ফিঙের_ডানা
পর্ব-২
আমার ছোটবেলা থেকে খুব শখ একটা প্রজাপতির বাগান থাকবে। হ্যাঁ ঠিক শুনছেন। ফুলের বাগান না, প্রজাপতির। যেখানে ফুল তো থাকবেই, তবে সেটা প্রজাপতির জন্যই। আমি দাঁড়িয়ে থাকলে আমাকে ঘিরে প্রজাপতিরা রঙবেরঙের পাখনা নাচিয়ে উড়ে বেড়াবে। কখনো নাকে বসবে, কখনো চোখের পাতায়। কী দারুণ না? আমি নিজেও জানি সেই শখ পূরন হওয়ার নয়। তবুও কিছু ইচ্ছে থাকে না, পূরন হবে না জেনেও ছোট্ট বাক্সে বন্দি করে মনের ভেতর লুকিয়ে রাখা যায়। মাঝে মাঝে বাক্স খুলে কল্পনায় সেই স্বপ্নের জগতে পা রেখে মনের মরে আসা অংশটা জীবন্ত করে নেয়া যায়।
বিধাতা অবশ্য মাঝে মাঝে সেই স্বপ্নের টুকরো অংশে বাস্তবিক ভ্রমন করিয়ে আনে। এই যেমন আজ। বাড়িওয়ালাদের বাগানে গিয়েছি লেবু আনতে। আজ মা রেঁধে রেখে গেছে কচুর লতি৷ এই জিনিস লেবু ছাড়া খাওয়া যায়? বাইরে গিয়ে কিনে আনব তারও উপায় নেই। বের হইনি এখন পর্যন্ত৷ কিছু চিনি না। তখনই মনে পড়ল ফুলের বাগানের এক পাশে কাগজি লেবুর গাছ আছে। পুরো গাছভর্তি লেবু হয়েছে৷ তার থেকে দুটো ছিঁড়ে আনলে নিশ্চয়ই কিছু বলবে না। এদিকে এসে দেখি প্রজাপতির মেলা। কম করে হলেও বিশটা প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে ফুল থেকে ফুলে৷ লেবু গাছটার পাশেই মাটিতে কয়েকটা গাছ বড় হয়েছিল। কী গাছ এতদিন বুঝতে পারিনি। আজ দেখি কসমস ফুটে আছে। সাদা গোলাপী দুই জাতের মেশানো। কী সুন্দর! কী সুন্দর! প্রজাপতির আনাগোনা সেখানেই বেশি।
“কী করছ?” ডাক শুনে পেছন ফিরলাম। কাকের বাসা চুলওয়ালা মাত্রই বাড়ি ফিরেছে৷ চোখে রোদচশমা। কাঁধে ব্যাগ। অমন ঝোপের মতো চুল থাকা সত্ত্বেও হ্যান্ডসাম লাগছে। গায়ের রঙ অনেক ফরসা। এত ফরসা ছেলে আমার জীবনেও ভালো লাগত না। একে দেখতে বেশ লাগছে! এখন প্রায় বিকেল হয়ে এসেছে। তেরছা রোদ এসে লাগছে ওর মুখে। মায়াবী সোনালী রঙ লেপ্টে আছে মুখটাতে।
বললাম, “লেবু নিতে এসেছি। কচুর লতি রান্না করেছে মা। লেবু ছাড়া খেতে ভালো লাগবে না।”
“আমি তো দেখলাম তুমি কথা বলছ বিড়বিড় করে।”
ওমা! এই ছেলে কখন এসেছে? আমার একা কথা বলার অভ্যাস আছে। মা বলে লোকে শুনলে পাগল বলবে। এই ছেলে আবার আমাকে পাগল ভাবছে না তো? বললাম, “এমনি ও কিছু না।”
সে বলল, “দুপুরে খাওনি?”
“নাহ।”
“আমিও খাইনি। ক্ষুধা লেগেছে।”
এই কথার মানে কী? ক্ষুধা লাগলে ঘরে গিয়ে খেয়ে নাও৷ আমাকে বলছ কেন? আমি কথাই বললাম না। দুটো লেবু ছিড়ে নিয়ে যাওয়ার আগে একটু হেসে বললাম, “ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিন।”
সে বলল, “লেবু আর লতি দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছে করছে।”
আমি হঠাৎ অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। এভাবে বললে কি না দিয়ে খাওয়া যায়? এদিকে দিলে কীভাবে দেব? ওদের ঘরে গিয়ে দিয়ে আসব? আমি তো বাড়িওয়ালাদের অংশে কখনো যাইনি। আবার তাকে আমার ঘরে ডাকাও যায় না। কেমন দেখায় ব্যাপারটা! সে বিষয়টা বুঝতে পেরে বলল, “আমি মজা করছিলাম মেয়ে! তুমি যাও, খেয়ে নাও।”
মানে মানে উল্টোদিক ফিরলাম। সে আবার পেছন ডেকে বলল, “এই শিফা, একটু হাসো! তোমাকে কেউ বিপদে ফেললে খুব মজা পাবে। তোমাকে এতক্ষণ চশমাপরা হনুমানের মতো লাগছিল।”
“কীহ!” এমন রাগ লাগল ইচ্ছে হলো মাথাটা ফাটিয়ে দেই।
সে গা দুলিয়ে হাসতে হাসতে বলল, “সত্যি।”
“আমি দেখতে হনুমানের মতো?”
“উহু, তখন লাগছিল।”
রাগে আমার গা কাঁপছে, এদিকে তার হাসি বেড়ে চলেছে। মাঝখানে বাগড়া দিল সাহিদা চাচী। এই মহিলাকে দেখে আমার রাগ চলে গিয়ে খানিকটা ভয় ঢুকে গেল মনে। উনি হচ্ছেন বিবিসি। শুধু এই বাড়ির না, আশেপাশের দশ বাড়ির খুটিনাটি সব খবর তার কাছে থাকে৷ এগুলো আবার রসিয়ে রসিয়ে গল্পও করে বেড়ায় সবার কাছে। সঙ্গত কারনেই উনাকে সবাই এড়িয়ে চলতে পছন্দ করে৷ এই ক’দিনেই আমারও তাকে চেনা হয়ে গেছে। তাকে দেখেই আর দাঁড়ালাম না। চুপ করে চলে এলাম৷ উনাকে দেখলাম সোহানের সাথে কী যেন কথা বলছে। মুখ দিয়ে মিষ্টি কথার ফোয়ারা ছুটছে৷ একটু পরেই সারা দুনিয়া বলে বেড়াবে, শিফা মেয়েটা ভালো না। দু’দিনেই বাড়িওয়ালার আত্মীয়র সাথে হাসাহাসির সম্পর্ক করে ফেলেছে! কী অবস্থা!
*
রাতে বসে গল্পের বই পড়ছি, মা বলল, “কিরে, তোর কী হইছে? তুই এক মিনিট পরপর আয়না দেখতেছিস কেন?”
আসলেই আজ আয়না দেখছি একটু পরপর। তখন ‘চশমাপরা হনুমান’ উপাধি পাওয়ার পর থেকে মনে সন্দেহ ঢুকে গেছে, সত্যি আমি দেখতে হনুমানের মতো নই তো? একবার মনে হচ্ছে আসলেই তাই। আবার মনে হচ্ছে না। ছেলেটা আস্ত ফাজিল!
মাকে বললাম, “কিছু হয় নাই। এমনি।”
আবার পড়ায় মনোযোগ দিলাম। মন বসছে না। আমার কয়েকটা গল্পের বই ছিল, নিয়ে এসেছি৷ এগুলোই রিভিশন দিয়ে যাচ্ছি। নতুন বই পাব কোথায়? এদিকে লাইব্রেরি আছে কি না খোঁজ নিতে হবে। সমস্যা হলো এই বাড়িতে আমার সমবয়সী কেউ নেই। হয় অনেক বড়, নয়তো অনেক ছোট। আচ্ছা কাকের বাসার কাছে বই আছে নাকি? থাকলে ধার করে পড়া যেত। দুপুরে ওর খেতে চাওয়ার কথাটাও খোঁচাচ্ছে। আবার সাহিদা চাচী মাকে কী না কী বলে, তার আগে আমি বলে দেয়াই ভালো।
“মা শোনো না। ওইযে বাড়িওয়ালদের বাসায় যে ছেলেটা থাকে দেখছ তো তুমি?”
“হ্যাঁ। ওর সাথে নাকি কথা বলিস তুই?”
বাহ! এর মধ্যে বলাও হয়ে গেছে! এই মহিলা তো ফাইভ জি স্পিডে খবর ছড়ায়।
“হ্যাঁ। ওইদিন একটু আলাপ হইছিল। আজকে লেবু আনতে গেছি, তখন বলল তার নাকি কচুর লতি খেতে ইচ্ছা করতেছে।”
মা অবাক হয়ে বলল, “তাই নাকি? ছেলেটা খেতে চাইছে তো তখন দিয়া আসতি৷ একটু বুদ্ধি হইলো না তোর!”
“আমি কেমনে দিব মা! ওদের ঘরে কোনোদিন ঢুকছি? কেমন লাগে না?”
“একঘরে হয়ে থাকলে তো কেমন লাগবেই। এখন নিয়ে যা। সাথে ভর্তাও নিয়ে যা।”
“ভর্তা বানাইলা কখন?”
“তুই আজকে কোন ধান্দায় আছিস? তোর সামনেই তো সব করতেছি।”
আমি ঢোক গিললাম। আল্লাহ বাঁচাও। মা কি কিছু সন্দেহ করছে? নাকি আমারই চোরের মন পুলিশ পুলিশ করছে?
দুটো বাটি নিয়ে পা বাড়ালাম সোহানদের অংশে৷ একটাতে লতি, অন্যটাতে তিন রকমের ভর্তা। শুটকি, ধনেপাতা আর কালিজিরা।
প্রথমদিন এদিকটাতে এসেছিলাম, আর আসা হয়নি। বাইরের বাতাসটা বড্ড ঠান্ডা! নিঃশ্বাসের সাথে ধোঁয়া বের হচ্ছে। বাতাসে কোন ফুলের যেন কড়া ঘ্রাণ আসছে। ওদের বাড়িটার সামনে মাঝারি পাওয়ারের হলদে বাতি জ্বলছে। এই আলো শীতটা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাতাসোর ঝাপটায় নারকেল গাছের পাতা দুলিয়ে দিয়ে গেল শব্দ করে। আমাকে সাথে বলে গেল, “যাও ভেতরে শিফা। ওই মানুষটাও তোমার কথাই ভাবছে। এখন তোমাকে দেখলে খুব চমকে যাবে। ভাববে তুমি তার টেলিপ্যাথির জোরে এসেছ। আসলেই হয়তো ব্যাপারটা তাই-ই!”
আমি উল্টো জবাব দিলাম, “ওই হতচ্ছাড়া আমাকে দুপুরে হনুমান বলেছে৷ আবার ভাববে আমার কথা? আমিই পাগল, ওর কথা ভেবে সময় নষ্ট করছি। আবার এত অপমানের পরেও ওর জন্য খাবার নিয়ে যাচ্ছি৷ আমারই মাথার তার ছেঁড়া।”
বাতাস আরেক ঝাপটা দিয়ে খিলখিল করে হেসে বলে গেল, “তার ছেঁড়া না। একটু একটু করে ছিঁড়ছে।”
আমার মনে ভয় ঢুকে গেল। আসলেই তার ছিঁড়ছে। কিন্তু সেটা হতে দেয়া যাবে না। এমনি ঝামেলায় আছি, আরও নতুন ঝামেলা ডেকে আনলে রক্ষা থাকবে না।
হঠাৎ খট করে দরজা খুলে গেল। বাড়িওয়ালা মহিলাটা অবাক হয়ে বলল, “এমা তুমি! দাঁড়িয়ে আছ বেল বাজাওনি কেন?”
(চলবে)