স্মৃতির দেয়াল🍁
#পর্ব_২৬
Writer -Afnan Lara
.
নীল মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে গেছে,আর কিছু বলবে না
বললেও মুন বুঝতে চাইবে না
ফোন বাজছে অনবরত,হিয়ার কল
নীল রিসিভ করেনি দুবার হলো,তাও হিয়া কল করেই যাচ্ছে
মুন বারান্দায় চেয়ার নিয়ে বসে বাহিরের দিকে মাথাটা তাক করে রেখে চেয়ে আছে,যদিও অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না তাও সে তাকিয়ে আছে অন্তত নীলের দিকে তাকানোর চেয়ে ভালো
.
হিয়ার তৃতীয় বার করা কলটা নীল রিসিভ করলো,কিন্তু হিয়াকে কিছু বলতে দিলো না,রিসিভ করেই বললো”আমি ব্যস্ত”
কেটে দিলো লাইনটা নীল,,ফোন পাশে রেখে পিছনে তাকালো মুনের দিকে
মুনের মন খারাপ তার মনটাকে আরও ভেঙ্গে দিচ্ছে
হয়ত ভয় পেলে মুন আবেগী হয়ে যেতো কিন্তু ভয় পায়নি বলেই ওর জেদটা বেড়ে আছে
আমার এখন কি করা উচিত?ক্ষমা চাইলাম তা তো করলো না
কি করে রাগ ভাঙ্গাই?হিয়া রাগ করলে তো ওকে জড়িয়ে ধরলেই রাগ পানি হয়ে যেতো ওর কিন্তু মুনকেও তো ধরেছিলাম ওর তো রাগ গেলো না,তাহলে কি করলে মুনের রাগ ভাঙ্গবে?
.
মুন চেয়ার থেকে উঠতেই নীলের সাথে ধাক্কা খেয়ে গেলো
নীল এতক্ষণ এখানেই দাঁড়িয়ে ভাবছিলো মুনের রাগটা কমানোর বিষয় নিয়ে
মুন দূরে সরে গিয়ে বললো”কিছু বলবেন?”
.
চলো কিছু খাবে
.
না খেলে?এখন আবারও অন্ধকার রুমে বন্দি করে চলে যাবেন?
.
না
.
তাহলে কি করবেন,আজকেই ডিভোর্স দিয়ে দিবেন?প্লিস দিয়ে ফেলুন,আমাকে মুক্তি দিন,আমি আর পারবো না সইতে
.
কথাটা বলে মুন বিছানায় এসে বসলো,নীল দরজা খুলে চলে গেছে সেসময়ে
হোটেলটার সামনে খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সে এখন
উর্মি ভাবী আর পপি ভাবী মিলে একটু হাঁটতে বেরিয়েছিলেন,নীলকে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তারা এগিয়ে আসলেন,নীলের মুখে বিষন্নতার ছাপ দেখে তাদের আর বুঝতে বাকি নেই যে মুনের সাথে কিছু একটা হয়েছে ওর
.
নীল উর্মি ভাবীকে দেখে চোখ মুছে নিজের আওয়াজটাকে ঠিক করে বললো”তোমরা এসময়ে?”
.
কারেন্ট নেই বলে একটু হাঁটতে বের হলাম,তা তুমি এখানে কি করো তাও মুনকে একা রেখে,ওকে নিয়ে আসতে
.
না আসলে…..
.
আবার ঝগড়া হয়েছে বুঝি?
.
নীল উর্মি ভাবীর দিকে তাকিয়ে বললো”ভাবী আমি বুঝতেছি না মুন বারবার আমাকে ভুল কেন বুঝে,আর আমিও ওকে ঠিক বুঝতে পারি না,কি করে ওকে আমি ভালো রাখবো তাই ভেবে পাই না,আর ও সবসময় কথার মাঝে হিয়াকে টেনে আনে,এখানে আসার পর থেকে আমি হিয়ার সাথে কথাই বলিনি,মাত্র কল করেছিলো আমি ব্যস্ত আছি বলে কেটে দিয়েছিলাম,মুন কেন বোঝে না আমাকে
.
সামান্য একটা আননউন নাম্বারের সাথে কথা বললেও স্ত্রীর খারাপ লাগে আর সেখানে কিনা তুমি তোমার প্রাক্তনের সাথে কথা বলো,ওর চিন্তায় মগ্ন থাকো এটা মুন কি করে সইবে?
.
আমার কি করা উচিত?
.
এটা নাহয় মুনকেই জিজ্ঞেস করো
.
নীল মুখটা ছোট করে চলে গেলো রুমের দিকে,মুন খাবারের দিকে তাকিয়ে মুখটা ফুলিয়ে রেখেছে,পেটে খিধা অনেক
সাথে মাথা ও ঘুরছে,গোটা দিন সে কিছু খায়নি,নীলের উপর রাগ ও উঠে আছে
মোমবাতিটা ও শেষ হতে চললো
নীল সবে রুমে ঢুকছে,হাতে একটা মোমবাতি,বেশ মোটাসোটা দেখতে
দরজা লাগাতে লাগাতে সে বললো”আজ রাতে নাকি কারেন্ট আসবে না”
মোমবাতিটা একপাশে রেখে খাবারের প্লেট নিয়ে সে মুনের পাশে এসে বসলো,চামচ দিয়ে এক চামচ ভাত তুলে ধরলো মুনের দিকে
মুন মুখটা আরেকদিকে ফিরিয়ে নিয়ে বললো”খাব না মানে খাব না”
.
নীল মুখ ফুটে “প্লিস” বললো,বলার সাথে সাথে ওর দুচোখ বেয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো নিচে
মুন সেটা দেখে স্তব্ধ হয়ে গেছে,এরকম করে খেতে বললে যে কেউ গলে যাবে
এই ছেলেটা এমন কাঁদছে কেন,এসময়ে আমার জায়গায় হিয়া হলে জামাই ফেলে আজকেই বাসর রাত করে ফেলতো এর সাথে,এরকম কিউট ফেসে চোখের পানি বেয়ে পড়লে যে কেউ ক্রাশিত হয়ে উদ্ভাসিত হয়ে যাবে
কিন্তু নাহ!!!মুন তোকে স্ট্রং হতে হবে
.
কি হলো খাবে না?আই এম সরি মুন,আর কখনও এমন হবে না,ট্রাস্ট মি
.
মুন খাবারের লোভ আর সামলাতে পারছে না
চুপচাপ নীলের হাতের চামচ থেকে খাবারটা গিলে ফেললো সে
নীল খুশি হয়ে আরেক চামচ রেডি করে বললো”থ্যাংকস,মাফ করে দেওয়ার জন্য”
.
মাফ করি নাই,বাসায় ফিরে ডিভোর্স দিয়ে দিবেন,আমার দ্বারা আর কোনো কিছু সহ্য করা সম্ভব হবে না
.
নীল মুখটা আবারও ফ্যাকাসে করে মুনকে আরেক চামচ খাইয়ে দিয়ে বললো”আমার স্ত্রী হয়ে থাকো”
.
কেন?আপনার আর হিয়ার লীলা দেখতে?
.
আর দেখাবো না
.
এটা আরও আগেও বলেছিলেন,যেই লাউ সেই কদু হয়ে যায় শেষে
.
এসব বাদ দাও,চুপচাপ খাও,তারপর গল্প করবো
.
হিয়াকে নিয়ে?
.
নাহ,তোমাকে নিয়ে
.
নীল নিজের হাতে খুব যত্ন সহকারে মুনকে খাবার খাইয়ে দিলো তারপর বালিশ কোলে নিয়ে মুনের সামনে বরাবর বসে বললো মুনের ছোটবেলা থেকে সবটা বলতে,তারপর নীল নিজেরটা বলবে
মুনের বোরিং লাগছিলো তার উপর নীল নিজ থেকে কথা বলতে চায় তো আর মানা করে কি লাভ,
বোরিং হওয়ার চেয়ে বকবক করা ভালো
মুন শুরু করলো তার যতো কথা
ছোটবেলা থেকেই সৎ মায়ের আদরে সে বড় হয়েছে
রুশা মুনের থেকে ২/৩বছরের ছোট হবে,পিঠাপিঠি ছিলো তারা দুজন
রুশা মুনকে নিজের বোন মনে করে আর মুন ও তাই
তবে সেলিনা তফাৎটা ঠিকই করতেন,আর সেটা হলো কখনও চকলেট দুটোর জায়গায় তিনটে আসলে,তিনি একটা মুনকে দিতেন আর দুটো রুশাকে
মুনের সামনে রুশাকে একটা দিতেন,পরে লুকিয়ে রুশাকে বাকিটা খাইয়ে দিতেন
মুন কিন্তু দেখতো এসব,তাও না দেখার ভান করে থাকতো
তার জ্বর হলে তা এমনি এমনি সারতো,হয়তবা বেশি জ্বরে দাদি এসে দেখতেন
সেলিনা কখনও এসবে নাক গলাতেন না,নিজের হাতে গোটা সংসার সামলাতেন তিনি এটাই অনেক মনে করতেন
বাবার তদারকিতে মুনের পড়ালেখাটা বহাল ছিলো এটা ভেবে মুন নিজেকে ধন্য মনে করতো সবসময়
প্রয়োজনে যা দরকার তার সব কিছু মুন পেতো না
যেমন প্রতি বছর ঈদে জামা হওয়া চাই এমন কথা বলা সাজতো না মুনের
অথচ বাবার টাকার অভাব ছিলো না,তার পরেও সে জামা পেতো না কেন তাই মাথায় ঢুকতো না
তবে রুশাকে নতুন জামা দেওয়া হতো, এক ঈদ ও মিস যেতো না
রুশা ছোট মানুষ তো,জামা না পেলে কাঁদবে তাই
সেলিনা নিজের হিসেবে মুনকে কখনও দেখেইনি,আবার মাঝে মাঝে এমন বিহেভ করত যেন তার আসল মেয়ে
মুন ভাবতো তার এমন আলগা ভালোবাসা চাই না
তার জীবনে এমন কেউ আসুক যে তাকে আলগা নয় পুরোটাই ভালোবাসবে
কিন্তু হয়ত আমার ভাগ্য আলগা ভালোবাসাই আছে
ছোট থেকেই,আমার জন্য রাখা ভালোবাসা -কেয়ার রুশা পেতো আর আমি পেতাম তার ছিঁটেফোটা
আর এখন আমার ভালোবাসা হিয়া পাচ্ছে,পেয়েও গেলো
আর আমি তার সুবাস!কি কো ইন্সিডেন্স তাই না?
.
নীল ছলছল চেখে মুনের দিকে তাকিয়ে আছে
.
মুন বিষয়টাকে হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললো”এবার আপনার কথা বলুন,আমার তো সবটাই জানেন”
.
আমার আর কি,এত বড় পরিবারে জন্ম নিয়েও কেনো কিছুর কমতি হয়নি কখনও,সব ভাইয়েরা সেম টু সেম অধিকার পেয়ে এসেছি
মা আমাদের সবাইকে ঠিক একই ভাবে ভালেবাসতেন,আমার কোনো কিছুর কমতি হয়নি আজ পর্যন্ত
.
শুধু যাকে ভালোবাসলেন তাকে পেলেন না,তাকে পেলে জীবনটা সার্থক হতো তাই না?
.
হুম,পুরোটাই সার্থক হতো,কিন্তু মানুষ তো তার জীবনে সবটা পায় না,আমিও তাই
.
চেয়েছিলাম হিরা,পেয়ে গেলেন এমিটেশন
.
তুমি এমিটেশন না,তুমি অনেক দামি
.
তাই তো এত এত অবহেলা করছেন,অবশ্য অনাথদের সবাই অবহেলা করে,কারণ তারা প্রতিবাদ করে না,তাদের প্রতিবাদ করার ক্ষমতা নেই,আপন বলতে কেউ নেই
আজ আমার নিজের মা থাকলে হয়ত আমাকে এত কষ্টে থাকতে হতো না,বাবার ও এমন রুপ দেখতে হতো না
.
আর কখনও তোমাকে বিন্দুমাত্র অবহেলা পেতে হবে না তাহা,আই প্রমিস
.
আপনি?আপনি বাসবেন আমাকে?গলা কেটে বললেও বিশ্বাস করবো না
.
বাসলেই সব পূর্ণ হয়ে যাবে তাহা?
.
তাহলে আর কি?একজন স্ত্রী তার স্বামী থেকে শুধু কেয়ারই আশা করে?
.
তুমি কি আশা করো?
.
মুন মনে মনে বললো”আমি তো গোটা তোরেই আশা করি
ঐ হিয়ার চক্করে বিয়ের এতদিনে সবে তুই আমাকে জড়িয়ে ধরেছিস,কিস করতে তো মনে হয় বছর পেরিয়ে যাবে”
.
কি হলো কিছু বলছো না যে?
.
কিছু না,,আপনাকে আর কি বলবো,আপনার তো মনে প্রানে শুধু হিয়া,আমি কিছু চাইলে কি আর দিবেন
.
কেন দিব না,বলো
.
মুন ব্রু কুঁচকে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো”কিস চাই,কাড়ি কাড়ি বাচ্চা চাই,দিবেন?এমন ভাবে বলছেন যেন আমাকে আজই সব দিয়ে দিবেন,কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলে তৈরি হয়ে জিজ্ঞেস করতে হয় বুঝলেন,”
.
তোমাকে তো আমি বিয়ের পরেই বলে দিয়েছি এসব আশা করবে না
.
আপনি সরুন তো,আমি ঘুমাবো,আপনি গিয়ে ডিভানে শোন,একদম আমার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করবেন না
যেদিন মাথা থেকে হিয়ার ভূত নামাতে পারবেন সেদিন আসবেন জিজ্ঞেস করতে,মুন তোমার কি চাই,এখন যান,সরেন,মেজাজ আর গরম করবেন না
আমি এখন ভাত ঘুম দেবো
.
মুন কাঁথা টান মেরে শুয়ে পড়লো
নীল মূর্তি হয়ে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে,তারপর বালিশ নিয়ে ডিভানে এসে বসলো সে,মুন ঘুমিয়েও পড়েছে
নীলের চোখে ঘুম নেই,সোফায় শোয়ার অভ্যাস নেই ওর
.
মুন মাঝরাতে জেগে গিয়ে দেখলো নীল ডিভানে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে,মানে এখনও ঘুমায়নি
উফ বুঝি না আমি এই লোকটা যখন আমাকে কষ্ট দেয় তখন তো তার এত খারাপ লাগে না,তাহলে আমি তাকে কষ্ট দিতে গেলে আমার এত কষ্ট লাগে কেন
এই যে শুনেন!!
.
মুন বিছানা থেকে নেমে নীলকে কয়েকবার ডাকলো,এপাশ ওপাশ করছে মানে ঘুমের মাঝেই,জেগে নেই সে
মুন নীলের কাঁধে হাত রাখতেই নীল জেগে গেলো,উঠে বসে বললো” কি হয়েছে”
.
আসুন,বিছামায় এসে ঘুমান,আপনাকে শাস্তি দেওয়া আমার কাম্য নয়
.
নীল সত্যি সত্যি বিছানায় চলে আসলো,শুয়ে ও পড়েছে
মুন বালিশটা নিয়ে চলে যাওয়া ধরতেই নীল ওর হাত ধরে আটকিয়ে বললো”যেও না”
.
আপনি বলেছিলেন আমার সাথে একই বিছানায় আর শুবেন না,বেশি অধিকার দিয়ে ফেলেছিলেন
.
সরি অনেকবার বলেছি,এবারও না শুনলে পুলিশ হয়ে ঘাঁড় ত্যাড়া কাউকে ঠিক করার কৌশলটা প্রয়োগ করতে পারি
.
মুন কোমড়ে হাত দিয়ে বললো”কেন?কি করবেন?”
.
নীল মুনকে হ্যাচকা টান দিয়ে বিছানায় নিয়ে এনে বললো”আমার সাথে একই বিছানায় শুতে বাধ্য করবো,যেমন ধরো ডিভানে পানি ঢেলে দিব
.
আমি ফ্লোরে ঘুমাবো তাহলে
.
ফ্লোরেও পানি ঢেলে দিব
.
তাহলে এ পানিতেই ঘুমাবো,তাও আপনার সাথে ঘুমাবো না
.
নীল দুহাত বাড়িয়ে মুনের মুখটা ধরে বললো”প্লিস তাহা,আমাকে বুঝো”
.
মুন ব্রু কুঁচকে গালের থেকে নীলের হাত সরিয়ে বললো”কি বুঝতাম?আমি আপনার সাথে শুলে আপনার তাতে কি লাভ?”
.
তোমাকে আরামে দেখলে তো আমার দায়িত্ব পালন করা হবে
.
ঢং!যাই হোক,চোখে ঘুম আমার অনেক,তাইই আর ঝগড়া বাড়াচ্ছি না,গুড নাইট
.
মুন দুম করে আরেকদিকে ফিরে শুয়ে পড়লো
নীল মুচকি হেসে মনে মনে ভাবলো”যার রাগ এত কম তাকে কিনা আমি এত দীর্ঘস্থায়ী কষ্ট দিলাম,আমাকে মাফ করা যায় না আসলেই”
চলবে♥