#যদি_বলি_ভালোবাসি♥
#PART_17
#FABIYAH_MOMO
মুগ্ধ আমাকে নিয়ে উনার বাসার দরজায় নক করলেন। মেইন দরজা যেহেতু খোলাই থাকে তাই উনি একটু দৃষ্টি আর্কষনের জন্য দরজায় তিনটা ‘ঠক ঠক’ করলেন। ঠকঠক নকের আওয়াজে রাফিয়া চলে আসলো, সাথে আসলো আঙ্কেল, আন্টি আর ওই রাফিন। মুগ্ধের জ্বর আবার বেড়ে চলছে, উনি তবুও আমার কাধে হাত রেখে আগলে ধরে আছেন। আমার মাথাটাও ঘুরছে, শরীরে অবসাদ কাজ করছে প্রচুর। মুগ্ধ মৃদ্যু গলায় বলে উঠলেন-
–বাবা তাড়িয়ে দিবে? চলে যেতে বললে চলে যাব সমস্যা নেই আমাদের। তাছাড়া আমার কথার মূল্য এ বাড়িতে কেউ রাখে না। থেকেও লাভ নেই। কি করবো বলো?চলে যাবো?
আঙ্কেল খুব নান্দনিক মানুষ। কিন্তু আজ উনার মুখ কালো। আমি বুঝে গিয়েছি আঙ্কেল আমার আর মুগ্ধের বিয়েতে খুশি নন। উনি জবাব না দিয়ে ভেতরে চলে গেলেন, আসন করে নিলেন সোফার রুমে। আন্টির মুখের ভাবসম্প্রসারন তেমন ভালো না। উনি মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে আমাদের ভেতরে আসতে বললেন। রাফিন পকেটে হাত ঢুকিয়ে অপ্রীতিকর চাহনিতে তাকিয়ে আছে। মুগ্ধ আমাকে প্রথমে পা রেখে ভেতরে ঢুকতে বললেন, আমি প্রবেশ করলাম। উনি আমার পাশে এসে উনার রুমের দিকে নিতে গেলে রাফিন কর্কশ গলায় বলে,
–ওখানেই দাড়া রাদিফ!এক পা ফেলবি না!
মুগ্ধ রাফিনের কথায় আমার দিকে বিনা উচ্চারণে ঠোট কাপিয়ে বললেন, ‘ভেতরে যা পাকনি আমি আসছি’। উনার চোখের দিকে তাকিয়ে ডানেবামে মাথা ফিরিয়ে ‘না’ বোধক বোঝাচ্ছি, আমি যাব না। রাফিন পকেটে হাত ঢুকিয়ে ধেয়ে আসলো মুগ্ধের দিকে। দুইভাই মুখামুখি হয়ে চোখ টু চোখ তাক করে দাড়ালো। মুগ্ধের শরীর অসুস্থজনিত কারনে রাফিনকে স্থবিরতা দেখাতে পারছেননা। রাফিন পকেট থেকে হাত বের করে মুগ্ধের গালে চড় বসিয়ে দিল। উনার পান্জবীর কলার টেনে ধরলো , উনি গলায় চাপ অনুভব করলে কাশতে শুরু করেন। রাফিয়া দৌড়ে রাফিনকে বাধা দিচ্ছে…আমি মুগ্ধের কলার ছাড়ার জন্য রাফিনের হাতে নখের প্রয়োগ চালাচ্ছি। আন্টি কেমন পুতুল সেজে উনাদের লড়াই দেখছেন। আঙ্কেল সোফায় বসে মাছের এ্যাকুরিয়ামে একধ্যানে তাকিয়ে আছেন।
–তোর পাওয়ার বেড়ে গেছে…না!বিদেশের মাটি খেয়ে চোখ উল্টে গেছে একদম! তুই এইটা ভালোভাবে জানোস আম্মু মমর সাথে আমার বিয়ে ঠিক করছে! আর তুই আমার সাথেই চেকমেট করলি! তোরে তো আমি ছাড়বো না!!
কলার টেনে উনার মুখে এক ঘুষি বসিয়ে দিলেন। ঘুষির সওগাত জোরেই ছিলো বটে। মুগ্ধ চোখ বন্ধ করে ঢোক গিললেন একটা। রাফিয়া রাফিনের কোমর ধরে আটকাতে বলে উঠলো-
–রাফিন ভাইয়া ছাড়ো…ভাইয়া তুমি রুমে যাও। তোমার মাথা ঠিক নেই ভাইয়া, রাদিফ ভাইকে মেরো না, রুমে যাও…
রাফিন হিংস্র বাঘের মতো মুগ্ধের দিকে তাকিয়ে আছেন, খুবলে খুবলে শেষ করতে পারলে রাফিনের শয়তানি কলিজায় সুখ জুটতো! দিশেহারা হয়ে যাচ্ছিলাম আমি… আমার পরিবার, উনার পরিবার কেউই রাফিনের মুখোশ লেপ্টানো খারাপ চেহারাটা দেখলো না। মুগ্ধকে রাফিনের মারপিট থেকে হেচকে টেনে রুমে এনে দরজার সিটকিনি লাগিয়ে দেই। রাফিন দরজায় হাতুড়ি পেটানোর মতো ধাক্কা দিয়ে যাচ্ছে,
–দরজা খোল কুলাঙ্গা! তোর ভিতরে যদি লাজ শরম থেকে থাকে বের হ! আমার সামনে আয়! বউয়ের আচল ধরে লুকাইছিস কেন! দরজা খোল!
আমি দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে হেচকি তুলে কাদছি। মুগ্ধ আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমার জন্য উনার সাথে অধমটা হলো…..আমার একটা প্রতিবাদে উনার পুরো পরিবার মুখ ঘুচিয়ে নিল…..উনার অসুস্থ শরীরটা কেউ দেখলো না। উনার কি ভুল ? আমায় বিয়ে করে বাড়ি তুলেছেন? আমার নাফরমানী এড়াতে পারেননি তাই বলে জ্বরের মধ্যে চড় খেলেন? সারাটা জীবন মুখে তালা লাগিয়ে আব্বু আম্মুর হাজারটা কথা শুনলাম, শেষে কিনা গলায় দড়ি পাকিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করার মতো রাফিনের সাথে বিয়ে দিতে লেগেছিলো!! কাদতে কাদতে দরজায় পিঠ ঠেকে ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ি। মনের সবযোগে কান্নার বিষাদে পড়ে যাচ্ছিলাম। আমার পরিবার আমার একটা কথা মানতো? একটাবার… শুধু একটা!! রাফিন ভালো ছেলে হলে মেনে নিতাম আব্বু ; সহ্য করতাম আমি। কিন্তু ও তো আমার জীবন নরক বানিয়ে দিতো আব্বু। ও আমাকে বিয়ে নামক নরক শিকলে বেধে দিতো।।।আজ নিজের নেওয়া একটা ডিসিশনে উনার জন্য অভিশপ্ত হয়ে উঠলো। উনার মুখটাও ম্লানে আচ্ছন্ন। হঠাৎ উনি আমার কাছে এসে অভিমুখী হয়ে বসলেন। আমার হাতদুটো ধরে ঠোট ছুয়িয়ে বললেন-
–আমি এখনো বেচে আছি পাকনি। আমি থাকতে তোর উপর কাল আসতে দিব না। আমাদের কাজে দুই পরিবারের রক্ত গরম হয়ে আছে মম, সময় দে সব ধীরেধীরে ঠান্ডা হয়ে যাবে। কাদিস না প্লিজ….
কান্নাকাটি করতে থাকলে উনি উঠে দাড়িয়ে কোলে তুলে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। অঝোরে কাদছি। উনি উনার ওয়ারড্রবের এক নং ড্রয়ার থেকে চিকিৎসা বাক্স বের করে আমার পায়ের কাছে ফ্লোরে বসলেন। বাক্স খুলে তুলো ছিড়ে আমার পায়ের কাছ থেকে শাড়ি উঠিয়ে ধরলেন…পা টা দেখা গেল ছিলে চিড়ে আছে। উনি স্যাভলন ভরিয়ে তুলোটা পায়ের তালুতে কাটা ধারালো ইটের টুকরোর জখমে আলতো আলতো করে মুছে দিচ্ছেন। হালকা হেসে বলে উঠলেন-
–আমাদের বিয়েটা যা হয়েছে না!! মাই গড! এই শুনতো, আমাদের নাতি নাতনীদের খুব স্পাইসি লাগিয়ে বিয়ের ঘটনা শুনাবো, ওকে?? প্লিজ তুই ত্যাড়ামি করিস না!! আমার নাতিনাতনীদের যত্ন করে কোলে বসিয়ে চশমা এটে শুরু করবো গল্পের আসর। সাবজেক্ট কি থাকবে জানিস??? “মমমুগ্ধের বিয়ে ইন্সিডেন্স” !!
ঘন্টা দুই আগে বিয়ে হলো, পরবর্তী দুই ঘন্টা বাচি না মরি উনি নাতি নাতনীদের বিয়ের ঘটনা শোনাবেন….আজব!!! উনি আমাকে হাসানোর জন্য কথাগুলো বলছেন, যে জায়গায় উনার মনের অবস্থা করুণাপূর্ণ। শেষ খন্ডটা দিয়ে পায়ের তালু পুরো মুছে ফ্লোরে সব তুলো জড় করে রাখলেন। শান্ত গলায় ব্যান্ডেজের দিকে মনোবল রেখে বলে উঠলেন-
–মম, বাবা- মা যদি তাড়িয়ে দেন, তুই টেনশন নিবি না। আমি হোটেল বা ফ্ল্যাটের ব্যবস্থা করছি। একসাথেই থাকব। তোকে নিয়েই থাকব। আমি হসপিটালের কাজে বিজি থাকবো, তুই তোর ইন্জিনিয়ারিং পড়াশোনায়। বেবী প্ল্যান তোর ইন্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে যাওয়ার পর ভাববো, আগে না।
পায়ে জীবাণুমুক্ত করা শেষ। উনি সবকিছু বাক্সে ভরে ওয়ারড্রবে রেখে দিলেন। ব্যবহার করা তুলো গুলো রুমের কোনায় ডাস্টবিনে ফেলে দিলেন। রুমের থাইগ্লাসের জানালা খুলে, পর্দা সরাতেই বলে উঠলেন-
–রুমটা তোর। দেখেশুনে রাখিস। আমি খুব পরিচ্ছন্ন বুঝলি!! নোংরা ডাস্ট দেখতে পারিনা। আচ্ছা ফ্রেশ হবি? নাহ্ ওয়েট আগে তোকে খাওয়াতে হবে। ওহ্ সিট! তুই শাড়িতে! আগে চেন্জ কর।
কান্না থামিয়ে পিটপিট করে উনার কাজ দেখছি। ফোন নিয়ে কল করলেন-
–হ্যালো, দোস্ত…নিড হ্যাল্প! আমার বাসার নিচে দুই প্যাকেট বিরিয়ানী নিয়ে আয়। নিচে এসে কল করিস, আমি নিয়ে যাব। হ্যা হ্যা সাফিন ঠিক বলেছে….হ্যা..বিয়ে করেছি। থ্যাংকস ইয়ার। আচ্ছা ঠিকঠাক মতো গ্রেন্ড ট্রিট দিব। ইয়েপ…পাওনা থাকলি। ওকে বায়।
ফোনটা টেবিলে রেখে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন-
–আমার টিশার্ট পড়ে থাকতে পারবি?
উনার টিশার্ট! উনার সাথে…! লজ্জা কি লজ্জা!! একা রুমে থাকলে চলতো কিন্তু….এইটা ঠিক উনি আমার হাসবেন্ড। হালাল মানুষ আমার। কিন্তু !!! সময় লাগবে……উনি আমার ইতস্তত ভাব দেখে হুহা করে হাসতে লাগলেন। হাসতে হাসতে বলে উঠলেন-
–বিয়ে করবা!!বর বানাবা!! আমার টিশার্ট পড়তেই তোমার ন্যাকামির ঝুলি শুরু!! কি বউ? এখনি এই অবস্থা!!! shame পুষে মনে রাখলে আমার আগাম সদস্য আসতে ডিফিকাল্ট হবে বুঝছো!! বোকাপাগলি! শোন আমি রাফিয়াকে বলে দিচ্ছি তোর মাপের ড্রেস দিতে। ওকে? আসছি বস।
উনি দরজা খুলে বাইরে গেলেন। রাফিন ছিলোনা…রুমের বাইরে থেকে চলে গিয়েছে। ফলে মুগ্ধের কোনো ঝামেলা পোহাতে হলোনা। বিছানাটা এখন পরিপূর্ণ। একবার বলেছিলাম, উনার বেডে সব থেকে সবকিছু বিদ্যমান, জাস্ট অনুপস্থিতির কাতারে ছিলো একটা বিয়ে করা ‘বউ’। সেটাও ফিলআপ। শৌখিন সজ্জায় উনার রুম সাজানো তার চেয়ে বেশি নজরে বাধলো রুমের পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা। কোনো রুম যত দামী জিনিসে সাজানো হোক, সেখানে যদি ‘পরিস্কার’ নামক উপকরণ দেয়া না হয় তাহলে রুম কেমন রুম রুম লাগেনা। রুমের প্রতিটা কোনায় গাছের টব রাখা, বাদামী রঙ করা কাঠের বুক শেল্ফ, চারটে পায়ে দাড় করানো একটা টেবিল বা ডেস্ক। গোল গোল করে ঘুরেঘুরে তিরিংবিরিং করে এমন একটা অফিসিয়ালি চেয়ার। কালো ধূসর রঙবিশিষ্ট চেয়ারের চামড়ায় ইটালিক বর্নে সাদা রঙে লিখা Dr. Radeef A. Mugdho . চেয়ারে ঝুলানো একটা সাদা এফ্রন, একটা আইডি কার্ড। ডেস্কের উপর ল্যাপটপ, সাদা মগ, তিনটা বড় মোটা ফাইল, দশটা বিভিন্ন কালারের কলম ঢুকানো কলমদানি। পাশাপাশি দম্ভোক্তি নিয়ে দাড়িয়ে আছে আলমারি, ওয়ারড্রব । ভাবতেই অবাক লাগছে কালও এ রুমের অংশীদারিত্ব নিয়ে পাগলামি করেছি!! আজ এ রুমটা আমার। Dr. Radeef A. Mughdho লিখা চেয়ারে এখন আমিও বসবো!! হঠাৎ রুমের দরজায় কারোর ঢোকার খটকা আসলো!
–হেই বিউটিফুল!
রাফিন দাড়িয়ে! ঝট করে দাড়িয়ে গিয়েও পায়ের ব্যান্ডেজের কারনে বিছানায় বসতে বাধ্য! মুগ্ধের জন্য দরজার চৌকঠা’র বাইরে তাকিয়ে আছি। বিছানার চাদর মুচড়ে ধরে আছি, বিপদ বারবার হানা দিচ্ছে!! রাফিন একটা ছেচড়া হাসি দিলো!
–বাইরে কি দেখছো সোনা? রাদিফের জন্য? ওহহোহো, আসবে তো। তোদের বাসর রাত!!ভালোবাসার রাত!! সেলিব্রেট করিস কিন্তু!!
আমি মনে শুধু মুগ্ধের নাম জপমালা করছি। প্লিজ মুগ্ধে চলে আসুন! আমি ঠিক নেই! প্লিজ! রাফিন আমার ব্যান্ডেজ করা পায়ে পা ছোয়াচ্ছে। আমি দূর দূর করে পা সরিয়ে নিচ্ছি। যত সরাই তত পা দিয়ে পা বুলাচ্ছে। ঘেন্না করছে আমার! ওর পায়ের ছোয়াও ওর মতো কুজাত! মুগ্ধের ভাই এতো বড় নিমোক বজ্জাত হয় কি করে আমি ভেবে কুল পাইনা! তীক্ষ্ণভাবে বলে উঠলাম-
–পা সরা রাফিন!
–নো নো নট রাফিন। আমি তোমার স্বামীর ভাই। বিগ ব্রাদার!!
–তুই আমার স্বামীর ভাই বলে তোকে ছাড় দিচ্ছিলাম! আর দিবো না বলছি! আমার মেজাজ অলরেডি বিগড়ে আছে রাফিন! পা সরা!
–পা তো আমি সরাবো না!!
–আমি কিন্তু চিৎকার করবো! মুগ্ধ আসলে তোর খবর আছে!
–চিৎকার করার সুযোগ পাবি?? রাদিফ আসার আগেই তোর সিচুয়েশন ফিনিশ!
রাফিন আর কিছু করবে মুগ্ধ রুমে ফিরে আসলেন। রাফিনকে রুমে দেখে মুগ্ধ দিব্যি তাকিয়ে আছেন। হাতে উনার খাবারের ব্যাগ, আমার জন্য আনা ড্রেস। রাফিন চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে, মুগ্ধ কৌতুহলের বশে পরিস্থিতি দেখছেন। হাতের জিনিস গুলো বিছানায় রেখে রাফিনকে বললেন-
–তুই রুম ত্যাগ কর ভাই। আমার রুমের প্রাইভেসি আছে প্লিজ!
রাফিন মুগ্ধের গাল চেপে বলে উঠলেন-
–আমি তোর আজাইরা প্রাইভেসি মানিও না! চলিও না!
রাফিন মুগ্ধের গাল থেকে হাত সরিয়ে উনার গালে তজর্নী আঙ্গুল বসিয়ে বললেন-
–থাপ্পরের কথা ভুলিস না রাদিফ! তুই ছোট…ছোটর মতো থাকবি। আমার সাথে কিরকম থাকবি মগজ ধোলাই করিস! বউ নিয়া কেমনে তুই বাসার মধ্যে থাকোস….আমিও দেখতেছি!সকাল হোক!
-চলবে
-Fabiyah_Momo
#বি_দ্র: গল্পের সতেরতম পর্ব এসে জানতে পারি আপনারা নায়িকার নাম ‘মোম’, ‘মুমু’ উচ্চারণ করছেন🙃। এটা মম(Momo), আমার নামেই লিখা😅। ধন্যবাদ 💐