ফিঙের_ডানা পর্ব-৪

ফিঙের_ডানা
পর্ব-৪

বন্ধু নিয়ে ভাবতে ভাবতে আমার সত্যি সত্যি এখানে বন্ধু হয়ে গেল। তাও একটা না, দুটো বন্ধু। একটা সাতেরো বছর বয়সী অতিরিক্ত মিষ্টি মেয়ে, আর একটা বড় বড় লোমওয়ালা বিদেশী কুকুর।

মেয়েটার সাথে পরিচয় চিনি কিনতে গিয়ে। সেদিন সকালে মা বেরিয়ে গিয়েছিল খুব ভোরে। আমি কিছুক্ষণ বিছানায় গড়াগড়ি করে উঠে পড়লাম। আগে আমার চা খাওয়ার বাতিক ছিল। মাঝে সেটা বন্ধ করে ফেলতে হয়েছিল। এবার মা প্রথম মাসের বেতন পেতেই আবদার করে বসেছি চা পাতা, গুড়োদুধ এনে দিতে। এখন জমিয়ে চা খাওয়া হয়। সকাল দুপুর বিকেল যখন মন চায়। চা বসিয়ে খেয়াল হলো চিনি নেই। কৌটায় অল্প একটু জমে আছে। সেটুকু দিয়ে মিষ্টির না হয়ে অমিষ্টি হবে। অমিষ্টি আমার বানানো শব্দ। মিষ্টি খাবারে চিনি কম হলে বলি অমিষ্টি। যাহোক, আমার মাথায় এখন চা খাওয়ার ভূত চেপে বসেছে। পাশের ঘর থেকে চেয়ে আনা যায়, তবে কিছু চাওয়ার ধাঁত নেই আমার। মাথায় ভালো করে ওড়না মুড়ে গায়ে শাল জড়িয়ে বের হলাম দোকানের উদ্দেশ্যে। আমাদের বাসা থেকে বের হয়ে বড় রাস্তাটা পার হলেই দোকান। কিন্তু এত সকালে দোকানপাট খোলেনি। খুঁজতে খুঁজতে কিছুদূর গিয়ে তবে এক মুদি দোকানের দেখা। মাত্র খুলেছে৷ গিয়ে চিনি চাইতেই দোকানি হেসে বলল, “ভালো হলো। মিষ্টি দিয়ে বউনি হলো।”

আমিও খুশিমনে চিনি নিয়ে ফিরছি। সে সময় হঠাৎ কুয়াশা ফুঁড়ে উদয় হলো এক মেয়ে। এলোমেলো সাইকেল চালিয়ে সোজা সেটা উঠিয়ে দিল আমার গায়ে৷ দুজনেই পড়ে গেলাম৷ ভাগ্য ভালো সামান্য ছড়ে যাওয়া ছাড়া কারও কিছু হলো না।

আমি খুবই বিরক্ত একটা চাউনি দিলাম। কিছু বলতেই ইচ্ছে করছে না। চিনির প্যাকেট পড়েছে, তবে চিনি পড়ে যায়নি দেখে একটু স্বস্তি হলো। মেয়েটা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, “সরি। আমি নতুন নতুন সাইকেল চালানো শিখছি তো, সারাদিন চালাতে ইচ্ছে করে। তোমাকে কুয়াশার মধ্যে ঠিকমতো দেখতে পাইনি।”

আমি মাথা সামান্য হেলিয়ে নিজের পথে রওনা দিলাম। মেয়েটার ওপর বিরক্তি যায়নি। কিন্তু সে আমার একটা হাত টেনে ধরে বলল, “আমি সরি তো!”

হঠাৎ মনটা ভালো হয়ে গেল৷ কী আদুরে মেয়ে রে বাবা! মনে হচ্ছে আমার কতদিনের আপন! অভিমান হয়েছে বলে মানিয়ে নিচ্ছে। আমি হেসে বললাম, “ঠিক আছে।”

মেয়েটার মুখটা উজ্জ্বল হলো৷ বলল, “কী নাম তোমার? দেখিনি তো কখনো।”

নাম বললাম। ও বলল, “আমি লিলি৷ তুমি কি এখানে নতুন এসেছ?”

“হ্যাঁ।” বলে বাড়ির অবস্থানটা বুঝিয়ে দিলাম। লিলি মাথা ঝাকিয়ে বলল, “চিনেছি। আমাদের বাড়ি এখানেই। এসো যাবে।”

আমি কেন যেন না করতে পারলাম না। চললাম ওদের বাড়ি। বাড়িটার প্রথম দর্শনেই বলতে ইচ্ছে করে, “ওমা! কী সুন্দর!”

দুটো দালান। একটা উত্তরমুখী, অপরটা পশ্চিমমুখী। উত্তরমুখী বাড়িটা দোতলা, পুরোটা লাল ইটের। পশ্চিমমুখী বাড়িটার ছাদ টিনের। সম্ভবত দোচালা বলে এটাকে৷ বাড়ির উঠোনে এঁকেবেঁকে উঠে যাওয়া পেয়ারা গাছ। এছাড়া আরও অনেক গাছ বাড়িটাকে ঘিরে রেখেছে৷ মাত্র ওঠা সকালের রোদ সেই গাছের পাতার ফাঁকফোকর দিয়ে উঠোনে গাড়িয়ে পড়ছে। কোথায় যেন টুই টুই করে একটা পাখি ডাকছে। একটা শান্তি শান্তি ভাব আছে পুরো বাড়িতে। কিন্তু মানুষজন দেখতে পেলাম না। লিলি সাইকেলটা পেয়ারা গাছে ঠেস দিয়ে রেখে আমার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে গেল। ভেতরে অনেকের দেখা পেলাম৷ ওর মা, ছোট ভাই, দাদী, বড় আপু আর মিলি খালা। সবাইকে বড় আপন মনে হলো। এত দ্রুত কাউকে নিজের মানুষ করে নেওয়া যায় ওদের না দেখতে জানতেই পারতাম না। মিলি খালার সাথে সবচেয়ে বেশি ভাব হয়ে গেল। খালা ওদের বাড়িতেই থাকে। বয়স বেশি না, চব্বিশ-পঁচিশ হবে। পড়ে ইউনিভার্সিটিতে। বিয়ে হবে হবে ভাব। কী যে সুন্দর করে কথা বলে! শুধু শুনতেই ইচ্ছে করে। ওদের বাড়িতে আবার পিঠেও হয়েছে সেদিন৷ পেটভরে দুধপুলি আর নারকেলের বরফি খেয়ে তবেই ফিরলাম। সাথে নিয়ে এলাম অনেকগুলো ভালোবাসা আর লিলির বন্ধুত্ব।

আরেক বন্ধু হলো কুকুর। কুকুরটার নাম দিয়েছি তুসু। তুসুর মালিক ছিল আমাদের ঠিক পাশের বাড়ির বুড়ো ভদ্রলোক। কোন দেশী কুকুর কে জানে! বাদামী লোমওয়ালা ভারি সুন্দর আমার তুসু। বুড়ো লোকটা এক সকালে হঠাৎ স্ট্রোক করে মরে গেল। তার আবার কেউ ছিল না। ছেলেরা সব প্রবাসী। লোকটার সৎকার তো হলো, কিন্তু তুসুর কেউ রইল না। আমিই কান্নাকাটি করে মাকে বলে ওকে নিয়ে এলাম। অবশ্য বাড়ির সবার মতামত নিয়েই এনেছি। কারো কোনো সমস্যা নেই। শুধু ওই কাকের বাসা, মানে সোহান নাক কুঁচকে বলেছে, “এই কুকুর যদি আমার ধারেকাছেও আসে, ওর লোম সব কেটে দেব।”

আমি তাকে ভেঙচি কেটে চলে এসেছি। আবার ভয়ও হচ্ছে, সত্যি লোম কাটলে তুসুকে কী বাজেই না দেখা যাবে!

আগের মালিক তুসুকে ডাকত টমি। এই বিদেশী নাম আমার মোটেও পছন্দ নয়। এজন্যই পাল্টে দিয়েছি। তুসুকে কত গল্প বলি আমি! আমার সবচেয়ে গোপন গল্প, সোহানের কথাও ওকে বলেছি। লিলিকে এখনো বলিনি সেকথা। কেমন যেন লজ্জা লজ্জা লাগে।

তুসুর সাথে কথা বলতে দেখলেই সোহানের গা জ্বলে যায়। আমাকে এটা সেটা বলে খুব ক্ষ্যাপায়! একদিন বলল আমার নাকি পাগলাগারদে যাওয়ার শখ হয়েছে। সারাদিন কুকুরের সাথে কথা বলা সুস্থ মানুষের লক্ষণ নয়।

একদিন সারা এলাকায় মাইকিং হলো, সিনেমা হলের মাঠে নাকি বইমেলা হবে। এদিকে আমাদের বাসা থেকে বেশ খানিকটা দূরে বড় একটা সিনেমা হল আছে। হলের পেছনেই বিশাল মাঠ। একদিন গিয়েছিলাম লিলির সাথে। মেলা শুনে আমি তো খুব খুশি। লিলিকে বলে রাখলাম যাওয়ার কথা। মাকে পটিয়ে পাঁচশ টাকাও জোগাড় করে ফেললাম বই কেনার জন্য। কিন্তু যাওয়ার দিন হঠাৎ লিলির খুব পেট ব্যথা। সে কিছুতেই উঠতে পারছে না। ভারি মন খারাপ করে ফিরলাম বাসায়। গেট দিয়ে ঢুকতেই কাকের বাসার সাথে দেখা। ভুরু দুটো তুলে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

বললাম তাকে। সে বলল, “আমার সাথে যাবে?”

ইচ্ছে হলো চেঁচিয়ে বলি, “একশবার যাব।”

কিন্তু মুখে একটু চিন্তার ভাব এনে বললাম, “আপনি যাবেন?”

“এই মেলায় আমার চয়েজের কিছু পাওয়ার সম্ভাবনা কম। তাও গিয়ে দেখব ভাবছি। চাইলে যেতে পারো।”

আমি টুপ করে দেখে নিলাম আশেপাশে কেউ আছে কি না। নেই দেখে তাড়াতাড়ি বের হলাম গেটের বাইরে। বললাম, “চলুন।”

হাঁটতে শুরু করলাম আমরা। মেলায় গিয়ে দেখি ভিড় ভালোই। ঘুরে ঘুরে দুটো বই কিনে ফেললাম আমি। সোহান কিনল তিনটা। সে আমাকে ফুচকা আর কদবেল ভর্তা খাওয়াল। ফেরার সময় আর হাঁটতেই পারছি না। আমার অবস্থা দেখে সোহান বলল, “বাড়ি তো দূর আছে। রিকশায় যাই চলো।”

রিকশার দিকে তাকিয়ে যে কথাটা প্রথম মনে হলো, সেটা মুখ ফসকে বলেই ফেললাম, “রিকশাগুলো একদম ছোট।”

সোহান আমার মনের কথা বুঝে এদিক ওদিক কী খুঁজতে শুরু করল। মিনিট দুই খোঁজাখুঁজির পর তুলনামূলক বড় একটা রিকশা নিয়ে বলল, “এটা চলবে? ওঠো!”
বলে নিজে উঠে তার পাশটা দেখিয়ে দিল। অগত্যা উঠে বসলাম। যথাসম্ভব চেপে বসেছি। তবুও উঁচুনিচু রাস্তায় রিকশা এদিক ওদিক হলেই হাতের সাথে হাত লেগে যাচ্ছে। একবার সোহানের দিকে তাকিয়ে দেখি সে অন্যদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে। খুব মজা পাচ্ছে!

রিকশা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে আমাকে দাঁড়াতে বলে কোথায় যেন গেল। পাঁচ মিনিট পর ফিরল। হাতের একটা ব্যাগ আমাকে দিয়ে বলল, “তোমার জন্য।”

“এটা আমার জন্য কিনেছেন আপনি?”

“হ্যাঁ। ঘরে গিয়ে খুলবে।”

আমার ভীষণ খুশি লাগল। ইচ্ছে হলো কাকের বাসাকে জাপটে ধরে বলি, থ্যাংক ইউ। কিন্তু অতটা দুর্মতি এখনো হয়নি। শুধু শুকনো ধন্যবাদ দিয়ে ঘরে ফিরলাম।

সোহানের দেয়া বইটা খুলে আমার মুখটা বিশাল হা হয়ে গেল। দারুণ লজ্জায় ঠাস করে বইটা বন্ধ করে লুকিয়ে ফেললাম বিছানার নিচে। কেউ দেখলে আর বাঁচার উপায় থাকবে না। ইচ্ছে হলো নিজেও লুকিয়ে পড়ি কোথাও। দুষ্টু ছেলেটা প্রথম পাতায় লিখে রেখেছে, “বিয়ের পর আমরা ছোট ছোট রিকশায় উঠব। কেমন?”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here