মনের মানুষ❤️পর্ব-১৩

0
705

#মনের_মানুষ❤️
#ত্রয়োদশ_পর্ব❤️
#কলমে_সাঁঝবাতি🌸

ওরে গৃহবাসী…..
খোল দ্বার খোল।লাগলো যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে লাগলো যে দোল।
দ্বার খোল দ্বার খোল।

রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে কয়েকটা বাচ্ছা তাল মিলিয়ে নেচে চলেছে…..আহেলি মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে সেদিকেই।শুধু আহেলি একা নয় সাথে সকলেই আছে।কলকাতা থেকে বেশ অনেকটা দূরে এসেছে ওরা।ওরা যেখানে এসেছে জায়গাটা নদী তীরবর্তী অঞ্চল।একটা গ্রাম…..যেখানে কয়েকঘর জেলে বসবাস করে।এখানে প্রান্তিকদের মেডিক্যাল ক্যাম্প আছে আজ…..প্রান্তিক ক্যাম্পে নিজের কাজ করে চলেছে আর আহেলি ও বাকিদের নদীর পাশে থাকা একটা রাধা-কৃষ্ণের মন্দিরে বসতে বলেছে।

আহেলি শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে আসার কিছুদিন পরেই ছিলো দোল উৎসব…কিন্তু তখন আহেলি হসপিটালে ছিলো।এখানে মন্দিরে দোলের দিন উৎসব হয় না…..বরং আরো কয়েকটা দিন পরে উৎসব হয়।এটাই এখানকার নিয়ম….এই গ্রামের সকলে প্রথমে রাধা-কৃষ্ণের মন্দিরে পুজো দেয় আর তারপর মেতে ওঠে রঙের উৎসবে!

মন্দির প্রাঙ্গণে চলছে দোল খেলা…..ছোটো থেকে বড়ো সকলেই যোগ দিয়েছে অনুষ্ঠানে।বাচ্ছারা নিজেদের মতোই রঙ নিয়ে খেলছে সাথে নাচ করছে……আহেলি আর বাকি সকলে বেশ খুশি এরকম একটা জায়গায় আসতে পেরে।প্রান্তিক এর ক্যাম্প বেশ কিছুটা দূরে…..ও বলেছে,ওর কাজ শেষ হলেই এখানে চলে আসবে।

“কি রে আহু?এবার ভালো লাগছে?”

অনুশ্রীর প্রশ্নে হালকা হেসে আহেলি মাথা নাড়িয়ে বললো,,,,
“সত্যিই খুব ভালো লাগছে……আমরা যেমন ছোটবেলায় রঙ খেলতাম ঠিক তেমন এরাও খেলছে তাই না?”

“সত্যিই তাই রে…..প্রান্তিক দা কিন্তু দারুন মানুষ।ও তো আমাদের নিজে থেকেই কল করে বললো একটা জায়গায় যাবে।আমরাও রাজি হলাম…..কিন্তু ব্যাপারটা বুঝলাম না।হটাৎ তোর জন্য প্রান্তিকদা এতটা ভাবছে কেনো?”

“তুই ঠিক কি বলতে চাইছিস অনু?”

“যেটা তুই বুঝেছিস…..আমি তো ভাবতেও পারছি না ঋষভদা তোকে চিট করতে পারে।”

“আমরা অনেককিছুই ভাবতে পারিনা তাও সেটা হয়…..আগের বছরের দোলের কথাটা মনে পরলেই শুধু একটা কথা মাথায় আসছে।”

“কি রে আহেলি?,কোন কথা?

“আগেরবছর দোলের দিন ঋষিদা বাড়িতেই ছিলো….আমি জানিস তো ওর ঘরে গিয়ে জোর করে ওকে রঙ মাখিয়েছিলাম।ঘরের মেঝেতে রঙ পরে যাওয়ায় সেকি রাগ…..কতকি বললো আমায়।আমিও ছলছল চোখে বেরিয়ে আসতে যাবো তখনই আমার একটা হাত ধরে টানলো…..সবসময় গম্ভীর থাকা মানুষটা হালকা হেসে বললো,,,,

“রাগ করলি আহেলি?তুই তো জানিস আমার ঘর নোংরা করলে আমার কেমন রাগ হয়,তোর যদি এতই রঙ দেওয়ার ইচ্ছা ছিলো বাইরে নিয়ে যেতিস আমায়….এভাবে কেউ ঘরে রঙ ছিটিয়ে দেয়?”

ঋষভের কথায় আহেলি ঠোঁট উল্টে বললো,,,,

“খুব ভুল হয়েছে আমার….আর কোনোদিন তোমার রঙ মাখাতে আসবো না।এটাই প্রথম আর শেষবার….আর কোনদিন রঙ দেবো না তোমায়।”

আহেলির রাগ আর অভিমানে ফোলা মুখটা ঋষভ নিজের দুহাতের মধ্যে নিয়ে নরম গলায় বললো,,,,

“আচ্ছা সরি।ভুল হয়েছে আমার…..এরপর আমার ঘরে এসে যা খুশি করবি তুই।কোনোদিন তোকে কিচ্ছু বলবো না…..কিন্তু আমায় রঙ দিবি না মানে কি হ্যাঁ?আমায় রঙ দেওয়ার আর কে আছে বল?তুই না থাকলে তো আমার পুরো জীবনটাই বেরঙীন হয়ে যাবে তাই এই কথাটা আর কোনদিন বলবি না।”

ঋষভ এর কথায় আহেলি নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করে বললো,,,,

“অনেক হয়েছে….বকে আর এখন সাফাই দিতে হবে না।এখন ছাড়ো তো আমায়,দেখি মামনি কি রান্না করলো।আজ আমি এখানেই তো থাকবো।”

“এতো সহজে তো ছাড়া পাবে না তুমি,আমার ঘরে আর মনে রঙ দিয়ে অন্যায় করেছো আর তার জন্য শাস্তি পেতে হবে।”

ঋষভ এর কথায় আহেলি অবাক হয়ে তাকাতেই ঋষভ আঙুলের দ্বারা আহেলির কপালের ওপর জড়ো হওয়া ছোট্ট এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিলো সযত্নে…….লাল,গোলাপি আর নীল রঙে মাখামাখি মুখটার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকার পর ঋষভ আহেলির ললাটে ভালোবাসার পরশ একে দিতেই আহেলি চোখ বন্ধ করে নিলো আবেশে।ভালোবাসার প্রথম স্পর্শ এর উষ্ণতাএকেবারেই অজানা আহেলির কাছে…এরইমাঝে আহেলির গালের সাথে ঋষভ নিজের গাল ঠেকিয়ে কানের কাছে মুখটা নিয়ে গিয়ে ধীর গলায় বললো,,,

“হ্যাপি হোলি……তুই জানিস তোকে এভাবে দেখে আমি কেমন হয়ে যাচ্ছি?তুই প্লিস বাড়ি ফিরে যা……আমি তোকে স্বীকৃতি দিয়ে তবেই গভীরভাবে ছুঁতে চাই,ততদিন যে আমাদের দুজনকেই অপেক্ষা করতে হবে।একদম আমার কাছাকাছি আসবি না।বুঝলি?”

ঋষভ এর হাতের বাঁধন আলগা হতেই আহেলি তৎক্ষনাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।আহেলির যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ঋষভ মৃদু হাসে।

অনুশ্রী কে ঘটনাটা বলতে গিয়ে যেনো আহেলির চোখের সামনে দৃশ্যটা ভেসে উঠেছিলো।পুরোনো কথা মাথায় আসতেই চোখ থেকে টপটপ করে জল গড়িয়ে পরতে লাগলো আহেলির।

“আহু কাঁদছিস কেনো?আচ্ছা কি দরকার পুরোনো কথা ভাবার?যত আগের কথা ভাববি ততই ওই শয়তানের জন্য আরো কষ্ট পাবি…..প্র্যাকটিক্যাল হো।যা হওয়ার হয়ে গেছে…..প্রান্তিকদা আমাদের সকলকে এমন সুন্দর একটা জায়গায় আনলো আর তুই এভাবে মন খারাপ করে থাকবি?তাহলে আর আসার কি মানে?

অনুশ্রীর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে আহেলি বললো,,,,

“অনু তুই একবার ভেবে বল তো,যে মানুষটা তোর সাথে এরকম করে মিশবে তাকে কিভাবে অবিশ্বাস করবি তুই?আমার কিন্তু কখনো মনেহয়নি ঋষিদা কারোর রিপ্লেসমেন্ট হিসাবে আমায় ইউস করছে।”

“তুই এখনো কোন মুখে ঋষভ দার কথা বলছিস আহু?ও তোকে ঠকিয়েছে তাও নিজের এক্স এরসাথে।কথা বললে বা যোগাযোগ রাখলেও জানতাম….ওরা দুজন তোর অনুপস্থিতি তে মাত্র কদিনের আলাপে ফিজিক্যাল রিলেশনে জড়িয়ে গেছে।এরপরেও তুই ওই প্রতারককে বিশ্বাস করছিস?এবার অন্তত এই অন্ধ প্রেমের জ্বাল থেকে বেরিয়ে আয়,পারলে ঋষভ কে ভোলার চেষ্টা কর।তোর জন্য বেটার হবে সেটা।”

“আমি পারছি না অনু….তুই যতটা সহজে কথা বলছিস ততটা সহজ নয় এটা।এতো সহজে একজনের কথা মনে থেকে মোছা যায় না।আমি ঋষভদা কে অনেকদিন আগে থেকে ভালোবাসি…..কিকরে ভুলে যাবো?তুই আমায় একটা উপায় বল অনু।আমি সত্যিই চাই ভুলতে..

“কি গল্প হচ্ছে দুই বন্ধুতে?আর দুজনেরই গাল ফাঁকা কেনো?রঙ খেলবে না?”

প্রান্তিককে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অনুশ্রী হেসে বললো,,,,

“আর তুমি?হয়ে গেছে ক্যাম্প?”

“হ্যাঁ….আমারটা হয়ে গেছে।আমি তৎক্ষনাৎ এখানে চলে এলাম।”

“আচ্ছা আপনি এই জায়গাটা সমন্ধে জানতে পারলেন কিকরে?”

“শান্তিনিকেতন থেকে হুট করে ফেরায় ওখানের বসন্ত উৎসবে তো থাকা হলো না….এদিকে আমার ফটোশ্যুট হয়নি।তাই গুগুল করে দেখছিলাম এরকম কোনো জায়গা আছে কিনা।তখনই জানলাম এই গ্রামের কথা…..যেখানে দোলের কয়েকদিন পর রঙ খেলা হয়।আর ভাগ্যক্রমে জানলাম এখানে আমাদের হসপিটাল থেকে আজ মেডিক্যাল ক্যাম্প হবে।আমার আজ আসার কথা ছিলো না…..কিন্তু যে ডক্টর আসবে বলেছিলো তাকে আসতে না দিয়ে আমি নিজেই এলাম আর ভাবলাম যাচ্ছি যখন আপনাদের সাথে আনি।”

“ওহ!তার মানে নিজের ফটোশ্যুট এরজন্য আসা?আমাদের মন ভালো করার কথাটা বাহানা মাত্র….”

আহেলির কথায় ঋষভ হেসে বললো,,,,

“দারুন গেস করতে পারেন তো আপনি।ঠিকই ধরেছেন….আমি নিজের জন্যই এসেছি”

প্রান্তিকের কথায় আহেলি মুখটা অন্যদিকে ঘোরাতেই প্রান্তিক নিঃশব্দে হাসলো।ক্যামেরার লেন্স বাচ্ছাদের ওপর তাক করে মনেমনে ভাবলো,,,,

“আমি সত্যিই নিজের জন্য এসেছি আহেলি…..আমার এই চোখদুটো যে আপনাকেই বারবার দেখতে চায় তাই তো এখানে আসা।মনের মানুষকে একপলক চোখের দেখায় যে এতটা শান্তি পাওয়া যায় তা আপনাকে না ভালোবাসলে জানতেই পারতাম না।”

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here