#ফেরা
২.
হাতের চিঠিটা ব্যাগে রেখে চুপচাপ রিক্সায় উঠে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
নিধি সঞ্চয়কে রাগী স্বরে বললো
– বললাম যে কিছু বলতে হবেনা। আর যা বললি তাও ওরে লজ্জায় ফেলে দিলি।
সঞ্চয় নিজের সাফাই দিয়ে বললো
– আরে ও যেভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিলো আমার কেমন যেন লাগছিলো। হার্টবিট বেড়ে গিয়েছিল, গলা শুকিয়ে আসছিলো….
– হয়েছে তোমার সাফাই গাওয়া। ও এমনিতেই লাজুক টাইপের তার উপর তুমি করেছো অকাম।
– দোস্ত প্লিজ ওকে একটু কনভিন্স করার চেষ্টা করিস। তা না হলে আমি মরে যাবো রে।
– ধুর এসব ডায়লগ দেয়া বন্ধ করে।
– ডায়লগ না সত্যি!
মা রাতে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর শাজু চিঠিটা নিয়ে ছাদে এসে দাঁড়ালো। তিন তলার এই বাড়িতে শাজু আর তার মা রানু তিনতলার ফ্ল্যাটে থাকে। প্রত্যেকটা ফ্লোরে দুটো করে ফ্ল্যাট কিন্তু তিন নম্বর ফ্লোরে একটা ফ্ল্যাট আর অন্য ফ্ল্যাটের জায়গাটা ফাঁকা।এটাই এই তিনতলা বাড়িটার একমাত্র ছাদ। যেই ছাদে শাজুর একচ্ছত্র আধিপত্য।
রাতের আকাশের দিকে তাকিয়ে শাজু মুচকি হেসে চিঠিটা পড়তে শুরু করলো।
নিধি ওকে যেভাবে বলেছে তাতে এটা লাভ লেটার ছাড়া অন্য কিছু হওয়ার সম্ভাবনা কম।
পরীক্ষার খাতায় যেভাবে চিঠি লিখে ঠিক সেভাবেই লিখা। হাতের ডান পাশে তারিখ, স্থান থেকে শুরু করে সব নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে। অদ্ভুত মানুষ! প্রেমপত্র কি এভাবেও লিখা যায়?
হয়তোবা যায়, তাতে কী?
শাহাজাদী,
কেমন আছো? আমি কেমন আছি ঠিক বলে বুঝাতে পারবোনা। কখনো ভালো আবার কখনো খারাপ। কখনো নিজের অজান্তেই হাসছি আবার কখনো সেই হাসি মিলিয়ে যাচ্ছে দূর আকাশের নীলিমায়! নিশ্চয়ই তোমার হাসি পাচ্ছে এরকম আবোলতাবোল কথা শুনে? তাহলে হাসো। প্রিয় মানুষের হাসির তুলনা হয়না। আচ্ছা তুমি এখন কী করছো?
খোলা ছাদে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিঠিটা পড়ছো আর মুচকি মুচকি হাসছো?
সামনাসামনি বলার সাহস পাচ্ছিলাম না। সেলফোনে যে বলবো তারও সাহস নেই। তাই এই আদি অকৃত্রিম পদ্ধতিতে বলার চেষ্টা।
শাহাজাদী তোমাকে ভালোবাসি। ঠিক কতটা আমার ধারণা নেই। তবে ভালোবাসি। আমি ভালো যদি না বেসে থাকো তাহলে সরাসরি না করে দিও। আমি কিছুই মনে করবো না। কিন্তু আমাকে ভুলের মধ্যে রেখোনা। তাহলে আমার ভেতরের সত্ত্বাটা মরে যাবে।
বেশ সিরিয়াস মুডে কথাগুলো লিখে ফেললাম। কী করবো বলো? সম্পর্কে সবকিছু স্বচ্ছ থাকতে হয়। কোনো রকম অস্বচ্ছতা নিয়ে সম্পর্কে জড়ানো ঠিক না।
তুমি আমার কাছে অন্য মেয়েদের তুলনায় আলাদা। মান্না দে’র একটা গান আছে। আমার খুব পছন্দের। শুনবে? আমার কেনো যেন মনে হচ্ছে গানটা তোমারও ভালো লাগবে।
” হয়তো তোমারই জন্য হয়েছি প্রেমে যে বন্য
জানি তুমি অনন্য তবু আশায় হাত বাড়াই ”
প্রিয় অনন্য, ভালো থেকো। হয়তো তুমিও একদিন আমায় বাসবে ভালো। উত্তরের অপেক্ষায় থাকবো।
ইতি
সঞ্চয়।
চিঠিটা পড়ে শাজুর কেমন যেন লাগলো। কেউ একজন তার এতোটা জানে?
নিধি বলেছে কিন্তু নিধি তো আর সেধে বলতে যায়নি। কীভাবে, কখন তাদের প্রথম দেখা তার হিসেবও কি ছেলেটা রেখেছে? ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে ছেলেটা ঢোক গিলছিলো বারবার। নার্ভাস লাগছিলো বেচারাকে।
” প্রেয়সীর চোখে চোখ রেখে ভালবাসি তোমায় বলার সাহস যার নেই, সে কি সত্যিই ভালোবাসতে জানে?”
ধবধবে সাদা কাগজে গুটিগুটি অক্ষরে প্রশ্নবোধক বাক্যটি লিখে, উদাসীন দৃষ্টিতে লাইনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। কাগজ টা ভাজ করে ব্যাগের ছোট্ট পকেটে রেখে দিলো।
মা কখনো তার ব্যবহৃত জিনিসপত্রে হাত দেননা। শাহাজাদী নিজেই গুছিয়ে রাখে।
সন্ধ্যায় চায়ের পানি চুলায় দিবে এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠলো। চায়ের পানি চুলায় দিয়ে দরজা খুলে দিলো। নিধি সবকয়টা দাঁত বের করে হেসে দিয়ে বললো
– ভিতরে আসবো কি?
– না, আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে নথিপত্র পাঠ করুন।
নিধি হাসতে হাসতে ভেতরে ঢুকে দরজা আটকে দিয়ে বললো
– চিঠিটা দে।
– চা বানানো হোক তারপর দিবো।
– না এখনি দিতে হবে।
নিধিকে চিঠিটা পড়তে দিয়ে রান্নাঘরে পা বাড়ালো শাজু।
তার একঘেয়েমি আর একাকীত্বের জীবনে অন্য কেউ একজন আসবে। হয়তোবা সে চিরদিন থেকে যাবে আর না হয় ক্ষণিকের স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে।
*****
মুক্তা রহমান এক হাতে কাঁচা বাজারের ব্যাগ আরেক হাতে ভ্যানিটি ব্যাগ নিয়ে তিনতলায় উঠে এলেন। সেল ফোন বাজছে কিন্তু এখন ধরার মতো সময় নেই। রাত ৯ টার মতো বাজে মেয়েটা খুদায় কষ্ট পাচ্ছে কিনা কে জানে।
কলিং বেল চাপার সাথে সাথেই দরজা খুলে দিয়ে শাজু বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে রান্নাঘরে রাখলো। আজকেও তার মা বাজার থেকে পায়ে হেঁটে এসেছেন।
কতো বার যে শাজু তাকে বাজার হাতে নিয়ে অন্ততপক্ষে হেঁটে আসতে নিষেধ করেছে তার ইয়ত্তা নেই।
ডাইনিং টেবিলের চেয়ার টেনে বসলেন মুক্তা। একটু বেশি ক্লান্ত শরীর। রাতের রান্না করাও নেই।
শাজুকে ডেকে বললেন
– রাতে কী খাবে? রুটি ভাজি করবো নাকি ভাত খাবে?
– রান্না আমি করে রেখেছি।
মুক্তা স্বস্তিবোধ করলেন।
– তাহলে আমি ফ্রেশ হয়ে নেই। একসাথে খেয়ে নিবো।
শাজু টেবিলে খাবার গুছানো অবস্থায় খেয়াল করলো মা আজকে একটু বেশি ক্লান্ত। কোনো কিছু কি হয়েছে? অফিসে কোনো সমস্যা? হলেও মা তাকে নিজ থেকে জানাবেনা।
তাকেই জোর করে জানতে হবে কী হয়েছে? কেনো মন খারাপ?
মুক্তা বাসার কাপড় পড়ে, হাত মুখ ধুয়ে এসে খেতে বসলেন। ঘরের বেশিরভাগ কাজ তার এই ছোটো মেয়েটাই করে। কাজের বুয়া এসে কাপড় ধোয়া আর ঘর মোছা আর হাড়িপাতিল মেজে দিয়ে যায়। রান্নাটা করেন মুক্তা ও শাজু মিলেমিশে। যদিও মুক্তা চাননা মেয়েটা এইবয়সেই সংসারের প্রতি মনোযোগী হন। পড়াশোনা ঠিকঠাক মতো করে ক্যারিয়ার হলেই হলো। খাবার টেবিলে মুক্তা বললেন
– তোমার পড়াশোনার কী খবর?
– এইতো চলে আম্মু।
– সাব্বির তিন যাবত তোমাকে পড়াতে আসছেনা। কারণ টা তুমি জানো?
শাজু মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে বললো
– আম্মু উনি আমাকে একটা বাজে কথা বলেছেন।
– কীরকম বাজে কথা?
মুক্তা বিস্মিত হয়ে প্রশ্নটা করলেন।
– আমি ওসব মুখে আনতে পারবোনা। কাগজে লিখে দিবো।
– আমাকে আগে বলোনি কেনো?
– আম্মু আমি ভেবেছিলাম তুমি আমাকে রাগ করবে।
– রাগ তোমাকে কেনো করবো? সাব্বিরকে রাগ করবো। সাহস কতো বড় স্টুডেন্টকে বাজে কথাবার্তা বলে।
– আম্মু উনি আমাকে নিষেধ করেছেন বলতে। বললে নাকি আমার ছবি সোস্যাল মিডিয়াতে তে ছেড়ে দিবে।
মুক্তা কোনোমতে প্লেটের ভাত টুকু শেষ করে এঁটো থালাবাসন সিংকে রেখে দিলেন। মেয়েকে পড়তে বসতে বলে দিলেন।
কাগজে দুটো লাইন লিখে শাজু তার মায়ের হাতে দিয়ে বললো
– মেয়ে টিচার টিউটর হিসেবে ভালো মেয়েদের জন্য।
মুক্তা কাগজে লাইন দুটো পড়ে মেয়ের দিকে তাকানোর সাহস পেলেন না লজ্জায়। টিচার হয়েও এভাবে এসব বলতে পারে কেউ?
” শাহাজাদী তোমার গোলাপি ঠোঁট দুটোকে ছুঁয়ে দেয়ার সুযোগ দিবে আমায়?”
কাগজ টুকরো টুকরো করে ময়লার ঝুড়িতে ফেলে দিলেন মুক্তা।
চলবে…
~ Maria Kabir