#যদি_বলি_ভালোবাসি ♥
#PART_25
#FABIYAH_MOMO🍁
রাতে আশ্চর্যজনক এক কাজ ঘটলো! আমি চলে গিয়েছিলাম বেকায়দায়। মা(আন্টি) এসে বললেন-
–টুকটুকি তুমি আর রাদিফ আলাদা থাকলে সমস্যা হবে গো? রাদিফ ওর খালাতো-মামাতো ভাইদের সাথে শুলে আপত্তি হবে?
–না মা, সমস্যা কেন? বিয়ের তাগিদে উনারা সবাই একত্র হয়েছে থাকুক একসঙ্গে। আমার সমস্যা নেই। আমি রাফিয়ার সাথে ঘুমাতে পারব।
–বেশ, আমি রাদিফকে বলে দিচ্ছি!!
আন্টি চলে গেলেন কাজে, আমি লাগেজের ব্যাগ নিয়ে রাফিয়ার রুমে যাচ্ছি। বাড়ি জমজমাট। বিয়ে বিয়ে ভাব জমেছে। নিজের বিয়ে নিয়ে আমার খুব শখ ছিলো, স্বপ্ন ছিলো, রাত-দিন গালে হাত দিয়ে ভাবনায় ডুবে থাকতাম। রাফিনের জন্য আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দরময় বিশেষ দিনগুলোকে হারিয়ে ফেলেছি। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম, সবার জীবনে সুখ ডেকে আসলেও হয়তো সুখ ছোয়া হয়না। রাফিয়া গ্রিল ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে, আমি ব্যাগটা টেবিলের পাশে রেখে ওর কাছে যাই। কাধে রাখতেই ও বিদুৎপৃষ্ঠের মতো চমকে উঠলো। যেন ভয় পেল।
–রাফিয়া তুমি ঠিক আছো? আমায় দেখে ভয় পেলে কেন?
–কিছু না মম আপু….সরি মম ভাবী। আমি একা ছিলাম তো, কখন আপনি ঢুকেছেন খেয়াল করিনি।
–সমস্যা নেই রাফিয়া। তোমার সাথে ঘুমাবো বলে চলে আসলাম তোমার রুমে। তোমার ভাইয়া উনার ভাইদের সাথে সময় কাটাবেন। আমার ওখানে কি কাজ? তাই চলে এলাম এখানে। তোমার প্রবলেম হলে বলে দিও…কেমন?
–ভাবী প্রবলেমের কথা বলে লজ্জা দিচ্ছেন!! আমার কোনো প্রবলেম নেই।
আমি লাগেজ খুলে তোয়ালে বের করছি, মুখহাত ধুয়ে ফ্রেশ হবো বলে। রাফিয়া অন্যমনষ্ক হয়ে চিন্তিত আছে, হাতে হাত ডলে উষ্ণ সূচক করছে। আজব আজব ব্যবহার দেখছি। কিছু তো হয়েছে একটা!! ও লুকোচ্ছে কিছু!! একটা ধমকের সুরে গলা ছাড়লাম, যদি ভয় পায় তাহলে নিশ্চিত কিছু লুকাচ্ছে।
–রাফিয়া !
আবারও ভয় পেলো!নিশ্চিত আমি!
–ভাবী ডাকলেন? চেচালেন যে?
–তোমার কি হয়েছে বলবে রাফিয়া? আমি বাসায় আসার পর থেকে তোমার ফ্যাকাশে চেহারা দেখছি, কিছু তো লুকাচ্ছো!! কি লুকাচ্ছে বলো!
–ভাবী…..
–থেমো না রাফিয়া! আমার চিন্তা হচ্ছে। বলো !
তোয়ালে নিতে নিচে বসেছিলাম আমি, রাফিয়া আমার তোয়ালে নিয়ে হাত ধরে বিছানায় বসালো। তোয়ালে পাশে রাখলো, আমার হাতদুটি ধরলো।
–ভাবী তুমি খুব বুদ্ধিমান, শক্ত মনের তেজী মানুষ। তুমি যে জিনিসে হাত দাও, তোমার নাম তাতে থাকবেই। কিন্তু ভাবী জানো? মা রাদ…..
হঠাৎ রূপা চলে এলো, রুমের দরজা খুলে উকি মেরে একগাল হাসলো। রাফিয়া আমার হাত ছাড়লো, বিছানায় বসে বালিশ ঠিক করতে লেগে পড়লো। রূপা অনুমতি নিয়ে বলল,
–মম ভাবী আমি কি আপনার সাথে ঘুমাতে পারি? তিনজন বেডে কুলাবে? আমাদের সব মেয়ে বোনগুলো আমার রুমে গাদাগাদি করে শুয়েছে। ফ্লোরে ছাড়া জায়গা নেই…
–আসো রূপা শুতে পারো। আমি তো তোমার মতো পুরোনো আচরন দেখাতেও পারিনা আবার শোধও নিতে পারিনা।
আমি খোচা দিয়ে কথা বললাম, রূপার রূপকলা দেখার জন্য। খারাপ কখনো খারাপের খারিজ করে? ইতিহাসর পাতা তো এমন কিছু বলেনা!! একমাসের ব্যবধানে এমন নাটকীয় পরিবর্তন, মানা যায় না বস! মানা যায় না! রূপা খোচা খেয়ে কিছু না বলে বায়পাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো।সবার পরিবর্তিত ব্যবহার আমি বুঝতে পারছিলাম না, মুগ্ধ কিভাবে আছেন জিজ্ঞাসের সুযোগ পাইনি। রাফিয়াও মুখে স্ট্যাপলার মেরে চুপ হয়ে গেল। খটকা মনে লাগলেও অশান্তি লাগছিলো আমার। মুগ্ধকে জানানো বোধহয় দরকার। অন্যপাশ ফিরে রাফিয়ার দিকে শুয়ে মুগ্ধকে ফোন করলাম, উনি কেটে দিলেন। আবার দিলাম, কেটেই দিচ্ছেন।চোখের পল্লব নামিয়ে ঘুমাতে নিলেই হঠাৎ দরজায় “ঠক ঠক” করে উঠলো। রূপার দিকে ঘুরে তাকাতেই ও দরজা খুলতে নেমে গেল। আধখোলা দরজার চিপা থেকে দেখাও যাচ্ছে না আবার রূপা পুরো দরজা খুলছেও না। শুধু শুনতে পেলাম,
–তুমি! এই রাতে তুমি এখানে কি করো? মেয়েদের রুমে তোমার কি প্রয়োজন পড়লো শুনি?
–তুই রানী? নাকি প্রেসিডেন্ট? তুই আমার কিছু? রাস্তা ছাড়! বউ ভেতরে নিয়ে যাব!
বাহ!ডাক্তার সাহেব দেখছি!! উনি কল কেটে সোজা এই রুমে এন্ট্রি!! রূপাকে হাত দিয়ে সরতে বলে রুমে ঢুকলেন উনি। আমি “মুগ্ধ! আসলেন কেন!” বলতে নিবো, উনি ঠোটে আঙ্গুল বসিয়ে চুপ করতে বলছেন। আস্তে করে বললেন- “উঠ!”, রূপা দরজা ধরে আমাদের মিয়া-বিবির রোমাঞ্চকর অবস্থা দেখছে। আমি উঠে চুলের খোপা করছি উনি বিছানায় এক হাটুতে ভর দিয়ে আমার কাছে এসে কোলে তুলে নিলেন।
–সবার সামনে কি শুরু করলেন! আমার পা নেই!
–আমার কাছে তোর চুলবাধার টাইম নেই! উঠতে বলছি তুই টাইম লাগাচ্ছিস! ইটস ডিসগাস্টিং মম !
ছাদে দাড়িয়ে আছি পাশাপাশি একসাথে ঘেষে দুইজন। উনি ফোনে কথা বলছেন, হসপিটাল ফ্যাক্ট! আর আমি? মশার কামড় খাচ্ছি। ইশশ….পায়ে মশা কামড়ে শেষ করে দিচ্ছে! উনি এখনো ফোন নিয়েই বিজি! ধ্যাত! ঘুমাবো…উনি মশার কামড় খাওয়াচ্ছেন। মেজাজ দেখিয়ে চলে আসবো ওড়নায় টান খেয়ে পা উল্টে পিছিয়ে উনার মাস্তান বডির সাথে ছোটোখাটো ধাক্কা খাই। উনি পেটে হাত দিয়ে চেপে ধরেছেন, কানে ফোন লাগিয়ে কথা!
–ওকে, ওকে, নট ফ্যাক্ট….দুতিনদিনের মধ্যেই সেরে যাবে, হুম…গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবো মেডিসিন ওটা কাজ করবে। ইয়েস ইয়েস…আরে না, আমার হসপিটালে আসা ইম্পসিবল ম্যান…বড় ভাইয়ার বিয়ে কি কাজ!!
করুন করে মাথা ঘুরিয়ে উনার দিকে তাকাই, কি সুন্দর হেসেখেলে পেচাল পারছে! আমি ঠেঙ্গা হয়ে মশার কামড়াকামড়ি খাচ্ছি!কনুই মেরে এক ঘুষি দিলাম উনার পেটে। উনি “ওউহ্” করে উঠলেন। ছেড়ে দিয়ে পেটে হাত ধরে কান থেকে ফোন সরিয়ে কোমর নুয়িয়ে ঝুকে আছেন। আমি একহাত দূরে যেয়ে দাতে দাত কটে ঘাড় বেকে ভাব নিয়ে আছি, ঠোট শক্ত করে হাত আবদ্ধ ভাজ করে বাম পায়ে উপরনিচে উঠানামা করছি। যেমনটা সিনেমায় অপেক্ষা করার দৃশ্য হিসেবে দেখানো হয়।
–তুই বড্ড পাজি হয়ে গিয়েছিস মম! ইটস টোটালি টু মাচ্! আমি ব্যাথা পেয়েছি! লুক…পেটে কনুই মেরেছিস! স্টিল পেইন করছে!
–ঠিকই আছে! পাকস্থলী নাড়িয়ে দিছি। পেটের নাড়িভুঁড়ি পেচিয়ে কাত হয়ে ভ্যা হয়ে থাকবে।। উফ শান্তি ভাই!
–ওই বদমাইশ! আমি তোর ভাই?? বর তোর ভাই হয়!!!
–রস কস ছাড়া কচু একটা! মশার চুম্মাতে পা ঝাঝড়া হয়ে যাচ্ছে আপনি ফোনে বকবক করছেন! যত্তসব ফালতু!
উনি কথাটা নিতে পারলেন না, যেন অদ্ভুত অদ্বিতীয় কোনো একটা ফাউল কথা বলে ফেলেছি আর মশাই বোকা হয়ে আছেন।
–মশা চুমা দেয়? ইউ মিন লাভ বাইট? দেখি.. দেখি স্যাম্পল দেখা তো! আমার বিষয়টা দেখা উচিত। পায়ে নাকি গালে? আমার বাইটের চেয়েও ডিপলি বাইট দিয়েছে?
উনি দুষ্টু চাপা হাসি দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে এগিয়ে আসতে নিলেন।
–খবরদার! দূরে থাকুন ! আপনার নিয়ত কাউয়া কাকের মতো কালা! কালার নাম কাউয়া! কাউয়া উইল বি শা…
–পরের ওয়ার্ড উচ্চারণ করবি! গরমে তেলে চুবিয়ে ধরবো! ল্যাংগুয়েজ দিন দিন ড্রেনে স্থান নিচ্ছে নাকি!ওয়েট…আমি কি গুন্ডা? পর মানুষ? তোর বর! হ্যান্ডসাম ফাস্ট ক্লাস হট কিলার বর!
–হেই! দূরে…দূরে…হ্যা দূরে! কচু ভেতুম খাম্বা বেটা কোথাকার! গলায় যে কামড় বসিয়েছেন এখনো দাগ যায়নি! ঘাড়ে তো এখনো ব্যথা! টর্চার করছেন আপনি! বেহুদা নিজের প্রশংসা করবেননা!
— কি করলে প্রমান পাবি আমি ডাক্তার হওয়ার আগে একটা রোমান্টিক সুইট ছেলে? হাও ক্যান আই প্রুভ মম?
–আমি আপনার পরামর্শদাতা হয়ে বসে আছি? মাসে বেতন দেন?
–কত কত…কত লাগবো! কত এমাউন্ট বসাবো? দশহাজার? পন্ঞ্চাশ হাজার? একলাখ?
–চার আনা-ও লাগবে না !
আমি মুখ ঘুরিয়ে ছাদের কিনারায় রেলিংয়ের ওখানে চলে গেলাম। উনি আমার পিছন থেকে দৌড়ে দ্রুততায় আসলেন। উনি কাধ ধরে পুরো আমায় উনার দিকে করে নিলেন, এরপর আলতো সুরে নরম কন্ঠে বলে উঠলেন,
–পায়ে পায়ে হাটবি? ছোটবেলায় খেলতি যেভাবে….”হাটি হাটি পা পা যেখানে খুশি সেখানে যা”…মনে আছে? আবিরের পর আমার সাথে পায়ের উপর পা রেখে হাটতি!!
মুচকি হাসলাম। হাসা ছাড়া উপায় ছিলো না আমার। উনি পুরোনো দিনের স্মৃতিচারন করে দিলেন, যখন আমি নতুন স্কুলে যাওয়া শিখেছিলাম। আব্বু আমাকে উনার পায়ে দাড়াতে বলে আমার দুইহাত শক্ত করে ধরে বলতেন, “আমার মা টা!! মম আজ কি খেলবে?? আব্বুর পায়ে পা রেখে গুটিগুটি করে হাটবে!!”। ক্রমে ক্রমে আবির ভাইয়ু শেষে মুগ্ধ। আব্বুকে অনেক মনে করি, স্মরন দিনে একশোবার। উনি আমাকে ভুলে গিয়েছেন। আব্বু আমাকে দেখতে চাননা। দিনে অবসর হলেই প্রতিটা স্মৃতির চাদর এসে চোখের পানিতে ভর করে। কষ্ট হয়। উনি ভাবনায় ছেদ ঘটালেন এবং ছেদরেখায় উনি আমার দিকে দুইহাত বারিয়ে বললেন,
–চল না আবারো, ছোট্ট পাকনি নিয়ে হারাবো!! আমি কি নরম হাতদুটোর ভরসাজনক আস্থা পেতে পারি? পায়ের উপর তার পা-টা নিয়ে আবারো হাটতে পারি?? প্লিজ!
উনার হাতের দুই তালুতে আমার হাত দিতেই উনি শক্তযোগে ধরে নিলেন। জুতা ছাড়া পায়ের উপর আমার পা রাখতেই উনি ঘাড় ঝুকিয়ে আমার কপালে কপাল লাগিয়ে বললেন,
–গান ধরবি? নাকি ধরবো? গলা ঠিক নেই। গান খারাপ হলে দোষারোপ করিস না..প্লিজ।
চোখ বন্ধ করে ভরসা দিলাম আপনি গান পারবেন। বাতাসের মুখরে ঠান্ডা পূর্নিমায় ঠান্ডা পরিবেশ। চাদেঁর জৌলুসে প্রকৃতি আলোকিত, ছাদের কিনারায় উনি আমি মিলিত।
“সব ভালোবাসা ছোঁয়া দিয়ে হয়না,
সব ছোয়াতে ভালোবাসা রয়না,
কিছু ছোয়া মনকে ছুয়ে যায়,
কিছু ছোয়া আধারকে,
কিছু কথা বলা হয়ে যায়,
কিছু কথা ভালাবাসাতে”🥀♥
উনার কন্ঠ, বিশিষ্ট শিল্পীর মতো না হলেও আমার জন্য উনিই সব। সব মানে সব। একটা কন্ঠ শোনার জন্য ব্যধির ব্যাকুলের মতো রূপা ঝুলে থাকে, তৃষ্ণার্ত কাকের মতো বহু মানবী, হয়তো উনি আমার বলে, সব হয়ে যাচ্ছে বিভোরী। ঠোটে একটা মিষ্টিসূচক মুচকি হাসি দিয়ে গান শুরু করলেন মুগ্ধ। রাতের আকাশে নিরিবিলি কুজনে গলা মিলাবেন উনি। একটা পলক নামছিলো না আমার, উনার মুগ্ধতায় হার মানতে হলো আবার। উনাকে চাদের ম্লানে আরো সুন্দর লাগছে….সব সৌন্দর্য কি মেয়েদের ভূষন? ছেলেদের নয়? ছেলেরাও সুন্দর হয় মিস্টার!!যার যার স্বীয় প্রিয়তমা তথা স্ত্রীর চক্ষুতারায়।
উনি আমার পন্ঞ্চাশ কেজি ভরের শরীরটা পায়ের উপর নিয়ে হাটি হাটি করছিলেন। এক পা এগিয়ে দুইহাত নিয়ে মাতিয়ে তুলছিলেন। গান ধরলেন উনি-
–“তুমি চোখের আড়াল হও
কাছে কি বা দূরে রও,
মনে রেখো আমিও ছিলাম
এ মন তোমাকে দিলাম,
এ প্রেম তোমাকে দিলাম…
বকুলের মালা শুকোবে
রেখে দিবো তার শুরভি
দিনে গিয়ে রাতে লুকোবে
ভুলো নাকো আমারই ছবি
আমি মিনতে করে গেলাম…..
. . . . . . . .
উনি গান গাচ্ছেন আমার বুকে ভয় বিরাজ শুরু করছে। অজানা ভয়, অদেখা ভয়, কিছু একটা ঘটবে। নিশ্চয়ই কিছু হবে। আমি নিজের মনকে শান্ত করতে পারছিনা, উনাকে চুপ বলতে মোটেও পারছিনা। এতো সুন্দর গলায় পরিবেশ মাফিক গান ধরেছেন কোন মুখে বলি? গান বন্ধ করতে বলাটা অপরাধপূর্ণ না হলেও আমার জন্য অপরাধবোধ কাজ করবে। উনি তো আমার জন্যই গান গাচ্ছেন, কিভাবে না করি? ভয়কে জয় করতে গিয়ে উনার হাত ছেড়ে পিঠে আকড়ে বুকে লুকিয়ে পড়ি। ভয় তো কাটবে! ভয় না যাক, মন তো ঠিক হবে! উনি গান থামিয়ে কপাল কুচকালেন বুঝি, মাথায় হাত রেখে দিয়েছেন আমার, মাথায় পরপর দুটো চুমু একে প্রশ্ন করলেন,
–রাতের বেলা ছাদে ভয় পাচ্ছিস? ভূতের ভয় তোর আছে মম? ভয়ের কোন্দলে বুকে লুকিয়ে আছিস, গান বেমানান?? আমি এক্সট্রেমলি স….
–গান ঠিকআছে, মুগ্ধ। অসম্ভব সুন্দর তাল, টান, মাধুর্যতায় গেয়েছেন। আমি কি আপনাকে ধরতে পারিনা? হুট করে ধরলে সমস্যা?
–উহু, সমস্যা ওয়ার্ড এপ্লায় করবিনা। আমরা একসাথে থাকলে সমস্যা ওয়ার্ডকে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিবি। পচা শব্দ। তুই ভয় পেয়েছিস পাকনি, কেন পেয়েছিস??
ভয়ের কারন কি বলবো? যে ভয়কে আমি দেখতেই পারছিনা, কোন কুলে বসে আছে, জানিও না। কিভাবে সেটার কারন ঠাওরাবো?ঘুরিয়ে দিলাম কথা, পাল্টিয়ে দিলাম প্রসঙ্গ,
— কখনো ভুল বোঝাবুঝি চলবে? জোর খাটানো সম্পর্ক? আমাদের কিন্তু বাসর হয়নি মুগ্ধ।
উনি হাসলেন, মাথার চুলগুলোকে মুঠো করে বেনি গেথে দিচ্ছেন। আমি চোখের দৃষ্টিতে পরোখ না করলেও ঠিক বুঝতে পারছি উনি চুলের গোজামিল সঠিক করে দিচ্ছেন। নেশা লাগানো ঘোর কন্ঠে বলে উঠলেন উনি-
–গাছে প্রতিদিন নিয়মকরে পানি দেওয়া লাগে মম পাকনি। গাছকে পরিচর্যা না করে যত্ন না করলে ফল পাবার আশা কখনোই করা উচিত না, ওটা গাধামি ছাড়া কিছুই ব্যাখ্যা পাবেনা। আমি সম্পর্ক চাই, শারীরিক না। চাহিদা দুইপ্রকার হলে, দুইজন মানুষের চাহিদাখাত বহু লভ্যাংশে বাড়বে এটা এবসোলেটলি কারেক্ট।যেদিন মনে হবে ভালোবাসার পরিমার্জন বেশিটা দরকার আমি পূরন করবো। আপাততঃ গাছকে যত্ন করতে দে, সম্পর্ক মজবুত বানাতে হেল্প কর।ভালোবাসি আমি মম, তোর মনকে নিয়ে ভালোবাসি। তোকে পাশে নিয়ে ভালোবাসি, বাসরের নামে ভালোবাসার পরীক্ষায় আমি যেতে চাইনা,প্লিজ। তোকে চাই। তুই আবেগী হতে পারিস, আমি তো ম্যাচিউর। ভুল করলে আমি তো আছি, ভয় কিসের?
উনার কথাগুলো খুব করে আপন ঠেকছিলো। কেননা মনের ভেতর ভয়ের উজাড় পালতুলে মেলেছে। চাপা আন্দোলিত ঢেউয়ের ন্যায় উত্থাল-পাতাল ভয়। কিছু একটা ঘটে যাবে, তা চিন্তা করেই আমার গলা বেয়ে গলাধঃকরন হবে ভয়!! ব্যবস্থা থাকলে গলাধঃকরন-ই করতাম। ওই রাস্তা নেই, বন্ধ।
.
.
সকালে উঠে কাজে এতোটাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছি নিজের দিকে তাকাবার সময় নেই, খাবার গিলার সময় নেই। নেই মানে নেই, ঘড়ির কাটার মতো চলনশীল আমি। একটার পর একটা কাজের বাহানায় ছুটাছুটি, হুড়োহুড়ি করছি। রূপা, রাফিয়া,ইপসিতা(মুগ্ধের মামাতো ছোট বোন), কনিকা(ছোট খালাতো বোন), উনার সব ভাইরা একে-দুকে কাজ নিয়ে টলেটলে আছে। মুগ্ধ হল বুকিং, বুফে মেন্যূ, কার্ড ছাপানো সহ বিভিন্ন কাজে ন্যস্ত…বড় ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা আছে একটা। বাবা রাতের ফ্লাইটে দেশে ফিরবেন, আমাদের নতুন বাসায় আসার পর পরই বাবা ব্যবসায়িক কাজে বিদেশে গিয়েছিলেন, আজ ফিরবেন। রান্নাঘরে কাজের ডাক পড়লো আমার, ছুটে গেলাম ডাকের সাড়া দিতে রূপার। শাড়ি পড়েছি, এমনেই হাটতে কষ্ট হচ্ছে, হোচট খাচ্ছি মাঝেমাঝে। রান্নাঘরে ফুপি, রূপা, মা সহ কতক তিনজন কাজের মহিলা ছিলো। ফুপি উনাদের বাইরে পাঠিয়ে আমাকে বললেন,
–মম মা, ব্লেন্ডার খারাপ হয়েছে গেছে, সচলই হচ্ছে না। তুমি তোমার শ্বাশুড়ী মায়ের মসলা গুড়োয় সাহায্য করবে?
–কেন না!! অবশ্যই করবো ফুফি। আপনি দেখিয়ে দিন কোন কোন মসলা পিষে গুড়ো করবো!!
ফুপি আমার দিকে না তাকিয়ে তাকালেন রূপার দিকে । মা অন্য চাহনিতে তাকালেন, আমি বুঝলাম না। মা বললেন,
–টুকটুকি গো…তোমার হাতে যন্ত্রণা করবে তো।। তুমি ছাড়ো এসব। আমি পিড়িতে বসে পাটায় নিয়ে মসলা পিষতে পারবো!! কোমর একটু ব্যাথা করবে, তোমার শ্বশুর বাবাজি একটু বকবে… এই। আমি করছি।
–নাহ্…মা। আমি থাকতে কেন করবেন?আপনার হাড়ে ব্যাথা করবে, আপনি শুয়ে থাকুন। আমি আছি তো!! আমি করবো!!
কেন জানি মনে হলো ফুপি ও রূপা এটাই অধীর হয়ে চাচ্ছিলেন। মা-কে বিয়ের ফুল দেখতে বলে দিলেন ফুপি। রূপা একটা ছুড়ি নিয়ে বাচ্চাদের খেলার মতো ঘুরপেঁচ করছিলো। আমি ফুপির কথা শুনতে মনোযোগ দিয়েছি,
–এক কেজি আদা, এক কেজি রসুন, এক কেজি কাচা মরিচ, দেড় কেজি শুকনো লাল মরিচ পাটায় পিষে গুড়ো করে দিও, রান্নায় যে কত কত পরিমান লাগে…বাপু! বাবূর্চি আসুক। তুমি মসলা গুড়ো.. দেখো। আমি আসছি।
রূপাও চলে গেল বাইরে, আমি কোমরে আচল গেড়ে পাটার পাশে পলিথিনের মধ্যে থেকে আদা,রসুন, কাচা ও শুকনো মরিচ সব নিয়ে পিষ্ট করা শুরু করেছি। আমি কখনো মেয়েলি কাজে হাত লাগাইনি। আম্মুর সাথে রান্নার কাজে কাটাকুটা, চুলায় তেল বসিয়ে মসলা দিয়ে আগ বারিয়ে দেওয়া ছাড়া কিচ্ছু করিনি। হাত আমার খারখার করে জ্বলছে। হাতের চামড়া পাতলা, আদার পিষ্টনে আমার হাতে জ্বালাপোড়া করছে। তাও শক্ত হয়ে নিজেকে দায়বদ্ধ রেখে বড়দের কাজে মাথানত করে সবটা করছি। সকাল দশটায় বসেছি, বিকেলের আযান শুনছি, আমি পাটায় শেষ দলাটা পিষে নিয়ে লাল মরিচের বক্সে রাখলাম, হাত লালে রক্তিম ভয়ঙ্কর আভা ধারন করেছে, নখের কোণা আকাবাকা হয়ে ভেঙে উল্টো চামড়া উঠে গিয়েছে। চোখের পানিতে নোনোর পরিমান ব্লাউজের হাতা জানে কত কত বার মুছেছি। কেউ আমাকে দেখতে ও খোজ নিতে আসেনি, সেইযে রান্নাঘরে বসেছি। পিড়ি থেকে উঠতে পাচবার ব্যর্থ হলাম, কোমর লেগে ব্যাথা হয়ে গিয়েছে, শেষে র্যাক ধরে উঠে দাড়ালাম। মাথাব্যথা করছিলো, হাতে প্রচুর জ্বালাতন, কোমরে ব্যাথা হচ্ছিলো, ঘাড়ে প্রবল। বেসিনে হাত ধুতে ট্যাপ ছাড়লাম, হঠাৎ একটা হাচিঁর আওয়াজ আসলো, হাই তোলা বড় হাচিঁ।বাড়ি কাপিয়ে হট্টশোরে হাচিঁ। আমি সাথেসাথে পিছনে তাকিয়ে দেখি ফুপি হাচিঁ দিয়ে নাক ঝাড়ছেন, আমার মসলা পিষার ঢাকনা খোলা। সমস্ত হাচিঁর নোংরা জীবানু গুড়ো মসলায় আসা। কেউ এগুলো ব্যবহার করবে? আমার হাড়ভাঙ্গা কষ্টের পরিমান এভাবে বিফলে যাবে? গল্প হলেও সত্যি সবাই আমার কাজ দেখলেও তার পেছনে দেয়া শ্রমের কষ্টটা কেউ দেখবে না ।
— “বউ মশলার গুড়ো তো ব্যবহারযোগ্য রইলো না, তুমি বরং ময়লার ঝুড়িতে ফেলো, কাল আবার নতুন করে পিষতে বসো।”
.
.
দরজা লাগিয়ে ওয়াশরুমের শুকনো ফ্লোরে পানিভর্তি বালতির মধ্যে হাত ডুবিয়ে বসে আছি, চোখজুরে অঝোর কান্না, হাতের জয়েন্টে জয়েন্টে ব্যাথার প্রকোপ বেড়েছে, নখের দুইকোনা ফুলে হাত লাল হয়ে আছে। কান্না আমি ব্যাথার জন্য করিনি, ধোকার কারনে করছি। ফুপি ধোকা দিয়েছেন, মা ধোকা দিয়েছেন, আমার কাজের ফুরসতে পাঠিয়ে দিয়ে কামলার মতো খাটিয়েছেন, যেখানে আমার করা কাজের ফলগুলা হাচিঁ দিয়ে ডাস্টবিনে ঢেলেছেন। পেটে খাদ্যশস্য নেই, পানির একরত্ন ফোটা নেই, সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে আমি “উপোস” বা “রোজা” আছি। বাড়িতে এতোগুলি মানুষ, এত এত সদস্য, রুমভর্তি মেহমান কেউ বাড়ির প্রথম ও ছোট বউ হিসেবে একটাবার এসে জিজ্ঞেস করেনি-“তুমি খেয়েছো? কোথায় যে থাকোনা!! এসো খাবে।।” রাফিয়ার রুমের ওয়াশরুমে আমি, দরজা দিয়ে দুঃখভোগ করছি। মুগ্ধ বাসায় ফেরেননি। হঠাৎ কেউ দরজায় কড়া দিল। ওয়াশরুমের দরজায় কড়াঘাতের শব্দে আমি “কে” বলে উঠলাম। উত্তর দিলো-
–বউ কি ভেতরে? বেরিয়ে আসলে ভালো হয়। কাটাওয়ালা গোলাপের ডালগুলো পরিষ্কার করতে বেরিয়ে আসো। গেট সাজ্জায় লাগবে।
–ফুপি আপনি যান, আমি আসছি।
উনি কথা শুনে রেগে গেলেন। কর্কশকণ্ঠে বললেন,
–শুনো বউ, আমাকে আদেশ দেওয়া মানুষগুলোকে আমি সহ্য করতে পারিনা! সে আমার স্বামী-ই হোক না কেন, বুঝেছো! তুমি সন্ধ্যাবেলা বাথরুমে বসে বসে কি করছো, আমার বড় দেখতে ইচ্ছে করছে। বেরিয়ে আসো!
আমি সারাদিন যার জন্য খাটলাম সেই আমাকে কটুকথা শোনাচ্ছে? আপনার ভালো লাগবে? আমিও হাত বের করে চোখের পানি মুছে জবাব দিলাম-
–আমি কি কাজের বুয়া ফুপি! হ্যাঁ ! আমি কি রেজিস্টেড কাজের মহিলা? বউ না? আবরার ভিলায় সার্ভেন্টের কমতি পড়লো? বউদের কাজ করতে হবে? আমি বউ! কেবল মা আমাকে যা আদেশসূচকে বলবেন, আমি চোখবন্ধ করে সেগুলো টু শব্দ ছাড়া করবো! আপনি চলে যান ফুপি!
ফুপি পুরোনো রূপে গালি দিলেন *****! চোখটা বন্ধ হয়ে আসলো আমার, ওয়াশরুমের ভেতর থেকেই চোখের পানি ছাড়লাম আবার। ফুপি চলে গেলেন। ঝর্না ছেড়ে আমিও দেয়ালে হেলান দিয়ে কাদছিলাম। মুগ্ধকে এসব বলব? উনি শুনলেও কিছু করবেন? আর কতো? আর কতো সহ্য করবো?মুক্তি দিবো? আব্বু-আম্মুর জন্য নিজেকে তিলেতিলে শেষ করতে ইচ্ছে করে, মানুষের ব্যবহার দেখলে মরে যেতে ইচ্ছে করে, মুগ্ধের দিকে তাকালে বারবার থেমে যেতে ইচ্ছে করে! আমি যাবো কোথায়? মরে যাই? আবেগের বশে করা ভুলের মাশুল বুঝিয়ে দেই? মরা লাশ পচেগলে গেলেও কেউ হয়তো আমার জন্য মায়াঘর সাজাবে না!!স্মৃতির বুনোজালে কলঙ্কিনী হিসেবে আখ্যা দেওয়া থাকবে, সমাজে মানুষ তাতে সমালোচনা করে নিজের আনন্দমেলা গড়বে। আর আমি? “দূর থেকে দেখবো সবার এই ভুলে যাওয়া”……
হঠাৎ কারো আছড়ে পড়া কান্নার শব্দ পেলাম।কেউ বাইরে থেকে গলা ফাটিয়ে হাউমাউ করে কাদছে। শোকের কান্না যাকে বলা হয়, কে কাদছে? বুকের মধ্যিখানে ভয়ের জোয়ার ভাসিয়ে দিয়ে হৃদের ক্রিয়া স্রোতের বেগে চলছে….খুব ভয়, প্রচুর ভয়, অনুমানশক্তির পূর্বাভাস পাওয়ার মতো ধকলে উঠা ভয়, আপন কাউকে হারানোর মতো কাঠিন্য ভয়…কারোর কিছু ছিলো? মৃত্যু?
-চলবে
#বি_দ্র: গল্পটা আপনারা যারা নিছক-নিছক করছেন, এটা একটা সত্য ঘটনা অবলম্বনে লিখা। কথাটা আমি নাম বানাতে বলতে চাইনি কিন্তু এখন বাধ্য হলাম নোটবার্তায় কথাটা বলতে। গত ২৪ পার্টে আমি যা লিখেছি তাতে আমার কিছু সংযোজন ছিলো, কিছু আমার শোনা সেই গল্পের অনুসারে ছিলো। আমি ইচ্ছে করে বাস্তব তুলে আনছিনা। যা ঘটেছে তা ধাপে ধাপে তুলে আনছি। অনুরোধ আমার, শেষ পযর্ন্ত পড়ে তবে মন্তব্য করুন। কার লাইফ এবং নাম কি ছিলো-সেটা শেষ পর্বে জানাবো। শুকরিয়া♥