মনের মানুষ ❤️ পর্ব-২৩

0
716

#মনের_মানুষ❤️
#ত্রয়োবিংশ_পর্ব❤️
#কলমে_সাঁঝবাতি🌸

মাঝেমাঝে কিছুটা সময় শুধু নিজের জন্যই রাখা ভালো…..যেসময়ে নিজেকে নিয়ে ভাবা যায়,নিজের সাথে অনেকটা সময় কাটানো যায়।ক্যালেন্ডারের পাতার হিসাব অনুসারে আহেলি মুম্বাই এসেছে আজ নিয়ে তিনমাস ছদিন হলো…..অফিস থেকে প্রথমে কোয়ার্টার দেবে বললেও,আহেলি কে একটা এক-কামরার ছোট্ট ফ্ল্যাট দিয়েছে।সেখানেই আহেলি নিজের জন্য ছোট্ট একটা সংসার পেতেছে।রোজ সাতটার মধ্যে রেডি হয়ে আহেলি কাজের উদ্দেশ্যে বেরোয়…..সকালের ব্রেকফাস্ট নিজে বানিয়ে খায় আর দুপুরটা অফিস ক্যান্টিনে।রাত্রে বাড়ি ফেরার সময় পছন্দমতো বাজার করে রাত্রের রান্না করে…..এসব করতে করতে প্রায় অনেকটাই দেরি হয়ে যায়।অফিসের কোনো কাজ পেন্ডিং থাকলে সেটা কমপ্লিট করে আহেলি যখন বিছানায় বসে তখন সাড়ে এগারোটা বেজে যায়…..এতো তাড়াতাড়ি ঘুমানোর অভ্যেস নেই আহেলির,বাড়িতে থাকাকালীন ঘুমাতে অন্তত একটা বাজতো।এখন রোজ অফিস যেতে হবে তাই বারোটা কিংবা সাড়ে বারোটার সময় আহেলির বেডরুম অন্ধকার হয়।মাঝের এই সময়টুকু আহেলি নিজের মতো করে কাটায়…..কখনো ফোন নিয়ে,বা কখনো গল্পের বই পড়ে আর নয়তো ল্যাপটপে ওয়েব সিরিস দেখে।আহেলির সময়টা বেশ ভালোই কাটছে তাও যে ওর কেনো মনখারাপ সেটাই বুঝে উঠতে পারছে না।আহেলির মনের তিক্ত স্মৃতিগুলো অনেকটাই ফিকে হয়েছে সময়ের সাথে…..কিন্তু আজকাল একজনকে ভীষণ মিস করে আহেলি।কর্ম ব্যস্তময় জীবন থেকে আহেলি একটু ছুটি নিতে চায়…..রোজকার দিনের থেকে একটু অন্যরকমভাবে কাটাতে চায়।তখনই মনে পড়ে প্রান্তিকের কথা…..অবসর সময়গুলো প্রান্তিক কিসুন্দর করে কাটায়।কখনো মেডিক্যাল ক্যাম্প করতে গিয়ে সেখানকার মানুষের সাথে মিশে,নয়তো প্রত্যন্ত কোনো এক নাম না জানা জায়গায় সময় কাটিয়ে আসা।যেখানে গেলেই একনিমেষে মনটা ভালো হয়ে যায়।

আহেলি রবিবার ছুটি পেলেও একা একা কোথাও যায় না….সবেমাত্র এখানে নতুন তাই কারোর সাথে তেমন বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক তৈরি হয়নি।অফিসে কয়েকজন বন্ধু থাকলেও সেটা অফিসে সীমাবদ্ধ…..বাকি সময়টা আহেলি একেবারে একা।প্রথম প্রথম আহেলি এই একা থাকাটা এনজয় করতো কিন্তু যতই দিন এগোয় ততই আহেলির বিরক্ত লাগে….মনেহয় কবে বাড়ি ফিরবে!কবে বাবা মায়ের মুখোমুখি হবে।ওই ছেলেটার সাথে একটু সময় কাটাবে…..মনে একরাশ দুঃখ থাকলেও সেটা দূর হয়ে যায় প্রান্তিকের ছোয়ায়।আহেলির একটা কথা বারবার মনেহয়,প্রান্তিকের মতো সাধারণ ছেলে আর হয় না….আর সাধারণ হওয়াটা এতটা সোজা নয়।

রাত প্রায় বারোটা বাজে…..আধঘন্টা ধরে ল্যাপটপে নানান ধরনের ওয়েব সিরিস বেছেও একটাও দেখতে ইচ্ছা করলো না।ল্যাপটপ রেখে আহেলি ইয়ারফোন নিয়ে কানে গুজলো….দু-একটা গান শোনার পরেই আবার বিরক্ত হলো।তৎক্ষনাৎ কান থেকে ইয়ারফোন খুলে সেটাও একপাশে রাখলো……কিছুই ভালো লাগছে না আহেলির।কাল রবিবার,সারাদিন ছুটি।কিকরে যে গোটা একটা দিন কাটাবে কে জানে।

মস্তিষ্ক না বললেই মনের কথায় আহেলি হাতে নিলো ফোনটা তারপর কললিস্ট থাকা দ্বিতীয় নাম্বার ডায়াল করতে কিছুক্ষন রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো….ওপাশ থেকে কিছু বলার আগে আহেলি নিজেই বললো,,,

“দুপুরে কল করলাম…তখন ধরলেন না!আবার বিকেলে কল করলাম তখনো বিসি বললো ফোনটা।কোথায় ছিলেন আপনি?ঠিক আছেন তো?একবারও কল ব্যাক করলেন না যে?”

“কোন প্রশ্নের উত্তরটা আগে দেবো আহেলি?”

“সরি….আসলে এরকম কোনোদিন হয় না তো তাই বললাম।”

“না ঠিক আছে…..তো এবার বলি,আজ যখন দুপুরে আপনি কল করেছিলেন তখন আমি রেস্টুরেন্টে ছিলাম তাই কল রিসিভ করা হয়নি।লাঞ্চের পরই ডিউটি জয়েন করি তাই আর কলব্যাক করা হয়নি।এইমাত্র বাড়ি ফিরলাম আর আপনারও ফোন এলো।”

“ওহ….আমি ভাবলাম হয়তো আপনার শরীর ভালো নেই।তো হটাৎ রেস্টুরেন্টে গেছিলেন যে?একাই?”

“নাহ একা নয় সাথে রিমিকা ছিলো….একচুয়ালি ওর অনুরোধেই যাওয়া।”

“রিমিকা মানে আপনার জুনিয়র সেই মেয়েটা?”

“ইয়েস…আসলে সামনেই পুজো।আপনি তো জানেন রিমিকা নর্থ বেঙ্গলের মেয়ে।পুজোতে হয়তো ও বাড়ি ফিরতে পারবে না তাই নিজের জন্যে শপিং করতে গেছিলো…..এখানে তেমনকিছু চেনে না তাই আমায় সাথে যেতে বলে আর শেষে লাঞ্চ করে আমরা একসাথেই হসপিটালে এলাম।”

“ওহ…..ভালোই সময় কাটালেন তাই না?”

“এটা একদম ঠিকই বলেছেন আহেলি….রিমিকার সাথে সময়টা বেশ ভালোই কাটে।মেয়েটা অনেকটা আমার মতোই….সহজে সব্বার সাথে মিশে যায়।”

“বাহঃ ভালোতো….আমারও পুজোয় ফেরা হবে না।এখানে নবরাত্রি হলেও আমার অফিসে মাত্র দুদিন ছুটি আর তারমধ্যে কলকাতা যাওয়া সম্ভব নয়।”

“তাতে কি?মুম্বাইতেও দুর্গাপুজো হয়….ওখানের পুজোটা এনজয় করুন।নতুন অভিজ্ঞতা হবে।”

“ঠিকই বলেছেন….চাইলে এখানেও আমি আনন্দ করতে পারি।আসলে পাড়ার পুজোতে প্রতিবছর থাকি তো তাই….বাবা মাকেও ছেড়ে!”

“কলকাতায় না থাকতে পারলে মন তো খারাপ হবেই….আচ্ছা তাহলে একদিন নয় আমি বরং আপনার পাড়ায় যাবো আর ভিডিওকলে সবটা দেখিয়ে দেবো কেমন?তাহলে আর মনখারাপ থাকবে না।”

“আমার জন্য আপনাকে এতো ব্যস্ত হতে হবে না প্রান্তিক……বাবা মা আছে তো।আর আপনিও হয়তো এবছর আপনার রিমিকা কে নিয়ে ব্যস্ত থাকবেন!না মানে কলকাতায় নতুন,ওকে নিশ্চই আপনি পুজোটা ঘুরে দেখাবেন।”

“এইই দারুন একটা আইডিয়া দিলেন তো…..থ্যাংক ইউ সো মাচ আহেলি।এই নাহলে বন্ধু?এভাবে রিমিকা আর আমি অনেকটা সময় কাটাতে পারবো তাই না?”

“হুমমম….তাই জন্য তো বললাম।আচ্ছা প্রান্তিক এবার আমি রাখি কেমন?কাল সকালেই তো অফিস।”

“ওকে গুডনাইট…..টেক কেয়ার।”

আহেলি ফোনটা কেটে বিছানার একপাশে ফেলে রেখে উঠে দাঁড়ালো…..কাঁচের জানলাটা টানতেই কিছুটা ঠান্ডা হাওয়া এসে ছুয়ে গেলো আহেলিকে।এসময় কলকাতায় থাকলে ছাতিম ফুলের উগ্র সুবাস পাওয়া যায় যা মা দুর্গা আসার আগাম বার্তা বয়ে আনে….কিন্তু এই মুম্বাই শহরে এসব ভাবাও বৃথা।আহেলি বুঝতে পারছে প্রান্তিক ক্রমশ রিমিকার উপর দুর্বল হয়ে পড়ছে আর তা ওর কথা-বার্তায় বোঝা যায়।আর হবে নাই বা কেনো?প্রান্তিক যখন আহেলিকে ভালোবাসার কথা বলেছিলো তখন আহেলি নিজেই তাতে ফুলস্টপ দিয়ে গল্পটা শুরুর আগেই সমাপ্ত করেছিলো যদিও তার কারণ আছে।এরপর আহেলির সাথে প্রান্তিকের একটা সম্পর্ক অবশ্যই গড়ে উঠেছে তবে তা শুধুই বন্ধুত্বের…..তার বেশি কিছুই নয়।তাই প্রান্তিক যদি নিজের মনের মানুষ খুঁজেও নেয় তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।আহেলি তো নিজেও তাই চেয়েছিলো……তবে আজ এতো খারাপ লাগছে কেনো আহেলির?জানলা বন্ধ করে বিছানায় এসে বসলো আহেলি….আবারো ফোনটা হাতে নিয়ে ফেসবুক ওন করলো।ফ্রেন্ডলিস্টে না থাকলেও আহেলির সার্চলিস্টে সবার প্রথম রিমিকার প্রোফাইল…..তাতে আঙুল ছোঁয়াতে খুলে গেলো প্রোফাইলটা।স্ক্রল করতে শুরু করেই এক জায়গায় এসে থামলো আহেলি…..আজকে বিকেলেই পোস্ট করা কতগুলো ফটো দেখতেই আহেলির মনখারাপের পাল্লা আরো ভারী হলো।

নেভি ব্লু শার্ট আর জিন্স প্রান্তিককে বেশ লাগছে…..পাশেই মেয়েটা।রিমিকাকে দেখতে বেশ সুন্দর…বিশেষ করে চোখ আর নাকটা।ফটগুলোর কমেন্ট সেকশনে গিয়া আরো অবাক আহেলি….সকলের একটাই কথা’একেবারে পারফেক্ট ম্যাচ’আরো নানান ধরনের কমেন্ট।প্রতিটা ছবি রিমিকা প্রান্তিককে ট্যাগ করে পোস্ট করেছে।এর আগে তো প্রান্তিকের সাথে আহেলি নিজেও ফটো তুলেছে কৈ প্রান্তিক কখনো এসব পোস্ট করেনি তো সোশ্যাল মিডিয়ায়।আহেলি দেখলো প্রান্তিক আর রিমিকা দুজনেই একটিভ আছে….বাকিটা বুঝতে দেরি হলোনা আহেলির।বালিশে মুখ গুজে আহেলি ঘুমানোর চেষ্টা করতেও ঘুম এলো না….চোখের সামনে প্রান্তিকের সাথে কাটানো মুহূর্তগুলো ভেসে উঠতে লাগলো একের পর এক।তৎক্ষনাৎ আহেলির ঠোঁটে তাচ্ছিলের হাসি ফুটে উঠলো…..একমাত্র আহেলি বাদে সকলেই নিজের মনের মানুষের সন্ধান পায় যার সাথে রঙিন মুহূর্ত কাটানো যায়।একটা সময় আহেলি ভেবেছিলো সত্যিই হয়তো ও একজন মনের মানুষ পেয়েছে কিন্তু সে যে আসলে এমন হবে তা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি আহেলি…..তাও আহেলি পুরোনো স্মৃতি ভুলে একটু একটু করে নিজের মনে আরেকজনকে যখন জায়গা তৈরি করে দিচ্ছিলো তখন সেও আহেলির থেকে দূরে চলে গেলো…..

আহেলি আজ একটা জিনিস স্পষ্ট বুঝেছে ওর জীবনটা হয়তো ভালোবাসাহীন…..এটা সেই অর্থের ভালোবাসা যা একজন প্রেমিকা তার প্রেমিকের থেকে দাবি করে।সকলেই কি আর নিজের মনের মানুষ খুঁজে পায়?কেউ কেউ একাই রয়ে যায় সারাজীবন……ঠিক আহেলির মতন।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here