#মনের_মানুষ ❤️
#সপ্তবিংশ_পর্ব❤️
#কলমে_সাঁঝবাতি
দুর্গাপুজোয় ঢাকের আওয়াজে বিভিন্ন রকম ফের থাকে…..মায়ের আগমনে যেমন আনন্দের বাদ্যি বাজে ঠিক তেমন ফেরার সময় বিষাদের সুর পাওয়া যায়।আজ দশমী…..উমার কৈলাশে ফিরে যাওয়ার সময় এসে উপস্থিত।বেলা বারোটা থেকেই বাবুঘাটে লম্বা লাইন।সমস্ত বনেদিবাড়ির ঠাকুর বিসর্জনের জন্য আসছে একের পর এক সাথে নানান লোকজন।নৌকায় করে দেবী মূর্তি নিয়ে গিয়ে মাঝনদীতে বিসর্জন করা হবে,ঢাক কাঁসর আর শঙ্খধ্বনিতে চারদিক মুখর হয়ে আছে।শরতের ঝকঝকে আকাশে তুলোর মেতে মেঘের খেলা…..অনেকে এসেই ভিড় জমিয়েছে ঠাকুর বিসর্জন দেখার জন্য।আহেলির কাল ফিরে যাওয়ার কথা আছে,এবং খুব ভোরেই ফ্লাইট।মুম্বাই ফিরে বেলা দশটার মধ্যে অফিস জয়েন করতে হবে….আহেলি আজকের দিনটা বাড়িতে থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু প্রান্তিক ওকে জোর করে এনেছে বাবুঘাটে।প্রান্তিক আজ একটা সাদা পাঞ্জাবি পরেছে আর গলায় ক্যামেরা ঝুলছে…..আহেলিকে শাড়ি পরার কথা বলেছিলো প্রান্তিক কিন্তু তাতে রাজি হয়নি আহেলি।এই গরম আর ভিড়ের মধ্যে শাড়ি পরে থাকা একেবারে অসহ্যকর ব্যাপার তাই সাদা রঙের সালোয়ার পরেছে।
প্রান্তিকের হাত ধরে ভিড় ঠেলে কোনোরকমে ওরা ভেতরে প্রবেশ করলো….বনেদিবাড়ির একচালার ঠাকুর,কোনোটা রাজকীয় সাজ তো কোনোটা ডাকের।তবে আজ প্রতিমার মুখেও বিষণ্নতার ছোয়া….বরণ শেষে মাথা ভর্তি সিঁদুর আর ওষ্ঠে সন্দেশ নিয়েই মা ফিরবে তার শ্বশুরবাড়িতে।আহেলির সবচেয়ে মজা লাগতো ছোটবেলায়……মন্ডপ থেকে ঠাকুর নামিয়ে বিসর্জন করার আগে যখন পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে যেতো তখন ভাবতো মহিষাসুরকে প্রণাম করবে কিনা।কিন্তু যখনই দেখতো মহিষাসুরের মুখেও সন্দেশ আর কপালে সিঁদুরের টিকা তখন ঝুপ করে একটা নমস্কার সেরে নিতো।
পুরোনো কথা ভাবতেই হেসে ফেললো আহেলি…..ওরা এই মুহূর্তে যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে নৌকো ছাড়া হবে।গঙ্গার ধারে বেশ জোরে হাওয়া দিচ্ছে…..আহেলির ক্লিপে আটকানো চুলগুলো বারবার এলোমেলো হয়ে যাওয়ায় বিরক্ত হয়ে আহেলি ভালো করে খোঁপা করে ক্লিপ দিয়ে দিলো।প্রান্তিক এগিয়ে গিয়ে একজন মাঝির সাথে কথা বলছে……কথা বলে আহেলির কাছে এসে বললো,,,,
“চলো….”
“কোথায়?”
“ওই নৌকাটা আমি আপাতত ভাড়া করলাম…..ফটোগ্রাফি করতে হবে তো নাকি?ওরা আমায় চেনে ভালোমতো।”
“কাউকে তো নিয়ে যেতে রাজি হলো না…..আর তোমার বেলাতেই রাজি হয়ে গেলো?”
“ম্যাজিক বুঝলে?সবার সাথে প্রান্তিকের তুলনা হয় না…..আর ঐ নৌকায় করে কয়েকজন যাবে নদীতে,ওরা সাঁতার কেটে ওই নদীতে ভেসে ওঠা ঠাকুরের বস্ত্রগুলো নেয়।”
আহেলি খেয়াল করলো ঘাটের একপাশে বেশ কয়েকটা জেসিবি দাঁড়িয়ে…..গঙ্গায় ক্রমাগত দূষণ বৃদ্ধি পাওয়ায় জন্য এ ব্যবস্থা।প্রতিমা নিরঞ্জনের খানিক পরই সেগুলো সরিয়ে ফেলা হবে।চারদিকে সিভিক ভলিনটিয়ার আর পুলিশ….এবার শুরু হবে বিসর্জন।প্রান্তিক আহেলি কে নিয়ে নৌকায় উঠলো…..আহেলি বেশ ভয়ের সাথে উঠলো নৌকায়।মাঝ নদীতে ঠিক নয়….বেশ কিছুটা দূরে যেতেই নৌকায় থাকা ছেলেগুলো জলে ঝাঁপিয়ে পরলো।ওদিকে এক এক করে দুর্গাপ্রতিমা আসছে…….প্রান্তিক নিজের ক্যামেরা নিয়ে একদম রেডি হয়ে থাকলো।
শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি পরিহিত যুবকটির দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রয়েছে আহেলি……রোদের মধ্যে বেশ ঘেমে উঠেছে অথচ একটুও ক্লান্তি নেই চোখেমুখে।কে বলবে এই ছেলেটা নাইট ডিউটি সেরে সোজা এখানে এসেছে…..প্রান্তিকের কথায় ঘুমানোর তো সময় অনেক আছে কিন্তু দুর্গাপুজো বছরে একবারই আসে।
জলে ডুবে যাওয়ার আগে অব্দি আহেলি তাকিয়েছিলো প্রতিমাটির দিকে…..কখন যে ওর চোখদুটো ভিজে গেছে তা ওর নিজেরই জানা নেই।তবে এই অশ্রুবিসর্জন শুধুমাত্র মায়ের বিদায়ের জন্য নয়….আহেলির বিশ্বাসই হচ্ছে না ও জীবনে এমন একটা মানুষ পেয়েছে যে সেই মানুষটা যতটুকু সময় পায় নিজের জন্য তারমধ্যে আহেলিকেও রাখে।এমন নয় তো যে প্রান্তিকের অঢেল সময়…..ওতো একজন ডক্টর,হসপিটাল নিজস্ব চেম্বার সবমিলিয়ে প্রায় সারাদিন ব্যস্ত থাকে তাও কিসুন্দর করে সময় বের করতে জানে তা সে যতই কম হোক।আসলে চেষ্টা করলে সবই সম্ভব।
🌸🌸🌸🌸
প্রান্তিকের যখন ফটো তোলা শেষ হলো তখন বিকেল হয়ে এসেছে….চারদিকে ভিড়ে ঠাসাঠাসি।কোনোরকমে আহেলিকে নিয়ে বেরিয়ে এলো প্রান্তিক।আজ অবশ্য ওরা গাড়ি বা বাইক কিছুই আনেনি….কারণ আজ রাস্তায় ভালোই জ্যাম হবে।প্রান্তিক আর আহেলি দুজনই পাশাপাশি হাঁটছে…..হঠাৎই আহেলি রাস্তার ধারের একটা ফুচকার দোকান দেখে বললো,,,,,
“ওই দেখো ফুচকা…..সেদিন তো রাত হয়ে যাওয়ায় খাওয়া হলো না।চলো না আজ খাই…প্লিস,না করতে পারবে না।”
“না করবো কেনো আহেলি?সেদিন বারন করেছিলাম অনেকটা রাত হয়েছিলো তাই….খেলে তোমারি সমস্যা হতো।কিন্তু আজ তো বিকেল…তুমি খেতেই পারো।”
“আমি একা নয়…সাথে তুমিও খাবে।”
“সত্যি বলতে কি আহেলি….নাইট ডিউটির পরই আমি ফ্রেশ হয়েই বেরিয়েছিলাম।এতকিছুর মধ্যে মাথাটা বেশ ধরেছে…..তাই তুমি খাও।”
“কেনো আমি একা কেনো খাবো?তুমি তো নিজেই বলো ফুচকা খেতে ভালোবাসো তাহলে আজ না করছো কেনো?”
“ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড আহেলি….আমার মাথাটা ধরেছে।তাই এখন না….অন্যসময় ঠিক খাবো।”
“ওকে ফাইন!খেতে হবে না….আমিও খাবো না।চলো বাড়ি ফেরা যাক,কাল ভোরের আগে উঠতে হবে তাই বাড়ি ফিরে রেস্ট নেওয়া দরকার।”
“ওকে দেন চলো…..তোমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আমিও যাবো।আজকে ছুটি নিলেও কাল আমাকেও তাড়াতাড়ি উঠতে হবে।”
আহেলি অবাক হয়ে তাকালো প্রান্তিকের দিকে….ছেলেটা একবারও ওর রাগ ভাঙলো না কেনো?রাগে আহেলি আর তেমন কিছু বললো না।
🌸🌸🌸🌸
আহেলির রাগ থাকলেও প্রান্তিকের সাথেই এয়ারপোর্ট যাচ্ছে…..অনেকটা তাড়াতাড়ি বেরিয়েছে ওরা।এখনো রাতের অন্ধকার চারদিকে…..রাস্তায় আলোর মালা আর প্যান্ডেলগুলো একেবারে ফাঁকা।কয়েকদিনের ভিড় সামলে যেনো বিশ্রাম নিচ্ছে শহর কলকাতা।আহেলি এখনো কথা বলেনি প্রান্তিকের সাথে…..প্রান্তিকও তেমন কিছু আর বলেনি।দুজনই চুপচাপ….হঠাৎই প্রান্তিক গাড়ি থামাতে চমকে উঠলো আহেলি।বাইরে তাকিয়ে বললো,,,
“এখন তুমি ভিক্টরিয়ার সামনে এলে কেনো?আমায় কিন্তু টাইমলি পৌঁছাতে হবে।”
“তোমায় টাইমলি পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব আমার কাঁধে তাই ওটা নিয়ে ভেবো না।এখন গাড়ি থেকে নামো।”
আহেলি কিছু বলতে গেলেও প্রান্তিক ওকে গাড়ি থেকে নামার ইশারা করলো।চারপাশটা অন্ধকার….সাথে হালকা কুয়াশার স্তর।কথা অনুযায়ী ঠাকুর জলে পড়ার সাথে সাথে ঠান্ডার ভাব আসে আর সত্যিই সেরকম একটা ভাব।সামনে থাকা ভিক্টরিয়া প্যালেসের দিকে তাকিয়ে আহেলি ভাবলো এখন প্রান্তিক এখানে কেনো এলো?ঘুরে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো আহেলি কারণ প্রান্তিক ওর সামনে হাঁটুমুড়ে বসেছে।আহেলি অবাক হয়ে তাকাতেই প্রান্তিক পকেট থেকে একটা প্যাকেট বের করলো যার মধ্যে পোড়ামাটির গয়না আছে আর এটা সেই গয়না যেটা আহেলি নিজের জন্য শান্তিনিকেতনে পছন্দ করেছিলো।প্রান্তিক প্যাকেটটা আহেলির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,,,,
“এটা আমি শান্তিনিকেতনে কিনেছিলাম তোমায় দেবো বলে,কিন্তু তা আর হয়ে ওঠে নি।কিন্তু ভগবান চেয়েছিলো আমরা এক হই তাইতো আমি আর তুমি এখানে।তাই আপাতত আমার প্রথম গিফটটা দিয়েই বলছি আহেলি…..
“উইল ইউ ম্যারি মি?সারাজীবন আমার সাথে থাকবে?”
আহেলি ওপর নিচে মাথা নারাতেই প্রান্তিক হাসলো…..হাসির সাথে ওর চোখ দিয়ে টপ করে একফোটা জল পরলো।উঠে দাঁড়িয়ে জড়িয়ে ধরলো আহেলিকে শক্ত করে।আহেলির গলায় মুখ রেখে জড়ানো গলায় প্রান্তিক বললো,,,,
“আমি তোমায় ভীষণ ভালোবাসি আহেলি…..সেই প্রথমদিন থেকে,যেদিন আমায় তুমি সানগ্লাস পরতে দেখে সাউথের ভিলেন বলেছিলে।”
প্রান্তিকের কথায় হেসে ফেললো আহেলি…..বড়ো করে একটা নিশ্বাস নিয়ে আরো শক্ত করলো হাতের বাঁধন।তখনই প্রান্তিক আহেলির কানের কাছে বললো,,,,,
“কাল তোমায় এমনি এমনি রাগিয়ে ছিলাম,দেখলাম অভিমান হলে কি করো তুমি।কিন্তু তুমি তো চুপ করে গেলে।এটা করবে না আর কখনো….রাগ অভিমান যাইহোক সেটা ঝগড়া করে মিটিয়ে নেবে।”
“সেকি?তুমি চাও সব্বার মতো আমিও ঝগড়া করি তোমার সাথে?”
“অফকোর্স….তুমি আমি কি আলাদা?আমরাও আর পাঁচজনের মতো করেই ভালোবাসবো।ওই যাকে টিপিক্যাল ভালোবাসা বলে সেটাই।আর প্রোপস করার পর কি হয় জানোতো?”
প্রান্তিকের কথায় আহেলি অবাক হয়ে তাকাতেই প্রান্তিক ভ্রূ নাচিয়ে হাসলো।আহেলি ঠোঁট কামড়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিলেও আবার তাকালো প্রান্তিকের দিকে…..প্রান্তিক একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলো আহেলির ঠোঁটের দিকে।তারপর স্বাভাবিক নিয়মেই কমে এলো দুই ঠোঁটের ব্যবধান….মিলিত হলো প্রাকৃতিক নিয়মে।ক্যালারি বার্ন করার মোক্ষম উপায় হলো নাকি চুম্বন….এমনটাই শোনা যায়।তো এহেন প্রোপোসাল চুমুতে কতো ক্যালারি ঝড়লো কে জানে?!
প্রান্তিকের গাড়িটা আবারো এগিয়ে চলেছে এয়ারপোর্টের দিকে…..আহেলি প্রান্তিকের একটা হাত ধরে ওর কাঁধে মাথা রেখেছে।হয়তো আবার কয়েকমাসের দূরত্ব থাকবে ওদের দুজনের মাঝে তবে ও দূরত্ব এর পরই আরো কাছাকাছি আসবে দুজন।গাড়ির রেডিওতে আহেলির বাজানো একটা গান বেজে চলেছে লো ভলিউমে,,,,
Meri Rahein Tere Tak Hain,
Tujhpe Hi Toh Mera Haq Hai,
Ishq Mera Tu Beshaq Hai,
Tujhpe Hi Toh Mera Haq Hai,
Saath Chhodungi Naa,
Tere Pichhe Aaungi,
Chheen Lungi Ya Khuda Se Maang Laaungi,Tere Naal Taqdeeran Likhvaungi,
Main Teri Ban Jaungi,
Hm..Main Teri Ban Jaungi,
চলবে……
(আমি আগেও জানিয়েছি আজ আবারো বলছি….পেজে রিপোর্ট মারার জন্য পেজ বন্ধ ছিলো।পেজটা ঠিকঠাক করতে কিছুদিন লাগলো।
এরপর পেজে রিপোর্ট করলেও কোনো লাভ হবে না।
আশা করছি নিয়মিত গল্প পাবেন)