#ফেরা
২১.
” আপা, আপনি এ খবর কাউকে বলবেন না তো?” তাহিরা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হয়তোবা ইতিবাচক কিছু শুনতে চাচ্ছে সে।
তাহিরার পাশে এসে দাঁড়িয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ” তুই কি চাস? ”
তাহিরা কোনো উত্তর দিল না। মিনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিনা উত্তর না পেয়ে বলল, ” আমি জানি তুই এখনো আগের মতোই ভালোবাসিস। কিন্তু বাসায় জানলে কী হবে তোর ধারণা আছে?”
” আছে কিছুটা। ” তারপর কিছুসময় চুপ থেকে বলল, ” আমি নিজেই সবকিছু করবো। কিন্তু আপনি পরিবারের কাউকে জানাবেন না, দয়া করে। পরিবার জানলে ওর সাথে খারাপ কিছু করা হবে। ” মিনা মাথায় এখনো হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন৷
” তুই এতো কিছুর পরেও ওর পক্ষ নিচ্ছিস?”
” আপা, আমি স্বীকার করি ওর দোষ ছিল। কিন্তু এতটাও না যে, অপমান অপদস্ত হেয় করতে হবে৷ পরিবারের মধ্যে ওকে ঝামেলায় ফালানোর মানে হয়না। আমাদের মধ্যে যা-ই ছিল সেটা সত্য ছিল। ” কথাগুলো বলার সময় তাহিরার গাল ভিজে উঠছিল। কথাগুলো সে খুব কষ্ট করে নিজের ভেতর থেকে টেনে বের করে এনেছে। সঞ্চয়ের সাথে যদি সত্যি তার বিয়ে হয়ে থাকে তাহলে সে কী করবে জানে না। কিন্তু এটা ঠিকই তার মাথায় এসেছে যে, আর যাই হয়ে যাক পরিবারকে জানানো যাবে না৷ তার বাবার স্ট্রোকের পেছনে দায়ী রিদ্দি। অন্য কেউ নয়। আর এই সত্য তার পরিবার মেনে নিতে চায়না৷
” আমি বলবো না কিন্তু অন্য কেউ কি কখনো বুঝতে পারবে না?”
” বুঝতে পারবে কিন্তু সময় লাগবে। আমি এই সময়ের মধ্যে একটা কিছু করে ফেলবো। ” মিনা বুঝতে পারলো না তাহিরা কী করে ফেলার কথা বলছে বারবার। তার হঠাৎ করে ভয় লাগছে । বড় ধরনের ঝামেলা সামনে বসে আছে।
” মামুনের পরীক্ষার পরেই নাকি তোকে উঠিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা । তার আগে তোকে কিছু একটা করতে হবে৷ উঠিয়ে নিয়ে গেলে বিষয়টা আরো গভীর হবে। ” মিনার কথার প্রতি উত্তরে তাহিরা কিছুই বলল না৷ জানালা দিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে রইলো।মিনার মনে পড়লো, কত রাত যে এভাবে কাটিয়ে দিয়েছে তার হিসাব নাই। ঘুরেফিরে সেই একই পয়েন্টে এসে দাঁড়িয়েছে এই দুই প্রাক্তন। এর পরিণতি কী হতে পারে তার ধারণা করার সাহসও সে পায়না। তার বাবা থাকেন নিরিহ প্রকৃতির রূপ ধরে কিন্তু আসলে তার প্রকৃতি পুরোটাই আলাদা।
” আমার মোবাইল দিয়ে যাবো? মামুনের সাথে কথা বলবি?”
” না, তাহলে মন অন্যকিছু আবদার করে বসবে। আমার ঘনিষ্ট সম্পর্কের দিকে যাওয়াটা ঠিক হয়নি৷ আমি জানি সে ভুল করেছে কিন্তু… ” তাহিরা থেমে গেল। সে বুঝতে পারছে না কী বলবে!
” তুই ক্যামনে ওর সাথে সংসার করবি? অতীত মনে পড়বে না? মনে পড়বে না একসময় ওর একটা ভুলের জন্য তোকে কতটা কষ্ট পেতে হয়েছে? ”
” আমি তো সম্পর্ক ছিন্নভিন্ন করে ফেলেছিলাম। কিন্তু ভাগ্যই তো কাছে টেনে এনেছে। চাচা চাচীই তো বিয়ে দিয়ে দিল। ” মিনা হঠাৎ প্রশ্ন করে বসলো, ” তুই কি জানতি মামুনই সঞ্চয়? ”
” না, জানলে আমি আম্মুর সাথে করা ওয়াদা ভাঙতাম না। আমি আম্মুকে ওয়াদা করেছিলাম ওর সাথে কোনোদিন যোগাযোগ করার চেষ্টা করবো না। এবং আমি কথা রেখেছিও। আমি দিনের পর দিন আর রাতের পর রাত জ্বলে পুড়ে মরেছি কিন্তু পেছনে ফিরে তাকাইনি। ”
” কিন্তু ওয়াদা তো ভাঙা হয়ে গেছে। ” মিনার কথায় সায় দিয়ে বলল, ” অনিচ্ছাকৃত ভাবে। ভাগ্যে ছিল সে আমার। সেখানে আমার কিছু করার আছে মিনা আপা?”
মিনা কী উত্তর দিবে ভেবে পাচ্ছে না।
****
তাহিরার চাচীর নাম্বার থেকে কল আসাতে সঞ্চয় খানিকটা অবাক হলো। কী কারণে হঠাৎ চাচী তাকে কল করলেন এটাই তার মাথায় আসছে না। পরোক্ষণে সে ভাবলো, তাকে কল করতেই পারে। সে যেহেতু এখন ওই বাড়ির মেয়ের জামাই। খোঁজ খবর না নিয়ে তো পারেনা। তার উপর নতুন জামাই সে।
সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করার পরে তার পরীক্ষা কবে সেটা জানতে চাইলেন মনো। সঞ্চয় তারিখ বলার সাথে সাথে মনো দ্বিগুণ মনোবল নিয়ে আবদার করে বসলেন।
আবদার করলেন, ” একটা দিনের জন্য হলেও শ্বশুড়বাড়িতে এসে ঘুরে যাও। আমার খুব সখ ছিল। ছেলের পরীক্ষার আগে আদর যত্ন করার৷ কিন্তু ছেলে তো আর হলো না৷ তাই তোমাকে দিয়েই সখ পূরণ করবো। আমার দুই মেয়ের চাকরিজীবী অবস্থায় বিয়ে করেছিল। তাই আর ও সখ অপূর্ণই রয়ে গেছে। তাই তুমিই শেষ ভরসা। ” সঞ্চয়ের মনে হলো অদ্ভুত সখ তো বটে! কিন্তু পরীক্ষা কাছে থাকা অবস্থায় তো বেড়ানোটা শোভা পায়না। ফাইনাল পরীক্ষা৷ একটাতে আটকালে একটা বছর মাটি৷
” চাচী আম্মা, এখন তো আসা সম্ভব না৷ আমি পরীক্ষা দিয়েই চলে আসবো। আপনি কিছু মনে করবেন না। আসলে ফাইনাল পরীক্ষা। ”
” একটা দিন আর রাতের জন্য তো তেমন কিছু হবেনা৷ বই খাতা সঙ্গে নিয়ে আসবা। তাহলে তো হয়৷ আর মুরব্বিদের দোয়া না নিলে পরীক্ষা হয় নাকি? এসে বেড়িয়ে যাও আর দোয়া নিয়ে যাও। তাহিরাও তুমি যাওয়ার পরে থেকে উদাসীন হয়ে গেছে। সারাদিন মুখ কালো করে এক জানালার কাছে গুটিসুটি মেরে বসে থাকে। তুমি আসলে ওরও মন ভালো হয়ে যাবে৷ ” এই ধরনের অদ্ভুত আবদার কীভাবে করতে পারে?
বাধ্য হয়ে তাকে শ্বশুড়বাড়িতে বই খাতা নিয়ে যেতেই হলো। বিকালের দিকে পৌঁছে তাহিরার টিকিটাও তার চোখে পড়লো না৷ রান্নাঘরে কণ্ঠ শুনেছিল কিন্তু কথা বলার সময় হয়ে উঠেনি।
রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে শোবার ঘরে একটা ক্ষীণ আশা নিয়ে সঞ্চয় ঢুকল। কিন্তু বরাবরের মতো সে আশাহতই হলো। তাহিরার পড়ার টেবিলে বই নিয়ে বসলো ঠিকই কিন্তু মাথায় ঘুরছিল কেনো তাহিরা এভাবে পালিয়ে বেড়াচ্ছে, এই প্রশ্ন। বউ কেনো দূরে দূরে পালিয়ে বেড়াচ্ছে এই প্রশ্ন তো কাউকে করতেও লজ্জা পাচ্ছে সে। এদিকে বইতেও মন আসছে না। আগামীকাল সকালেই সে আবার ফিরে যাবে ক্যাম্পাসে। হাতে মাত্র কয়েকটা ঘণ্টা! এদিকে অতিরিক্ত মাত্রায় খাওয়ার জন্য প্রচুর ক্লান্ত আর ঘুম আসছে তার। কতক্ষণ এভাবে জেগে থাকতে পারবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সঞ্চয় লাফিয়ে উঠলো। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ” কে?”
” আমি তোমার চাচী। ”
” ওহ, চাচী। ভেতরে আসুন, দরজা খোলাই আছে। ” দরজা খুলে পুরো ঘরে চোখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ” তাহিরা কই, মামুন?”
” ওকে তো রাতের খাবারের পরে আর দেখিনি। ”
” আমাকে জানাবে না? ”
” আমি ভেবেছিলাম ও আপনার সাথে। তাই আরকি বলিনি৷ ”
“এভাবে ঘরে স্বামীকে বসিয়ে রেখে নিজে আকাশ বাতাস দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছেমরি। তুমি একটু অপেক্ষা করো। আমি ওকে কান ধরে টেনে নিয়ে আসছি। ” মনো দ্রুত পায়ে চলে গেলেন৷ তিনি জানেন এই মেয়ে কোথায় আছে। জামাইকে এইভাবে হুদাই বসায় রাখলে চলে? দেখা যাবে অন্য দিকে পা বাড়াবে৷ তখন তো কপাল চাপড়ে কাঁদবে! কিন্তু এখানে নিজেরও দোষ ছিল সেটা ভুলেও স্বীকার করবে না৷
চলবে…
~ Maria Kabir