শুভ বিবাহ পর্ব-১১

0
1148

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

১১

❝আর তাতেই তুই গলে গেলি?❞

নীনা কোমরে দুই হাত রেখে ভ্রু কুঁচকালো। ফোনের ওপাশে আমি বললাম,
❝কি করব বল? তোরা তো জানিস আমি দিন দিন শুভর উপর কত দুর্বল হয়ে পড়ছি। ও যখন আমার হাত ধরে, আমার এখনো শরীর কেঁপে উঠে। ও আমার চোখের দিকে তাকালে মাথা ঘোরায়। শুধু শুধু দরকার কি এত সুন্দর সময় নষ্ট করার?❞
❝সময় নষ্ট? ও যে রূপা আসার পর থেকে তোকে সমানে ইগ্নোর করে গেল, তোর সামনে বসে ফ্লার্ট করল, এসব তোর চোখে লাগে না? খারাপ লাগে নি?❞
স্নিগ্ধা মিনমিন করে নাকীস্বরে বলল,
❝ছেলেরা যে কেন এমন হয়! কি হয় এরকম ফ্লার্ট না করলে? ইমরানও এমন করল। রূপা দেখে মনে হলো যে একটা ফুল, আর মৌমাছিগুলো ওকে ঘিরে ধরেছে!❞
নীনা ওকে ধমক দিল,
❝কিসের মৌমাছি? কিসের মধু? রূপা হলো একটা হাগু, আর ছেলে গুলো সব মাছি, হাগুতে বসা মাছি!❞

আমরা তিনজন কনফারেন্সে ফোনের তিন পাশে খিলখিল করে হেসে উঠলাম। হাসি শেষ করে নীনা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল,
❝শোন কণা। তুই একটা ইন্ডিপেন্ডেন্ট শক্ত সামর্থ মেয়ে। তুই এত দুর্বল কি করে হচ্ছিস ঐ গাধাটার উপর? শুভর চরিত্রের এই দিকটা ভবিষ্যতে কন্সিডার করতে পারবি? মনে কর তোর কলেজ সার্কেল কিংবা কাজিন সার্কেলের কারো সাথে যদি ও তোর সামনেই ফ্লার্টিং শুরু করে, ভালো লাগবে?❞
কণা অনিশ্চিত জবাব দেয়,
❝কি জানি! দেখি, ওকে বুঝাই, বদলানোর চেষ্টা করি। মাত্র তো শুরু। এত তাড়াতাড়ি হাল ছাড়ি কি করে?❞

বান্ধবীদের সাথে গল্প শেষে ফোন কেটে দেখলাম শুভর দুইটা মিসকল। আমি ওকে কল ব্যাক করলাম। ফোন রিসিভ করেই শুভ প্রশ্ন করল,
❝কার সাথে কথা বলছিলে?❞
❝নীনা আর স্নিগ্ধার সাথে❞
❝আসলেই? এতক্ষণ কি কথা বলো তোমরা? বদনাম করো নিশ্চয়ই?❞
❝মানে কি! তুমি কি আমাকে সন্দেহ করো? ওদের সাথে আমার কথা থাকতে পারে না?! এতক্ষণ কথা বলা কি অস্বাভাবিক নাকি?❞

শুভ কিছুটা দমলো বোধহয়। নিঃশ্বাস ফেলে নরম স্বরে বলল,
❝রাগ করে আছ এখনও আমার সাথে?❞
আমি ভারী কন্ঠে জবাব দিলাম,
❝না❞
❝তোমার না বলাতেই বোঝা যায় রাগ করে আছ। আর কত বার সরি বলব বলো তো?❞
❝সরিতে কাজ হবে না❞
❝তাহলে কি করতে হবে?❞
❝প্রমিজ করতে হবে❞
❝কি প্রমিজ?❞
❝প্রমিজ করো তুমি আর মেয়েদের সাথে এমন টাংকিবাজী করবা না। তুমি জানো কত জঘন্য স্বভাব এটা?❞

শুভ ফোনের ওপাশে কিছুটা অসন্তুষ্ট হলো।
❝কণা তুমি কি মজা বোঝো না? আমি ওর সাথে মজা করতেছিলাম! আমি কি তোমার সাথেই আছি না? তোমার হাত ধরে বসে ছিলাম না? ইট ওয়াজ জাস্ট ফান! আমার অবাক লাগে। তোমাকে দেখলে তো মনে হয় ফান বুঝো, অথচ এই সামান্য বিষয় নিয়ে এরকম বাড়াবাড়ি করতেছ! অবাক হয়ে গেলাম❞

আমারও মেজাজ নিয়ন্ত্রণে রাখা কষ্ট হয়ে যাচ্ছে। আমিও গলা চড়ালাম।
❝কোনটা ফান আর কোনটা লুচ্চামি, আমি বুঝি শুভ! আমাকে বুঝাতে আসবি না তুই! শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করবি না আমার সামনে! এরপর যদি আর কোনো মেয়ের সাথে এই ধরনের জঘন্য ফান করিস, তোর নাক মুখ আমি ফাটায় ফেলব!❞

থ্রেট মেরে ফোন কেটে দিলাম। কত বড় সাহস, আমাকে ফান বুঝাতে আসে! কলিজা কয় মণ হলো সেটা ওর বুক কেটে বের করে দেখা লাগবে আমার! ইতর একটা!

ফোন কেটে ডাইনিং এ গেলাম। এখনো খাবার বাড়া হয়নি তাই মেইডের সাথে গলা ফাটিয়ে ঝগড়া করলাম। মেইড আমার এসব ব্যবহার পেয়ে অভ্যস্ত, সে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো। বাসার আজ আব্বু আম্মু দুজনেই আছে। আম্মু ঘর থেকে বের হতে বলল,
❝কণামনি! কি হলো তোমার? এত রেগে যাচ্ছো কেন? খাবার বাড়া হয়নি, এখনই বাড়া হবে। একটু বসো❞
❝খাবো না আমি এই বাসায়!❞

রাত হওয়া সত্ত্বেও আমি বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। পেছন থেকে আব্বু আম্মু ডাকলেও আমি থামলাম না। গন্তব্য মামাবাড়ি। আব্বু আম্মু জানে আমি ওখানে যাবো, তাই খুব বেশি ডাকাডাকিও করে নি। আমার রাগ উঠলে গাদা গাদা খাওয়ার অভ্যাস। খাবার সামনে নিয়ে কেবল মুখে খাবার ঠুসতে থাকি। আস্তে আস্তে প্রিয় খাবারের স্বাদে রাগ কমে আসে। এমন অনেকবার হয়েছে যে, রাগ করে খাবার না দেখে বাসা মাথায় তোলে মামার বাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছি। আমার বড় মামী আমাকে সবচেয়ে বেশি আদর করে। মামীর রান্নাও অনেক বেশি মজা হয়। আমাদের পরিবারের অন্যান্য নারীরা টুকটাক বাইরে কাজ করলেও বড় মামী পাক্কা গৃহিণী। এক হাতে রান্না করতেন আর আরেক হাতে বাচ্চা পালতেন। আগে মামী একটা ব্যাংকে চাকরি করত। বাচ্চা হওয়ার পর উনি চাকরি ছেড়ে বাচ্চাদের দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিয়েছেন।

আমি সোজা বড় মামার বাসায় ঢুকে গেলাম উনারা মাত্র খেতে বসেছে। আমাকে এই অসময়ে দেখে মামী হাসলেন,
❝কি রে? রাগ করে এই সময় চলে আসলি?❞
আমি এক দৃষ্টিতে টেবিলে বেড়ে রাখা খাবারের আইটেম গুনছি। মামী এক গাল হেসে বললেন,
❝কোনটা খাবি, ভাবছিস নাকি?❞
আমি গম্ভীর মুখে বললাম,
❝এখন আলকাতরা দিলে সেটাও খাবো❞

মামী কোনো প্রশ্ন না করে আমার জন্য প্লেট এনে দিলেন। আমি সামনে যা পেলাম গোগ্রাসে গিলতে থাকলাম। সবাই আমার এসব কান্ড দেখে অভ্যস্ত, তাই কেউ কোনো প্রশ্ন না করে যার যার মত খাচ্ছে। খেতে খেতে আমার মাথায় হুট করে শুভকে শায়েস্তা করার চমৎকার একটা বুদ্ধি চলে এলো!

পরদিন ভালোবাসা দিবস। আমাদের যদিও ক্লাস আছে, তাই সবাই লালের মাঝে কিছু একটা পরে এসেছে। অনেক আউটসাইডারও ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজকাল এই বিশ্ববিদ্যালয়কে পার্কের চেয়ে কম কিছু মনে হয় না। পাব্লিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নামের সর্বোচ্চ ব্যবহার করছে পাব্লিকরা!

আমি আজকে একটা নীল কুর্তির উপর কালো কটি চাপিয়েছি, সাথে জিন্স প্যান্ট। ভাব নিয়ে ক্লাসে গিয়ে বসলাম। গতকাল ফোন বন্ধ করে ফেলেছি বলে দেখিনি, সকালে ফোন অন করতেই শুভর এতগুলো মেসেজে এসে ইনবক্স ভরে গেল। সেই পুরাতন কথা সে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে বলছে, মাফ চাচ্ছে, আবার বলছে লেবুর মত বেশি চিপে আমি সব তিতা করে ফেলছি। ওকে কোনো জবাব দেইনি, এমনকি ক্লাসে এসেও ওর দিকে তাকাইনি। স্নিগ্ধা আর নীনা এসে আমার এক পাশে বসল, আমি বেঞ্চের একপাশে বসে আছি। ওদের সাথে গল্প করছি, এই সময় শুভ এসে জোর করে আমার পাশে গা ঘেঁষে বসে পড়ল। আমি পাশে চোখ গরম তাকানোর পরও সে তোয়াক্কা না করে সামনে চেয়ে রইল, যেন কিছুই হয়নি!

ক্লাস শুরু হওয়ার পরও ও আমাকে খোঁচাতে থাকলো। কখনো আমার কলম নিয়ে যাচ্ছে, কখনো বই ধরে টানছে, কখনো খাতার পৃষ্ঠা ওল্টাচ্ছে। আমি অনেক কষ্টে মেজাজ ধরে রেখেছি। সব সুদে আসলে উসুল করব, ক্লাস শেষ হোক!

ক্লাস তিনটা ছিল আজকে, মাঝে কোনো ব্রেক নেই। আমি উঠে নীনা আর স্নিগ্ধাকে নিয়ের বেরিয়ে এলাম। তখন সেখানে সজীব এসে হাজির হলো। সজীব হলো আমাদের এক বছরের সিনিওর। সে আমাকে পছন্দ করে, বেশ আগে থেকে টের পেয়েছি। প্রায় প্রতিদিনই সে আমার মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে, আমিই পাত্তা দিইনা। আজ তার সাথে খুব হেসে হেসে কথা বললাম, বিশেষ করে যখন শুভ আমাদের দেখছিল। সজীবের শার্টে কাঁধের কাছে একটা কি যেন পড়ে ছিল, আমি সেটা হাত দিয়ে সরিয় দিলাম। শুভকে দেখিয়ে দেখিয়ে হিহি করে হাসলাম। তারপর ওর সাথে কথা বলতে বলতে ভবন থেকে বেরিয়ে এলাম। বাইরে পা রেখে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি শুভ মুখে চুনকালি মেখে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হাত দিয়ে পোড়া গন্ধ পাচ্ছি, এমন অভিনয় করে চলে আসলাম।

আমি এখন থাকি সুখে, আগুন জ্বলুক তোমার বুকে!

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here