“প্রিয় দিও বিরহ”
১৯.
নিশিতা তখন গভীর নিদ্রায় বিভোর। মুখে মুচকি হাসি বিদ্যমান৷ স্বপ্নে মগ্ন সে। কীসের একটা সুবাস নাকে এসে লাগছে। নিশিতা ঘুমিয়ে স্মৃতির পাতায় বিচরণ করছে। গোলপাতা গুলো দুলে দুলে উঠছে বাতাসের তোড়ে। কী অপূর্ব সুন্দর জায়গাটা!নিশিতা পরিবেশটা দেখে মনে মনে ভাবে এই জায়গাতে ওর বেবি হওয়ার পর অর্পণ আর সে আবারও আসবে। এসব ভেবেই পাশের সিটের অর্পণের হাতটা আঁকড়ে ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো,
‘এই অপু! এই! ‘
অর্পণ চমৎকার একটা হাসি দিয়ে তাকালো। দুই গালের মাঝে গর্ত ভেসে উঠলো। গাড়ি চালাতে চালাতে বললো,
‘বলো নিশি। ‘
নিশিতা বড়ই আহ্লাদী সুরে বললো,
‘ওগো, আমার ইচ্ছে করছে কী জানো? আমি এই অসাধারণ মনমোহিনী রাস্তাটাতেই আজীবন থেকে যাই। ‘
অপূর্ব বললো,
‘তা তো যাবে না। তুমি এখানে থেকে গেলে তোমার এই হ্যান্ডসাম বরটাকে তো অন্য মেয়ে নিয়ে চলে যাবে! ‘
নিশিতা অপূর্বের কাঁধে কিল বসালো। মুখ ফুলিয়ে বললো,
‘রাখো তোমার রসিকতা। ভালো লাগে না সবসময়। ‘
‘উঁহু! রাগ করে না। সোনাবউ আমার! আমি তোমাকে এখানেই একটা বাড়ি বানিয়ে দেবো। দশটা দাসী থাকবে, তিনটা বাগান থাকবে, একটা ইচ্ছে জ্বিন থাকবে। সে সকাল বিকাল তোমার হুকুম পালন করবে। হবে না?
কথায় ফিক করে হেঁসে দিলো নিশিতা। দুই বছরের প্রেম,আড়াই বছরের সংসার। এই পুরোটা সময় জুড়েই কত মিষ্টি মুহুর্ত পাড় করেছে দুজনে। প্রেমের শুরুর দিকে তখন খুব একটা ভালো লাগতো না এই কৃষ্ণ বর্ণের ছেলেটাকে। অর্পণ হয়েছে তার মায়ের মতো দেখতে। কিছুটা কালো রঙের। কিন্তু কথায় আছে, গায়ের রং কখনো কারো মনকে বিচার করার ক্ষমতা রাখেনা। দিন যতই গেলো, নিশিতা ততই এই রসিক, হাসিখুশি মানুষটাকে দেখে মুগ্ধ হচ্ছিল। একজন মানুষ কতটা শান্ত, হাস্যরসিক হতে পারে তা অর্পণকে না দেখলে বোঝা যাবেনা। দীর্ঘ একটা সময় পর এই ছেলেটাকে ছাড়া বেঁচে থাকাটা অনেক নির্মম হয়ে উঠছিলো। তখন পরিবারের সম্মতিতে চারহাত এক হয়। তবে, লালিমা শেখের খানিকটা আপত্তি ছিলো। কারণ তিনি চেয়েছিলেন আরও উচ্চ বংশীয় মেয়ে বিয়ে করাতে। কিন্তু তার পথের বাঁধা হয়েছিলো এই নিশিতা। আগুন সুন্দরীও তো না! সুন্দর বলা যায় তবে আহামরি নয়। তাই সব দিক মিলিয়ে তিনি মত দিচ্ছিলেন না এই বিয়েতে। তবুও,অর্পণ তার মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বিয়ে করে। নিশিতার হাত সেই যে ধরেছিলো শেষ নিশ্বাস অব্দি ধরে রাখার পণ করেছিলো।
নিশিতা হাসিমুখে অর্পণের কাঁধে মাথা রাখে। তার গর্ভে স্বপ্নশিশু তাদের। পাশে ভালোবাসার মানুষ। কী নেই তাদের? সুখ, শান্তি সবই আছে। পৃথিবীটা আসলেই বড় সুন্দর। কিন্তু নিশিতা কী তখন জানতো,এই সুখটা মরিচীকা মাত্র। কয়দিনের স্মৃতি হয়ে যা আজীবন রয়ে যাবে। ড্রাইভিং সিটে বসে তখন দু’জনে নানা স্বপ্ন বুনছে। নিশিতা তখন ধীরে ধীরে ঘুমে ঢলে পড়ছে। কানে ভেসে আসছে অর্পণের গাওয়া সুরমেশালো গান,
এই পথ যদি না শেষ হয় তবে
কেমন হতো তুমি বলোতো?
–
দীর্ঘ পাঁচটি মাসে নানা উথাল-পাতাল ঢেউ সংসারে উঠানামা করেছে। কখনো রাগ, অভিমান। কখনোবা দুষ্ট মিষ্টি মুহুর্ত। সবটা মিলিয়ে ভালোই কাটছে দিনকাল৷ সুন্দর সুখের দিন নাকি তাড়াতাড়ি কেটে যায়। মেহতিশা নিজেকে এখন অবশ্য খুব সুখীই মনে করছে। তবে ভয়ও হয়, বলা তো যায়না কার নজর লাগে এই সুখে। দুঃখ না জানি এসে দাঁড়ায় এই সুখনীড়ে।
ঘুমটা আগের তুলনায় অনেকটা বেড়েছে। মাঝে মাঝে আবার মাঝরাতে ঘুম হয়না৷ তাই মেহতিশা করিডোরে হাঁটাহাঁটি করে। কখনো ক্যানভাসে এলোমেলো রঙ দিয়ে ছবি আঁকে। চিপসের প্যাকেটটা নিয়ে এসে খচরখচর করতে করতে দর্পণের পাশে বসলো। দর্পণ ল্যাপটপে কাজ করতে করতে একবার আঁড়চোখে তাকালো। রাত অনেক হলেও দু’জনেই জাগনা। দর্পণ অনেক বার ধমকি-ধামকি দিলেও মেহতিশাকে কোনোভাবেই ঘুম পাড়াতে পারেনি। তাই দর্পণও চুপ করে আছে। সেও কোনো কথা বলেনি। মেহতিশা ওকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বিরক্ত করছে যেনো দর্পণ কিছু বলে।
খালি চিপসের প্যাকেটটা ল্যাপটপের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ফিক করে হেঁসে উঠলো মেহতিশা। দর্পণ প্যাকেটটা সরিয়ে দিয়ে প্যাকেটটা ফেলে মুখ বুঁজেই কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো। মেহতিশার এবার রাগ লাগে। সে কাঁথা ধরে ইচ্ছেমতো টানাটানি করছে। দর্পণ এবার বললো,
‘ছেড়ে দিন, ব্যাথা পাবেন। ‘
‘না না না, ছাড়বো না। ‘
দর্পণ এবার মেহতিশার টেনে নিজের উপরে নিয়ে আসলো। গালের উপরের চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে বললো,
‘এমন করছেন কেনো?’
মেহতিশা মুখ ফুলিয়ে বলে,
‘আপনি কথা বলেন না কেনো?’
‘তাহলে আপনি ঘুমাচ্ছেন না কেনো?’
‘ঘুম আসে না তো, আমি চেষ্টা করি। ‘
‘কচু করেন। দুই মিনিট শুয়ে এদিক ওদিক করেই উঠে গিয়ে চিপস নিয়ে বসলেন। একটু আগে চকলেট খেলেন। ‘
‘আমি খাইনি তো! ‘
‘কে খেয়েছে তাহলে?’
‘আপনার ছেলে৷ ‘
‘হু, এখন সব দোষ নন্দ ঘোষ। ‘
‘হুম, সব দোষ দর্পণ সাহেবের ছেলের। ‘
বলে নিজেই হাসিতে ফেটে পড়লো মেহতিশা। দর্পণ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে দেখলো। একসময় গভীর ঘুমে ঢলে গেলো মেহতিশা। দর্পণ একটু ভালো করে পরখ করে মেহতিশাকে শুইয়ে দিলো। পড়নের শার্টটা ঝেড়ে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সারাদিনে মাত্র একবার দাঁড়ানো হয়েছে। তাই পা দুটো ঝিমঝিম করছে। আর কয়টা মাস ভালো করে গেলেই হলো। তারপর আর এই লুকোচুরির প্রয়োজন হবেনা। ভেবে ঠোঁট এলিয়ে হাসে দর্পণ। খেলাটা মজার আবার একটু রিস্কিও। এখন কিছুতেই ধরা দেয়া যাবেনা। হিতে বিপরীত হতে পারে। একবার এলোমেলো চুলে ঘুমিয়ে থাকা মেহতিশার দিকে তাকালো। মোবাইলটা নিয়ে পকেটে ঢুকালো। কাউকে একটা মেসেজ করে শিটি বাজাতে বাজাতে নিঃশব্দে বের হয়ে গেলো।
–
দর্পণের দরজা আটকানো মাত্রই চোখ খুলে উঠে বসলো মেহতিশা। ঘন ঘন শ্বাস ফেলে দুই মিনিট থম মেরে বসে থাকলো। তারপর ধীর পায়ে উঠে দাঁড়ালো।
কতক্ষণ অবিশ্বাস্য চোখে দরজার দিকে তাকিয়ে রইলো। কী সুন্দর নাটক করে যাচ্ছিলো এই মানুষটা!
আর একেই নাকি অন্ধের মতো বিশ্বাস করেছিলো সে। হাহাকার জাগছে বুকে। কয়েক দিন ধরেই ঘুম ভেঙে মাঝরাতে ওকে যখন বিছানায় পায়না মেহতিশা তখন একটু অদ্ভুত লাগছিলো। কারণ, দর্পণ তো আর একা চলাচল করতে পারে না। হুইলচেয়ারটাও তো বিছানার পাশেই পড়ে আছে। তাহলে দর্পণ কীভাবে বাহিরে যায়!মেহতিশা বুঝতে পারলো প্রতিটা রাতই দর্পণ ঘর ছেড়ে মাঝরাতে বেরিয়ে যায়৷ মেহতিশা দরজা বন্ধ দেখে চোখ মুছে নেয়। এই বিশ্বাসঘাতককে ভালোবাসাটা ওর পাপ ছিলো। বিরাট অপরাধ। ওর উচিত ছিলো বাবার কথা মতো ছয় মাস পর কাগজপত্র তল্লাশি করে বেরিয়ে যাওয়া। এসব ভেবে ক্রুদ্ধ মনে আলমারি খুলে দর্পণের গোপন লকারটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে শুরু করলো। যে লকারটায় কখনো আড়দৃষ্টিতে তাকিয়েও সে দেখেনি, আজ সেটাই হাতাচ্ছে। সময় সত্যিই পাল্টায়। একসময় আকাঙ্ক্ষিত কাগজটি পেয়েও গেলো। কাগজটার দিকে তাকিয়ে ভেজাচোখেও হাসলো।
এমন সময় হঠাৎ করেই দর্পণ ঘরে এসে গেলো। গেটের চাবিটা নিতে ভুলে গিয়েছিলো সে। মেহতিশাকে আলমারি খুলে নাড়াচাড়া করতে দেখে চমকে উঠলো।
দরজাটা লক করে দিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে সামনে আসলো। প্রথমবার দর্পণের ক্রোধ ভরা চোহারাটা দেখে মেহতিশার ভয় লাগলো। তবুও, সাহস সঞ্চয় করে বললো,
‘দর্পণ শেখ, ভালো মানুষীর মুখোশটা তাহলে খুলেই গেলো। ‘
দর্পণ মুচকি হাসলো৷ দেয়ালের এক পাশে হেলান দিয়ে হাত বুকের উপর ভাজ করে বললো,
‘জেনেই গেলেন তাহলে বউজান৷ ‘
পরমুহূর্তেই মেহতিশার গলাটা চেপে ধরে হিসিয়ে উঠলো,
‘জেনেছেন ভালো কথা, কিন্তু ভুলেও মুখটা খুলবেন না। পরিণাম একটুও ভালো হবে না। ‘
চলবে-