#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব-১৯
প্রকৃতিতে প্রতিটা মুহুর্ত ভিন্নরূপ নিয়ে আসে। জীবনের একেকটা সকাল আসে একেক ভাবে। তবে জীবন রয়ে যায় সেই পুরোনো আঙ্গিকে। জীবনের একেক পর্যায়ে একেক রকমের বার্তা নিয়ে সামনে আসে, কিন্তু ভালোবাসা কিংবা কষ্ট রয়ে যায় মনের গহীনে, যার পরিবর্তন কিংবা ক্ষয় কোনটাই হয় না। শুধু রয়ে যায় ক্ষত।
মামনি অফিস থেকে এসে, আমাকে আর নানীকে রুমে ডেকে পাঠালেন। এমন অসময়ে মামনি অফিস থেকে ফিরেছে, আমি কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না।
নানী আর আমি মামনির রুমে গিয়ে বসলাম। মামনির মুখটা খুব গম্ভীর । চেয়ারে বসে জানালা দিয়ে বাহিরের আকাশটা দেখছে। আনমনে বিড় বিড় করে কিছু বলছে। আমি আর নানী যে বসে আছি মামনি খেয়াল করেনি। আমি ডাকলাম,
– মামনি! মামনি!
মামনি চমকে আমার দিকে তাকালো, চোখ দুটো রক্তের মতো লাল হয়ে ফুলে আছে। মামনি অনেক কেঁদেছে বোঝা যাচ্ছে। ছোট মানুষের মতো আমারে জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। আমি বুঝে গেছি মামনি কেন কাঁদছে। নানীকে আমি সকালেই বলেছিলাম এই খবর, তাই নানীও চুপ করে বসে রইলেন। মামনি একটু শান্ত হয়ে বললেন,
– আফিফা, তোমার বাবা বেশ কিছুদিন আগে বিয়ে করেছে। যখন আমি অসুস্থ ছিলাম, গত কাল তার নতুন বৌয়ের ছেলে হয়েছে।
মামনি এবার একটু শক্ত হলেন, হয়ত ভেবেছেন যে আমি আর নানী ভেঙ্গে পড়বো এগুলো শুনে। কিন্তু আমার আর নানীর নির্বিকার মুখ দেখে মামনি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। নানী মামনির পাশে গিয়ে মামনির মাথায় হাত রেখে বললেন,
– মারে জীবন বড়ই কঠিন। এখানে তুই যতই ভালোবাসা মায়া দিয়ে কিছু আগলে রাখতে চাস না কেন, যার যাবার সে যাবেই। আর নিয়াজ তোর অতীত, সে যতটাই দূরে চলে যায় তাতেই মঙ্গল। আবার এটাও সত্য যে সে তোর স্বামী। ভালোবেসে তুই সেই সব করেছিস যা তোর জন্য খুব কষ্টের ছিল। সে যখন এতো বড় কষ্ট দেয় তা সহ্য করা খুব কঠিন। খুব কষ্টের, বিশ্বাস ভাঙ্গার কষ্ট খুব খারাপ। কিন্তু তোকে বুঝতে হবে যে সে তোর যোগ্য কোন দিনই ছিল না। সে তোর ভালোবাসাও কখনও বুঝেনি মা। তুই না হয় পরের মেয়ে, তার নিজের সন্তান গুলোও তার কাছে মূল্যহীন। এতোটা বছর ছেলেমেয়ে গুলো দূরে, তুই কিভাবে ওদের মানুষ করছিস, সে খোঁজ কি সে কখনও নিয়েছে? তাহলে কেন তার কথা ভেবে নিজের শরীর খারাপ করবি, আর কেনইবা মন খারাপ করছিস মা? আর নিয়াজের বিয়ের কথা আমি এবং অবন্তি অনেক দিন আগে থেকেই জানি, তুই যদি আবার অসুস্থ হয়ে পড়িস তাই তোকে আমরা বলিনি।
– মা, সুস্থ হবার পরে রংপুরের শেফালি খালার সাথে আমার কথা হয়েছিল। উনি আমাকে নিয়াজের বিয়ের খবর দেয়। তোমরা কষ্ট পাবে, তাই আমি তোমাদের কিছু বলিনি।
আমি মামনিকে জড়িয়ে ধরে কেদেঁ ফেলেছি। মামনি আমাকে বুকের মাঝে লুকিয়ে নিলো। বহুদিন পর মামনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। নানী আমাদের জড়িয়ে ধরলেন। তিন প্রজন্ম চোখের জলে বুকের কষ্ট গুলো ভাসিয়ে দিলাম।
এরপরের দিন থেকে আমি আমার সামনে এক অন্য রকম মামনিকে দেখতে পেলাম। সে দৃঢ, প্রত্যয়ী এবং আত্মনির্ভরশীল। মামনি এরপরে আর কখনও বাবার জন্য আমাদের সামনে কাঁদেনি। তবে আমি জানি এটা মামনির মনের ভেতরের চিত্র নয়। মামনির ভেতরে অনেক ঝড়, অনেক তুফান। যা উপর থেকে কেউ বুঝতে পারেনা, শুধু বুঝতে পারে মামনির ডায়রি। আমি মামনির ডায়রি পড়েছি সেটা কেউ জানে না। ঠিক যায়গায় রেখে দিয়েছি। কারন ওটাই মামনির যুদ্ধের জীবনের একটা বিশ্বস্ত বন্ধু।
আমি সাদের সাথে আবার কথা বললাম,
– সাদ, মামনি বাবার বিয়ের খবর জেনে গেছে।
– উনি কেমন আছে?
– হুম ভালো আছে।
– সাদ তোমার মন খারাপ?
– কই, নাহ।
আমি সাদকে চিনি অনেকদিন থেকেই। যে কারনেই হোক সাদের মন আজ খুব খারাপ। আমরা রংপুরে থাকতে, সাদ বিভিন্ন সময়ে তার আচরনে বুঝিয়ে দিতো যে সে আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু বুঝেও আমি না বুঝার ভান করতাম। তবে আমি যতই চেষ্টা করি না কেন, সাদ এটা বুঝতেই পারতো যে আমিও সাদকে পছন্দ করি। আর আফরিন সাদের বোন সে সব কিছু বুঝতে পারতো কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতো না। অনেক পরে আমি জানতে পারি যে সাদের বাসায় সাদের মা ও বাবা দুজনেই আমাকে খুব পছন্দ করতেন। এবং বর্তমানে উনারা আমাদের সম্পর্কের কথা জানে। সাদের সাথে আগে যোগাযোগ হতো চিঠিতে। ইউনিভার্সিটিতে উঠার পর মামনি মোবাইল কিনে দিলে তারপর থেকে মোবাইলেই যোগাযোগ হয়। তবে সেই চিঠি গুলো আমার বেশি পছন্দের। সাদ গুছিয়ে সেখানে কত কথা লিখতো, কবিতা লিখতো। সাদের সাথে এতো দিনের পরিচয়, আমি নিশ্চিত যে সাদের মন খারাপ। সাদ তার সব মনের কথা আমাকে বলে কিন্তু আজ ওর কন্ঠ অন্য রকম লাগলো। একদম ভরাট কন্ঠে প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের মতো করে। সাদ এমন নয়, সে ব্যাক্তিত্ত সমপন্ন কম কথা বলা মানুষ, তবে আমার সাথে ভিন্ন। আমার সাথে সেই বেশি কথা বলে, আর আমি ওর কথা শুনি। কিন্তু আজ কি হলো?
আমার যেহেতু পরীক্ষা সামনে, তাই সব দিকে থেকে আমার মনোযোগ পড়াশোনাতেই বেশি দেয়া দরকার। তবে আমি মাঝে মাঝে মামনির ডায়রি পড়ি। কারন মামনির ডায়রির প্রতি আমি এর প্রকারের আসক্ত হয়ে পড়েছি। ঘুরে ফিরে আমার মন ছুটে যায় মামনির ডায়রির প্রতি। মামনি অফিসে গেলে আমি তার ডায়রিটা পড়ি।
আজ দুপুরে মামনির ঘরে গিয়ে ডায়রিটা নিয়ে রকিং চেয়ারটা বেলকনিতে নিয়ে বসলাম। তারপর পড়তে শুরু করলাম।
—
ডায়রিতে পড়তে শুরু করলাম –
জীবনে অনেক শিক্ষাই গ্রহন করেছি, তবে ঠেকে ঠেকে যে শিক্ষা পেয়েছি। তাই সবচেয়ে বড় শিক্ষা এবং যথার্থ।
প্রতিটা মেয়ে তার সংসার টিকে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে যেতে হয়, হয় পরিবারের সাথে না হয় নিজের সাথে। আর প্রতিটা যুদ্ধ তাকে বুঝিয়ে দেয় ‘মেনে নাও’, ‘মানিয়ে নাও’……
এভাবে মেনে নিতে নিতে এক সময় সে নিজেই টিকে যায়, শুধু টিকে যাওয়ার আড়ালে তার ভাঙ্গা গড়ার গল্পটা কারোর জানা হয়ে ওঠে না।
একটা আমি, এক জীবনে নিয়াজের দেয়া বহু শত শত কষ্ট সহ্য করেছি। কত অন্যায় অত্যাচার সহ্য করেছি। অযথাই মাথা নত করেছি। মনের বহু সখ, ইচ্ছা, আকাঙ্খা গলা টিপে মেরেছি। তা এই পৃথিবীর জানা হলো না। জানলো না কেউ। জানবেও না।
আমি সুস্থ হয়ে রংপুরের শেফালী আন্টিকে ফোন করেছিলাম। তার মুখে নিয়াজের বিয়ের কথা শুনলাম। হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছি মাত্র কয়েকদিন। ভাই আসছেন অস্ট্রেলিয়া থেকে, ইরাও এসেছে। সাথে ইরার বর।
খবরটা শুনে প্রথমে নিজেকে সামলে নিলাম। কারন একবার আমার ক্ষতি হয়ে গেলো শরীরের উপর দিয়ে, আর নয়। তাই নিজেকে নিজেই খুব বোঝালাম।
যে আমার নয়, তাকে নিজের ভেবে কষ্ট পাবার মানে হয় না। তারপরও কত কথা সারাদিন মনে পড়লো। আমি কাউকে তা বুঝতে দেইনি। অবন্তি কিংবা আবীর যদি শোনে যে তাদের বাবা আবার বিয়ে করেছে। দুজনেই ভেঙ্গে পড়বে। মায়ের বয়স হয়েছে, উনিও কষ্ট পাবেন। ভাই আর ইরার রাগ বেশি, ওরা আবার কোন ঝামেলাও করতে পারে। আমার জন্য ওরা অনেক কষ্ট করেছে। আমি ওদের আর কোন কষ্ট দিতে চাই না।
এমনিতেই আমি এখন হাটতে পারিনা, তার উপর নতুন কোন ঝামেলা, আমার পরিবারের উপর আসতে দেবো না।
শেফালি আন্টির সাথে প্রায় আমার কথা হয়। শেষ অবদি শেফালি আন্টি রফিক চাচাকে বিয়ে করেননি। কারন রফিক একজন লোভী ও মিথ্যুক মানুষ। আর তা বুঝতে পেরে শেফালি আন্টি রফিককে নিজের জীবন থেকে বের করে দিয়েছেন।
শেফালি আন্টি খুব ভালো চাকরি করেন। এবং বিয়ে হয়েছে শিক্ষিত এবং খুব ভালো মনের মানুষের সাথে। আন্টি রংপুরেই থাকেন, আর এ কারনেই আমি সব খবর পাই নিয়াজের।
আমি যতই শক্ত হয়ে ঘুরে বেড়াই কিন্তু আমার ভেতরটা সর্বক্ষন বিশ্বাস ঘাতকতার অনলে পুড়ে। আমার তিলে তিলে গড়া সংসারে আজ অন্য কেউ রাজত্ব করছে। কেমন করে আমি তা সহ্য করবো।
ভাই আর ইরা আমাকে বগুড়ায় নিয়ে যাচ্ছেন, আমার মোটেও যেতে মন চাইছে না। কিন্তু আমাকে যেতেই হবে।
সবার সাথে বহু দিন পর দাদা বাসায় এসে মনটা আসলেই ভালো লাগছে। সবাই মিলে একসাথে খুব ভালো কাটছে দিন গুলো। দাদা বাসা থেকে নানা বাসাতেও বেড়াতে গেলাম। চট্টগ্রাম থেকে বেড়িয়ে এসে বেশ ভালো লাগছে। এবং ধীরে ধীরে শরীর ও ভালো লাগছে।
এখন একটু একটু করে হাটতে পারছি। ঠিক প্রথমবার হাটতে পারার মতো আনন্দ লাগছে। জীবন থেকে যা কিছু হারিয়ে যাচ্ছি, তা হয়তো আমার ছিল না কোন দিনই।
#সিরাজুম_মনিরা
আমার পুরো পরিবারের অবস্থা খুব খারাপ, করোনার কারনে। তাই সব পর্ব গুলো নিয়মিত দিতে পারছি না। লেখা আসছে না মাথায়।