#ধূসর_ভালোবাসা
পর্ব ৩০
সকালে ঘুম ভাঙ্গলো বৃষ্টির রিনী ঝিনী শব্দে। বেলকনিতে দাড়িয়ে অদূর আকাশে মেঘ আর মেঘের গর্জনের অপূর্ব খেলা দেখতে কতটা সময় পার করেছি জানি না। মা আমার পেছনে দাড়িয়ে আছে, বুঝতে পারিনি। আমার হাতে চায়ের কাপটা দিয়ে, আমার পাশে বসলেন।
-অবন্তি মা, তোকে কিছু কথা বলার ছিল।
-বলো মা।
-মা, আমাদের জীবন বড়ই বিচিত্র। তুই বেশ পরিনত মনের মানুষ। এই ব্যাপার গুলো আশা করি তুই বুঝতে পারবি। যেখানে মানসম্মান নেই, সেখানে ভালোবাসা ক্ষনস্থায়ী মা। তুমি হয়ত আমার সাথে এক মত হবে।
আমি হাসলাম, তারপর মামনিকে বললাম, তুমি চিন্তা করোনা। তুমি যা সিদ্ধান্ত নিবে, তাতেই আমি তোমার সাথে আছি। বাবার ওখান থেকে যেদিন চলে এসেছিলাম, সে দিন থেকেই বুঝেছি বাঁচতে হলে যুদ্ধ করেই বাঁচতে হবে। আমি প্রস্তুত আছি মা, যে কোন যুদ্ধের জন্য। তোমার মেয়ে আমি, এতো সহজে হার মানাবে না। তুমি আমাকে নিয়ে চিন্তা করো না। যে কোন পরিস্থিতির মোকাবেলার জন্য আমি প্রস্তুত।
পরপর কয়েকদিন পার হয়ে গেলো, তহমিনা আন্টির বাসা থেকে কোন খবর আসেনি। তাহলে হয়ত আমাকে পছন্দ হয়নি।
ভাবতেই মন খারাপ হয়ে, আমাকে কেউ যদি অপছন্দ করে। তা অপমান জনক, কষ্টের। বিয়ে করার কোন ইচ্ছে নেই আমার। তাই বলে কেউ চাইলেই ছোট করে যাবে, সেটা সহ্য করা খুব কঠিন।
মাথা থেকে এসব ঝেড়ে ফেলে, নতুন চাকরীর জন্য চাকুরীর সার্কুলার গুলো দেখতে শুরু করেছি। কয়েকটা সিলেক্টও করেছি, এপলিকেশন করার জন্য।
মোবাইলের পুরনো সিমটা পাল্টে ফেলেছি। তবুও সাদ আবীরের ফোনে বহুবার ফোন দিয়েছিল। আবীরকে ফোন ধরতে নিষেধ করেছি। সাদ যেন আমাকেই ভুল বোঝে। সে আমাকে বেইমান ভাবতে পারলে, তবেই ওর বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাবে। নইলে…….
খুব জানতে ইচ্ছে করে সাদ কেমন আছে, ঠিক সে সময়ে সাদের বাবার কথা গুলো মনে পড়ে যায়। আর কিছুই তখন ভালো লাগে না। নিজেকে খুব ছোট আর তুচ্ছ মনে হয়।
এ জীবনে সাদকে কখনই ভুলতে পারবো না, সেটা কোন ভাবেই সম্ভব না। কিন্তু বেঁচে থাকতে যে হবেই। আর তাই মনের গহিনে সাদের জন্য চির দিনের বরাদ্দ করা স্থানটায় তালা মেরে দেবার চেষ্টা করছি। সেখানে প্রবেশের অধিকার কারো নেই। হয়ত আমারও আর নেই।
আবীর কোথা থেকে লাফা লাফাতে এসে বললো, তোমাকে আর আপু বলবো না। বুবু বুড়ি বলবো।
– কেন রে ?
– বিয়ে হলে মেয়েরা বুড়িয়ে যায়, তাই।
– তোকে বলেছে।
– বলেছে তো, কেমন যেন বুড়ো বুড়ো গল্প করে তখন।
– কাকে দেখলে শুনি।
– দেখিনি, দেখবো।
– কার?
– তোমার।
– কিভাবে?
– ঐ যে তহমিনা আন্টির ছেলে আজ বিকেলে আমাদের সবাইকে নিয়ে ফাস্ট ফুডে দেখা করবে।
– কেন?
– জানি না, বুবু বুড়ি।
– হা হা হা, নাম টা মন্দ নয়।
সন্ধ্যার কিছু আগে আমরা রওনা দিলাম। আমি, মামনি, আবীর ও নানু। তহমিনা আন্টি এসেছেন, তমালিকা আন্টি, অর্ক আর ঈশান।
সবাই বসার পর, তমালিকা আন্টি বললেন,
– আফিফা, ঈশান একটু অবন্তির সাথে একা কথা বলতে চায়।
মামনি আমার দিকে তাকিয়ে, হ্যা সূচক মাথা নাড়লেন।
আমার বুকের মাঝে কেমন যেন তোল পাড় হলো। সে কি বলতে চায়? আমি কিইবা বলবো? চিন্তা করতে করতে উঠে দাঁড়ালাম।
আমরা এসেছি শহর থেকে একটু দূরে, আর সে কারনেই জায়গাটা কোলাহল হীন, সুন্দর ও পরিপাটি। চার পাশটা খুব মনোরম। খোলা আকাশ, মুক্ত আবহাওয়া। যে কাওরি এখানে আসলে মন ভালো হয়ে যাবে। আমি আর ঈশান হাটছি একটা জলাশয়ের ধার দিয়ে।
আমি কোন কথা খুঁজে পাচ্ছি না, চুপচাপ হাটছি। ঈশান, সেও কোন কথা বলছে না। হেঁটেই যাচ্ছে। খানিক বাদে, ঈশান আমাকে জিজ্ঞেস করল,
– আচ্ছা আপনাকে জোর করা হচ্ছে নাতো বিয়েতে?
– মানে?
– আসলে প্রথম দিন থেকেই দেখছি, আপনি খুব চুপচাপ থাকেন, তাই বললাম।
– না, আমাকে কেউ জোর করেনি।
– আপনাকে আমার পছন্দ হয়েছে। আমি এ বিয়েতে রাজি। আপনার কোন আপত্তি নেই তো?
আমি কি বলবো? কি বলতে হয়? মাথাটা কেমন ঘুরে উঠলো। জীবন বড় আজব। কখন যে কি হয়ে যায় আমাদের জীবনে তা আমরা ভাবতেও পারিনা।
– কিন্তু আমার কিছু কথা বলার ছিল।
– আমাকে আপনার পছন্দ না হলে স্পস্ট বলতে পারেন।
– আমি আমার অতীত সম্পর্কে বলতে চাই।
– প্রায় মানুষের অতীত থাকে। সেটাই স্বাভাবিক। তবে অতীত যদি অতীতেই থাকে, তাহলে বর্তমানে তা মূল্যহীন। আর সে কারনেই, আপনার অতীত আমি জানতে চাই না। আমার নিজের সম্পর্কে আপনাকে কিছু বলতে চাই, আমি বরাবরই কম কথা বলি। তবে বাবার মারা যাবার পর থেকে আমার নিজের জন্য কোন সময় বের করতে পারিনি। কলেজ লাইফে আমারও পছন্দ ছিল একজনকে। বলি বলি করে বলা আর হয়নি। এরপর জীবন আমাকে আর সময় দেয়নি, কোথাও থামার। তাই আপনাকে পছন্দ হবার পর আর দেরি করতে চাইনি। আপনার কোন আপত্তি আছে কি, আমাকে বিয়ে করার বিষয়ে। থাকলে নির্দ্ধিধায় বলতে পারেন।
– বাবা এবং মা, দুটো দায়িত্বই আমাদের জীবনে মা পালন করেছে। তাই আমাদের জীবনের যে কোন সিদ্ধান্তে আমরা মায়ের মতামতকেই প্রাধান্য দেই। মামনি আপনাদের জানিয়ে দেবে।
– বাদ দেই আপাতত এই কথা। আপনি গান গাইতে পারেন? চলেন ঐ নৌকায় করে লেকটা ঘুরে আসি।
– আমি সাঁতার পারিনা।
– ভয় পাবেন না, আমি আছি। আমি সামলে নেবো।
বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো, সাদ এভাবেই আমাকে সব সময় সাহস দিত। আমি কি সাদের সাথে বেইমানি করছি? কিন্তু এ ছাড়া আমার আর কি করার আছে?
রাতে বাড়ি ফিরে, মা আমাদেরকে নানীর ঘরে ডাকলেন। বললেন, তহমিনা আন্টির নাকি যেদিন প্রথম আমাকে দেখেছে সেদিন থেকেই পছন্দ। আর ঈশান আজ বলেছে যে, তার আমাকে পছন্দ। মামনি আর নানী আগামীকাল তহমিনা আন্টির বাসায় আন্টি বাসায় যাবে বিয়ের দিন করতে। আন্টি মা আর নানীকে দাওয়াত দিয়েছেন।
আমি বললাম, মামনি তুমি আর নানী যা ভালো মনে করো, তাই করো। আমার কোন সমস্যা নেই।
মামনি বললেন, মা আমি দেরি করতে চাচ্ছি না। যত দ্রুত সম্ভব দিন করে ফেলবো।
খুব সকালে ঘুম ভেঙ্গে গেলো, বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছি। একি সাদ!
আমাকে দেখে লাফ দিয়ে, হাত নেড়ে আমার নজর কাড়ার চেষ্টা করছে। এক মুহূর্ত দাঁড়াইনি আমি। ঘরে চলে এসেছি। কর্নার টেবিলে পায়ে খুব জোরে ধাক্কা লেগে মেঝেতে পড়ে গেলাম। কোন রকমে উঠে নানীর রুমে গিয়ে, নানীকে জড়িয়ে কেঁদে ফেলেছি।
– অবন্তি কি হয়েছে?
– নানী, বাসার সামনে সাদ দাঁড়িয়ে আছে।
নানী আমাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমাকে নানী বললেন,
– কেঁদে বুক হাল্কা কর বুবু, যত খুশি কাঁদতে চাস কাঁদ। কারন কাঁদলে বুকের কষ্ট একটু হলেও কমে।
আমার মন পড়ে রইল বেলকনিতে, আর অসার দেহটা নানীর ঘরে। ভালোবাসলে বুঝি এভাবেই কাঁদতে হয়। আজ আমার কষ্ট গুলো শুধু আমার। নদীতে ভাঙ্গন লাগলে যেমন কোন কুল আর থাকেনা, বেহিসেবি ভেঙ্গে যায়। ভালোবাসায় ভাঙ্গন ধরলেও মনের ভেতর সব ভেঙ্গে তোলপাড় হয়ে যায়। আজ আমার কষ্ট গুলো, আমার কান্না গুলো সুখের চেয়ে ঢের মূল্যবান। আজ তোমার অপেক্ষমাণ চোখ দুটো, আমাকে ক্ষত বিক্ষত করেছে। হয়ত এক বুক অভিমান নিয়ে আজ ফিরে গেছো, জানি আমার মতো তুমিও যে কষ্টের আগুনে পুড়ছো। কিন্তু আমার যে আর কোন পথ নেই, তোমাকে কষ্ট দেয়া ছাড়া।
দুপুরের পরে সাদ চলে গেছে, নানী তাই বলল। মা ও নানী বিকেলে তহমিনা আন্টির বাসায় গেলেন। আবীর দিনে দিনে অনেক পাল্টে যাচ্ছে, আর আগের মতো বাজে ছেলেদের সাথে মিশে না। পড়ায় বেশ মনোযোগী হয়েছে। ছোট খাটো ব্যবসার চিন্তা ওর মাথায় ঘুরছে। অন লাইনে কিছু করার চিন্তা করছে। ভালো লাগছে, ভাইয়ের চিন্তা ধারা ধীরে ধীরে গঠন মুলক দিকেই যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় পাওয়া, সে বোঝে আমার কষ্ট গুলো। সাদকে হারিয়ে আমি ভালো নেই, সেটাও সে বোঝে। তবে ঈশানকে আবীরের বেশ পছন্দ হয়েছে। ঈশানের ভাই অর্ক এর সাথেও আবীরের বেশ ভাব হয়ে গেছে।
#সিরাজুম_মনিরা
বি:দ্র: আমি খুব অসুস্থ, তাই লিখতে পারছি না। আমি এবং আমার পরিবার করোনা আক্রান্ত, আপনাদের সাময়িক সমস্যার জন্য আমি দু:খিত।