ফিঙের_ডানা পর্ব- ৩

#ফিঙের_ডানা
পর্ব- ৩

বাড়িওয়ালাদের বাড়ির সদস্য চারজন। ভদ্রলোকের নাম রোকনুজ্জামান, তার স্ত্রী তান্নি, ছেলে রিশান আর তান্নির ভাই সোহান। আরেকজন সদস্য আসছে। শুনেছি এই অংশটা পরে করা হয়েছে। আগে শুধু ভাড়া অংশটুকু ছিল। রোকন সাহেবের বাবা মারা যাওয়ার পর ভাইরা সব আলাদা হয়ে যায়। রোকন সাহেবের ভাগে এই জায়গা পড়েছে। তিনি নিজের মতো বাড়ি করে নিয়েছেন।

তান্নি আপু আমাকে নিয়ে ড্রইং রুমে বসাল। ভর্তাগুলো রেখে এসেছে রান্নাঘরে৷ আমার হাত ধরে বলল, “জানো, আমার কী পারিমানে ইচ্ছে করে ভর্তা খেতে? কিন্তু নিজে করে নিতে পারি না। বেশিরভাগ সময় থাকি অসুস্থ। এবারের প্রেগন্যান্সি এত যন্ত্রণা দিচ্ছে কী বলব! তোমায় যে কী বলে ধন্যবাদ দেই। কী নাম তোমার? একবার দেখা হলো, কথাও হয়নি।”

“শিফা।”

“ভারি সুন্দর নাম তো!”

আমি একটু হাসলাম। তান্নি আপা বলল, “দাঁড়াও আসছি।”

দু’মিনিট পর ফিরল পিরিচে দুটো মিষ্টি নিয়ে। মিষ্টি আমার কী যে প্রিয়! কতদিন খাই না হিসেব নেই। এমনিতে তো মিষ্টি কেনা হয়ে ওঠে না। আগে বাড়িতে মেহমান এলে মিষ্টি আনত, খাওয়া হত। বাবা মারা যাওয়ার পর কেন যেন মেহমানদের আনা মিষ্টিও নিজে থেকে খেতে সংকোচ হতো। কেউ বলতোও না। খাওয়ার প্রচন্ড ইচ্ছে নিয়েও ভদ্রতা করে বললাম, “এগুলো আনতে গেলেন কেন? আমি এখুনি গিয়ে ভাত খাব।”

“তো কী হয়েছে? দুটো তো মাত্র। খাও!”

আমি পিরিচ হাতে নিলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাকের বাসাকে খুঁজে পেলাম না৷ নেই নাকি? একবার এসে দেখতে তো পারে কে এসেছে! অবশ্য আমি বেল বাজাইনি। সে কেমন করে জানবে কেউ এসেছে? মিষ্টি শেষ করে আরেকটু তান্নি আপুর গল্প শুনলাম। আমি নিজে কথা বলতে পারি না খুব একটা। তবে শ্রোতা হিসেবে মনোযোগী। আপু বলল, “মাঝে মাঝে এসো শিফা। তোমাকে খুব পছন্দ হয়েছে আমার। এবাড়ির কারো সাথে তেমন খাতির নেই। কেউ এদিকে আসে না বড় একটা৷ তুমি এসো সময় পেলে।”

আমি উঠলাম৷ বের হয়ে যেতে যেতে মনটা খারাপ লাগতে শুরু করল। একটাবার দেখা হতে পারত! হুট করে কথাটা মনে পড়তে বললাম, “আচ্ছা আপু আপনার গল্পের বই আছে? পড়তে ভালোবাসি, কিন্তু বই নেই আমার।”

“আমি তো পড়ি না, আমার ভাই খুব পড়ে। বই কিনে পাহাড় বানিয়ে ফেলেছে৷ চলো ওর কাছে যাই।”

“উনি কি বই দেবেন?”

“দেবে না মানে! যখন ইচ্ছে হবে আসবে, পছন্দ করে নিয়ে যাবে। সোহানের অত খুঁতখুঁতি নেই। আর তুমি তো বাড়িরই মেয়ে।”

সোহানের ঘরটা ওপরে। এই বাড়িটা মূলত দেড়তলা। নিচ তলাতেই সব, ওপরতলার অর্ধেকটাতে তিনটা ঘর তোলা। তার একটাতে সোহান আর ভাগ্নে রিশান থাকে। আমরা গিয়ে দেখি সোহান টেবিলে বসে পড়ছে। আর রিশান তার কাঁধে বসে চুলগুলো দুই হাতে খাঁমচে ধরে রেখেছে। সোহানের তাতে কোনোই অসুবিধা হচ্ছে না।

আমাকে দেখে সে একেবারে বেকুব হয়ে গেল। হা করে তাকিয়ে রইল। তান্নি আপু বলল, “ও হচ্ছে শিফা। নতুন ভাড়া এসেছে। খুব লক্ষী মেয়ে। তোর থেকে কয়েকটা বই ধার দে তো৷ পড়বে।”

সোহান কাঁধ ঝাঁকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “কী বই নেবে নিয়ে যাও।”

বইয়ের স্তুপ দেখে আমার ভিড়মি খাওয়ার জোগাড়। বুকশেলফের তাক সব ভরে গেছে কবেই! তারপর বাকি বইগুলো মেঝেতে রেখে দিয়েছে। কতগুলো বইয়ের টাওয়ার হয়েছে ইয়া বড় বড়৷

তান্নি আপু সোহানকে বলল, “জানিস ও ভর্তা আর কচুর লতি নিয়ে এসেছে। আজকে রাতে মজা করে খাওয়া হবে। তুইও তো পছন্দ করিস।”

সোহান বিষ্ময়ে ভুরু কপালে তুলল।

আমি খু্ঁজে খুঁজে হুমায়ূন আহমেদের ‘অপেক্ষা’ আর রবীন্দ্রনাথের ‘যোগাযোগ’ নিলাম।

রিশান এসে আমার হাত ধরে বলল, “এই তুমি আমার কী হও?”

সোহান বিড়বিড় করে বলল, “মামী বল।” একদম অস্পষ্টভাবে বললেও আমি ঠিক শুনতে পেলাম। চমকে তাকিয়ে দেখি তান্নি আপু চলে গেছে৷ আর পিচ্চিটা বুঝতে পারেনি। আমিও না বোঝার ভান করে বললাম, “আমি তোমার আন্টি।”

পিচ্চিটা বদের হাড্ডি। বোধহয় মামার মতোই হয়েছে। ফিক করে হেসে বলল, “আন্টিরা হয় বড়, মোটা। তুমি তো ছোট্ট।”

“তাহলে আপু বলো।”

“না আমি তোমাকে নাম ধরে ডাকি? দেখো আরেকটু লম্বা হলেই আমি তোমার সমান হব।”

আমি মেনে নিলাম, “আচ্ছা নাম ধরেই ডেকো।”

আমি মানলেও কাকের বাসাটা মানল না। বলল, “বড়দের নাম ধরে ডাকবি? কান লাল বানিয়ে দেব।”

“আমাকে ধরতে পারলে তো!” বলেই দে ছুট।

ঘরে আমি আর সোহান একা। সে মিটমিটি হেসে বলল, “আমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছ? থ্যাঙ্ক ইউ!”

“আপনার জন্য আনিনি। তান্নি আপুর জন্য এনেছি।”

“আমি তাহলে খাব না?”

“খাবেন না কেন?”

কাকের বাসা উত্তর না দিয়ে মনোযোগ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বিব্রত হয়ে বললাম, “কী হয়েছে?”

“তোমার চুলগুলো এভাবেই সুন্দর লাগে৷ উঁচু করে বেঁধে। বেনী করলে বেশি বাচ্চা দেখায়৷ ছবিতে চুলের স্টাইল বদলে দেব ভাবছি।”

আমি সুযোগ পেয়ে বলে বসলাম, “আমার ছবি আমাকে দিয়ে দিন।”

সোহান অবাক হয়ে বলল, “আহ! তোমাকে দেব বলে এঁকেছি মনে হয়!”

“তাহলে আঁকলেন কেন?”

“বলব না।”

“আমি তান্নি আপুর কাছে বিচার দেব কিন্তু।”

“আচ্ছা? দাও৷ তারপর আমি যে উত্তর দেব তাতে লুকানোর জায়গা খুঁজে পাবে না৷ মনে রেখো। শুধু আপু না, যদি কেউ ঘূর্ণাক্ষরেও জানে, খবর করে দেব তোমার!”

“গুন্ডা কোথাকার!” বলেই তাড়াতাড়ি চলে এলাম৷ কখন কী বলে ফেলে ঠিক নেই৷ কী ভেবেছে? আমি সত্যি বলে দেব? কী বলব? ইশ্ লজ্জা করে না?

তান্নি আপুকে বলে চলে এলাম৷ মনটা কেমন খুশি খুশি লাগছে। এমন কখনো হয়নি। জানতামই না কোনো মানুষের সাথে একটু কথা বললেও এত ভালো লাগতে পারে! আমার বান্ধবীরা অনেকেই প্রেম করত৷ আমার সেরকম অভিজ্ঞতা নেই। রাস্তার মোড়ে যে ছেলেরা ফুল, প্রেমপত্র দিত, দাঁড়িয়ে থাকত তাদের জন্য বিরক্তি ছাড়া কিছু আসেনি কখনো। সত্যি বলতে আমি কোনেদিন প্রেমেই পড়িনি। প্রেম বলতে রাত জেগে লুকিয়ে ফোনে কথা বলা আর একসাথে ফুচকা খাওয়াকেই বুঝতাম৷ ভাবতে ভাবতেই সন্দেহ হলো, আমি কি প্রেমে পড়েছি? নাকি অন্যকিছু? কাউকে বলা গেলে বেশ হতো! কিন্তু এখানে কোনো বন্ধু নেই আমার। ভালো করে কথা বলার মতোই কেউ নেই। ধুর!

রাতে মা শুয়ে পড়ার পরেও আমি অনেকক্ষণ জেগে রইলাম৷ মায়ের অগোচরে জানালাটা আলতো করে খুললাম। শীতের বাতাস ঢুকল হু হু করে। কাঁপিয়ে দিল পুরো শরীর৷ তবু জানালা বন্ধ করতে ইচ্ছে হলো না৷ বাইরে আঁধারের দাপটে কিছু দেখবার জো নেই। শুধু রাতজাগা পোকামাকড় ডাকাডাকি করছে। ঘুরেফিরে মনে পড়ছে সেই সোহানের কথা৷ কী করছে সে এখন? ঘুমাচ্ছে হয়ত। এখন সে সামনে থাকলে কী করত? মাথামুণ্ডু ছাড়া কথা বলত? আমার ভীষণ তৃষ্ণা পেল। এমন এক শীতের রাতে সোহানের সাথে বসে গল্প করার তৃষ্ণা।
(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here