হৃদয়ের কোণে পর্ব ৩৮

0
653

#হৃদয়ের_কোণে (পর্ব ৩৮)
#নাহার
·
·
·
ছাদের রেলিং ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিরা। গোধূলি বিকেল। সূর্যের হালকা কমলা আভা আকাশে ছড়িয়ে আছে। সাথে আছে সাদা সাদা মেঘ। এপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত উড়ে বেড়াচ্ছে। হালকা হালকা বাতাসে নিরার খোলা চুলগুলো উড়ছে। নিরা একধ্যানে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। মনের মধ্যে হাজারো প্রশ্ন কিন্তু উত্তর দেয়ার মানুষটা নেই।

রাফিন অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে প্রায় দু’মাস হয়ে গেছে। এই দু’মাসে নিরার সাথে একবারো যোগাযোগ করেনি। কেনো করবে যোগাযোগ? নিরাতো এখন তার কাছে চরিত্রহীন। অনেকদিন হলো সেই প্রিয় কণ্ঠ শুনা হয়না। নিরার মন ব্যাকুল হয়ে আছে প্রিয় কণ্ঠ শুনার জন্য।

কৌশিক ছাদে এসে নিরার পাশে দাঁড়িয়েছে। নিরার মুখপানে তাকিয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেছে তার। মুখটা একদম শুকিয়ে গেছে। এই দুই মাসে কারো সাথে তেমন কথা বলেনি। কৌশিক যে এসে দাঁড়িয়েছে নিরার কোনো খেয়াল নেই সেদিকে। কৌশিক হালকা কাশি দেয়। নিরা চমকে উঠে পাশে তাকায়। আবার অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। কৌশিক বললো,
— এভাবে আর কতদিন নিরা?

নিরার ভেতরের কষ্টগুলো কান্না হয়ে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলো এতক্ষণ কিন্তু খুব কষ্টে আটকে রেখেছিলো। কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ভা ভা ভাই….

আর কিছু বলতে পারলো না। ডুকরে কেঁদে দিলো। কৌশিক শক্ত করে নিরার দুইহাত ধরে রেখেছে। এই দুই মাসে নিরা একটুও কাঁদেনি। তাই কৌশিক চায় আজকে কাদুক। খুব করেই কাদুক। অন্তত একটু হলেও মেয়েটা হালকা হবে। অনেকক্ষণ এভাবে যাওয়ার পর নিরা নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
— ভাই একবার আমি কথা বলতে চাই। শুধু একবার। এরপর আর কোনোদিন চাইবো না। আর কোনোদিন এমন আবদার করবো না। সত্যি। প্লিজ।

কৌশিক কিছু বললো না। নিরার হাত এখনো শক্ত করে ধরে রেখেছে। নিরা আবার বললো,
— আচ্ছা আমার দোষ কি ছিলো ভাই? আমি কি করেছি? কেনো এভাবে ছেড়ে চলে গেলো? উনি কি জানে না উনি আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তাহলে কেনো চলে গেলো? প্লিজ শুধু একবার কথা বলতে চাই।

— এইসব প্রশ্ন করার জন্য?

— না না। আমি এসব কিচ্ছু বলবো না সত্যি। শুধু উনার কথাই শুনবো। আওয়াজটা শুনবো। আর কছু না। প্লিজ ভাই।

— রাফিনের কোনো কন্ট্যাক্ট নাম্বার নেই আমার কাছে।

কৌশিকের কথা শুনে নিরা সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কান্নার আওয়াজ বন্ধ হয়ে গেছে কিন্তু চোখের পানি পড়া বন্ধ হয়নি। একদম মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলো। কৌশিক আবার বললো,
— একটা নাম্বার আছে। সেখানে কল দিয়ে দেখতে পারি।

মোবাইল বের করে একটা বিদেশি নাম্বারে ডায়াল করে নিরার হাতে দিলো। নিরা মোবাইল কানে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। মনের মধ্যে উত্তেজনা। এই বুঝি তার ডাক্তার রিসিভ করে বলবে, “হ্যালো কে বলছেন? হ্যালো…হ্যালো। কথা বলছেন না কেনো? কে আপনি? কাকে ফোন দিয়েছেন? আজব মানুষ তো।” কথাগুলো বলেই ফোন কেটে দিবে আর নিরার অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ হবে। সে তার ডাক্তার সাহেবের কণ্ঠ শুনতে পাবে। কিন্তু মোবাইলের অপাশ থেকে একজন মেয়েলি কণ্ঠে বললো, “This number is unreachable. Please try again later.” নিরা মোবাইলটা কৌশিকের হাতে দিয়ে ছাদ থেকে নেমে গেলো। রুমে এসে দরজা লাগিয়ে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়লো। উঠে এসে কাবার্ড থেকে রাফিনের সেই সাদা শার্ট বের করলো। যেটাতে একবার সে জুস ফেলে দিয়েছিলো। তারপর রাফিন তাকে এটা ধুতে দেয়। নিরা ধুয়ে শার্টটা নিজের কাছে রেখে দেয়। এই শার্টটা এখন নিরা জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। শার্টটা নাকের কাছে আনলেই মনে হয় তার ডাক্তার সাহেবের গায়ের ঘ্রাণ নাকে আসছে।

——————————
তূর্য, কাশফি, তুহিন এবং নিরাদের বাড়ির ছেলে মেয়ে সবাই চায় বর্ষাকাল আসার আগেই বান্দরবান ঘুরে আসতে। কৌশিক বেশি ইচ্ছুক। সে নিরাকে সেখান থেকে ঘুরিয়ে আনতে চায়। খোলা পরিবেশে ঘুরে আসলে হয়ত মনটা পরিষ্কার হবে। বাড়ির সবাই মত দিয়েছে। নিরাকে জানানো হয়নি। সবাই চায় নিরাকে সারপ্রাইজ দিবে। ঘুমিয়ে গেলে কোলে তুলে গাড়িতে তুলে বান্দরবান নিয়ে যাবে। সকালে ঘুম থেকে উঠে সারপ্রাইজড হবে। সবার সব প্ল্যানিং শেষ। এবার শুধু সেটা সফল হওয়ার পালা।

এইদিকে তুহিন অনেকটা খুশি। কারণ সে একটু হলেও নিরাকে আবার ফিরে পেতে চায়। গত দুই মাসে নিরাকে তিনবারের মতো বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। সবাই রাজি হলেও নিরা একদমই রাজি না। সে তো অপেক্ষা করছে। কৌশিকের বিয়েতে রাফিন যেই কথাটা বলেছে, -“যদি কোনোদিন বাধ্য হয়ে তোমায় ছাড়তে হয় তবে অপেক্ষা করো আমি তোমার কাছে ঠিক ফিরে আসবো। এই নিরুপাখিকে রাফিন নামক খাচায় বন্দী করতে। ” নিরা এই কমিটমেন্ট এর ভরসায় অপেক্ষায় আছে। যদিও সে জানে না সত্যিই কি রাফিন এই কমিটমেন্ট রাখবে নাকি। কিন্তু নিরা রাখছে। সে অপেক্ষা করছে। নিরা জানে না এই অপেক্ষার প্রহর কবে শেষ হবে।

বান্দরবান যাওয়ার একদিন দিন আগের রাতে মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। সবাই আরামে ঘুমিয়ে গেলেও নিরার চোখে ঘুম নেই। নিরা চুপিসারে ছাদে চলে আসে। ভোর পর্যন্ত ছিলো বৃষ্টির মধ্যে। আজানের আগে বৃষ্টি থেমেছে তখন নিরা ছাদ থেকে নেমে রুমে আসে।

পরেরদিন সবাই চুপিসারে প্যাকিং করছে বান্দরবান যাওয়ার। নিরাকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে সবাই সারপ্রাইজড হয়ে গেলো। ভোরের দিকে রুমে গেছিলো নিরাকে নিতে। নিরাকে কোলে তুলে নিচে নেমে আসে কৌশিক। তখনও ভেবেছিলো নিরা ঘুমিয়ে আসে। গাড়িতে বসার পর দেখলো নিরার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আছে। প্রথমে পাত্তা না দিলেও পরে ভালো করে খেয়াল করে দেখলো ঠোঁট শুকিয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। কৌশিক ভয় পেলো। নিরাকে ঘুম থেকে তোলার জন্য ডাক দিলো কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পেলো না। পানির ছিটা দেয়ার পরেও যখন নিরা উঠেনি তখন সবাই ভয় পেয়ে গেলো। আবার বাড়িতে ফিরে আসে সবাই। নিরাকে রুমে শুইয়ে দিয়ে ডাক্তারকে ফোন দেয়। ডাক্তার চেকাপ করলো। হাতে স্যালাইন লাগানো হলো।

দুপুরের দিকে নিরা হালকা করে চোখ খুলে আশেপাশে তাকালো। ঘড়ি দেখে অবাক হলো। দুপুর হয়ে গেছে সে এতক্ষণ ঘুমিয়েছে। অবাক হয়ে উঠে বসার সময় হাতে ব্যাথা পেলে তাকিয়ে দেখলো হাতে ক্যানেলা ফিট করা। নিরা আরো অবাক হলো। তাড়াতাড়ি দাঁড়িয়ে গেলো। শরীর দুর্বল লাগছে। এরপর মাথায় এলো সে হয়ত অজ্ঞান ছিলো বাসায় জেনে যাওয়ায় ডাক্তার ডেকেছে।

ডাক্তার ডেকেছে এটা ভেবে নিরা আনমনে হেসে ফেলে। নিরা মনে মনে বললো,
— আমি জানতাম আপনি ফরে আসবেন। সত্যিই এসেছেন। এসেই আমার এমন অবস্থা দেখে রেস্টে রেখেছেন। নিরা বাইরে যেতে নিলেই দেখলো কৌশিক রুমে আসলো। কৌশিককে বললো,
— ভাই আমার ডাক্তার সাহেব ফিরে এসেছে? আমি জানতাম ফিরে আসবে। কোথায় উনি?

কৌশিক কিছু বলার মতো পেলো না। চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো। পেছন থেকে একজন বয়স্ক ডাক্তার এসে বললেন,
— মামনি তুমি উঠেছো কেনো? তোমার আরো রেস্ট দরকার।

নিরার হাসি উবে গেলো। কিচ্ছুক্ষণ কৌশিকের দিকে তাকিয়ে থাকলো। কৌশিক মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো। নিরা মাথায় এলো, তার ডাক্তার সাহেব আসেনি। তাকে অনেক ঘৃণা করে। আর আসবে না। সে হয়ত মালিহাকে..। আর ভাবতে পারলো না। সাথে সাথেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো নিরা।

——————————
নিরার শরীর দিন দিন আরো খারাপ হচ্ছে। বিছানা থেকে উঠার শক্তি নেই একদমই। গত কয়েকদিন ধরেই স্যালাইন চলছে। নিরা মা মিসেস শায়েলা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসান। একমাত্র মেয়ের এ অবস্থায় তিনি কিছুই করতে পারছেন না। নিরা একবার বলেছিলো সে রাফিনের সাথে কথা বলতে চায়। কেউ রাজি হয়নি। তখন নিরা বললো “হয়ত এটা আমার শেষ ইচ্ছা।” আর কেউ কিছু বলতে পারলো না। কয়েকদিন লেগেছে রাফিনের বর্তমান নাম্বার যোগার করতে।

কৌশিক নাম্বার হাতে নিয়ে নিরার রুমে আসলো। তাকে দেখে নিরা আধা শোয়া হয়ে বসলো। কৌশিক হাতে থাকা কাগজ উঁচিয়ে বললো,
— অনেক কষ্টে যোগার করেছি তাও তোর জন্য। এখনি কল দিচ্ছি।

কৌশিক নাম্বার তুলে ডায়াল করলো। রিং পরার কিছুক্ষণ পর রিসিভ হলো। কৌশিক আর রাফিনের মাঝে কি কথা হলো তার মধ্যে শুধু কৌশিকের, “আচ্ছা, ঠিকাছে, ওকে” এতটুকুই শুনেছে নিরা। লাউডস্পিকারে রাফিনের কথা শুনে নিরা থম মেরে বসে রইলো। রাফিন খুব রাগি মেজাজে বললো,
— যদি তোর লজ্জা সরম থেকে থাকে দ্বিতীয়বার আমার সাথে কন্ট্যাক্ট করার চেষ্টা করবি না। আর শুন আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। আর বিরক্ত করবি না আমায়।

এতটুকু বলেই কল কেটে দিলো। নিরা শান্ত স্বরে বললো,
— ভাই তুই রুমে যা।

কৌশিক ভয় পেলো। বললো,
— তুই উলটা পালটা কিছু করবি না তো?

নিরা হাসলো। এক রহস্যময়ী হাসি। তারপর স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
— নাহ। আমি এতোটাও লুজার না যে, একজন মানুষের জন্য জীবন দিয়ে দিবো। একটু একা থাকতে চাই।

কৌশিক কিছু না বলে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। নিরা উঠে বসে। আস্তে আস্তে বেড থেকে নেমে পড়ার টেবিলের কাছে আসে। বইগুলাকে ছুয়ে দিয়ে বলে,
— অনেকদিন অবহেলা করেছি তোদের। যার জন্য করেছি সে এখন আমায় অবহেলা করে। আজকের পর থেকে আর অবহেলা করবো না।

নিরা পশ্চিম পাশের জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে তাকিয়ে বললো,
— এক নতুন ভোর হবে কাল।

——————————
ডাইনিং টেবিলে বসে সবাই নাস্তা করছিলো। এমন সময় নিরা বোরকা পড়ে কাধে ব্যাগ নিয়ে এসে একটা চেয়ারে বসে পড়ে। উপস্থিত সবাই অবাক হলো নিরাকে দেখে। নিরা নাস্তা নিতে নিতে বললো
— এমন ভাব তোমাদের যেনো কোনো এলিয়েন দেখছো।

সবাই ঢোক গিলে। নিরার মা জিজ্ঞেস করলেন,
— কোথায় যাচ্ছিস?

— মা তুমি ভুলে গেলে আমি এখন অনার্সের ছাত্রী। ক্লাস করবো না নাকি? ভাবছি কয়েকটা টিউশন করাবো। ঝুমুরকে বলবো আজ। কি বলো ভালো হবে না?

আফিয়া এসে নিরার কপালে হাত দিয়ে বললো,
— গায়ের তাপমাত্রা তো স্বাভাবিকই আছে।

নিরা বিরক্ত হয়ে বললো,
— আজব। কি হয়েছে তোমাদের? এমন উদ্ভট আচরণ করছো কেনো?

কেউ আর কিছু বললো না। নিরা নাস্তা খেয়ে ব্যাগ নিয়ে বের হবার আগে তার বাবাকে বললো,
— আমি টিউশন করালে কি কোনো সমস্যা হবে তোমার? না মানে তোমার আপত্তি নেই তো?

নিরার বাবা একবার মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন। তারপর বললেন,
— না সমস্যা নেই।

নিরা হেসে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। সবাই খুশিও হলো আবার চিন্তিতও হলো। তবে খুশি হয়েছে বেশি। স্বাভাবিক ভাবেই বাঁচতে চাইছে নিরা। তাই কেউ কিছু বললো না।
·
·
·
চলবে………………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here