#ফেরা
২৬.
( শেষ পর্ব )
সঞ্চয় কয়েক ঘণ্টা যাবত শাজুর বাড়ির সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে। মেইন গেটে বহুবার নক করেছে কিন্তু কেউই খোলেনি। কলিংবেল বাজিয়েও লাভ হয়নি। দুপুরের কড়া রোদে গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে কিন্তু কারোরই কোনো খোঁজ নেই। ক’দিন আগেই জামাই আদারের কোনো সীমা পরিসীমা রাখেনি শাজুর চাচা চাচী। কিন্তু এখন? এতো দ্রুত মানুষ পরিবর্তন হয় কীভাবে? দেয়াল টপকে কি বাসার ভেতরে যাওয়া ঠিক হবে? তার মা এসে খুব বিশ্রী ভাবে অপমানিত হয়ে গেছেন৷ এতটা বাজে অবস্থা হতো না যদি তার ফুপু এসে ঝামেলা না পাকাতেন। শুধু ঝামেলা পাকিয়ে ক্ষান্ত হননি। শাজুর গায়েও নাকি হাত তুলেছিল। চরিত্র নিয়ে যা তা বলেছেন। এতকিছুর পর কোনো মেয়ের অভিভাবক তো জামাই আদর করবে না। মিনা আপাকেও ফোন করে পাওয়া যায়নি। রিনা আপার নাম্বার তার কাছে নেই। তা নাহলে ফোন করে অনুরোধ করলে হয়তোবা শাজুর সাথে কথা বলা যেত। কথা বলে কোনোভাবে ওকে বুঝাতে পারলে হয়তোবা ডিভোর্সের দিকে এগোত না।
****
” কীরে? তোরে না সেই কোন সময় ভাত দিয়ে গেলাম। এখনো খাচ্ছিস না ক্যান?” মনো ঘরে ঢুকতেই প্রশ্নটা করে বসলেন৷ সেই কখন এসে খাবার রেখে গেছেন কিন্তু তাহিরা ছুঁয়ে অব্দি দেখেনি। যখন থেকে শুনেছে সঞ্চয় এসে দাঁড়িয়ে আছে। তখন থেকে একভাবেই জানালার পাশে বসে আছে। শত চেষ্টা করে ওখান থেকে নড়ানো যায়নি।
” চাচী, উনাকে একটা বারের মতো আসতে দেন। অনেক সময় যাবত বাইরে দাঁড়িয়ে আছে এই কড়া রোদে। ” তাহিরা নিচু স্বরে ধীরে ধীরে বলল।
মনো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বললেন, ” নিজের মরণ ডাইকা আনতে চাও তাই না? ওর ফুপু তোরে আমাগো সামনে মারছে। আর ওই বাড়ি গেলে তোরে কী করবে? ভাবতে পারিস? পাশের এলাকার নাসিমার কথা মনে নাই? ওরে ওর জামাই, ফুপু শ্বাশুড়ি মিলে জবাই করছিল। তোরেও তাই করবে। ” তাহিরা শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে বলল, ” আমি তো আর ফুপুর সাথে থাকবো না। থাকবো সঞ্চয় আর ওর শ্বাশুড়ির সাথে। ”
” ওই পোলা একসাথে দুইটা মাইয়ার লগে পীরিতি করছে। ওই পোলা বিয়ের পরে আরেক নারীর ঘরে যাবেনা, এমন কোনো নিশ্চয়তা তুই দিতে পারবি?”
” চাচী, আমাকে উনার সাথে একবার কথা বলতে দেন। আমি তার সাথে কথা না বললে সে যাবেনা৷ কখন থেকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।” অনেক কষ্টে কান্না চেপে কথাগুলো তাহিরা বলল।
” ওই পোলার কারণে তোর বাপ মরছে, আর তোর মা বিরাট কষ্ট নিয়ে মরছে। তোর চরিত্রে দাগ পড়ছে। তোর বেইজ্জতি হইছে সাথে আমাগো পরিবারেরও হইছে। পুরো এলাকায় মুখ দেখানো বন্ধ হয়ে গেছে আমাগো। আশেপাশের মানুষ তোরে নিয়ে কানাকানি করতেছে। তোর চাচা আজকে লজ্জায় মসজিদে অব্দি যাইতে পারে নাই। তারপরও যদি তুই ওই পোলার লগে যাস। তাহলে বুঝবো, তোর যৌবনের চুলকানি বেশি। সেই চুলকানি মেটানোর জন্যই তুই কাউরে পাইতেছস না তাই ওই হারামজাদার কাছে যাবি। ”
মনো চাপাস্বরে কথা গুলো বললেন। শাজু চাচীর দিকে তাকিয়ে বলল, ” আমি তাকে ভালোবাসি, চাচী। তাকে ভালোবাসা আমার ঠিক হয়নি। অনেক বড় অপরাধ করেছিলাম। তাই আমাকে তার সাথে একটু কথা বলার সুযোগ করে দেন৷ ”
” আমি জানিনা তোর মতলব? তুই ওই পোলার হাত ধরে পালাবি। ”
” না, চাচী। ” আজহারুল ঠিক এইসময় শাজুর ঘরে ঢুকলেন। মনো স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ” দ্যাখো তোমার ভাতিজী কী বলে! ”
” মনো, তুমি বাইরে যাও তো। আমার ওর সাথে কথা আছে। ”
মনো স্বামীর কণ্ঠের গাম্ভীর্যে খানিকটা ভয় পেলেন। তাই কোনো কথা না বাড়িয়ে চলে গেলেন।
শাজুর সামনে চেয়ার এনে বসলেন। শাজু চাচাকে ভয়ে ভয়ে বলল, ” চাচা, আমাকে উনার কাছে যেতে দিন। ”
” যেতে চাও, অবশ্যই যাবে৷ তবে যাওয়ার আগে আমার সাথে তোমার বোঝাপড়া সেরে নিতে হবে। ” শাজু অবাক হয়ে চাচার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার চাচা কখনো এমন স্বরে কথা বলেন না। আজকে মনে হচ্ছে, অগ্নিমূর্তি হয়ে আছেন।
” চাচা, কী বোঝাপড়া? ”
আজহারুল এতক্ষণ ভাতিজীর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। ভাতিজীর চেহারায় ছোট ভাইয়ের চেহারার ছাপ স্পষ্ট। ছোট ভাইয়ের কথা মনে পড়তেই চোখ সরিয়ে নিলেন। তিনি কখনো ভাবেননি ছোট ভাই এভাবে ফেলে রেখে আগেই চলে যাবে।
*****
সঞ্চয় মৃদু হেসে বলল, ” এই হাতে খাব কী করে? ”
” হাত কাটলো কীভাবে? ” শাজু যন্ত্রের মতো প্রশ্নটা করলো।
” দেয়াল টপকাতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলাম। তখন রাস্তার পিচে লেগে এই অবস্থা। ” শাজু ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে স্যাভলন ক্রিম আর তুলা বের করে আনলো।
” না, না এসব লাগবে না। ঠিক হয়ে যাবে একটু পরেই। তুমি একটা চামচ এনে দিলেই হবে। ”
শাজু জোর করে সঞ্চয়ের হাত টেনে নিল। তারপর তুলা দিয়ে রক্ত আর ধুলাবালি মুছে স্যাভলন ক্রিম লাগিয়ে দিল। সঞ্চয় ভাবতেও পারেনি আজহারুল তাকে বাসায় ঢোকার অনুমতি দিবেন। মনের মধ্যে বিন্দুর মতো আশার আলো জেগে উঠেছে। সারাদিন কিচ্ছু খাওয়া হয়নি। সকালে কোনোমতে এক কাপ চা আর একটা রুটি খেয়ে বের হয়েছিল। আর এখন প্রায় সন্ধ্যা। নাওয়া, খাওয়া কোনোটাই হয়নি।
” চামচ আনতে পারবো না। ”
” তাহলে খাব কী করে, শাজু?”
” আমি খাইয়ে দেই আপনাকে?” সঞ্চয়ের মনে হলো সে ভুল শুনেছে। তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য বলল, ” কী বললে?”
” আমি খাইয়ে দেই? ”
” অবশ্যই, কেনো দিবে না। তার আগে আমাকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিও। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে আমার। ”
শাজুর এখন মনে হলো, সে পানি আনতেই ভুলে গেছে। অনেক কষ্টে চাচাকে রাজি করিয়ে সঞ্চয়কে বাসার ভেতরে ঢুকিয়েছে সে। এখন তার উপর গুরু দায়িত্ব এই ছেলেকে চির জীবনের জন্য এই বাড়ি ছাড়া করা।
শাজু নীরবে উঠে গেল পানি আনতে।
পানি নিয়ে আসার পরে শাজু প্লেটে হাত দিবে তখনই সঞ্চয় বলল, ” তুমি আমাকে ডিভোর্স তো দিচ্ছ না, তাই না?”
” চুপচাপ খেয়ে নিন। তারপর কথা বলবো। ”
*****
” সঞ্চয়? ” দু’জনে পাশাপাশি বিছানায় বসে আছে। শাজু অনেক সময় যাবত কথাগুলো বলতে চাচ্ছে। কিন্তু গুছিয়ে বলতে পারছে না। চাচার আদেশ অমান্য করার ক্ষমতা তার নেই। এদিকে সঞ্চয়কে ছাড়াও কীভাবে থাকবে সেই চিন্তাও সে এখন করতে পারছে না। মা বেঁচে থাকলে তো এটাই চাইতেন। যেটা তার বড় চাচা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
” হ্যাঁ, বলো। ”
” আমি আপনার সাথে যেতে পারবো না। ”
” তুমি আমার সাথে মজা করছ তাই না? আমি কীভাবে তোমাকে ছাড়া থাকবো?”
” সঞ্চয়, আপনার মনে পড়ে। যখন আপনি আমাকে অবহেলা করতেন? আমি আপনার একটা ম্যাসেজের, কলের জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করতাম। কিন্তু আপনি ব্যস্ত ছিলেন রিদ্দিকে নিয়ে। আমার এখনো মনে পড়ে, সঞ্চয়। আমি সেই দিনগুলোর কথা কখনো ভুলতে পারি না। আমি চেষ্টা করি সেটা ভুলে যাওয়ার। কারণ আপনি আমাকে সত্যিই ভালোবেসেছেন। কিন্তু কিছু স্মৃতি ভোলা যায়না। ” সঞ্চয় শাজুর হাত টেনে নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলল, ” আমি ভুল করেছি। সেজন্য আমি তোমার পা-ও ধরতে রাজি কিন্তু তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না। ”
” আমার এখানে ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্ন আসে না। আমি যতবারই আপনার কাছে আসার চেষ্টা করেছি ততবারই কোনো না কোনো ভাবে আমাদের মাঝে বাঁধা চলে আসে। এইযে দেখুন আমাদের বিয়ে হয়ে গেছে। বিয়ে নামের পবিত্র সম্পর্কে আমরা জুড়ে গেছি। তারপরও আমাদের মাঝে কতো বাঁধা এসে দাঁড়িয়েছে। আপনি না হয় আমাকে কষ্ট আর দিবেন না। কিন্তু সংসারে তো আমি আর আপনি একা থাকবো না। আপনার ফুপু, মা, বাবা, চাচা অন্যান্যরা থাকবেন। আমার চাচা, চাচীও থাকবেন। কারো দোয়া ছাড়া, অমতে সংসার আমি করতে পারবো না। ” শাজু সঞ্চয়ের হাত শক্ত করে ধরে বলল।
” শাজু, তুমি আমার সাথে চলো৷ একসময় মেনে নিবেই। ” সঞ্চয়ের কথা শুনে শাজু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, ” আমরা একে অপরকে প্রচণ্ড ভালোবাসি। কিন্তু আমাদের মাঝের সুরটা হারিয়ে গেছে সেদিনই যেদিন তুমি অন্য কারো কাছে নিজেকে মেলে ধরে ছিলে। আমি এখনো তোমাকে ভালোবাসি কিন্তু তোমার পাশে আমি থাকতে পারবো না। ওইযে, সুরটা আমাদের মাঝের ছন্দ নষ্ট করে দিয়েছে। ” শাজু কতো সহজে কথা গুলো বলে দিল। কথাগুলো বলার সময় হাসছিল। সঞ্চয় অবাক হয়ে সেই হাসি দেখছিল। মানুষটা আর আগের মতো নেই। হুট করে অন্য কেউ হয়ে গেছে।
” আমাকে শেষ পর্যন্ত দূরে সরিয়ে দিলে?” সঞ্চয়ের মনে হলো তার বেঁচে থাকার কোনো কারণ এখন নেই।
” কবেই বা কাছে এসেছিলাম আমরা? ” শাজুর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে সঞ্চয় বলল, ” শেষ বারের মতো আমাকে জড়িয়ে ধরবে, শাজু?”
শাজু জোর করে হেসে বলল, ” অবশ্যই। ”
শাজু নিজেই সঞ্চয়ের কাছে এসে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, ” আপনাকে আমি আজীবন ভালোবাসবো। এই পৃথিবীতে আপনি একমাত্র মানুষ, যাকে আমি নিজের থেকেও বেশি ভালোবেসেছি। কিন্তু এই পৃথিবীতে নিজের থেকে বেশি কাউকে ভালোবাসতে হয়না। সেটা মনে হয় একপ্রকার পাপ। ”
সঞ্চয় আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। এটাই যে শেষ কাছে আসা তাদের!
” love is fire. But whether it’s gonna warm your heart or burn your house down you can never tell. ”
( সমাপ্ত )
~ Maria Kabir