ট করতে চায় নি। ঘন্টাখানিক ধরে রোজাকে দেখতে না পেয়ে চুপিসারে দোতলায় চলে আসে উৎস। রোজার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ দেখে সে আর ডিস্টার্ব করে নি। নিজের ঘরেই ফিরে যায়। কিন্তু মনটা খচখচ করতে থাকে। খানিকবাদেই আবারও ফিরে আসে রোজার ঘরের সামনে। দু-একবার নক করতেই ধীরপায়ে হেঁটে দরজা খুলে দেয় রোজা। উৎস অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে হেসে জিজ্ঞেস করে, ‘কি-রে রোজানু, সবাই নিচে আনন্দ করছে তুই একলা ঘরে বসে বসে মশা মারছিস না-কি?’

কিন্তু ঘরে ঢুকেই মুখ থেকে হাসিটা মিলিয়ে গেল উৎসের। ব্যাগপত্র গোছগাছ করে, বইপত্র গুছিয়ে সম্পূর্ণ তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোজা। ওর চোখ ফোলা, রক্তিম আভা ছেয়ে আছে চেহারায়, নাকের ডগা টকটকে লাল। এককথায় বিধস্ত দেখাচ্ছে ওকে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটা এতক্ষণ কেঁদেছে। কিন্তু কি এমন হলো যে রোজা কাঁদছে? উৎস ব্যথাযুক্ত পা- নিয়েই নিষ্প্রভ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘কী-রে রোজানু? তোর এই অবস্থা কেন? এত রাতে ব্যাগপত্র নিয়ে কোথায় যাচ্ছিস?’

রোজা শান্ত, ভাঙ্গা গলায় জবাব দিল, ‘আমি এখনি বাড়ি ফিরে যেতে চাই ভাইয়া। দয়া করে তুমি কী আমাকে নিয়ে যাবে?’

উৎস ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘এত রাতে?’

রোজা দৃঢ় কন্ঠে বলল, ‘হুম, এত রাতেই।’

‘কিন্তু হয়েছেটা কী? তোকে কেউ কিছু বলেছে? কে কী বলেছে বল, আমি এক্ষুনি তাকে শাস্তি দেব। বলনা রোজানু!’

রোজা ধারালো কন্ঠে উত্তর দিল, ‘আমি আর এক মুহূর্তও এ-বাসায় থাকতে চাই না ভাইয়া। আমাকে গ্রামে দিয়ে আসো। আর যদি না যেতে পারো তো, আমি একাই যেতে পারবো।’

উৎস হতভম্ব হয়ে গেল। হলো টা কী ওর বোনটার? এমন করছে কেন রোজানু? ওর মতো শান্তশিষ্ট মেয়ের এরকম বিধ্বংসী রুপ তো কখনো দেখে নি। বাড়ির লোকজন কী ওকে কিছু বলেছে? উৎস চিন্তাযুক্ত হয়ে ওর বোনের রক্তিম চেহারার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে ওর মনোভাব।

——————————–
Group – Israt’s Typescripts

[নোট: রোজার সিদ্ধান্ত কী ঠিক? ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। রি-চেইক করা হয় নি। গঠনমূলক মন্তব্যের প্রত্যাশায় আজকের পর্বটি।]

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here