#যদি_বলি_ভালোবাসি ♥
#PART_33
#FABIYAH_MOMO🍁
মনিরার আসা নিয়ে আমি হচকিত হয়ে যাই। বলে কি? মনিরা বাসায় আসবে? মুগ্ধ মনিরাকে নিয়ে সন্দেহের উদ্বেগ ঘোচাচ্ছেন?? কেন?
উনি কথাটা শেষ করতেই ফোন কেটে দিলেন, পাল্টা আমার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করেননি। আমি সোফায় মোবাইলটা রেখে রান্না করতে রান্নাঘরে গেলাম। দুপুর দুইটার মধ্যে সব রান্নার কারসাজি সাজিয়ে টেবিলে রেখে, গোসল সেরে সোফায় বসলাম। আমাদের এখনো টিভি কিনা হয়নি, উনি আসলেই একটা টিভি কিনে আনবেন, এখন মোবাইল দিয়েই অবসর কাটানো লাগে। হঠাৎ দরজায় কলিংবেল বাজলো। দরজায় লুকিং মিরর নেই, হু হা করে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করিনি। ফের তিনটে বেল দিয়ে ছাড়লো, আমি তবুও দরজা খুলছিনা। এখনো মনে সেই পুরোনো ভয়টা তরতাজা সজীব হয়ে আছে । আমি ভুলিনি, ভুলবোও না। কলিংবেল দেওয়া অফ হলোনা, শব্দ শুনে দরজাও খুললাম না। রুমে গিয়ে বসে আছি। ভয়ের শিহরণ দমে যায়নি। আমার ফোন বাজছে, দরজায় কলিংবেল দিচ্ছে, আমি কোণঠাসা হয়ে বসে আছি। উঠে ফোনটা নিলাম। কল রিসিভ করলাম, দৃষ্টি কলিংবেল বাজানো দরজার দিকে।
–তুই দরজা খুলছিস না কেন? পাকনি ভয় পাচ্ছিস? হ্যালো??
মুগ্ধের প্রশ্নমালাতে দরজায় তাকানো হটে গেল।দরজা খুলছি না চিটাগাং থেকে উনি কি করে জানলেন? আমি ফোন কানে এখনো কোনো শব্দ করিনি, উনি দরজা না খোলার বিষয়ে জানেন? অবাক হলাম! জিজ্ঞেস করলাম,
–দরজায় আপনি?
–আমি কেন হবো? মনিরা আসবে বললাম না!! তুই দরজা না খুলে রুমে বসে আছিস…ও আমাকে কল করছে! দরজা খোল।
–আমার নাম্বার জানে না?আপনাকে কেন কল করতে গেল?
–তোর এই নাম্বার কাউকে দিয়েছিস! এটা না আবিরের ফোন! মাথা কোথায় থাকে? ভুলে গেলি?
–নাহ্….আচ্ছা খুলছি। রাখি।
দরজা আস্তে করে খুললাম। মনিরা দাড়িয়ে। আমাকে দেখে উৎকোচ করছিলো, কিছু বলার প্রয়াসও করলো কিন্তু কোথায় কি যেন আটকা পড়লো মনিরা থেমে গেলো। কিছু বলল না। আমি মাথা হেলিয়ে ভেতরে আসতে বললাম, ও আসলো। পুরো বাসার চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে তাকালো। দরজা আটকে আমি চুপচাপ টেবিল রাখা পানির জগ থেকে এক গ্লাস পানি ঢেলে নেই। মনিরা শীতল গলায় স্বর ডুবিয়ে বলল,
–দোস্ত তোরে আমি ফোনের বিষয়ে বকছিলাম, আমার কথা শুনলে শিফা *** কাজটা করতে পারতো না…
পানির স্বচ্ছ গ্লাসটা নিয়ে মনিরাকে দিলাম। ও গ্লাস হাতে সোফায় বসে তিন চুমুকে পানি খেলো। মনিরা আমাকে আসলেই বকেছিলো, ফোন রেখে যাওয়াতে কথা শুনিয়েছিলো….তবে আমি শুনি নি। বেকুবের মতো কাজ করেছি। স্বাভাবিক পরিস্থিতি টেনে আমি বলে উঠলাম,
–গোসল করছিস? না করলে ওইদিকে ওয়াশরুম। যেয়ে গোসল করে নে। আমি খাবার প্লেটে দিচ্ছি।
মনিরা মাথা নাড়িয়ে “না” বোঝালো। গোসল করেনি। আমি টেবিলে গ্লাস রেখে ঘুরে দাড়াই, কিচেনে যাবো বলে…মনিরা হুট করে সোফা থেকে দৌড়ে এসে আমাকে জাপটে ধরলো। আমি হঠাৎ জাপটে ধরাতে বিচলিত হয়ে যাই। ও বলল,
–বইন রাগ করিস না রে…আমি জানলে ওই শালীর ঘরের শালীরে কুত্তা দিয়ে উস্টাইটাম। তোরে আমি রাতের বেলায়ও কইছিলাম, ফোনটা নিয়া নে.. দিস না। কথা শুনোস নাই….শিফা ছেড়ি এমন ** হইবো আমি জানতাম নারে বইন, তুই শা*** মাইয়ার লিগা আমারে না বইলা এখানে আসছোস…আমারে একটা বারো ফোন দিয়া বলোস নাই “মনিরার বাচ্চা ভালো আছোস! রেজাল্ট তো তুই ফাটায়া উল্টাইলি দিছোস!!!!”….আমারে তুই ভুইলা গেছোস…আমারে তুইও স্মরন করলি না…বাপ মা গ্রামে থাইকা আমার খোজও লয় না। কেমনে আছি, মরছি না বাচছি! জিগায় না…..
“বরিশাইল্লা খ্যাত” — নামটা বলে যতই অপমান করি, শাষাই, থাপড়াই…যাই করি না কেন আমার সঙ্গ ছাড়েনি এই “মনিরা” নামক “বরিশাইল্লা খ্যাত”। খ্যাত বলতেও নিজের কাছে কান্না পাচ্ছে কারন…মনিরা খ্যাত না…ওর ভাষা খারাপ হলেও ও খারাপ না। কাউকেমুখের উপর গালি দিলেও অন্যের গালি খাওয়ার স্বভাব ও রাখেনা। মনিরা মেহনতি মেয়ে, আঙ্কেল আন্টি ওর পড়াশোনা নিয়ে ঘোর বিপক্ষে, কখনো ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেও টাকাপয়সা নিয়ে কথা বলেননা।গ্রাম থেকে ওর জন্য টাকা পাঠাননা। ওর পরিবার সচ্ছল না। মনিরা নিজের টাকায় পড়াশোনা করছে, টিউশনি করিয়ে নিজের খরচ নিজে জোটাচ্ছে। একমাত্র শিফার জন্য আমার এত্তো কাছের মানুষকেও আমি দূরে ঠেকাতে দ্বিধায় পড়িনি, আমার মনিরা নামক বান্ধবীকেও সন্দেহের তালিকায় শামিল করেছি। মনিরার মাথায় হাত বুলিয়ে ওর কাছ থেকে ছাড় নিলাম। ও চোখের পাপড়ি ভিজিয়ে কেদেঁই দিয়েছে, আমার ওড়নাটা দিয়ে ওর চোখ মুছে দেই…হাতে একটা তোয়ালে ধরিয়ে ওয়াশরুমে যেতে বলি,
–গোসল কর, আমি টেবিলে অপেক্ষা করছি। তুই গোসল করে ডাইনিং স্পেসে আয়। একসাথে খাবো।
“আচ্ছা” বলে মনিরা গেল গোসলে। আমি টেবিলে প্লেট বসিয়ে চেয়ার টেনে নিলাম আপনমনে। দুজনে একসাথে হাসিঠাট্টা ফাজলামি করে খাওয়া-দাওয়া শেষ করলাম। বিকেলে ড্রয়িং রুমে ফ্লোরে বিছানো বেডে দুইজনে শুলাম। মুগ্ধের নাম দেওয়া “অন্ধকারবিলাস”। ডাক্তার সাহেব অন্ধকার পছন্দ করেন, অনেক বেশি পছন্দ। অন্ধকার নাকি মানুষের জীবনে সফলতা একেঁছে, এই অন্ধকার-ই তার সবচেয়ে আপন। উনি সবসময় বলেন-
“পাকনি? অন্ধকারবিলাস করবি বুঝলি! বাচ্চাকালে আমরা অন্ধকারে ছিলাম…দম ত্যাগের পর আবারো অন্ধকারে ফিরবো। জানিস দিনশেষে যখন রাত ঘনিয়ে আসবে তখন অন্ধকারে নিজেকে বির্সজন করবি। কথা-কান্না-কষ্ট নিয়ে অন্ধকারে খুজবি জীবন তোকে কি কি দিয়েছে; এটা ভাববিনা কমতি কিসে আছে। বড্ড তুলনামূলক কাজ ওটা! মানুষকে নিয়ে নিজের তুলনা করলে বিকৃত মস্তিষ্কের উদ্ভব ঘটে, নিজের সত্ত্বাতে বিশ্বাস টিকে থাকে না, আর ফলাফলস্বরূপ…মানুষ-ই নিজেকে ধ্বংস করে দেয়। কখনো খারাপ পরিস্থিতি বা খারাপ মানুষকে নিয়ে তুলনা করবি না, এতে মানুষ খোদ্ ধ্বংসাত্মকের মুখে চলে যায়।”
মাথায় চাপড়ের অনুভব হলো! চাট্টি! মাথায় চাট্টি মেরেছে! চোখ বন্ধ করে কি সুন্দর মুগ্ধকে ফিল করছিলাম সব উড়িষ্যার বহরে ভাসিয়ে দিল। ইশশ…চোখ বন্ধ করলেও উনার কন্ঠ মাথায় ঘোরাফেরা করে!! চোখ খুললে উনাকে দেখতে ইচ্ছা করে!! কানে ভেউভেউ করে কেউ বলল,
–সোনা বন্ধু তুই আমারে করলিরে দিওয়ানা মম তো মানে না মুগ্ধ তো আহে না!
মেজাজটা উল্টে গেল! নরম বালিশে দখিনার হাওয়ায় ফ্লোরের বিছানায় কাউয়া মার্কা গলায় গান শুনলে আপনি ঠিক থাকবেন! ভাই..আমি ঠিক নেই! চোখ খুলে মনিরার দিকে ডানে ঘুরে গালের উপর মশা মেরে দেই! মনিরা থম মেরে গাল ধরে তাকিয়ে আছে।
–কেরে থাবড়াথাবড়ি করার জায়গা পাস না? আমার নরম গালটায় কেন থাবড়া দিলি!
–চটকায়া চামড়া তুলে দেওয়া দরকার বদের হাড্ডি! চোখ বন্ধ করে থাকলে কাউকে পেরেশান করা যায় না…মগজের মগবাজারে জানা নাই!
গালে হাত বুলাতে বুলাতে বিহ্বল গলায় বলল,
–তুই আমার লগে আড্ডা না দিয়া চোখ হান্দায়া ঘুমাস কেন!
–ওই! আমি ঘুমাইছি! তোরে কোথাও বলছি আমি ঘুমাইছি!
–চোখ ঢাইকা তুই চুপ মাইরা আছোত! আমারে কস ঘুমাস নাই!
–যা সর…ফালতু! কথা বলবি না আমার সাথে!
.
.
মনিরা ওর ফোনে কার রেসিং খেলছে। আমি শুয়ে শুয়ে লিস্ট করছি সাজেকের কোথায় কোথায় কি কি জিনিস কিনতে পাওয়া যায়। আমাদের প্রথম ঘুরাঘুরি। বিয়ের পর এই প্রথম কোথাও একসাথে ঘুরতে বের হবো। ভাবলেই আমার ঘুম পালিয়ে জানালা দিয়ে চলে যায়। আমরা সাজেক যাবো!! ডাক্তার সাহেব পরশুদিন আসবেন। উনি প্রচুর ব্যস্ত। ট্রেনিং নাকি শেষের দিকে। জোর করে বলতেও পারছিনা “দুই একদিন আগে চলে আসলে কি হয়???”। নাহ্…এভাবে বললে কাজের ক্ষেত্রে নাফরমানী হবে। একজন ডাক্তার হিসেবে পেশার সাথে “নাফরমানী”?? উহু..মওকুফ করা ঠিক না!! উনি বলেছেন যেহেতু আসবেন তাহলে আসবেন। কাঙ্ক্ষিত মানুষের চিন্তা করতেই তার ফোন চলে এসেছে, মনিরা আমার ফোনের রিংটোনে আড়চোখে হাসি দিল। ও বুঝে গিয়েছে কে দিয়েছে!!
–হ্যালো শুনছিস? আমার না ঢাকা আসতে সময় লেগে যাবে। আমি পরশু আসতে পারবো না পাকনি!! একসপ্তাহ পর আসবো।
ঝাকুনি দিয়ে আসলো শরীরে! আরো এক সপ্তাহ?? আমি পরশু’র চিন্তায় ঘুম হারাম করে স্বপ্ন দেখছি উনি আমাকে অপেক্ষার কষ্টভুবনে দিনপ্রহর আরো বাড়িয়ে দিলেন!! হতভম্ব আমি! ফোন কানে হা করে আছি! উৎকন্ঠার দৃঢ়তা বোঝাতে পারছি না! মনিরা আড়চোখে তাকানো বাদ দিয়ে সোজা করেই তাকালো, ফোনের রেসিং গেমস বন্ধ করে কাত করে ফোন রাখলো। আমি এখনো থতমত খেয়ে আছি… কপালে কুচকানি ফেলে রাগে দাড়িয়ে পোহাচ্ছি! আমার কান্না পাচ্ছে না! রাগ! রাগ হচ্ছে এখন! ফোনের ওপাশের মানুষ সামনে এসে দাড়ালে উনার কলার চেপে দুইগালে চড় মারতাম! ঠাটিয়ে চড়! রাফিনের সাথে বিয়ে নিয়ে অনুরোধের বেলায় রাতে যেভাবে ঠাসঠাস করে ঠাটিয়ে মেরেছিলাম! ওরকম ঠাটিয়ে চড়! ফোন আছড়ে ফেলে পায়ের নিচে পিষে ভাঙচুর করতে ইচ্ছে করছে! মনিরা উঠে এসে আমার হাত ধরে ঝাকালো!
–ভাই কল করছেনা? তুই লাল টমটমের মতো মুখ ফুলাইলি কেন? কিরে মম? কলে ভাই না??
তীব্রতর চাহনি আমি মনিরার দিকে দিলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে হাত ঝাকানো ছেড়ে দিলো। ফোনটা মনিরার হাতে দিয়ে শ্বাস ছেড়ে বললাম,
–তোর ভাইকে বলে দিস আমাকে কল না করে রূপাকে কল করতে। রূপার সাথে ভাব জমাতে বলে দিস!
রান্নাঘরে চা বানাতে গেলাম। কড়া লিকার করে একচাপ গরম চা প্রয়োজন। মাথা ঠিক করতে তুমুল আকারে প্রয়োজন। অপ্রয়োজনীয় কথা ভুলার জন্য হলেও কড়া লিকারের গরমাগরম চা প্রয়োজন। চা খাওয়া নেশা আমার। অবান্তর নেশা। অপ্রকট নেশা। নেশাদ্রব্য না খেয়ে এককাপ চা খেলেই নেশা ধরে যাবে আমার…..তুখোড় নেশা! রাগ যে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে! ভুললে চলবে? মুগ্ধ যে বকবে!
-চলবে🍁
-Fabiyah_Momo🍁]