মনের মানুষ ❤️ পর্ব-২৫

0
715

#মনের_মানুষ❤️
#পঞ্চবিংশ_পর্ব❤️
#কলমে_সাঁঝবাতি 🌸

“যারা যারা অষ্টমীর অঞ্জলী দেবেন,অবিলম্বে আমাদের মন্ডপ প্রাঙ্গণে এসে উপস্থিত হোন।আর কিছুক্ষণের মধ্যেই অঞ্জলী শুরু হবে….”

মাইকের মাধ্যমে দৃঢ় গলায় ভেসে আসা কথাগুলো শুনে আহেলি বললো,,,,,

“তাড়াতাড়ি করো মা….ওদিকে অঞ্জলী শুরু হয়ে যাবে তো।”

“আর কতো তাড়াতাড়ি করবো বলতে পারিস আহু?সেই সকাল থেকে একদন্ড বসার সময় পাইনি…..তোর বাবার পাঞ্জাবি পরার সময় আমার হেল্প চাই,তোর শাড়ির কুচি ধরতে হবে।এতো কাজ আমি একসাথে সামলে নিজে কখন যাবো বলতে পারিস?”

“আমার সঙ্গে এখনই যাবে…..আমি কি শাড়ির কুচি ধরতে পারি একা?”

উমা দেবী কুচিগুলো ঠিক করে উঠে দাঁড়ালেন…..একবার আহেলির দিকে তাকিয়ে প্রশংসার সুরে বললেন,,,

“লাল শাড়িতে তোকে বেশ মানিয়েছে তো….নাহ বলতেই হবে ছেলেটার পছন্দ আছে।নে নে…তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে নে এইবার।ওদিকে অঞ্জলী সত্যিই শুরু হয়ে যাবে।”

“তুমি ঠাকুরের ভোগ দিতে দিতে আমি রেডি হয়ে যাবো মা….”

আহেলির মা ঘর থেকে বেরিয়ে যেতেই আহেলি আয়নার সামনে এসে দাঁড়ায়…..লাল রঙের জামদানিতে সত্যিই বেশ সুন্দর লাগছে ওকে।আহেলি অনেকদিন পর নিজের ড্রেসিং টেবিল থেকে প্রসাধনী বাক্স বের করলো….বেশ খোঁজাখুঁজির পর ব্ল্যাক পলিশের অক্সিডাইসের ঝুমকো সাথে একটা হার পরলো সাথে ম্যাচিং চুড়ি,চোখে কাজল দিয়ে ঠোঁটে লাল লিপস্টিক দিলো।চুলগুলো খোলা রাখবে ভেবেও গরমের চোটে খোঁপা করে তাতে জুঁই ফুলের মালা জড়িয়ে দিলো।

আহেলি আরো একবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো…..বাইরে থেকে মায়ের ডাক কানে আসতেই পার্স আর মোবাইল হাতে বেরোলো ঘর থেকে।আহেলি দরজার সামনে দাঁড়াতেই উমা দেবী কয়েকপলক তাকিয়ে থাকার পর মুচকি হাসলেন তারপর মেয়েকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন বাড়ি থেকে।

ধুপ-ধুনোর সুগন্ধির মধ্যে দিয়ে অষ্টমীর অঞ্জলী চলছে….থিম প্যান্ডেলের বাইরে আরেকটা প্যান্ডেল হয় আহেলিদের পাড়ায় যেখানে মা দুর্গার মৃণ্ময়ী রূপের আরাধনা করা হয়।মন্ডপের মধ্যে চার সন্তানকে নিয়ে রাজসজ্জ্বায় সজ্জিত মা দুর্গা……সেদিকে সকলেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে।অঞ্জলী শেষ হতে আহেলি পুরোহিত মশাইয়ের হাতে টাকা দিয়ে প্যান্ডেলের কোনায় রাখা স্ট্যান্ড ফ্যানের সামনে দাঁড়িয়েছিলো।এমন সময় ওর বাবা-মা দুজনই কথা বলতে বলতে ওর সামনে এসে দাঁড়ালো।আহেলি দুজনকে দেখেই বুঝলো কোনো একটা বিষয় নিয়ে মনোমালিন্য চলছে।আহেলি ভ্রূ নাচাতেই উমা দেবী বললেন,,,,

“তোর বাবার কোনো কান্ডজ্ঞান নেই বুঝলি তো!বলছি লুচি করবো,তাতে নাকি ওনার হবে না।ওনার আজ রাধাবল্লভী আর আলুকষা চাই।”

মায়ের কথায় অতীতে ফিরে গেলো আহেলি।আগে পুজোর সময় অষ্টমীর দিন করে ওর মা স্পেশালী রাধাবল্লভী আর আলুকষা বানাতো।অমিও বাবুর বয়স হয়ে যাওয়ার জন্য আজকাল সেই রেসিপি হয় না…সাদামাটা লুচি-আলুরদম হয়।

“আচ্ছা আহু তুই বল….সবসময়ই তো খাই নাকি ওই লুচি।আজ যদি আমার প্রিয় জিনিস রান্না হয় তাতে কি এমন হবে?আমি বলছি তো অল্প করেই খাবো….”

“বুড়ো বয়স হলো তবুও লোভ গেলো না!আর আমি একা একা কতদিক সামলাবো?ওসব করতে কতো ঝামেলা জানো?”

“উফফ….থামবে তোমরা দুজন?এই প্যান্ডেলে দাঁড়িয়েও আজকের দিনে ঝগড়া করবে?আচ্ছা শোনো মা,বাবা যখন আজকের দিনটা খেতে চাইছে তখন আর না করো না।”

“এইতো।আমার মেয়ে যখন হ্যাঁ বলেছে তখন আর কি?এবার তোমায় বানাতেই হবে।”

“বললেই হলো বানাতে হবে!মেয়েটা তো বাড়ি থাকবে না….আমাদের দুজনের জন্য বানিয়ে কি লাভ?”

“আমার জন্য কেনো আটকাচ্ছে?আমি রাত্রে এসে খাবো….আর শোনো আমি ময়দা মেখে,পুর তৈরি করে ফ্রিজে গুছিয়ে রেখেছি।তুমি বানিয়ে নিও জাস্ট।আমি বেরোতাম না কিন্তু….”

“এইজন্য আজ সকাল থেকে রান্নাঘরের দিকে যেতে দিস নি আমায়?তোকে এসব কে করতে বলেছে?আর প্রান্তিক আসবে কখন?”

উমা দেবীর কথা শেষ হওয়ার আগেই পেছন থেকে প্রান্তিক বললো,,,

“আন্টি আমি এই যে….”

প্রান্তিকের গলা পেয়ে সকলেই সেদিকে তাকালো…..আজ আহেলির বাবা মা আহেলির কিনে দেওয়া শাড়ি পাঞ্জাবি পরেছে।এমনকি প্রান্তিক নিজেও আহেলির দেওয়া শার্ট আর প্যান্ট পরেছে….আহেলি একপলক প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দিলো।কাল থেকে যতবার প্রান্তিকের মুখোমুখি হওয়ার কথা ভেবেছে তত আহেলি লজ্জ্বা আর শঙ্কায় ভুগেছে।প্রান্তিককে আজকে অন্যান্য দিনের থেকে একটু বেশিই হাসিখুশি লাগছে।প্রান্তিকের দিকে তাকিয়ে উমা দেবী বললেন,,,,,

“তুমি অঞ্জলী দিয়েছো?”

“হ্যাঁ আন্টি…..অঞ্জলী দিয়ে সোজা এখানেই এলাম।”

“তা ভালোই হয়েছে….চলো বাড়ি চলো।কিছু খেয়ে বেরোবে দুজন।”

“আন্টি আম সরি আজ আমি আপনার কথা রাখতে পারছি না।একচুয়ালি মা আহেলি কে তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে….তাই।কাল তো এমনিই আসবো।

“আচ্ছা তাই হোক…..তবে সাবধানে যেও তোমরা।যা রাস্তার হাল।”

“হ্যাঁ আঙ্কেল।আপনারা চিন্তা করবেন না…আমি আহেলিকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যাবো।আর আপনাদের যদি কোনো সমস্যা হয় তাহলে অবশ্যই আমায় নয়তো আহেলি কে জানাবেন।”

উমা দেবী আর অমিও বাবু সম্মতি জানাতেই আহেলি কে প্রান্তিক বললো,,,,

“আমি বাইক প্যান্ডেল থেকে কিছুটা দূরে পার্ক করেছি…..আসুন।”

প্রান্তিকের কথায় আহেলি বাবা মাকে বলে এগিয়ে গেলো।ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে উমা দেবী বললেন,,,,

“এতদিনে আমার মেয়েটা এমন একটা মানুষকে পেয়েছে যার কাছে ওর দাম আছে।দুজনকে একসাথে কতসুন্দর লাগছে তাই না?”

“ঠিক বলেছো উমা…হয়তো এটাই আমাদের আহুর কপালে ছিলো তাই এতকিছুর পর প্রান্তিকের সাথে দেখা হলো।”

আহেলির মা প্যান্ডেলের ভেতরের দিকে তাকিয়ে দুহাত কপালে ঠেকিয়ে বললেন,,,,

“সবই মায়ের ইচ্ছা….”
🌸🌸🌸🌸🌸🌸🌸

মাঝারি স্পিডে এগিয়ে চলেছে প্রান্তিকের বাইক….আহেলি আয়নার মধ্যে দিয়ে প্রান্তিকের দিকে একবার করে তাকিয়ে তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে নিচ্ছে।রাস্তায় প্রায়ই নানান জায়গায় জ্যামের কারণে থেমে যাচ্ছে দুজনে…..ট্রেনের লেভেল ক্রসিং পেরোনোর জন্য বেশ লম্বা জ্যামের মধ্যে আটকা পরেছে দুজনে…..একেই গরম তার ওপর এমন ভিড়।আহেলি বেশ বিরক্ত….প্রান্তিক এদিক ওদিকে তাকাতে হঠাৎই খেয়াল করলো ওর বামপাশের একটা দোকানের মধ্যে একটা ছেলে দাঁড়িয়ে আর তার দৃষ্টি আহেলির দিকে নিবদ্ধ।আহেলি যদিও সেসব জানে না…..তবে ছেলেটার মুগ্ধ দৃষ্টির দিকে প্রান্তিক আরো একবার তাকাতেই মনেমনে কিছু ভাবলো।আহেলি ডানহাত দিয়ে চুলগুলো ঠিক করছিলো হটাৎই প্রান্তিক আহেলির হাতটা ধরে নিজের কোমড়ে রাখলো।আহেলি অবাক হয়ে তাকাতেই প্রান্তিক কিছু বললো না….ঠিক এমন সময় জ্যাম ক্রসিং উঠতে শুরু করলে প্রান্তিক স্টার্ট দিলো।আর অমনি আহেলি আরো শক্ত করে প্রান্তিকের কোমরটা জড়িয়ে ধরলো।এগিয়ে যাওয়ার আগে প্রান্তিক একবার ছেলেটার দিকে তাকালো….সে বেশ নিরাশ মুখে অন্যদিকে তাকিয়ে।

প্রান্তিকের বাইক গিয়ে থামলো সেই একতলা বাড়ির সামনে….এরআগে যদিও আহেলির জোরাজুরিতে ওরা একটা জামাকাপড়ের দোকানে ঢুকেছিলো।আহেলির হাতে বেশ কয়েকটা শপিং ব্যাগ…..প্রান্তিকের সাথে সাথে আহেলি ঢুকলো বাড়িতে।আজ অবশ্য সুব্রত বাবু উপস্থিত আছেন….আহেলি আর প্রান্তিককে দেখেই সৌরিক ছুটে এগিয়ে এলো।আহেলি এগিয়ে গিয়ে প্রান্তিকের মা আর সুব্রত বাবু কে নমস্কার করে ওনাদের হাতে একটা করে প্যাকেট ধরিয়ে দিতেই প্রান্তিকের মা বললো,,,,

“এসব আবার কেনো?তুমি সবেমাত্র কাজ শুরু করেছো….তুমি এসেছো এতেই খুশি আমরা।”

“সেটাই তো….এইতো প্রান্তিক আমাদের কিনে দিয়েছে আবার তুমি কেনো মা?”

“প্রান্তিক তো আমার বাবা মাকেও গিফ্ট করেছে কারণ নাকি ও ওদের ভালোবাসে।তাহলে আমি ভালোবেসে দিলেই দোষ?”

“আচ্ছা হয়েছে…..যেমন প্রান্ত তেমন তুমি।তোমাদের দুজনকে একসাথে দেখে কি ভালোলাগছে যে কি বলবো।আমার ছেলেটা তোমার মতো একটা মিষ্টি মেয়েকে আমার বৌমা করবে ভেবেই আনন্দ হচ্ছে।”

“করবে কি গো?আহেলি তো চাকরি করছেই।ট্রেনিং শেষে কলকাতায় ফিরলেই ওদের চারহাত এক হবে….সেরকমই তো কথা হয়ে আছে নাকি?”

আসলে ঘটনা হলো প্রান্তিক ওর মাকে জানায় ও ভালোবাসে আহেলি কে……তখন প্রান্তিকের মা আর সুব্রত বাবু দুজনই আহেলির বাড়িতে যায় প্রান্তিককে সাথে নিয়ে।আহেলির বাবা মা ঋষভ এর ব্যাপারে কিছুই গোপন করেননি….আবার প্রান্তিকের মাও সবটা বলেন।দুই পরিবার প্রান্তিকের কথাতে সামনের ফাল্গুনে ওদের বিয়ে ঠিক করে রেখেছেন।ব্যাপারটা আহেলি না জানায় ওর বাবা মা প্রথমে চিন্তায় ছিলেন..তখনই প্রান্তিক বলে আহেলি কোনোদিন না বলবে না কারন ওর স্থির বিশ্বাস আহেলিও প্রান্তিককে ভালোবাসবে।এসবই হয় আহেলির অগোচরে……আর প্রান্তিক ইচ্ছা করে রিমিকা কে নিয়ে রাগাতো যাতে আহেলি নিজে থেকে এগিয়ে আসে কোনো দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছাড়াই।আর হয়েছে তাই…..এসবই কাল আহেলি জেনেছে প্রান্তিকের কাছে।

সৌরিকের হাতে জামার প্যাকেট দিতে সৌরিক বললো,,,

“আমি সেদিনই বুঝেছিলাম তুমিই আমার বৌদিভাই হবে….মিললো তো আমার কথা?”
🌸🌸🌸🌸

আহেলি প্রান্তিকের মায়ের সাথে জোর করে রান্নাঘরে এসে দাঁড়িয়েছিলো….প্রান্তিকের মা ওকে কিছু করতে না দিলেও আহেলি সরলো না।সৌরিকের সাথে প্রান্তিক বাইরে খেলছে…..ঘর থেকে সুব্রত বাবুর ডাক শুনে প্রান্তিকের মা আহেলি কে ওভেনে বসানো রান্নাটা দেখতে বলে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।

প্রান্তিকের মা যেতেই আহেলি ওভেনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো…..হঠাৎই শাড়ির ফাঁক দিয়ে পেটের ওপর দুটো উষ্ণ হাতের স্পর্শ অনুভব করতেই চমকে উঠলো আহেলি।ঘাড়ের ওপর নিঃশ্বাসের আভাস পেতেই কোনোরকমে আহেলি বললো,,,,

“কি হচ্ছেটা কি?কাকিমা চলে আ-আসবে তো।”

“আসবে না….কাকু দোকানে গেলো কি দরকারে আর সৌরিককে নিয়ে মা গেছে মন্ডপে।”

“মন্ডপে?কৈ আমায় কিছু বলে গেলো না…..”

“সন্ধ্যেবেলা ফাংশন হবে এখানে…..তাই সৌরিক নাম দেবে।মা ছাড়া গেলে নাকি হবে না তাই!”

আহেলি আরো কিছু বলবে তার আগেই ওর আরো কাছে এলো প্রান্তিক।ধীর গলায় বললো,,,,

“কাল এতবার করে বলার পরেও সেই আপনি!!কি মেসেজ করলে?আমি রেডি….টাইমলি চলে আসবেন।”

“তো আর কি করবো?অভ্যেস হয়ে গেছে তো….”

“অভ্যেসটা যে বদলাতে হবে এবার…..”

আহেলির ঘাড়ে নাক ছুইয়ে প্রান্তিক একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বললো,,,

“তোমার এই সাজ,স্মেল…সবকিছু পাগল করে দিচ্ছে আমায় আহেলি…..প্লিস আর দূরে থেকো না।আমি কিন্তু আর কোনোরকম দূরত্ব সহ্য করবো না।”

প্রান্তিকের কথা আর ওর কাজকর্মএ আহেলির হার্টটা খুব দ্রুত গতিতে এগোচ্ছে…..লজ্জ্বায় আহেলি একহাতে শাড়ির আঁচল চেপে ধরেছে।প্রান্তিক যে এমন তা ধারণার বাইরে ছিলো আহেলির…..তবে আজ এই ভালোবাসা পেয়ে আহেলির নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে।সে যে নিজেও প্রান্তিকের থেকে দূরে যেতে চায় না।

ঘাড়ের নরম উষ্ণ স্পর্শ পেয়ে আহেলি শিহরিত হয়ে সামনে ফিরে প্রান্তিককে জড়িয়ে ধরলো।প্রান্তিক নিজেও দুহাতের মধ্যে আগলে নিলো আহেলিকে।আজ থেকে প্রান্তিক নিজের স্বভাব বদলে অন্যরকম হতে চায়…..তাতে যদি ওকে আহেলি নির্লজ্জ্ব ভাবে তো ভাবুক।ভালোবাসায় নির্লজ্জ্বতা না থাকলে কি চলে?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here