প্রিয় দিও বিরহ ” পর্ব-৭

0
1094

”প্রিয় দিও বিরহ ”

৭.

পদতলের ভূমিতে কম্পন হচ্ছে মেহতিশার। চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে আচমকা আক্রমণে। সাদা শাড়ির এলোমেলো মহিলাটির মাঝে যেনো অসুরের শক্তি ভর করেছে। দুই হাত দিয়ে মেহতিশার কোমল গলা চেপে ধরেছেন। মেহতিশার দম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চোখে অশ্রু ভীড়েছে। বাকী সবাই হতভম্ব হয়ে গেলেও, দ্রুত লালিমা শেখ ছুটে এলেন। মেহতিশার গলা থেকে হাত ছাড়াতে ছাড়াতে বললেন,

‘নিশিতা, ছাড়ো বলছি! মেহতিশা এই বাড়ির বউ। ‘

মেয়েটার হাত হাল্কা হয়ে আসলো। চোখ দু’টো করুণ টলমলে হয়ে আছে। মেয়েটা কাঁপছে। মেহতিশার থেকে দুই হাত পিছিয়ে গেলো। মেহতিশা বুকে হাত চেপে হা করে শ্বাস নিচ্ছে। দর্পণ পাশ থেকে এক গ্লাস পানি মুখের সামনে ধরলো। মেহতিশা পানিটুকু ঢকঢক করে পান করে নিলো। মেহতিশা বুঝতে পারছে না, কে এই মেয়ে। দুইদিনে একবারও দেখেনি একে। মেয়েটার পোশাক, চুল যদিও এলোমেলো পাগলাটে। তবে, চেহারায় চকচকে তরুণী ভাব। লালিমা মেয়েটাকে ধরে বারবার বলছেন,

‘নিশিতা, চলো মা তোমাকে ঘরে দিয়ে আসি। ‘

নিশিতা নামক মেয়েটা কান্নারত গলায় বলল,

‘না, আমি যাবো না। তুমি কী বললে? ওই মেয়েটা এ বাড়ির বউ! না না, এ বাড়ির বউ তো শুধু আমি। কে এই মেয়ে? ‘

লালিমা আমতা আমতা করে বললেন,

‘তুমি যেমন তেমনই মেহতিশাও। পাগলামি করে না মা, চলো। ‘

‘এই এই মেয়েকে চলে যেতে বলো, নাহলে আমি কিন্তু সেই চাকুটা দিয়ে আবারও হাত কেটে ফেলবো। ‘

বলে মেয়েটা বাম হাতের আঙুল দিয়ে ডান হাতের শিরায় রাখলো। যেনো ওটাই একটা ধারালো ছুরি। মেয়েটার যে মানসিক রোগ আছে তা বুঝতে বিন্দুমাত্র সমস্যা হলো না। মেহতিশা কৌতুহলী চোখে মেয়েটাকে পর্যবেক্ষণ করছে। তবে ভয়ে, আগে থেকেই দর্পণের হাতটা আঁকড়ে রেখেছে। মেয়েটা হঠাৎ করেই দর্পণের কাছে আসলো। দর্পণের মুখভঙ্গি স্বাভাবিক একেবারে। নিশিতা মেহতিশাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলো। মেহতিশা ভড়কে গিয়ে পাশের চেয়ারটা ধরলো। নিশিতা হাঁটুগেড়ে দর্পণের হুইলচেয়ারটার সামনে বসে পড়লো। দর্পণের হাত মুষ্টিমেয় করে বলল,

‘মা, এসব কী বলছে! মিথ্যা বলে তাই না? ‘

দর্পণ মুচকি হেসে বলল,

‘মা, মজা করে বলছে ৷ তুমি জানো না, মা কত মজা করে! ‘

নিশিতা উৎফুল্ল হয়ে হাত তালি দিয়ে ওঠে। দর্পণের দিকে তাকিয়ে বাচ্চাদের মতো বলে,

‘আমি জানতাম, আমি জানতাম। তুমি তো শুধু আমাকে ভালোবাসো তাই না? কথা দিয়েছিলে, কখনো অন্য মেয়ের দিকে তাকাবে না। চলো আমার সঙ্গে, ওই পঁচা মেয়েটার দিকে কিন্তু তাকিয়োনা। ‘

‘ঠিক আছে, চলো। ‘

‘নিশুপাখি বলো! ‘

‘আচ্ছা বাবা,নিশুপাখি৷ ‘

নিশিতা হাততালি দিতে দিতে লাফিয়ে নিজের ঘরের দিকে ছুটে। দর্পণের স্বাভাবিক মুখশ্রী। হুইলচেয়ারটা একজন কাজের লোক সেদিকেই নিয়ে যেতে থাকে দর্পণের আদেশে৷ মাঝখানে লালিমা বাঁধা দিয়ে বলেন,

‘এই দর্পণ, তুই ওই মেয়ের কথা শুনে কেনো চলে যাচ্ছিস? মেহতিশার বাপের বাড়ি যেতে হবে না? ‘

দর্পণ থেমে গিয়ে গম্ভীর গলায় বলল,

‘নিশিতার এখন আমাকে প্রয়োজন। ‘

‘আর মেহতিশার! ‘

‘মেহতিশা একা যেতে পারবে। কী মেহতিশা পারবে না?’

মেহতিশা নিস্তব্ধ চোখে চেয়ে থাকে। ক্ষনিকের মাঝেই কী ঘটে গেলো! মেহতিশা মনের অজস্র ক্ষতকে লুকিয়ে মুখে হ্যা বলে। দর্পণের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে আনমনে। লালিমা শেখ ইতস্তত করছেন। মেহতিশা জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলে,

‘মা, এই মেয়েটা কে? আর এমন পাগলামী করছিলো কেনো? ‘

লালিমা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন,

‘ও হলো নিশিতা। আমার বড় ছেলের বউ। ‘

‘বড় ছেলে! ‘

‘হ্যা আমার বড় ছেলে অর্পণ। ‘

মেহতিশা চমকে গিয়ে বলল,

‘কী! এক মিনিট, আমি তো জানি দর্পণ এ বাড়ির একমাত্র ছেলে। আর সেই অর্পণ ভাইয়া এখন কোথায়? ‘

‘ওসব কথা পরে হবে মা, তুমি এখন রওনা হও। চিন্তা করো না, দুপুরের আগেই দর্পণকে পাঠিয়ে দেবো আমি। ‘

মেহতিশা একরাশ কৌতূহল নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়। দারোয়ান এসে লাগেজ টেনে গাড়িতে ওঠালেন। মেহতিশা গাড়িতে উঠে বসে। গাড়ি ছাড়ার আগ পর্যন্ত মেহতিশা শেখ মহলের প্রতিটি ইটকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে থাকে। কীসের একটা রহস্য পুরো বাড়িটাকে জড়িয়ে রেখেছে আষ্টেপৃষ্টে। যার রহস্য ভেদ করতে গিয়ে নিজেই আরো বেশি তলিয়ে যাচ্ছে। নাহ, এভাবে নয়। ঘি সোজা আঙুল না উঠলে আঙুল বাঁকাতে হয়। আর তা ভালো করেই জানে মেহতিশা জামান। চলন্ত গাড়ির জানালার বাহিরে তাকিয়ে তাচ্ছিল্য হাসে। নিজের নামের সঙ্গে শেখ নাম কখনোই যুক্ত করবে না সে। থাকুক কাগজে, সমাজের চোখে। নিজের কাছে মেহতিশা বিশুদ্ধ। তবে, এই বিশুদ্ধতা যে তাঁকে বিসর্জন দিতে হবে এই শেখ মহলেই তা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত সে।

দেখতে দেখতে গাড়ি অনেকটা পথ অতিক্রম করে কল্যাণপুর এসে পৌঁছায়। মেহতিশা নিজের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে চোখ বন্ধ করে শ্বাস নেয়। এই বাড়ির আনাচে-কানাচেতে কত প্রাণ জুড়ানো স্মৃতি ভেসে বেড়ায়। মেহতিশা গেটের দিকে পা বাড়াতেই সেখানে বসে থাকা কুকুরটা ঘেউঘেউ করে হাঁক ছাড়লো। মেহতিশা চমকালো না। ছোটবেলা থেকেই কীসের একটা শত্রুতা এই কুকুরের সঙ্গে। মেহতিশা বোঝে না, কোন কুক্ষণে বাবা এই কুকুরটাকে বাড়ি আনে। না আছে দেখতে কোনো সৌন্দর্য। আর না কোনো আদব। কম সময় তো হয়নি মানুষের সাথে থাকছে। তবুও কেমন করে বিচ্ছিরী গলায় খ্যাকখ্যাক করে। মেহতিশা গেট দিয়ে যাওয়ার সময় ইচ্ছে করে কুকুরটাকে দেখে বলল,

‘এই পাগলা কুকুর তুই এখনো এখানে বসে আছিস কেনো? ওহ, পাশের বাসার মেয়ে কুকুর সিলভী বুঝি পাত্তা দেয়নি! ভেরী স্যাড। ‘

প্রথমত কুকুরটা মোটেও পছন্দ করে না কেউ তাকে পাগলা কুকুর বললে। তার জন্য বিশেষ আয়োজন করে একটা নাম রাখা হয়েছিলো, জেমি। শামীউল্লাহ জামানের আদরের কুকুর কিনা। জেমিকে যেদিন বাড়িতে আনা হয়, তখন অদ্ভুত ভাবেই মেহতিশার সঙ্গে দন্দ লেগে যায়। মূলত তখন মেহতিশার বয়স মাত্র ষোলো বছর। জেমির নোংরা ধুলোবালি ভরে থাকা শরীর দেখে ছিটকিয়ে বলেছিলো, ওকে নিয়ে রাস্তায় রেখে আসতে। কিন্তু তিনি করেননি। বাসায় মেহতিশাকে দেখলেই গলা ফাটিয়ে চেঁচায়। সামনে একদমই যেনো সহ্য করতে পারে না। আড়ালে যদিও ওকে খুঁজে বেরায়। মেহতিশা আবার অন্য দিকে জেমিকে খোঁচায়। পাশের বাড়িতে একটা মেয়ে কুকুর থাকে। ওখানের একজন পালে শখ করে। নাম রেখেছে সিলভী। সেই সিলভী আবার বিদেশি সুন্দরী কুকুর। জেমি প্রায়ই টহল দিতে থাকে পুলিশের ন্যায়। বাড়ির আশেপাশে কোনো অন্য ছেলে কুকুর দেখলেই শাসায়। এটা মেহতিশা লক্ষ্য করে। এতে যখনই সুযোগ পায় দু’টো কথা শোনাতে ছাড়ে না। জেমি এতগুলো দিন পরিবারের লোকজনের সঙ্গে থাকতে থাকতে অনেক কিছুই বোঝে। কেউ হেয় করে কথা বললেই খবর আছে। তবে, হয়তো আজ পণ করেছিলো সে মেহতিশা আসলে কোনোরকম ঝগড়া করবেনা। তাই এতক্ষণ বের করে রাখা লম্বা জিহ্বাটা মুখে পুড়ে মুখ ভেঙচিয়ে চলে গেলো লেজ নাড়াতে নাড়াতে। মেহতিশা ওটার দিকে তাকিয়ে বকতে বকতে ভেতরে ঢুকে পড়ে।

পরিবারের সবাই একে একে ঝাপিয়ে এসে পড়ে মেহতিশার দিকে। মেহতিশা নিজেও আবেগাপ্লুত হয়ে যায়। মা বাবা,চাচা চাচি, চাচাতো ভাই বোন মারিয়া, আশফিন সবাই জড়িয়ে ধরে। একে একে সবার সাথে কথা বলে দুপুরের খাবার খেয়ে নিজের ঘরে আসে মেহতিশা। হয়তো কিছু একটা লুকাতে৷ নিজের ঘরটায়
এসে বিছানায় ধপ করে বসে মেহতিশা। বুকের একপাশে তীব্র জ্বলুনি অনুভব হচ্ছে। চোখের পানিগুলো আটকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়ছে। চোখ বন্ধ করতেই টপটপ করে পানি ঝরে পড়ে। মেহতিশা শূন্যে তাকিয়ে বিরবির করে বলে,

‘আমি কী এতোটাই গুরুত্বহীন দর্পণ! ‘

চলবে-
লেখিকা-নাঈমা হোসেন রোদসী।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here