#বেখায়ালি_ভালোবাসা,
#পাট_৪
লেখিকা:#সাবেরা_সুলতানা_রসিদ
.
মেঘ অল্প কথা বলে ফোনটা কেটে দিয়ে ডাইনিংয়ে এসে দেখে সৈকত খেয়ে চলে গেছে। সৈকত কে না পেয়ে একটু মন খারাপ হয়ে যায় মেঘের । যে মানুষটার জন্য সে এতক্ষন না খেয়ে অপেক্ষা করেছিল আর সে একটুখানি সময় তার জন্য অপেক্ষা না করে নিজের মত নিজে খেয়ে চলে গেল!!
মনে মনে ভীষন রাগ হয় মেঘের ।
রাগটা সৈকতের উপর না। সৈকতের দেওয়া ওই সাইরেন নামক যন্ত্রটার উপর। ফোনটা আসার আর সময় পেল না।
দ্বীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে কি আর করা!!? কপালগুনে এমন হাড়বজ্জাত বর জুটেছে তা না হলে একটু হলেও বউয়ের কথা ভাবতো।
মেঘ চেয়ার টেনে বসেই খাবার নিতে গিয়ে দেখে সৈকত তার প্লেটের সব খাবার না খেয়ে কিছুটা রেখে গেছে।মেঘ ওর মায়ের মুখে শুনেছিল স্বামী-স্ত্রী একই প্লেট আর একই গ্লাসে পানি খেলে নাকি ভালবাসা বাড়ে। তাছাড়া আমাদের শেষ নবী ও তার ছোটবিবি আয়েশা সিদ্দীকা ওতো একই প্লেট আর একই গ্লাসে খেতেন।মা আয়েশা গ্লাসের যেখানে মুখ লাগিয়ে পানি পান করতেন আমাদের প্রিয় নবী ও ঠিক সেখানে তার ঠোঁট লাগিয়ে পানি পান করতেন।
এইভেবে মেঘ সৈকতের রেখে যাওয়া প্লেটের বাকি খাবার টুকু খায় আর ভাবে তার হাতের খাবার তো খেতে পারলাম না ,তবে তার হাতের স্পর্শের খাবার সে খাচ্ছে । পরম তৃপ্তি নিয়ে মেঘ খাবারটুকু খেয়ে নেয় ।
রাত থেকে এ পর্যন্ত না খেয়ে একটু বেশি ক্ষুধা অনুভব কিন্তু এই টুকু খাবার খেয়েই যেন মেঘের আর খাবার খেতে ইচ্ছা করেনা। মনে হচ্ছে এটুকুতেই তার পেট ভরে গেছে।
খাবার টা শেষ করে মেঘ রুমে চলে আসে।
দরজা খুলতেই খুক খুক করে কেশে ওঠে। কাশিটা এমনি নয় । মেঘ সিগারেটের ধোয়া সহ্য করতে পারে না।
সৈকত রুমের বেলকনিতে দাড়িয়ে সিগারেট টানছিল হঠাৎ মেঘের কাশি শুনে সিগারেট টা আস্তে করে ফেলে পা দিয়ে আগুনটা নিভিয়ে দেয় ।
মেঘ কাছে গিয়ে বলেঃ
— আপনি আর এ রুমের মধ্যে সিগারেট টানবেন না।
—রুমে না বেলকনিতে ।
—কিন্তু বাতাসে সব ধোয়া রুমে আসছে।
—তাতে তোমার কি??
—আমার কি মানে !!আমি সিগারেটের ধোয়া সহ্য করতে পারি না।
—সহ্য করতে পার না যখন আসছো কেন?আমি তোমাকে নিষেধ করেছি না এ রুমে আসতে। (বিরক্ত হয়ে)
—বললেই হলো না!?দরকার হলে আপনি অন্য রুমে যান আমি যাবো না।
—আমি কেন অন্য রুমে যাবো!!?এটা আমার রুম।
—এতদিন আপনার ছিল কিন্তু এখন থেকে এটা আমার ।
—উড়ে এসে জুড়ে বসা । এত বছর আমি এ রুমে আছি আর এখন বলছো এটা তোমার রুম!!
—উুহ অসহ্য!!
—কি?
—আপনি।
—তাহলে আছো কেন?
—কি করবো?
—চলে যাও।
—উপায় নেই।
—কেন?
—কবুল বলে ফেলেছি যে তাই।
—তাতে কি!!?তুমি চাইলে সেটা শুধরে নিতে পারো।
—মেঘ উৎসুক হয়ে বলে কি ভাবে?
—কবুল এর বিপরীত কথা টা বলে।
—মানে?
—মানে!?আচ্ছা থাক এসব ছাড়ো। আমাকে একটা কথা বলো।
—কি কথা?
—তোমার কোন লাভার আছে?আই মিন তোমার ভালবাসার মানুষ যাকে তুমি ভালবাসো??
মেঘের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায় সৈকতের এমন কথা শুনে।
—কি হলো বলো??
মেঘ সৈকতের চোখের দিকে তাকিয়ে শান্ত ভাবে বলেঃ
—না নেই।
—কি বলছো!!?এটাও আমাকে বিশ্বাস করতে হবে যে তোমার মত সুন্দরী একটা মেয়ের কোন বি এফ নেই বা ছিল না!!?
—হুম এটাই সত্য । কিন্তু হঠাৎ আপনি এমন প্রশ্ন কেন করলেন??
—এমনি।
—আপনি যে কোন কারণ ছাড়া কোন কথা বলেন না সেটা আমি বুঝে গেছি।
—হা হা হা।
—হেসে কথা ঘুরানোর চেষ্টা করবেন না।
—আমি কেন কথা ঘুরাবো?
—তাহলে বলুন কেন জিঙ্গাসা করলেন ?
—জানতে ইচ্ছে হল তাই।
মেঘ সৈকতের কাছে দু’পা এগিয়ে এসে বলে চোখের দিকে তাকিয়ে বলে আর কিছু জানতে ইচ্ছা হয় না??
সৈকত তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ মেঘের গভীর কালো চোখের দিকে । সৈকতের মনে হয় সৈকত যেন হারিয়ে যাচ্ছে গভীর কোন তলদেশে জড়িয়ে পড়ছে গভীর কোন মায়ায় ।
সৈকত তাড়াতাড়ি করে চোখ সরিয়ে বলে আর কি হচ্ছে হবে!!?আর কিছু জানার ইচ্ছা নেই।
মেঘ নিজেও হারিয়ে গিয়েছিল সৈকতের চোখের গভীরে । মানুষ মিথ্যা বলে কিন্তু মানুষের চোখের ভাষা কখনও মিথ্যা বলে না। মেঘ সৈকতের চোখে অনাবিল ভালবাসার সন্ধান পেয়েছে। দেখেছে সৈকতের চোখে ভালবাসার ছায়া কিন্তু ———-
হঠাৎ ঝিনুকের কন্ঠে মেঘ সব ভুলে যায়।
—দরজা খোলা আছে ভিতরে এসো।
মেঘ সৈকতের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে স্বাভাবিক হয় ।
সৈকত কিছু না বলে ঘুরে বেলকনির রেলিং ধরে দাড়িয়ে দূর আকাশ পানে তাকিয়ে থাকে।
—ভাবি ডিস্টার্ব করলাম??
—আরে না!!ডিস্টার্ব কেন হবো?
—না মানে এই সময় ।
—তাতে কি?বল কি বলবে?
—আসলে আমার কিছু ফ্রেন্ড এসেছে তোমাকে দেখতে সবাই অপেক্ষা করছে তাই তোমাকে ডাকতে এলাম।
—ছেলে ফ্রেন্ড না মেয়ে ফ্রেন্ড??
—কি যে বলো না ভাবি গালর্স কলেজে ছেলে ফ্রেন্ড আসবে কোথা থেকে?
—ওহ সরি। আসলে কিছু মনে করো না। আমি প্রশ্নেটা অন্য কারণে করেছি। তুমি যাও আমি দু মিনিটে আসছি।
—ওকে ভাবি।
ঝিনুক চলে যেতেই সৈকত আড়চোখে তাকিয়ে দেখে মেঘকে।
মেঘ নিজের শাড়ি টা ভাল করে গুছিয়ে নেয় । তারপর মাথায় শাড়ির সাথে ম্যাচ করে তার লাগেজ থেকে একটা হিজাব বের করে সেটা মাথায় পরে নেয় ।মেঘ এমনিতে খুব সুন্দরী কিন্তু হিজাবে পরে আগের থেকে আরোও বেশি কিউট আর সুন্দর দেখাচ্ছে।
মেঘ গুছিয়ে দরজা খুলে বের হতেই শাড়ির আচলে একটু টান খায় ।
মেঘের মুখ লজ্জায় লাল হয়ে যায় সৈকতের দুষ্টামি ভেবে।
মেঘ পিছন না ফিরে বলেঃ
—কি করছেন ছাড়ুন??
তবুও যখন ছাড়ছে না তখন পিছন ফিরে দেখে শাড়িটা দরজার হুকে বেধে আছে। আর সৈকত বেলকনিতে দাড়িয়ে ওর দিক তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে আর দু’হাত নাড়িয়ে ঘাড়টা এদিক ওদিক নাড়িয়ে বোঝাল যে সে একাজ করে নি।
মেঘ নিজের বোকামির কথা মনে করে আরো বেশি লজ্জা পেল।তাড়াতাড়ি শাড়িটা ছাড়িয়ে নীচে নেমে এলো।
ঝিনুকের ফ্রেন্ডসদের সাথে আড্ডা দিতে দিতে সন্ধ্যা হয়ে গেল তারা বিদায় নিয়ে চলে গেল ।
ততক্ষনে অফিস শেষ করে সবাই বাসায়
চলে এসেছে ।সারাদিন বাড়িটা যত নিরিবিলি থাকে সবাই বাসায় ফিরতেই বাসার পরিবেশটা অন্য রকম হয়ে যায় ।
সবাই এক সঙ্গে মিলে চা কফি খাওয়া গল্প ,হইহুল্লোড় করা। সবাই যখন হল রুমে বসে চা খাচ্ছে তখন মেঘ কিচেনে গিয়ে রোজির সাথে নাস্তা তৈরির কাজে হাত লাগায় রোজিকে সাহায্য করে ।
রোজি নাস্তার ট্রে টা সবার সামনে এনে রাখে
—এই নাও সবাই চিকেন পাকড়া খেয়ে বলো কেমন হয়েছে।
বড় ভাই,মেঝ ভাই ,ঝিনুক একসঙ্গে বলে চিকেন পাকড়া ওয়্যাও।
কে কয়টা খেতে পারে শুরু হয়ে গেল কাড়াকাড়ি। সবাই মুখে দিয়ে বললো উুহ যা টেস্টি হয়েছে না লা জবাব।
হঠাৎ চৌধুরী সাহেবের আগমন ঘটল।
সবাই বেশ অবাক হয়ে গেল কারণ সাধারনত উনি এত তাড়াতাড়ি বাসায় আসেন না । তার বাসায় ফিরতে দশটা না হয় এগারোটা বাজে।
এতক্ষন যে হইচইপূর্ণ পরিবেশ ছিল সেটা থেমে গেল সবাই চুপ চাপ খাচ্ছে কারো মুখে কোন কথা নেই। মেঘ বুঝতে পারল যে তার শ্বশুর আসায় সবাই এতোটা চুপ হয়ে গেছে।
মেঘ শ্বশুরের কাছে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিয়ে ভালমন্দ জিঙ্গাসা করে হাত থেকে কোট টা নিয়ে তাকে বসতে বললো।
চৌধুরী সাহেব সবার সঙ্গে হলে রুমে বসলেন । মেঘ চা করে এনে সঙ্গে কিছু পাকড়া ও দিল। চৌধুরী কোন কথা না বলে খেতে শুরু করলেন। এতে সবাই আরো বেশি অবাক হল। কারণ উনি এসব ভাজাপোড়া পচ্ছন্দ করেন না আর সবচেয়ে বড় কথা উনি নেতা হবার পর থেকে কখনও এভাবে নিজের পরিবারের সঙ্গে বসে সন্ধ্যায় এত তাড়াতাড়ি ফিরে এক সঙ্গে নাস্তা করেন নি।
সবার মুখে বিস্ময়ের ছাপ। কিন্তু কেউ সেটা মুখ ফুটে বলতে পারছে না।
উনি পাকড়া গুলো সব শেষ করে বললেন নিশ্চয় মেঘ মা বানিয়েছে?
রোজি হাসি মুখে এগিয়ে এসে বললো হ্যা বাবা মেঘ নিজের হাতে সব করেছে।
চৌধুরী সাহেব বললঃ
—আজ অনেক বছর পর সেই স্বাদ আবার মুখে পেলাম। তোমার শ্বাশুড়ী মা যখন বেচে ছিল তখন প্রায় সে এটা বানাতো তারপর আর খাওয়া হয়নি। এত বছরে ভুলতে বসে ছিলাম সেই স্বাদটা কিন্তু আজ তোমার হাতের টা খেয়ে সেই স্বাদ ফিরে পেলাম।
মেঘ বুঝলো তার শ্বশুরের অতীতের স্মৃতি মনে পড়েছে।তাই তার গলাটা ভারী হয়ে গেছে। হয়তো চোখটা ছলছল করছে।
মেঘ বুঝলো আসলে সবাই যে এই মানুষ টাকে এত ভয় পায় হয়তো সেটা তার এই বাহ্যিক আচারন আর মুখের গাম্ভীর্য দেখে । কিন্তু তার মনটা এখনও সেই বাচ্চাদের মতই আছে। হয়তো বড় নেতা হয়েছেন বলেই নিজের মনের ভাব নিজের আবেগ ,ভালবাসা কাউকে বুঝাতে পারেন না বা বুঝানোর চেষ্টা করেন না । লোকে শুনলে কি বলবে কি ভাববে হয়তো এই জন্য!!
—কি ভাবছো মা??
শ্বশেরের কথায় মেঘের ঘোর টা কেটে যায়।
—না ,বাবা তেমন কিছু না।
—এতো ভাল করে পাকড়া করে খাওয়ালে এখন বল আমার কাছে তোমার কি চাই।
মেঘ তার শ্বশুরের কাছে এসে বলে আমার কিচ্ছু চাইনা বাবা শুধু তোমার এ মেয়েটার জন্য দোয়া কর ।
চৌধুরী মেঘের মাথায় হাত রেখে বলে আমার দোয়া সবসময় তোমার সাথে থাকবে ।
মেঘ যেন নিজের বাবার হাতের ছোয়া খুজে পায় । নিজের বাবা মা আর ভাইয়াকে খুব মিস করতে শুরু করে ।
রোজি এসে মেঘের কাধে হাত রেখে বলেঃ
—কি রে বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে তাই না??
—হুম।
চৌধুরী সাহেব বলে সৈকত কোথায় ?
মেঘ মাথা নিচু করে বলে ও ঘরেই আছে।
হঠাৎ না ভাবি ভাইয়া তো একটু আগে বেরিয়েছে ।
—কখন?
—তুমি তখন কিচেনে ছিলে।
—ও
মেঘের মন কিছুটা খারাপ হয়ে যায় । ভেবেছিল নিজের হাতের বানানো চিকেন পাকড়া আর চা দিয়ে আসবে উপরে কিন্তু তা আর হলো না।
চৌধুরী সাহেব উঠে মেঘের কাছে এসে বলে মেয়ের বাবারা তার মেয়েকে জামাইয়ের হাতে হাত দিয়ে বলে তার মেয়েটাকে দেখে রাখার জন্য । আর আমি আজ তোকে বলছি আমার খামখেয়ালি আর বদমেজাজি ছেলেটাকে তুই যে করেই হোক একটু মানুষের মত মানুষ বানিয়ে দে।বলে চোখ মুছে উনি নিজের রুমে চলে যায়।
বাসার পরিবেশটা মুহূর্তে যেন কেমন ভারী হয়ে ওঠে।
হঠাৎ করে সৈকত বাসায় ঢোকে । সৈকতের আগে আগে একটা কুকুর দৌড়ে ঘরে ঢোকে ঘেউ ঘেউ শুরু করে দেয় ।
কুকুর টা ঘেউ ঘেউ করতে করতে মেঘের দিকে ছুটে আসতেই মেঘ ভয়ে চোখ বন্ধ করে চিৎকার দিয়ে ওঠে।
সবাই হো হো হেসে ওঠে। হাসির শব্দে কোনরকম একচোখ খুলে তাকিয়ে দেখে
ওর থেকে এক হাত দূরে কুকুরটা এসে থেমে গেছে। সৈকতের হাতে ওর গলার দড়ি টা ধরা।
মেঘ লাফ দিয়ে পিছনে সরে বলেঃ
—এ কুকুর এখানে কেন??
(সবাই পাশ থেকে আস্তে আস্তে বলে এইবার শুরু হবে)।
সৈকত কটমট চোখে মেঘের দিকে এগিয়ে আসে————-
(চলবে….)