#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria
২১
আজকাল মাথা আমার কাজ করে না। শুভর সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা নীনা আর স্নিগ্ধার মাঝে আটকে আছে, অন্যান্যরা টের পায়নি বোধহয়। টের পেলেও আমার কান পর্যন্ত কিছু আসেনি। আজ-কাল অবশ্য প্রণয়-জুটির মাঝে এমন অন্তরঙ্গতা অস্বাভাবিক না। অনেকেই এতে জড়িয়ে পড়ছে, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটছে সমাজ জুড়ে। মোটামুটি টিনেজ বয়সে এমন কাজ করা ছেলে মেয়ের অভাব নেই। তবে আমিও যে এত বড় ভুল করব, সেটা কখনো ভাবিনি। নিজের উপর কনফিডেন্স ছিল সবসময়, আবেগের বশে আমার পা কখনো পিছলে যাবে না। সেই আমি আবেগে কেবল পিছলাইনি, রীতিমতো আছড়ে পড়ে মাথা ভেঙে পড়ে আছি।
আমার জীবনে রেস্ট্রিকশন বলে কখনো তেমন কিছু ছিল না। ছোট থেকে যা চেয়েছি, তাই পেয়েছি। অঢেলের মাঝে বসবাস করেও আমার সবসময় মনে হতো, আমাকে সীমিতের মাঝে থাকতে হবে। বাবা মা আমাকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করে না বলে নিজেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখে গিয়েছি। মোরাল ভ্যালুজ কিংবা সোশ্যাল নরমস- সবটা নিজের দেখায় শিখে নেয়া। সমাজের যে অংশে আমার পরিবার ও আমি থাকি, এটা অন্যান্য অংশ থেকে ভিন্ন। এখানে সব টাকা, চাকচিক্য আর কৃত্রিমতায় মোড়া। তার মাঝেও আমি নিজেকে কলুষিত করিনি। শামীমের সাথে ক্লাস সেভেন থেকে পরিচয়, যদিও সে আমার দুই বছরের বড়। ছেলেটা ভালো ছাত্র হলেও দুষ্টুমিতে ক্লাসের অন্য সবাইকে হার মানাবে। তাছাড়া একটু ডেয়ারিং হওয়ায় আমার ওর সাথে ভালোই জমত। শামীমের সাথে প্রেমের শুরুটা কলেজে পা রাখার পর। আমি মাত্র পা রাখলাম, আর ওর ছেড়ে যাওয়ার পালা। শুরুতে সবার মত আমাদের ভালোবাসায় অনেক মাখামাখি ছিল, ভালোবাসায় ডুবে থেকে থেকে আমাদের রাত ভোর হত। ধীরে ধীরে ঘোর কাটলো, আমি আবিষ্কার করলাম অন্য এক মানুষকে যার ভেতরে আমাকে নিয়ে নানান কুধারণা কিলবিল করে। জাহিদ আমার কলেজের বন্ধু হওয়ার সুবাদে আমাদের প্রণয়নের ঘটনা জানত। কিন্তু আমি সহজে আমাদের মধ্যকার সমস্যা অন্য কারো কাছে বলতাম না। দিন দিন আমার উপর শামীমের কর্তৃত্ব আর সন্দেহ বাড়তে বাড়তে এক সময় আমারই মানসিক রোগী হবার জোগাড়। ফলাফল ব্রেকাপ। তাও স্বাভাবিক ভাবে নয়।
আমি ওর সাথে দেখা করলাম। বললাম, ব্রেকাপ করব। কারণ সামনে এইচএসসি। আমি কিছুতেই পড়ালেখা কম্প্রোমাইজ করব না। ওদিকে ব্রেকাপের কথা শুনে সবার আগে গালি দিয়ে বলল, আমার তো চরিত্র খারাপ, নিশ্চয়ই কারো না কারো সাথে প্রেম হয়েছে। এখন অকারণে ব্রেকাপ করতে চাচ্ছি। আমি সময় ক্ষেপণ না করে পায়ের জুতো খুলে ওর দুগালে মেরে বসলাম। এমন অতর্কিত আক্রমণের জন্য সে প্রস্তুত ছিল না, চমকে উঠে পেছন থেকে উলটে পড়ল। বিস্ফোরিত চোখে যখন আমার দিকে তাকালো, তখন আমি আবার জুতো হাতে তাকে মারতে গেলাম। সে তখন এক ছুটে লাপাত্তা!
সম্ভবত এরপর কয়েক দিনে সে বুঝলো, আমাকে কখনো ডোমিনেট করতে পারবে না। তারপর শুরু হলো আমার হাতে পায়ে পড়া। আমি ততদিনে অনেক শক্ত হয়ে উঠেছি। বসে বসে মার খাবো, ওর অত্যাচার সহ্য করব, তা আর আমার ধৈর্যের সীমায় নেই। যতবার আসত, ততবার অপমান করতাম। পাগলামী শুরু হলো, মাফ চাওয়া শুরু হলো, আমি গললাম না। একেবারেই গললাম না। আমার অগোচরে করে ওর নানান কুকীর্তির খবর তখন আমার কাছে আসত। আমি সেসব শুনিয়ে ইচ্ছে মতো অপমান করতাম। ওকে ইগ্নোর করে আমার পরীক্ষাও তখন ফাটাফাটি হলো। এমনকি ঠিকঠাক মতো পড়াশোনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্সও পেলাম। অবশ্য আমার ধারণা, শামীমের মত বিছরি চ্যাপ্টার আমার জীবনে না থাকলে আমি ডি ইউনিটে ইংরেজি পেতাম না, বরং সাইন্সের কোনো সাবজেক্টে পড়তাম। সেই কার্জন হলে পা রাখতে পারতাম যেখান থেকে আমার প্রিয় লেখক হুমায়ুন আহমেদ পা রেখে বেরিয়েছেন। তাদের পদচারণার আশেপাশে আমারও পদচারণ হতো।
শামীমের সাথে ঘটে যাওয়া সব কিছু জাহিদ জানত। ও আমাকে সাপোর্ট করত। তবে আমি ওর উপর নির্ভর করতাম না, এতটাই শক্ত মানসিকতার ছিলাম। সবাই জানত, শামীম আর আমার দিনে চৌদ্দবার ব্রেকাপ হয়। কেবল আমিই জানি আমাদের আসলে সেভাবে কখনো সম্পর্কই ছিল না। যা ছিল, তা হলো ডোমিনেন্ট আর সাবঅর্ডিনেটের। শুরুতে ও ছিল ডোমিনেন্ট আর আমি এখন সাব অর্ডিনেট। এখন উলটো। শামীম আমার সাফল্য দেখে আরও পাগল হয়ে গিয়েছিল। ওকে আমি একেবারে হারপিক দিয়ে নিশ্চিন্ন করে ফেলেছি, যেন টয়লেটে জমে থাকা একটা নিকৃষ্ট ময়লা!
অথচ সেই আমি যে শুভর মত ছেলের প্রেমে পিছলে পড়ব, আর দাঁড়াতেই পারব না, কে জানত?
শুভর প্রতি কেন আমার এত আবেগ, তা আমি অনেক ভেবেছি। কেন শামীমের মত ওকেও অপমান করে ছুঁড়ে ফেলতে পারিনি? কেন ওকে ঘৃণার তালিকার সর্বোচ্চ স্থানে স্থান দিতে পারিনি? অনেক ভেবে আমি সিদ্ধান্তে এসেছি।
শুভ আমাকে কখনো আঘাত করার কথা ভাবেনি, আঘাত করেনি।
শুভ আমাকে ইগ্নোর করেছে, বিরক্তি প্রকাশ করেছে, রেগে গিয়েছে, কিন্তু তুচ্ছ, নিচু করেনি, শামীমের মতো।
শুভ অনেক মেয়ের সাথে কথা বললেও আমার সাথে কমিটেড থাকাকালীন অন্য কারো সাথে সম্পর্ক করেনি। ও কেবল ফ্লার্ট করে। অল্প সময়ে আবার তাদের ভুলেও যায়।
শুভ আমার ছোট ছোট বিষয়ে প্রশংসা করে। যেমন আমার ছোট চুল সবাই অভিযোগ করলেও আজ অব্দি শুভ করেনি। সে আমার ছোট চুলের প্রশংসা করত।
শুভ সত্যি বলত নাকি মিথ্যা জানি না, কিন্তু সে প্রচুর পেম্পার করত। পৃথিবীতে এমন কোনো মেয়ে নেই যে প্যাম্পারিং এ খুশি হয় না।
শুভ হুটহাট করে আমাকে ভালোবাসায় ভাসাতো। হুট করে এমন কিছু কাজ করত যে আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। এই মুগ্ধতা কখনো কখনো কয়েকদিন পর্যন্ত থাকত।
শুভ হাজারটা মেয়ের সাথে কথা বললেও আমার পার্সোনাল স্পেসে কখনো হাত দেয়নি। স্বাধীনচেতা, কিছুটা নারীবাদী এই আমি শুভর প্রতি তাই দুর্বল হয়ে পড়েছি।
কিন্তু শুভ বোধহয় দুর্বল হয়নি। আমি ভেবেছিলাম, আমার স্থান ওর জীবনে অপরিবর্তনীয় থেকে যাবে। ও যাইই করুক, আমাকে ফেলে যাবে না। গত তিন মাসে আমি বুঝেছি, শুভর জীবনে আর দশজন মেয়ের মতো আমিও অস্থায়ী। হয়ত আমার স্থায়িত্বটা বেশিদিনের ছিল, কিন্তু সেটা স্থায়ী হয়নি। যেমন অনেকে চার-পাঁচ বছর চাকরির পর শোনে তার চাকরি স্থায়ী হয়নি!
এত এত ভালো দিকের মাঝে শুভর একটাই ভুল- নারী আসক্তি আর সেই আসক্তি ঢাকতে সে আমাকে বারবার প্রশ্ন-পরীক্ষার মুখে ফেলেছে। আমি ওকে বিশ্বাসের প্রমাণ দিতে গিয়ে শেষ পর্যায়েও গিয়েছি, হলো না। হয়ত ওর জীবনে সত্যিকারের ভালোবাসা হলে আমাকে এমন পরীক্ষায়ও নামতে হতো না।
তাই আমি ভাবলাম, ও নিশ্চয়ই আমাকে ছাড়া অন্য কারো সাথে জড়িয়ে পড়েছে ভীষণভাবে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেলাম। ওর পাশের বাসার এক পিচ্চি। প্রথম যেদিন ড্রাইভার কাকাকে নিয়ে অনুসরণ করলাম, সেদিন মনে হলো, এই মেয়েটা দেখতে এত নিষ্পাপ কেন? এই নিষ্পাপ মেয়েটা শুভর দ্বারা এতটা কলুষিত হচ্ছে কেন? ও কিছুই বোঝে না, তার জন্যই কি?
নিশ্চিত হবার আশায় মেয়েটাকে অনুসরণ করলাম বিভিন্ন সময়। এক্সিডেন্টের ফলে তার বাইরে বের হওয়া কমে গিয়েছে। তাই ওদের বাসার সামনের দোকানের এক ছেলেকে সেই দায়িত্ব দিলাম। ছেলেটা কিছু টাকার বিনিময়ে আমাকে সব তথ্য দেয়। কোনোভাবেই এতে মনে হলো না শুভ তুতুনের সাথে কোনো সম্পর্কে জড়িয়েছে। তবুও খেয়াল করলাম। নাহ, আমার অবজারভেশনের ফলাফল নেতিবাচক। তবুও আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, তুতুনের মুখোমুখি হবো। কারণ শুভ আমার সাথে স্বাভাবিক হচ্ছে না। দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা দিলাম, কিন্তু শুভ কয়েকবার আমাকে দেখল, দৃষ্টি বিনিময় হলো, একবার একটা তথ্য দিয়ে সাহায্য করল- এইটুকুই। এই যে এত ভালোবাসাবাসি, এত মাখামাখি, কিছুই যেন হলো না, সব মিথ্যে স্বপ্ন!
আমি তুতুনের কলেজের সামনে দুদিন গেলাম। ওর মা আছে সাথে, তাই গেলাম না। তৃতীয় দিন সুযোগ পেয়ে ওকে গাড়িতে নিয়ে আসলাম। খুব কাছ থেকে দেখলাম ওকে। একেবারেই কাদা মাটি, এখনো কোনো ছাঁচ ধারণ করেনি। ওর বড় দুই ভাই দেশের বাহিরে থাকে। তারা সেখানেই সেটেল হয়ে আছে। হয়ত এই মেয়েও এক সময় চলে যাবে। সবার ছোট ও একমাত্র মেয়ে হওয়ায় খুবই নরম, যেন একটা তুলো। ওকে কিছুই বলতে পারলাম না। যা বললাম, তা বলতে না বলতেই কেঁদে ফেলল। শুভ নাকি ওকে উল্টাপাল্টা কথা বলে কেবল, বকা ঝকা করে। ওকে কাঁদতে দেখে জড়িয়ে ধরলাম। আমারও কান্না পেল। কেন পেল? হয়ত শুভকে আমি অনেক বেশি ভালোবাসি বলে, হয়ত শুভকে আমি সব দিতে চেয়েছি বলে, হয়ত অপমান বোধ, হারানোর কষ্ট থেকে!
তুতুনের আসলে কোনো দোষ নেই। আমিই বাড়াবাড়ি করএ ভুল বুঝেছি, প্যারানয়েড হয় যাচ্ছি। কি মনে করে যেন ওকে আমার নাম্বার দিলাম। শুভ কামনা জানিয়ে চলে আসলাম আমার পথে। এক মাত্র শুভই যৌক্তিক উত্তর দিতে পারবে ওর এমন আচরণের, আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কারণ।
আমার ঐ মুহূর্তে, ঠিক ঐ মুহূর্তে মনে হলো, শুভর ব্যাখ্যা আমি জানি। আর যেটুকু জানি না, সেটুকু জানতেও চাই না। নিজেকে তুচ্ছ মনে হলো। বারবার প্রশ্ন করছি নিজেকে, কেন করছি? কি ভেবে এমন করছি? আমি তো এমন ছিলাম না!
একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। এই দেশ থেকে চলে যাবো। এখানে আর নয়। আমি নিরুপায়। আমার মত মেয়েও এখন পালাবে সব কিছু থেকে। নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে আনার একমাত্র উপায়।
চলবে…
(গল্প দিতে দেরী হয় বলে বড় বড় করে দেই। আজও দিলাম❤️)