ফেরা পর্ব-১৯

0
465

#ফেরা

১৯.

তাহিরা ডালে লবণ হয়েছে কিনা দেখার জন্য তাহিরা খুন্তি খুঁজছিল। পাশ থেকে মিনা বলল, ” কীরে জামাই পছন্দ হয় নাই তোর? ” তাহিরা খুন্তি খুঁজে পাচ্ছিল না৷ এদিকে লবণের ঝামেলা হলে চাচী তাকে বিশ বার কান ধরে উঠবস করাবেন। মিনা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাহিরার কাজ দেখছিল। গ্যাসের চুলার উপর খুন্তি রাখা। কিন্তু তাহিরা আশেপাশে সব জায়গায় খুঁজছে। এর অর্থ মন এখানে নেই। একটা মাত্র চাচাতো বোন তাও যদি এমন বোবা, কানা হয় তাহলে তো সমস্যা। তার উপর কয়েকদিন পরে শ্বশুড়বাড়িতে যাবে। মিনা খুন্তি নিয়ে তাহিরার হাতে দিয়ে বলল, ” সামনে রেখে আশেপাশে খুঁজে মরছিস কেন?”
” ও আপা, খেয়াল করিনি। ”
” তোরে একটা প্রশ্ন করছিলাম। ” লবণ দেখা শেষ করে তাহিরা বলল, ” খেয়াল করে সারতে পারিনি, আপা। ”
” তোর জামাই পছন্দ হয় নাই?”
” এখন জেনে লাভ আছে? সেই সংসারই তো করতে হবে। ” তাহিরা দ্রুত কথাটা বলল। যান্ত্রিক জীবন তার অচেনা নয়। অনেক ছোট থেকেই তো এই জীবনে অভ্যস্ত সে। কিন্তু সেই যান্ত্রিক জীবনে সে একটা ছন্দ তৈরি করে নিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ একটা ধাক্কা এসে আর যান্ত্রিক জীবন থেকে সেই ছন্দও কেড়ে নিয়ে যায়। যে মেয়ের সাথে তার একবারের জন্যও কথা হয়নি। সেই মেয়ে তাকে রাস্তার মধ্যে মেরে, সেই ভিডিও সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দিল। মেয়েটার নাম, ছবি আর কিছু ভিডিও সে দেখেছিল।
” আমাকে খুলে বল হয়েছে কী?” মিনার প্রশ্নে তাহিরা বলল, ” তেমন কিছুই হয়নি। আর মামুন সাহেবকে দেখার তেমন সুযোগ হয়নি। ”
” কেনো? মামুন কি বোরখা পরে থাকে নাকি?” তাহিরা হেসে বলল, ” ঠিক তেমন কিছু না। ”
” তাহলে কী? রাতে কিছু হয় টয় নাই?”
” হয়েছে কিন্তু… ” মিনা কানে কানে বলল, ” কিন্তু কী? মজা পাস নাই?”
” আসলে আমি… আসলে মামুনের মধ্যে সঞ্চয়কে দেখেছি৷ ” মিনার হাসি মুখ ভাবলেশহীন হয়ে গেল। সে জানত হ্যালুসিনেশনের কথা কিন্তু বিষয়টা এতো দূরে এগিয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি।
” আমি মামুনের চেহারা এখনো দেখিনি। যদি মামুন এর ছবি দেখতে পারতাম। তাহলে হয়তোবা হ্যালুসিনেশন হতো না। ” মিনা কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। সঞ্চয়কে সে কখনো দেখেনি। মামুনকে দেখেছে হাতে গোণা কয়েক বার। চেহারাও ঠিক মনে নাই। মিনা ভেবে বলল, ” মা, তোরে ছবি দেয় নাই?”
” আমাকে নিয়ে নিতে বলেছিলেন কিন্তু ভুলে গেছিলাম। পরে আর খুঁজে পাইনি। ” তাহিরা চুলা নিভিয়ে দিয়ে বলল।
” ওর ফেসবুক আইডি থেকে তো ছবি দেখা যাবে। ”
” যদি না থাকে একাউন্ট? আমি তার হাতে স্মার্টফোন তো দূরে থাক বাটন ফোনও দেখিনি। ” তাহিরার কথায় মিনা দমে গেল। দুই গেয়ো ভূত একসাথে জুটেছে তাহলে। পারফেক্ট কাপল!
” ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়া ছেলের ফেসবুক একাউন্ট নেই? তোর কি মাথা খারাপ, তাহিরা?” কেন এই কথা বলল মিনা জানে না। একটু চেষ্টা করাই যায়। কিন্তু তার মনে হচ্ছে কোনো কাজ হবে না।
” আমার তো মাথা খারাপই। ”
মনো রান্নাঘরে লাউ শাক নিয়ে ঢুকলেন। আসার সময়ই দুজনের কুটুর কুটুর গল্প করার শব্দ কানে আসছিল তার। কাজ বাদ দিয়ে শুধু গল্প আর গল্প এদের। এক দেড় মাস পরে উঠায় দিতে হবে শ্বশুড়বাড়ির জন্য। আর এখনো রান্নাবান্না শেখাতে পারেনি তাকে।
” এইভাবে গল্প করলে, ওরে রান্না বান্না আর কাজকর্ম শিখামু ক্যামনে? ” মায়ের খোঁচা দেয়া কথায় বলল, ” আসছি সেই গতকাল রাতে। আর এখন দুপুর বারোটা বাজে। এতটা সময়ের মধ্যে কেবল কথা বলার সুযোগ হলো। আর তুমি বলতেছ, আমাদের গল্পের জন্য ওর শিক্ষা-দীক্ষা বন্ধ হয়ে আছে! মানে ভালোই ফাজলামি লাগায় দিছ। ”
” তোমার তো আর শ্বশুড়বাড়িতে থাকা লাগে না তাই বুঝো না দায়িত্ব আর সাংসারিক কাজকর্ম কী জিনিস! ওর তো বিয়ে হইছে এমন জায়গায় যেখানে শ্বাশুড়ির আঁচল ধরে ঘুরতে হবে গোল গোল। বুঝছিস?”
মিনা রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল। মনো লাউশাক কুলার উপর রেখে তাহিরাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” এই শাক এখনই বাছবি। একটা হলুদ আর মরা পাতা যেন না থাকে। ” মিনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” নিজে তো হাওয়ায় হাওয়ায় ঘুরে বেড়াস আর হুকুম দিয়ে কাজ চালাস। সবার তো আর তোর মতো কপাল হয়না। ”
মিনা ডাইনিং রুম থেকে বলল, ” রিনা আর তাহিরাকে উঁচু ঘরে বিয়ে দিতে পারলে না?”
” না পারিনি। সবার ভাগ্য এক না৷ পারলে ওরে কাজকর্ম শিখিয়ে চালু করে দে আর না পারলে ওর সময় নষ্ট করিস না। ” তাহিরাকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে গলা চড়িয়ে বললেন, ” কথা গিলছিস ক্যান? কাজে মন দে৷ শ্বশুড়বাড়িতে গিয়ে কি এভাবেই হা করে সবার খোটা শুনবি? ছেলের বড় ফুপু এখনই শুরু করে দিয়েছে৷ ” তাহিরা এবার বুঝতে পারলো চাচীর এমন আচরণের পেছনের কারণ।
মিনা ডাইনিং রুমে থেকে আবার রান্নাঘরে ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল, ” কী বলেছে শুনি তো? ”
” ক্যান শুনে কী করবি? ঝগড়া করতে যাবি? ”
মনো চেঁচিয়ে উঠলো। মিনা শান্ত স্বরে বলল, ” বলো, শুনি আমরা। ”
” বলেছে, মেয়ে কাজের মেয়ের মতো দেখতে৷ কাজের মেয়ে আনতেছে নাকি বউ? মেয়ের চাচা কী কী দিতে চাইছে ওমন ভাতিজীর জন্য? বাপ মায়ের ছাড়াছাড়ি হইছে এমন মেয়ে হলো অলক্ষুণে। আরো বলছে, আমার অতো মনে নাই। ” মনো পূর্বের তুলনায় নিচু স্বরে বলল।
মিনা বুঝতে পারলো যে, তাহিরাকে সাজানো গোছানো জাহান্নামে বিয়ে দেয়া হয়েছে। যেই সংসারে ফুপু এসে নাক গলায়, সেই সংসারে তো ওর শ্বাশুড়িই তো শান্তিতে নাই। তাহলে ওর কী হবে?

****

” আমি শাজুর খোঁজ পেয়েছি। আমি আগামীকালই সেখানে যাচ্ছি। চাকরিটাও হয়ে গেছে। পারফেক্ট টাইমিং! ” নীরব হাসি মুখে বলল। রিদ্দি বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল, ” আমি কী করবো বুঝতে পারছি না। ”
” আসলে তোমার উচিৎ-ই হয়নি আন্টির কথা শোনা৷ আমি আগেই বলেছিলাম, সঞ্চয়কে জোর করে বিয়ে করে নিতে। কিন্তু তুমি মহান সঞ্চয়ের মনে ভালোবাসা জাগার অপেক্ষায় আর আন্টির মধুর কথায় ডুবে ছিলে। ” নীরব বেশ ভালো মেজাজেই আছে। এতদিন পরে সে শান্তির সাথে স্বস্তি পেল। সঞ্চয় এখন বিবাহিত। তার আর শাজুর মাঝের পথ এখন পরিষ্কার।
” তুমি শিওর তো শাজু এখনো সিঙ্গেল আছে? ওই মেয়েকে বোকা দেখা গেলেও মনে হয় না ও বোকা অতোটা । ” রিদ্দির কথায় নীরব হেসে বলল, ” সবাই তোমার মতো তো না, রিদ্দি৷ তোমার সাথে আমার কথা ছিলো যে, শাজুকে ধমকাবে বা রাগ করবে সামনা-সামনি। কিন্তু তুমি কী করলে? তুমি ওরে পাবলিক প্লেসে চাকু দিয়ে কোপালে। তারপরও মেয়েটা তোমার নামে কেস করেনি। এমনকি ওর কাছে সব প্রমাণ ছিলো তোমার বিরুদ্ধে। কিন্তু ও তা ব্যবহার করেনি। আর তুমি কুপিয়েও ক্ষান্ত হলে না। সোস্যাল মিডিয়াতে ওকে ভাইরাল করে দিলে৷ ও কি পারতো না, সঞ্চয়কে দিয়ে তোমার ক্ষতি করাতে? করেছে কি?”
” এতো গুণগান গেয়ো না, নীরব। এতো সাধু হলে তো সঞ্চয়ের মতো ছেলের সাথে প্রেম করতে যেত না। ওই ছেলের আমি প্রেমিকা ছিলাম না তাই লিপ কিস করেছিল। আর সেখানে ও প্রেমিকাই ছিল। চার দেয়ালের মধ্যে কে কী করে সে খবর তো আর না বললে জানা যায়না। ”
” রিদ্দি, তুমি আসলেই ওর সাথে মেলামেশা করোনি। তাই জানো না। আমি কি মেয়ে চিনি না? আর ওদের মধ্যে তেমন কিছু হলে তো আমি শাজুর পিছুপিছু ছুটে বেড়াতাম না। আমি নিজেও কোনোদিন ওইসব পথে যাইনি। অনেক কষ্টে নিজেকে এসব থেকে দূরে রেখেছি একমাত্র শাজুর জন্য। ”
” তোমার বন্ধুর প্রেমিকা ছিল। একটা বারও কি মাথায় আসেনা? ”
” এই যুগে, কারো না কারো এক্স জিএফকেই বিয়ে করতে হবে। সেটা নিজের হোক বা অন্য কারো। তাই ওসব নিয়ে আমি ভাবি না। আমার ফ্যামিলি তো মোটামুটি রাজিই এখন খালি শাজুর ফ্যামিলি রাজি হলে হয়। ”

*****

মিনা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে মামুনের আইডি খুঁজে বের করলো। প্রোফাইলে দারুণ সুন্দর একটা ছবি টানানো। ছেলে তো একেবারেই আগুনের গোলা। মানে তাহিরার কপালে এতো সুন্দর ছেলে জুটলো কীভাবে? মিনা প্রোফাইলের ছবি তাহিরাকে দেখানোর জন্য মোবাইল এগিয়ে দিল। শাজুর মনে হচ্ছিল, দেখবে না। হ্যালুসিনেশনটা তাকে মিথ্যা একটা সুখ দিচ্ছে। খারাপ লাগছে না। পরোক্ষণেই ভাবলো, এভাবে তো জীবন চলে না। একটা না একটা সময় এই কল্পনা কেটে যাবে তখন কী হবে তার? এটা ভেবেই ছবিটার দিকে তাকালো। কিন্তু অবাক না হয়ে পারলো না। এখানেও সঞ্চয়কে দেখছে সে৷ হলো কী তার? মুখভঙ্গি দেখেই মিনা বুঝতে পেরেছে যে, ছবিতে সেই সঞ্চয় বাবাই বসে আছে। ছবি দেখে মামুনের বর্ণনাও দিল কিন্তু লাভ হলো না।
” সঞ্চয়ের আইডির নাম কী ছিল? আর ওর পুরো নাম কী? ” শাজু কিছু সময় চুপ থেকে বলল, ” ওর পুরো নাম কখনো আমাকে বলেনি। নাকি বলেছিল ঠিক মনে নাই। অনেক বছর আগের কথা না! ফেসবুক একাউন্টের নাম মনে আছে। ”
” তাহলে সেটাই বল ”
” ফারদিন সঞ্চয় ” কিন্তু এই নামে এমন কোনো আইডি খুঁজে পেল না তারা। যেটা সঞ্চয়ের হতে পারে৷
” সরাসরি আইডি লিংক হলে ভালো হতো। তোর বান্ধবী আছে না একটা? নিধি না কী নাম যেন৷ ওরে জিজ্ঞেস কর। ”
” ওর সাথে অনেক দিন যাবত আমার যোগাযোগ নেই। মোবাইল নাম্বারটাও ডিলিট করে ফেলছি। ” মিনা চিন্তায় পড়ে গেল। মামুনের কলেজের নাম দেখে খানিকটা অবাক হলো৷
” সঞ্চয় কোন কলেজে পড়তো রে? আর কতো সালে এইচএসসি পাশ করছে রে?”
তাহিরা কলেজের নাম আর সাল বলার পরে মিনা বলল, ” সঞ্চয় আর মামুন একই কলেজের এবং ব্যাচমেটও। ” তাহিরা হেসে বলল, ” তাহলে হয়েছে কাজ। কাজের মেয়ে হয়ে গেছিলাম এখন কলঙ্কিনী নামও জুটবে। ”
” নিধির আইডির নাম বল৷ ”
” স্রোতস্বিনী নিধি ” মিনা নাম শুনে অবাক হলো৷
” এ কী নাম?”
” ওর বর এই নাম দিয়েছে। ”
” তুই ঘনিষ্ঠ মুহুর্তে কি সঞ্চয় নাম উচ্চারণ করেছিলি? ”
” হ্যাঁ, কয়েকবার৷ কিন্তু উনি তো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না৷ ঘনিষ্ঠ মুহুর্তে অন্য পুরুষের নাম নিলে তো আমাকে আস্ত রাখার কথা না৷ উল্টো তাকে সন্তুষ্ট মনে হচ্ছিল। ”
” তুই নিজে তো একটা আস্ত পাগল আর আমাকেও পাগল বানানোর চেষ্টায় আছিস। তোর এই হ্যালুসিনেশনের বিষয়টা আমার মাথা খেয়ে ফেলছে। ” কথা বলছিল আর নিধির আইডিতে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট দিয়ে ম্যাসেজ লিখে পাঠিয়েও দিল মিনা। কিন্তু কোনো রেসপন্স পেল না। যা করার দ্রুত করতে হবে৷ তার নিজেরই পুরো বিষয়টা গোল মেলে লাগছে। কোথায় যেন একটা কিছু মিসিং আছে।

চলবে…

~ Maria Kabir

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here