বাইজি কন্যা পর্ব-৩২

0
3703

#বাইজি_কন্যা
#লেখা_জান্নাতুল_নাঈমা
#পর্ব_সংখ্যা_৩২ (প্রথমাংশ)
[৪৮]
রাত তখন ক’টা বাজে অনুমান করা গেলো না। ঘুমন্ত শাহিনুর’কে পাঁজাকোল করে বিরতিহীন হেঁটে চলেছে প্রণয়। তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে বুকে মুখ গুঁজে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ছে মেয়েটা৷ প্রতিটি নিঃশ্বাস একদম প্রণয়ের বুকের মধ্যখানে গিয়ে ঠেকছে। প্রণয় বুঝলো শাহিনুরের ঘুম বেশ গাঢ়৷ একবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলে সহজে জেগে ওঠে না৷ গুণে গুণে আর মাত্র চৌদ্দ দিন৷ তারপরই তাদের বিয়ে। অথচ সেইদিন তার রুক্ষ আচরণের স্বীকার হয়ে মেয়েটা কেমন যেনো মিইয়ে গেছে। আগে যাও দু’চারটা কথা বলতো এখন একেবারেই বলে না৷ বিয়েতে অসম্মতি পর্যন্ত দেয় না। হাজারটা কথা বলেও ওর মুখ থেকে একটি বর্ণ বের করা যায় না৷ সারাক্ষণ চুপমেরে বসে থাকে। খাবার দিলে খায়। না দিলে কিছুই বলে না৷ ঘুমানোর সময় নিবিড়ভাবে ঘুমিয়ে পড়ে৷ আগে মাঝেসাঝে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে থাকতো৷ চুপিচুপি দেখতো তাকে। সেদিনের পর আর তাকায়ও না। বড্ড ভয় হচ্ছিল প্রণয়ের, তার নুর মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে না তো? রাগের বশবতী হয়ে বাচ্চা মেয়েটা’কে কঠিন আঘাত করেনিতো? হাজার হোক অল্প বয়স। কতোটুকুই বা বোঝার ক্ষমতা হয়েছে তার? মনের ভিতর অসংখ্য ভয় নিয়েই মান্নাতের সঙ্গে দেখা করে সে। সেদিনের ঘটনা পুরোটা বর্ণনা করে, সবটা শুনে কিঞ্চিৎ রাগান্বিত হয় মান্নাত। কিন্তু প্রকাশ করতে পারেনা৷ শুধু জানায় নুর’কে কিছু সময়ের জন্য তার কাছে ছেড়ে দিতে। প্রণয়ও ঠিক এটাই চাইছিলো। এমন পরিস্থিতি’তে নুরের পাশে একমাত্র মান্নাত’কেই প্রয়োজন। তার সঙ্গ যেহেতু পছন্দই করেনা যার সঙ্গ পেলে মেয়েটা একটু আরাম বোধ করবে তার কাছেই এলো প্রণয়। পাঁচফোড়ন গৃহ থেকে বেরিয়ে সোজা পেছনের রাস্তা ধরলো সে৷ জোছনার মৃদু আলোতে অনায়াসে হেঁটে চলেছে। চারপাশে ঝিঁঝি পোকারা অবিশ্রান্ত ডেকে যাচ্ছে। আকাশে খলখল হাসিতে পূর্ণ চাঁদ ওঠেছে আজ। সেই আলোতে শাহিনুর’কে সন্তর্পণে বক্ষেঃচেপে এগিয়ে গেলো। পুকুরঘাটের সিঁড়িতে বসে আছে মান্নাত বাইজি৷ অপেক্ষা করছে নুরের জন্য। প্রণয় তার সম্মুখে হাজির হতেই বিস্মিত হয়ে গেলো সে৷ বসা থেকে ওঠে বিচলিত কন্ঠে বললো,
-‘ কী হয়েছে নুরে’র? ‘
-‘ কিছু হয়নি মান্নাত। ঘুমে ছিলো তাই জাগানোর প্রয়োজন মনে করিনি এভাবেই নিয়ে এসেছি। ‘
স্বস্তির শ্বাস ত্যাগ করলো মান্নাত। প্রণয় সযত্নে শাহিনুর’কে সিঁড়িতে বসিয়ে মান্নাতকে ইশারা করলো ধরতে৷ মান্নাত পাশে গিয়ে বসে আদুরে হাতে শাহিনুর’কে ধরে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো। মাথায় আলতো হাত বুলাতে বুলাতে আদুরে স্বরে ডাকলো,
-‘ নুরমনি… ও নুরমনি। ‘
নোনাপানিতে মান্নাতের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে ওঠলো৷ প্রণয় বললো,
-‘ সাবধানে ধরে বসো,আর দ্রুত জাগানোর চেষ্টা করো আমি আশপাশেই আছি। ‘
প্রণয় চলে গেলো। হুহু করে কেঁদে ফেললো মান্নাত। একহাতে শাহিনুরের কাঁধ জড়িয়ে অন্যহাতে গালে আলতো ছুঁয়ে ডাকতে লাগলো। কিছু সময় অতিবাহিত হতেই ঘুম আলগা হলো শাহিনুরের। আলস্য ভণিতায় পিটপিট করে তাকাতেই দেখলো সামনে কয়েক ধাপ সিঁড়ির পরেই পানি। চারপাশে কেমন আবছা আলো। অনুভব করলো সে কারো আদুরে বুক ছুঁয়ে আছে৷ সহসা ঘাড় কাত করে তাকাতেই মান্নাত’কে দেখে ‘বুবু’ বলে ডুঁকরে ওঠলো। এ’কদিনের জমিয়ে রাখা কান্না উগ্রে বেরিয়ে এলো তার। মান্নাত বুকে টেনে নিলো তাকে। আদুরে বুকের সান্নিধ্য পেয়ে সে বাচ্চাদের মতো ফোঁপাতে লাগলো। একসময় কান্না থামিয়ে চোখ বুজে লম্বা করে শ্বাস নিতে শুরু করলো৷ তার মাথায় আর পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে মান্নাত বললো,
-‘ মা মা গন্ধ খুঁজছিস? ‘
-‘ উহুম। ‘
-‘ তাহলে? ‘
-‘ বুবু বুবু গন্ধ পাচ্ছি। ‘
বক্ষঃস্থল মৃদু কেঁপে ওঠলো মান্নাতের। দু-চোখে ভরে ওঠা নোনাপানিগুলো অবিরত গাল বেয়ে পড়তে লাগলো। মাথায় চুমু খেয়ে বললো,
-‘ তুই নাকি ডাক্তার সাহেবের সাথে একেবারেই কথা বলছিস না? ‘
-‘ ডাক্তার খুব খারাপ বুবু, ডাক্তার খুবই ভয়ানক! ‘
এটুকু বলে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রইলো মান্নাত’কে। এক নিঃশ্বাসে প্রণয়ের সম্পর্কে বেশ বদনাম করলো। মান্নাত মৃদু হেসে বললো,
-‘ নুর ডাক্তার সাহেব তোকে ভালোবাসে, খুব ভালোবাসেরে তাই তো তোর মুখে অন্য পুরুষের নাম শুনে অমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। ‘
নুর অভিমানী কন্ঠে বললো,
-‘ আমিও তো বাঁশিওয়ালা’কে ভালোবাসি। বাঁশিওয়ালা যখন অন্য নারী’কে ভালোবাসার কথা বলে আমিতো রাগ করিনা, আমার তো খারাপ লাগে না। ‘
ম্লান হেসে মান্নাত বললো,
-‘ যেদিন সত্যি সত্যি মনেপ্রাণে কোন পুরুষ’কে ভালোবাসবি সেদিন তার আশেপাশে তুই ব্যাতিত অন্য কোন নারী’কেও কল্পনা করতে পারবিনা। যদি করিস ডাক্তারমহাশয়ের মতো তোরও অন্তর জ্বলেপুড়ে খাঁক হয়ে যাবে। ‘
-‘ তাহলে কী আমি বাঁশিওয়ালা’কে ভালোবাসিনা? ‘
-‘ উহুম একটুও না। ‘
অনেক কিছু বোঝালো মান্নাত৷ শারমিন বেঁচে থাকতে প্রণয় যে তার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছিলো৷ এই সত্যির মাঝে একটু মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে বললো, শারমিন তার সঙ্গে প্রণয়ের বিয়ে দিতে চেয়েছিলো৷ এমন কথা শুনে যেনো আকাশ থেকে পড়লো শাহিনুর৷ অবাকান্বিত কন্ঠে বলে ওঠলো,
-‘ আম্মা উনার সাথে আমার বিয়ে দিতে চেয়েছিলো? কিন্তু আম্মা যে বলতো জমিদার বংশের সবাই’কে ঘৃণা করে।’
একটু মিথ্যা বলে যদি নুর’কে সমস্ত বিপদ থেকে রক্ষা করা যায় তাহলে তো ক্ষতি নেই। তাই মান্নাত বললো,
-‘ সখী যখন ডাক্তার সাহেব’কে জানতো না তখন ঘৃণা করতো। যখন ডাক্তারের সম্পর্কে জানলো মানুষ হিসেবে তিনি কতো ভালো বুঝলো তখন আর আপত্তি করেনি৷ রাজি হয়ে গিয়েছিলো। ‘
সব শুনে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো নুর। মান্নাত বললো,
-‘ আমার একটা কথা রাখবি ? ‘
-‘ বলো… ‘
-‘ আমাকে ছুঁয়ে কথা দে রাখবি? ‘
পুনরায় কেঁদে ফেললো শাহিনুর। মান্নাত’কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
-‘ এই দুনিয়ায় এখন তুমি ছাড়া আপন বলে আর তো কাউকে অনুভব করিনা বুবু৷ আমি জানি তুমি যা বলবে আমার ভালোর জন্যই বলবে৷ ঠিক আম্মার মতোন। ‘
-‘ তাহলে ডাক্তারসাহেব’কে বিয়ে করতে রাজি হো নুর৷ বিশ্বাস কর এতেই সবার মঙ্গল হবে। তোর আম্মাও খুশি হবে৷ ‘
নীরব হয়ে গেলো শাহিনুর। ক্ষণকাল চুপ থেকে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। তারপর কতোক্ষণ সময় কেটে গেলো ওরা জানেনা৷ হঠাৎ প্রণয়ের আবির্ভাব ঘটলো। জানালো এবার ফিরতে হবে। শাহিনুর প্রচণ্ড শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো মান্নাত’কে বললো,
-‘ বুবু আমার খুব কষ্ট হয়। ‘
ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো মান্নাত। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-‘ নুর, মানুষের জন্য দুনিয়া’টা একটা সরাইখানা৷ এখানে কেউ চিরকাল থাকতে পারেনা। তাই যতোকাল থাকা যায় ততোকাল একটু স্বস্তি নিয়ে থাকাটাই শ্রেয়৷ যে স্বস্তিটুকু আমরা পাইনি সে স্বস্তিটুকু তুই পাবি। মনে রাখিস কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা একটু হলেও কঠিন। কিন্তু সুঁচ দিয়ে কাঁটা তোলা খুব সহজ৷ তোর জীবনে সেই সুঁচ এই ডাক্তারসাহেব! ‘

মান্নাত চলে গেলো। শাহিনুর ওঠে দাঁড়াতেই একটি ইটের খন্ড পায়ের তলায় বাজতেই ‘আহ’ সূচক শব্দ করে ওঠলো। আঁতকে ওঠে প্রণয় নিচে চেয়ে দেখলো শাহিনুরের পা খালি। মনে পড়লো আসার সময় কোলে চড়ে এসেছে। যাওয়ার সময় জুতার প্রয়োজন হতে পারে বেমালুম ভুলে গিয়েছিল সে। শাহিনুর পায়ে ব্যথা পেয়ে চোয়াল শক্ত করে রাগি চোখে তাকালো প্রণয়ের দিকে। প্রণয় বেশ বুঝলো যতোদোষ এখন এই ডাক্তারের। তাই কোন কিছু না ভেবে আবারো কোলে তুলে নিলো তাকে। শাহিনুর ছটফটিয়ে ওঠলো। নিচু কন্ঠে বললো,
-‘ কি করছেন, ছাড়ুন আমায় ছিঃ ছিঃ। ‘
তাচ্ছিল্য হেসে হাঁটতে শুরু করলো প্রণয়। বললো,
-‘ হুহ্ আসার সময় এভাবেই এসেছো। এখন ঢং করোনা।’
অভিমানে, ক্রোধে গাল ফোলালো শাহিনুর। সে আশ্চর্য রাগান্বিত রূপ দেখে একগাল হাসলো সে। রাতের মায়াবী আশ্চর্য সৌন্দর্য, হৃদয় আহত করা শাহিনুরের রূপে মুগ্ধ হয়ে হঠাৎ মাঝপথে থেমে গেলো সে৷ একবার শাহিনুরের মুখপানে আবার দূর আকাশপানে তাকালো। চোখ বন্ধ করে লম্বা একটি শ্বাস ছাড়লো। প্রকৃতির মৃদুমন্দ বাতাসে শরীরজুড়ে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে গেলো। বক্ষঃস্থলের ঢিপঢিপ আওয়াজ শুনতে পেলো অতি সুক্ষ্মভাবে। অনুভব করলো শাহিনুরের ছোট্ট প্রাণের ধুকপুকানিও৷ একটি নিস্তব্দ রাত৷ চারিদিকে জোৎস্নায় মাখামাখি। আকাশে চাঁদের হাসি। হৃদয়ের অতি নিকটে প্রিয়তমার উষ্ণ নিঃশ্বাস সব মিলেমিশে রোমাঞ্চকর হয়ে ওঠলো প্রণয়ের মন৷ এক পলক চাঁদের পানে তাকিয়ে আরেক পলক শাহিনুরের দিকে তাকালো। সহসা উচ্চধ্বনি তুলে বলে ওঠলো,
‘ শুন হে আকাশ, শুন হে বাতাস, শুন গো অবুঝ ছোট্ট মন। আমার বোকাসাহসীর কিছু কথা শুনে যাও গো তোমরা। সে বড়োই রূপবতী তার রূপের জাদু’তে করেছে আমার মন চুরি। হয়েছে আমার মনোহারিণী। হরিণাক্ষী দৃষ্টির প্রেমে পড়ে করে নিলাম তাকে হৃদয়াক্ষী। মন বলে দূর আকাশে চন্দ্রের আলো যেনো সে। কাছে যেতে দেয় না মোরে দূরে থাকতে পারিনারে। সে কেন বুঝেনা মোরে, সে কেন বুঝেনারে… এটুকু বলে শাহিনুর’কে কিঞ্চিৎ ঝাঁকিয়ে বলে ওঠলো,
-‘ ওগো মোর প্রিয়দর্শিনী কেন বুঝনা তুমি মোরে?’
প্রণয়ের প্রলাপ শুনে আকস্মাৎ এভাবে ঝাঁকিয়ে দেওয়াতে পড়ে যাওয়ার ভয়ে চোখ,মুখ খিঁচে দু’হাতে প্রণয়ের শার্ট খামচে ধরলো শাহিনুর৷ সুযোগ পেয়ে অতিসন্তর্পণে আরেকটু বুকে চেপে ধরলো প্রণয়। প্রকৃতি যেনো উচ্চরোলে বলতে শুরু করলো,
‘ যাবজ্জীবন হয়ে যাক এ সময়টার…’

চলবে…
(কার্টেসী ছাড়া কপি নিষেধ)
শেষ যেনো করতেই পারিনা লিখতে বসলেই বড়ো হয়ে যাচ্ছে কি জ্বালা। শেষাংশ দিব দ্রুতই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here