ফেরা পর্ব-২০

0
598

#ফেরা

২০.

রাতে মিনা ঘুমানোর আগে ফেসবুকের ম্যাসেজ দেখছিল। নিধি তো ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট একসেপ্ট তো করেনিই। ম্যাসেজ সিন তো দূরে থাক! ডাটা অফ করতে যাবে আর তখনই নিধির ম্যাসেজ আসলো। মিনা ম্যাসেজ পড়ে কিছুটা স্বস্তি পেল। সঞ্চয়ের আইডি প্রথমে দিতে চাচ্ছিল না। তাহিরার পপরিস্থিতি খুলে বলার পরে আইডি লিংক খুঁজে দিল। আইডিতে ঢুকে মিনা আকাশ থেকে পড়লো। এতো মামুনুর রশীদ, তাহিরার স্বামী! নিধির তো এই ছেলেকে চেনার কথা না। তাহিরা ম্যাসেঞ্জারে কল দিল। নিধি রিসিভ করার সাথে সাথে মিনা বলল, ” তুমি যে আইডির লিংক দিয়েছ সেটা তো তাহিরার হাজবেন্ডের। তুমি তাকে চিনলে কীভাবে? ”
” মিনা আপা, আমি আপনাকে ঠিক আইডিই দিয়েছি। ওর আগের আইডি ডিএক্টিভেট। আগের আইডির নাম ফারদিন সঞ্চয়। আর ভালো নাম মামুনুর রশীদ। আর এখন এই নামেই আইডি ব্যবহার করে। ” নিধির কথা শুনে মিনার মনে হলো তারও হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। পাগলের সাথে থাকলে পাগল হইতে হয়। কথাটা সত্য।
” তাহিরার হাজবেন্ডের নামও মামুনুর রশীদ। এমনকি একই কলেজের ওরা। ” নিধি অবাক হয়ে বলল, ” বলেন কি আপু? এও কি সম্ভব? ”
” আমার কাছে ওর হাজবেন্ডের আইডি লিংক আছে। আর যে দিয়েছে সে ভুল তথ্য দেয়ার মানুষ না। ” নিধি বুদ্ধি করে বলল, ” আমাকে আপনার কাছে যে আইডি লিংক আছে সেটা দিন। ”
লিংক দেয়ার পরে নিধি কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সঞ্চয়ের সাথে ফেসবুকে কানেক্টেড না সে। কিন্তু মাঝেমাঝে ম্যাসেজ করে শাজুর খবর জানতে চায় বলেই আইডির খবর সে জানে। কিন্তু ওই আইডিতে ঘুরে দেখার বা সঞ্চয়ের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে তার জ্ঞান নেই। আইডিতে ঘুরতে গিয়ে ম্যারিড দেখে আরো অবাক হলো। মানে হচ্ছে টা কী? শাজুর পাশাপাশি কি তারও মাথা খারাপ হলো নাকি? শাজু নাকি আবার ঘনিষ্ঠ মুহুর্তে সঞ্চয়ের নাম বারবার উচ্চারণ করেছে। মানেটা কী?
নিধি সঞ্চয়ের ম্যাসেঞ্জারে নক করলো । এদিকে মিনা আপা তার প্রতি উত্তরের অপেক্ষায় আছে। সঞ্চয় সাথে সাথে ম্যাসেজ সিন করলো।
” কীরে? এতোদিন পরে আমার খোঁজ নিচ্ছিস যে?”
” তুই রিদ্দিকে বিয়ে করলি কবে?”
এই প্রশ্নে সঞ্চয় এংরি রিএক্ট দিয়ে রিপ্লাই দিল, ” রিদ্দিকে বিয়ে করেছি, এই কথা কে বলল?”
” তাছাড়া আর কাকেই বা বিয়ে করবি তুই? ওই মেয়েই তো তোর জীবন মরণ! ” এই ম্যাসেজে হা হা দিয়ে রিপ্লাই দিল, ” এইসব বলিস না। তোর বন্ধবীর কপাল আর পুড়াইস না। আমি কীভাবে কীভাবে যেন, শাজুকেই বিয়ে করে ফেলেছি। ”
” আমার সাথে মজা করছিস? বিয়ে যদি করেই থাকিস তাহলে ছবি দে। ”
” ছবি সামনে বার তুলে পাঠাব। ছবি তোলার মতো পরিস্থিতিতে ছিলাম না। ”
” তুই মিথ্যা বলছিস না তো?”
” না রে, এখন যাই আমার আবার পরীক্ষা। ” সঞ্চয়ের হঠাৎ মন রাঙা হয়ে গেছে। পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল এক মাস পরে কিন্তু পরীক্ষা পনেরো দিন এগিয়ে দেয়া হয়েছে। মা বলেছেন, পরীক্ষা শেষ হলেই শ্বশুড়বাড়িতে যাওয়ার উপায় খুঁজে দিবেন৷ কিন্তু পরীক্ষা ভালো হতে হবে। সঞ্চয়কে একা একা হাসতে দেখে জারিফ বলল, ” কীরে, বউয়ের সাথে ঝুন্টু মুনু করার কথা মনে পড়ছে নাকি?”
” তুই স্লা আছিস খালি ওসব নিয়ে। ”
” কী করবো বল? বাপ মা তো দেখে না তার ছেলে মরুভূমিতে এক ফোঁটা পানির জন্য আহাকার করে মরছে। তাই আরকি বিবাহিত বন্ধুদের গল্প শুনে সান্ত্বনা দেই৷ ”
” পরীক্ষা শেষ হতে কতদিন লাগবে রে?”
” এক দেড় মাস তো লাগবে বন্ধু। ” তখনই সঞ্চয়ের মোবাইলে রিদ্দির ম্যাসেজ আসার কারণে আগের উচ্ছাস মিলিয়ে গেল।
” রিদ্দির কী করি বল তো?”
” এই মাইয়া তোর জীবন তেজপাতা করে দিল। তুই শাহাজাদীকেও হারাইলি ওই মেয়ের জন্য। ” আমি ভুল করেছি এবং স্বীকার করেও নিয়েছি। আমি ক্ষমা অব্দি চেয়েছি রিদ্দির কাছে। আর কী করতে পারি? ”
” আসলে রিদ্দি তোকে ভালোবাসে। ও চায় কী সেটা তো জানিস৷ তা নাহলে ছয় সাত বছর ধরে তোর পেছনে লেগে থাকতো না। ”
” আমি জানি কিন্তু কিছু করার নেই আমার । ওর প্র‍তি আমার কোনো অনুভূতি কাজ করে না। আমি কেনো ওর সাথে টাইম পাস করেছিলাম তারও কোনো কারণ খুঁজে পাই না। আমার ভুল ছিল ওর অনুভূতির খোঁজ জানা সত্ত্বেও পেছনে না ফেরাটা। কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসতে পারবো না। ভালোবাসা বার বার জীবনে আসে। এটাও যেমন সত্য। ঠিক তেমন ভাবে ভালোবাসা একবার জীবনে আসে এটাও সত্য। ” সঞ্চয় দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বলল।
” তাহলে তাহিরার জন্য এতো পাগল হয়ে আছিস কেন?”
” কারণ তাহিরাই শাজু। ”
জারিফ প্রথমে অবাক হলো তারপর নিচু স্বরে বলল, ” রাহাত জানে?”
” না, আমি জানি ও রিদ্দির ফ্যান। ”
” আমাকে বলছিস আর কাউকে বলিস না। আমি অবাক হই তোকে দেখে। সাধারণত মানুষ একবার ভুল করে কাউকে হারালে আর শুধরানোর চেষ্টা করে না। কিন্তু তুই তো আগের চেয়েও সুবোধ বালক হয়ে গেছিস। ”
” তাছাড়া উপায় ছিলো না। আমি তখন কেমন পরিস্থিতিতে ছিলাম তুই ধারণাও করতে পারবি না। একদিকে অসুস্থ শাজু, একদিকে আমার বড় ফুপু, আরেক দিকে শাজুর ভিডিও ভাইরাল। আর দোষ আমার। রিদ্দি এদিকে আমার বড় ফুপুর বাসায় গিয়ে বসত গেড়েছে। শাজুর মা তো আমার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ করিয়ে দিল৷ তারপর… ” জারিফ কথার মাঝে বলে উঠলো, ” তোর শ্বাশুড়ি আম্মা তো চিনতেন তোকে। তাহলে বিয়েটা কীভাবে সম্ভব হলো? ”
” না, আমাকে সামনা-সামনি কখনো তিনি দেখেননি। একটা বিষয় আমি মাথায় ঢুকাতে পারছি না। সেটা হলো, শাজুর দাদা বাড়ির কারো সাথে যোগাযোগ ছিলো না। কিন্তু ও এখন ওর চাচার বাড়িতেই আছে। এমনকি বিয়ের সময় ওর বাবা মাও ছিলো না। ”
” তোর মা’কেই তো জিজ্ঞেস করতে পারোস। ”
” মনে থাকে না৷ আবার বাসায় ঝামেলা হয়েছে৷ বড় ফুপু তাহিরার ছবি দেখে নাকি কাজের মেয়ে বলে সম্বোধন করেছে৷ এমনকি এই ঘটনা তাহিরার চাচীর কানেও গেছে। কেবল বিয়ে হয়েছে আর এখনই শুরু করে দিয়েছে। ” জারিফ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে বসলো, ” শাজু, রিদ্দির থেকে সুন্দরী না?”
” না, শাজু… এটা বলা ঠিক না। সৌন্দর্যের দিক থেকে রিদ্দির আশেপাশেও নেই শাজু। মা কেনো ওকে পছন্দ করলো, আমি বুঝতে পারছি না। ” জারিফ কিছুসময় ভেবে বলল, ” এখানে কোনো প্যাঁচ আছে, দোস্ত। আগে বল তোর বড় ফুপু আর মা’র মধ্যে কেমন সম্পর্ক? ”
” দা কুমড়া সম্পর্ক। বড় ফুপু তো সুযোগ পেলেই মা’কে তীর ছুড়েন। ”
” তোর ফুপু কি আগে থেকেই জানতেন এই বিয়ে হবে এমন কিছু? ”
” না, মা সবাইকে জানাননি৷ হাতে গোণা কয়েকজন মাত্র। ”
” তোর মা তাহলে মাস্টার প্ল্যান করেছন। বাপরে কী সাপ লুডু খেলা! তুই তো এদের মধ্যে চ্যাপ্টা হয়ে যাবি রে। ”
” তাহাকে পেয়েছি, এটা কি কম?”
” আমার মনে হয় তুই মিথ্যা বলছিস। শাজু অনেক সুন্দর। তা নাহলে তোর মতো হ্যান্ডসাম লেডি ক্রাশ কীভাবে ওর প্রেমে পড়ে?”
জারিফের হাতে এতক্ষণ গিটার ছিল। সঞ্চয় হাত থেকে এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বলল, ” একটা গান শুনবি? আমাদের ফাইনাল ব্রেকাপের পরে এই গানটা মধ্যরাতে প্রায়ই গাইতাম। নিজেকে প্রচণ্ড একা আর শূন্য মনে হতো। মনে হতো আমার ভেতরে কেউ মারিয়ানা ট্রেঞ্চের মতো গভীরতা তৈরি করে দিয়েছে। আর আমি সেই গভীরতায় ডুবে যাচ্ছি। ” জারিফ হেসে বলল, ” তাহলে আমারেও শোনা। দেখি আমার ভেতরে এমন শূন্যতা আহাকার করে উঠে নাকি। ” সঞ্চয় গিটারে সুর তুলল। তারপর গলা ছেড়ে গান গাইতে শুরু করল, ” এই অবেলায় তোমারই আকাশে
নীরব আপসে ভেসে যায়
সেই ভীষণ শীতল ভেজা চোখ
কখনো দেখাইনি তোমায়
কেউ কোথাও ভালো নেই যেন সেই
কতকাল আর হাতে হাত অবেলায়
কতকাল আর ভুল-অবসন্ন বিকেলে
ভেজা চোখ দেখাইনি তোমায়
সেই কবেকার ভায়োলিন
বেজে যায় কতদিন
প্রাণে চাপা ঢেউ
দেখেনি আর কেউ
কখনো অভিমান, অবাধ্য পিছুটান… ” জারিফ খেয়াল করলো সঞ্চয়ের গাল বেয়ে পানি এঁকেবেঁকে চলতে শুরু করেছে। জারিফ চোখ সরিয়ে আশেপাশের পরিবেশ দেখার ভান ধরলো। দুজনে মেসের ছাদে বসে গল্প করছিল। বেশ জমেও উঠেছিল কিন্তু হঠাৎ…

****
মিনা স্ক্রিনশট গুলো দেখে অনুভূতি হারিয়ে ফেললো। যে ছেলের ছায়ার কাছ থেকে সরানোর জন্য তাহিরার নাম পরিবর্তন করে দেয়া হয়েছে। আর সেই ছেলেই শেষ পর্যন্ত ভাগ্যে জুটলো। তাহিরাকে সে কী বলবে? না বলেও তো উপায় নেই। মিনা বিছানা থেকে নেমে সোজা তাহিরার শোবার ঘরের দিকে গেল। দরজা ভেড়ানো ছিলো। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই তাহিরার দিকে নজর গেল। সেই একই ভঙ্গিতে জানালার কাছে বসে আছে। হাসনাহেনা গাছের ফুলগুলো তার সাথে যেন গল্প জুড়ে দিয়েছে।
” আপা, কিছু বলবেন?”
” হ্যাঁ ”
” নিধির সাথে কথা হয়েছিল?”
” হ্যাঁ, মামুনই সঞ্চয়। মামুনুর রশীদ ওর পুরো নাম। ” তাহিরা তার দিকে ঘুরে তাকাল। ঘরের বাতি নেভানো। কিন্তু বাহিরের পূর্ণিমা সেই অন্ধকারে অনেকটা জুড়ে বসেছে। সেই আলো আঁধারের খেলায় তাহিরার গাল বেয়ে পড়া নোনা পানিকে হীরকচূর্ণের মতো মনে হলো, মিনার কাছে।

চলবে…

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here