নাটাই ঘুড়ি পর্ব-৪

0
1206

#নাটাই_ঘুড়ি
।।৪।।
ফুলি কাগজ কলম নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। মীরার দার্শনিক ভাবনায় ছেদ পড়ল।
“কী কী রানব মামা?”
“তুই রানবি কেন? তোর রান্না তো প্রতিদিনই খাচ্ছি! রান্নার দলে তুই থাকবি না। তুই বাদ।”
ফুলি আকাশ থেকে পড়ল। “আফনেরার কাডাকাডি, বাডাবাডি করনের লোক লাগত না?’
“তাও তো কথা। পয়েন্ট এক্সেপ্টেড। আমরা রাঁধব খিচুড়ি, মুরগির মাংস আর ডিম ভুনা।“
ফুলি আনন্দিত গলায় বলল, “মামা, ডাইল দিয়ে মুরগির লটপটি রাখেন। একটা আইটেম বাড়ল।“
চাচা গম্ভীর মুখে বলল, “এই কথাটা তো তুই খারাপ বলিস নাই। যাক, রান্নার দলে তোকে নেওয়া গেল।“
চাচা পুরিতে কামড় বসিয়ে বলল, “আমি বলছি মীরা, তুই লেখ।“
বাম হাতে পুরি খেতে খেতে ছোট চাচার ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী ডান হাতে লিখতে শুরু করল মীরা। যে জিনিসটা দাঁড়াল সেটা এরকমঃ
প্রোজেক্টঃ ছাদ ভোজন
পরিকল্পনাঃ ইমরুল হাসান
সহযোগিতাঃ মিরানা আফরোজ
প্রস্তাবিত আইটেমঃ
খিচুড়ি
ডিম ভুনা
মুরগির মাংস ভুনা
মুরগির লটপটি
সালাদ
স্প্রাইট
কোকা কোলা
এই পর্যন্ত লিখে মীরা নিজেই যোগ করে দিল, পায়েস।
চাচা বলল, “বাজেট তো বাড়িয়ে দিচ্ছিস খালি। ফাণ্ড জোগাড় করতে পারবি?”
এই পর্যায়ে চাচার পকেটে মোবাইল ফোন বেজে উঠল। চাচা ফুলিকে হাত ইশারা দিয়ে চলে যেতে বলল।
ফুলি বেজার মুখে নিচে নেমে গেল। চাচা ফোন ধরে ওপাশে সরে গেল।
গলা নামিয়ে বলল, “তিথিমণি আমি এখন একটু ব্যস্ত আছি।“
মীরা কান খাড়া করে শুনছে। অন্যের প্রেমালাপ শোনায় মজা আছে।
ওপাশ থেকে কী বলছে শোনা যাচ্ছে না, তবে চাচার উত্তর শুনে মোটামুটি অনুমান করে নেওয়া যাচ্ছে।
“আমাদের ছাদে পিকনিক হবে তো। সেটার লিস্ট করছি।“
…………………………………………………………………………………
“এই তো, খিচুড়ি, ডিম ভুনা, মুরগির মাংস, লটপটি আর পায়েস।“
………………………………………………………………………………………
“আমাদের বাসায়? দাঁড়াও গুণে বলি। আমাদের বাসায় এগারো জন মানুষ। মোটামুটি পনের জনের আয়োজন করতে চাচ্ছি। যদি কোনো গেস্ট চলে আসে!”
………………………………………………………………………………………………
ওপাশ থেকে কী কী যেন বলে ফোন রেখে দিল। ছোট চাচা ফিরে এল বিমর্ষ মুখে।
মীরা বলল, “কী হয়েছে?”
“তিথিকে দেখতে আসবে। ও বলল, ওদের বাসাতেও আজকে পনেরজনের জন্য রান্না হচ্ছে। ও নাকি ওদের বাসার লিস্টটাই মেসেজ করে দিচ্ছে।“
টুং করে শব্দ হলো। চাচা মেসেঞ্জার খুলে দেখল বাজারের লিস্টের ছবি।
ওপাশ থেকে মেসেজ টাইপ হচ্ছে। প্রবল আগ্রহে ফোনের ওপর ঝুঁকে পড়ল মীরা।
মেসেজ এল, ‘তুমি একটা গুড ফর নাথিং।“
চাচা ফোন সরিয়ে নিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, ‘মীরা, তুই আমার সামনে থেকে যা।“
মীরা বলল, “লিস্টের ছবিটা আমাকে ফরওয়ার্ড করে দাও।“
চাচা চোখ গরম করে আমার দিকে তাকাল। মীরা তার অগ্নিদৃষ্টি উপেক্ষা করে বলল, “তোমার তিথিমণি কিন্তু কথাটা খুব একটা ভুল বলেনি। যদি সত্যি সত্যি পিকনিক করতে চাও, তাহলে ছবিটা আমাকে ফরওয়ার্ড করে দাও। তোমার কাছে থাকলে কাজ হবে না।“
“তুই ফাণ্ড ম্যানেজ করতে পারবি?”
“সেটা আমি বুঝব।“
চাচা ছবিটা মীরার হোয়াটস এপে মেসেজ করে দিল। মীরা বলল, “তিথিমণি কি বেশি চাপে আছে নাকি?”
“বড়দের সব কথায় আসবি না তো!”
মীরা উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “এক কাজ কর, বিকালে ওদের বাসায় চলে যাও। বাসার সামনে গিয়ে হাঁটাহাঁটি কর। বিয়ে এমনিতেই ভেঙে যাবে।“
“বিকেলে তো আমার টিউশ্যনি আছে।“
“একদিন বাদ দিলে কী আর হবে!”
“স্টুডেন্টের পরীক্ষা, ফোন করে হইচই করবে।“
“ও আচ্ছা। তাহলে কী আর করা। আমি যাই, গিয়ে পিকনিকের জোগাড় যন্ত্র দেখি। তারিখ কি আগামী শুক্রবার ফেলব?”
“সেটাই ভালো হবে। বেশি দেরি হয়ে গেলে আবার বাসার ঝামেলাটা জানাজানি হয়ে যেতে পারে। তখন আর আমাদের পিকনিক করতে দেবে না।“
“এটা ঠিকই বলেছ। আমি গিয়ে দেখি কী করা যায়।“
ছোট চাচাকে এইজন্যই এত ভালো লাগে মীরার। সমস্যার মধ্যে ডুবে থেকেও কীভাবে রিল্যাক্স থাকা যায় সেটা যে কেউ তার কাছ থেকে শিখতে পারে।
নিচে নেমে এক কাপ লেবু চা বানিয়ে নিয়ে দাদার ঘরে গেল মীরা। মীরার দাদা শেখ আলিমুল হাসান, বয়স পৌনে একশ বছর ছুঁই ছুঁই করছে।
এই বয়সেও তিনি বেশ ফিট আছেন। ডায়াবেটিস আর ব্লাড প্রেশারের সামান্য সমস্যা ছাড়া তেমন কোনো সমস্যা নেই।
বড় রাস্তার ওপরে একটা ডায়াগনোস্টিক সেন্টার আছে, নাম পাটোয়ারি ডায়াগনোস্টিক এণ্ড ডক্টরস চেম্বার। সেখানে নতুন পাস করা এক ছোকরা ডাক্তার বসে।
তার সাথে মাসকাবারি বন্দোবস্ত করা আছে। এক দিন পর পর সকালে এসে সে প্রেশার আর ডায়াবেটিস চেক করে দিয়ে যায়।
দুটোই মোটামুটি কন্ট্রোলে আছে। শেয়ার মার্কেটে লস খাওয়ার পর বাড়িতে দাদার দাপট কিছুটা কমলেও এখনো টাকা পয়সা সব তাঁর নিয়ন্ত্রণেই থাকে।
তাঁর ফাণ্ডিং ছাড়া কোনো পিকনিক করা সম্ভব না। মীরা দাদার সামনে চায়ের কাপ ধরে আদুরে গলায় বলল, “দাদা দেখো তো চা কেমন হয়েছে।“
দাদা চা নিয়ে বললেন, “কী মতলবে এসেছিস বলে ফেল।“
“আমার আবার মতলব কী? আমি কি এমনি এমনি আসতে পারি না?”
“এমনি এমনি আসবি তুই? আমার চুলগুলো বাতাসে পাকে নাই।“
“দাদাজান, আমার পাঁচ হাজার টাকা লাগবে।“
“কী করবি এত টাকা দিয়ে?”
“আমাদের এক স্যারের খোঁজ পেয়েছি, উনার সাজেশন থেকে বোর্ড পরীক্ষায় খুব কমন পড়ে। সেই সাজেশন কিনব।“
“এত টাকা দিয়ে সাজেশন কেনার কোনো দরকার নাই।“
মীরা মুখ কাঁদো কাঁদো করে ফেলল। তাতে দাদার কোনো ভাবান্তর হলো না।
পাশ থেকে মীরার দাদি জাহান বেগম বললেন, “এমন করেন কেন আপনি?”
“তুমি চুপ কর। যা বোঝো না তা নিয়ে কথা বলতে এসো না।“
দাদা চায়ের খালি কাপ এগিয়ে দিলেন। মীরা খালি কাপ নিয়ে করুণ মুখে চলে আসছিল।
দাদি ধমক দিয়ে বললেন, “দাঁড়া! নাজমুলের আব্বা, বিয়ের সময় তো আমাকে ভালো কিছু দেন নাই। শুধু একটা মালা শাড়ি দিয়ে দায় সারছেন!”
দাদা বিরক্ত হয়ে বললেন, “আর কি যন্ত্রণা! এখন বিয়ের শাড়ির কথা আসলো কী জন্যে?”
“আমার নাতিন মুখ কালো করে আমার সামনে থেকে যাবে এইটা আমি হতে দিব না। আপনার টাকা থেকে না দেন, আমার টাকা থেকে দেন!“
দাদা গজগজ করতে করতে চাবি দিয়ে আলমারির ড্রয়ার খুলে টাকা বের করে দিয়ে বললেন, “যা, ভালো মত পড়িস।“
মীরা টাকা হাতে নিয়ে নিচু হয়ে দাদা দাদির পা ছুঁয়ে সালাম করে ফেলল। দাদির মুখে খুশির আভা ঝলক দিয়ে গেল।
দাদি বয়সে দাদার দশ বছরের ছোট হলেও বেশ বুড়িয়ে গেছেন। উনাকেই বেশি বয়স্ক মনে হয়।
মীরা দাদার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে গেল। ছোট চাচার পাঠানো ছবিটা শিহাব ভাইয়ার হোয়াটস এপে পাঠিয়ে দিয়ে ফোন করল তাকে।
“হ্যালো ভাইয়া, আসসালামু আলাইকুম!”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম, কী খবর মীরু?”
শিহাব ভাইয়া ছোটবেলা থেকেই মীরাকে মীরু বলে ডাকে। আচমকা মীরার কী হলো কে জানে, একটু দুষ্টুমি করতে ইচ্ছে হলো।
“আপনাকে লিস্ট পাঠিয়েছি হোয়াটস এপে, দেখেছেন?”
“হ্যাঁ, কী করব এগুলো, পাঠিয়ে দেব?”
“না এখন না, আগামী শুক্রবার সকালে পাঠাবেন। শুক্রবার নীরা আপুকে দেখতে আসবে তো, এইজন্য।“
“নীরাকে? এখনই? এত তাড়াতাড়ি? ও তো মাত্রই ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে!”
“হ্যাঁ, ভালো প্রস্তাব আসলো, এইজন্য চাচা চাচি আর দেরি করতে চাচ্ছে না!”
শিহাব ভাই নিষ্প্রাণ গলায় বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে পাঠিয়ে দেব।“
“শোনেন ভালো জিনিস দিয়েন কিন্তু। বুঝতেই পারছেন বরপক্ষের সামনে প্রেস্টিজের ব্যাপার!”
“আচ্ছা ঠিক আছে।“
ফোন রেখে দিল শিহাব ভাইয়া। মীরার এখন একটু একটু খারাপ লাগতে শুরু করেছে।
একদিনে এতগুলো মিথ্যা কথা বলে ফেলল। বাম কাঁধের ফেরেশতা তো খাতা ভরে লিখে কুল পাচ্ছে না।
এখন একটু ডান কাঁধের ফেরেশতাকে সুযোগ দেওয়া উচিত। সকাল এগারটা বেজে গেছে প্রায়।
মীরা ভালোমানুষের মত মুখ করে পড়তে বসল। দাদার কাছ থেকে সাজেশন কেনার জন্য টাকা নিয়েছে। এখন একটু পড়াশোনা না করলে ভালো দেখাচ্ছে না।
(আগামী পর্ব রবিবার সন্ধ্যায় ইন শা আল্লাহ্‌)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here