শুভ বিবাহ পর্ব-২০

0
726

#শুভ_বিবাহ
লেখা #AbiarMaria

২০

আজকে আমার প্লাস্টার খোলার দিন৷ আব্বু আম্মু দুজনেই আমার সাথে হাসপাতালে আসার কথা। কিন্তু আব্বু একটা জরুরী কাজে আটকে গিয়েছে, তাই আসতে পারেনি। আব্বুর স্থানে বড় মামা আসলেন। মামা ব্যবসায়ী মানুষ, চাইলেই জরুরী কাজে হয়ে যেতে পারেন মন মতো। আব্বু পারেন না।

ডক্টর খুব যত্ন নিয়ে খুলে দিচ্ছেন প্লাস্টার। কিছু মাসাজ ক্রিম দিয়েছেন রক্ত চলাচল স্বাভাবিক করার জন্য। কিছু ব্যায়াম দিয়েছেন, বিধিনিষেধ আছে। আমি চুপ করে শুনছি সব কিছু। ডাক্তার ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়ার পর মামা আর আম্মু আমাকে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। তখন অবাক হয়ে দেখলাম শুভ ভাইয়া বাইরে দাঁড়িয়ে। মামার নাকি জরুরী কাজ আছে, তাই শুভ ভাইয়াকে বলল আমাদের বাসায় পৌঁছে দিতে৷ আজকাল এই অশুভ আত্মা আর তার পরিবারের সাথে মাত্রাতিরিক্ত মাখামাখি হচ্ছে। আমার বিরক্তি ধরে গেছে এসবে। তার উপর উনাকে দেখলেই সেদিনের কথা মনে পড়ে। পাষাণ কোথাকার! এখন এত দরদ উথলে উঠছে কি করে? সেদিন তো মরতে দেখেও থামেনি!

শুভ ভাইয়া একটা টেক্সি ডেকে আমাদের নিয়ে উঠল। আম্মুর সাথে কি নিয়ে টুকটাক কথা বলেছে, আমি সেসবে কান দেয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি। কানে হেডফোন গুঁজে সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছি। আমি ভাবছি অন্য কিছু। প্লাস্টার খুলে ফেলায় খুব হালকা লাগছে, মুক্ত মনে হচ্ছে নিজেকে। এতদিন কি কষ্ট করেই না এর ভার বইতে হতো! কিন্তু এই ভার কি আমার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল না? প্রয়োজন ছিল না? আমার ভালোর জন্যই কি প্লাস্টার করা হয়নি? জীবনটাও বোধহয় এমন। এই যে আম্মু পাশে বসে আছে, হাসছে, কথা বলছে, সুযোগ পেলেই বকে দিচ্ছে। মানুষটাকে মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে, চিৎকার করে তার কাজের প্রতিবাদ করতে ইচ্ছে হয়। তার বকাগুলো মনের উপর খুব ভারী পড়ে যায়। এই বকাগুলোই তো আমার জন্য উপকারী, ঠিক প্লাস্টারের মত। আম্মুর উপর মধ্য দুপুরের কড়া রোদের ছটা পড়ছে। আমি সিটে হেলান দিয়ে আম্মুর মুখ দেখছি। পৃথিবীর সবচেয়ে প্রিয়, আপন মুখ।

কয়েকদিন পার হয়েছে। আমি কলেজে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করছি বাসায়। আব্বু আম্মু কেউ রাজী না। তারা আরও কিছুদিন বসিয়ে রাখতে চায়, বিশ্রাম নেয়াতে চায়। তিন মাস তো পার হলো। আর কত? তারাও বুঝতে পারছে না আমার প্রতি মিনিটে মিনিটে দমবন্ধ লাগে, বাহিরে যাওয়ার জন্য আমি ছটফট করতে থাকি। খুব ইচ্ছে করছে আবারও কলেজ ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াতে মুক্ত বিহঙ্গের মত! কিন্তু সেসব হবে না। সামনেই টেস্ট পরীক্ষা। পড়ালেখার চেষ্টা করেছি এই তিন মাসে, তবে লেখা তো সম্ভব ছিল না। টেস্ট পরীক্ষায় লিখতে গেলে কিছুই তো পারব নাহ। কলম ধরলে মাঝে মাঝে আমার হাত কাঁপে। আমি তবুও সর্বশক্তি দিয়ে তিন আঙুলে কলম চেপে ধরি, যেন এই কলমের উপর আমার জীবন মরণ সব নির্ভর করছে। আমার কপাল বেয়ে ঘাম ঝড়ে। এক পাতা লিখতে গিয়ে আমার চোখ মুখ লাল হয়ে ওঠে। লিখতে পারাটা একটা বিরাট যুদ্ধ আমার জন্য, কিন্তু এই যুদ্ধে আমি হারব না। আমি হারতে আসিনি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার জন্য খুব বেশি সময় হাতে নেই। এই সময়টুকু আমার কাজে লাগাতে হবে। আমাকে কেউ প্রথম পজিশন থেকে সরাতে পারবে না, পরীক্ষার ফলাফলও খারাপ হতে পারে না, না।

সত্যি সত্যি যেদিন কলেজে যাওয়ার অনুমতি পেয়েছি, সেদিন কেঁদে আম্মুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম আনন্দে। আম্মু এরপরও গলে না গিয়ে মুখে কৃত্রিম গাম্ভীর্য টেনে বলেছে, সে আমাকে কলেজে দিয়ে আসবে আর আনবে। তবে এরপর থেকে আমাকে আনতে মামা অথবা চাচ্চু যাবে। আমি তবুও আনন্দে মাথা নাড়ি। আমাদের ক্লাসে তৃষ্ণার মা এখনো ওকে কলেজে দিয়ে যায় ও নিয়ে যায়। আমরা যখন কলেজ, গার্জিয়ানদের ফাঁকি দিয়ে, জ্যামের দোহাই দিয়ে মিছে বলে আশেপাশের ঝাল মুড়ি আর ফুচকা খেতে পারদর্শীতা অর্জন করছি, তখনও তৃষ্ণাকে ওর মা আঁচলে বেঁধে রাখছে। আমরা সেসব নিয়ে হাসতাম। তৃষ্ণা অবশ্য রাগ করত না। ও বৌদ্ধ হওয়ায় ওকে স্কুলে থাকতে বেশ কিছু সমস্যায় পড়তে হতো। স্কুলের ছেলে মেয়েরা মজা করত, যেটা বেশিরভাগ সময় টিজের পর্যায়ে চলে যায়। আন্টি তাই ওকে এখন আর একা ছাড়েন না, মিশতে দেন না। অবশ্য ক্যাম্পাসের ভেতরে আমাদের মাঝে খাতির আছে, তবে তা এর বাইরে যেতে পারে না। আজ তৃষ্ণার মত আমার মাও আমাকে নিবে, আনবে। আমার দুঃখ হচ্ছে না, আনন্দ হচ্ছে। আমি এই তিন মাসে একটা গুপ্তধন পেয়ে গেছি যে! আম্মুর মাখন স্বরূপ মনের সন্ধান মিলেছে।

আম্মু প্রথম দুদিন আমাকে কলেজে নিয়ে গেছেন আবার নিয়ে এসেছেন। সকালে কাজ গুছিয়ে যাওয় যায়। কিন্তু দুপুরের দিকে কি করে যাবেন? রান্না গুছিয়ে বেরোতে বেরোতে আম্মুর সমস্যা হয়ে যায়, শরীর ক্লান্তিতে ছেড়ে দেয়। তাছাড়া কাজও গোছানো হয় না। দুদিন পর আব্বুর সাথে পরামর্শ করে ঠিক হলো, আমাকে আনার জন্য আমার মামাতো ভাইয়ারা একেকজন একেক দিন যাবে। ভাইয়ারা আমাকে ভীষণ আদর করে। মামাতো ভাই বলতে বড় মামার দুই ছেলে। বড় ভাইয়ার পড়ালেখা শেষ, ছোট ভাইয়া এখন অনার্স তৃতীয় বর্ষে আছে। যেহেতু ওর ক্লাসের ফাঁকে সুযোগ আছে, তাই আমাকে নিয়ে আসবে। আমার ভাইদের সাথে শুধু আদরের সম্পর্ক না, ভাইয়ারা লুকিয়ে চুরিয়ে আমাকে আম্মুর নিষেধাজ্ঞা ভাঙতে খুব সাহায্য করে। এই যেমন বৃষ্টিতে ভেজা, গ্রামে কালবৈশাখির মাঝে আম কুড়ানো, চটপটি ফুচকা খাওয়া, ঠান্ডা লাগতে পারে জেনেও আইস্ক্রিম খাওয়ানো- এসব কাজে ভাইয়ারা পারদর্শী। আমিও ছোট বোন হিসেবে তাদের কাছ থেকে আমার সব পূরণ না হওয়া আবদারগুলো করতে থাকি। বড় ভাইয়ার নাম স্বাধীন, আর ছোট ভাইয়ার নাম নির্ঝর।

নির্ঝর ভাইয়া আর স্বাধীন ভাইয়া খুব সহজেই আমাকে কলেজ থেকে বাসায় আনার দায়িত্ব নিয়ে নিল। ইসাবেলা আপু, স্বাধীন ভাইয়া, নির্ঝর ভাইয়া, রাতুল ভাইয়া আর আমি- ছোট্ট একটা কাজিন গ্রুপ। এরা সবাই আমার ভীষণ প্রিয়। দাদাবাড়ী আর নানাবাড়ির কাজিনদের এই দলটা ছোট থেকে আমার কাছে একটা আনন্দ, রিফ্রেশমেন্ট আর আমার বন্দী জীবনের একটা আনন্দের উৎস। ওরা যখন খেলত, তখনও আমি খুব ছোট। ওদের কোলে কোলে ঘুরতাম আর ওদের খেলায় দুধভাত হতাম। সবাই আমাকে ভীষণ আদর করত, পুতুলের মত আগলে রাখত। এ কারণে যখন শুনলাম স্বাধীন কিংবা নির্ঝর ভাইয়া আমাকে কলেজ থেকে আনবে, তখন অজানা রোমাঞ্চের কথা ভেবে আমি আনন্দে শিহরিত হলাম!

তৃতীয় দিন কলেজ শেষে আমি অতি উৎসাহী হয়ে গেটের বাহিরে আগে আগে এসে দাঁড়ালাম। আজকে নির্ঝর ভাইয়া আমাকে নিয়ে যাবে। ঠিক করেছি, আজ আইসক্রিমের বায়না ধরব। শীত পড়ে যাচ্ছে বলে আম্মু আমাকে আইসক্রিম ছুঁতেই দেয় না। অস্থির হয়ে এদিক ওদিক খুঁজছি আর ঘড়ি দেখছি। ভাইয়া একটু লেট লতিফ জানার পরও তার দেরী সহ্য হচ্ছে না।

ঠিক তখন আমার চোখে সে ধরা দিল!

না, ভাইয়া না। একটা মেয়ে। কাঁধ পর্যন্ত চুল ছোট করে কাটা। পরনে একটা রাজস্থানী কটি, নিচে সাদা ফতুয়া আর কালো জিন্স, চোখে দামী বাদামী রোদচশমা। আমি প্রথমে ভেবেছি অন্য কারো দিকে আগাচ্ছে। একটু খেয়াল করে দেখলাম, আমার আশেপাশে অন্য কেউ নেই। মেয়েটা আমার কাছে এসে রোদচশমা না খুলেই বলল,
❝ফাহমিদা জেবিন তোমার নাম?❞
আমি জবাব না দিয়ে অবাক হয়ে তার দিকে তাকালাম। নাম জানে কি করে সে? আমার কোনো বান্ধবীর কেউ হয়? বোন নাকি? চেনে কি করে? সে আবার বলল,
❝তোমার ডাকনামটা খুব সুন্দর। তুতুন❞
এবার আমি আরও অবাক হলাম। আমার ডাকনাম কলেজের কেউ জানে না। আব্বু আম্মুও ঘরের মানুষ ছাড়া অন্য সবার সামনে জেবিন নামে ডাকে। তুতুন একেবারেই আমার ঘরের নাম। অপরিচিত একজন মানুষের মুখে শুনলে তাই আমার অবাক হবারই কথা। আমাকে সেই বিস্মিত মনোভাব প্রকাশ করতে না দিয়ে আরও বিস্ময়ে ডুবিয়ে তিনি বললেন,
❝একটু আমার সাথে সামনের দোকানে বসবে? তোমার সাথে কথা আছে❞

আমি ঠিক কি বলব বুঝতে পারছি না। এই আপুকে কিভাবে মানা করব? উনি আবার বললেন,
❝সমস্যা কোনো?❞
বিড়ালের মত মিন মিন করে জবাব দিলাম,
❝আমাকে এখন ভাইয়া নিতে আসবে❞
❝কোন ভাইয়া? তোমার তো কোনো ভাই নেই❞
❝আমার মামাতো ভাই আসবে❞
❝ওহ। সমস্যা নেই। তুমি নাম্বার বলো, তোমার ভাইয়াকে কল করে মানা করে দিব। বরং আমি তোমাকে বাসায় পৌঁছে দেব❞
আমি প্রতিবাদের আগেই সে ফোন বের করে আমার মুখের দিকে তাকালো।
❝জিরো ওয়ান। এরপর?❞

এমন পরিস্থিতিতে কখনো পড়িনি। আমার মাথায়ও আসছে না কি করা উচিত। অথচ আমি তোতাপাখির মত ভাইয়ার নাম্বার বললাম। কল করে আপুটা আমার কানে ফোন ধরিয়ে বলতে বলল, আজ যেন না আসে। তার কথামতো আমি নির্ঝর ভাইয়াকে নিষেধ করে দিই। এরপর তার পিছু পিছু একটা গাড়িতে উঠে বসি। উলটো দিকের দরজা খুলে তিনিও গাড়িতে বসেন। আমি আড়ষ্ট হয়ে বসে আছি গাড়িতে। মাথায় ঢুকছে না কি হচ্ছে আশেপাশে। অনেক প্রশ্ন মাথায় একত্রে আক্রমণ করে আমার ব্রেইন এখন কমপিউটারের মত হ্যাঙ করে আছে। যতই মাউস ক্লিক করুক, কিবোর্ড চাপাচাপি করুক, কাজ হচ্ছে না!

পাশে বসা আপুটা এবার রোদচশমা খুলে আমার দিকে স্মিত হাসি হেসে বলল,
❝তুমি খুব কিউট একটা মেয়ে তুতুন, ঠিক তোমার নামের মত❞
তাকে হয়ত ধন্যবাদ জানানো উচিত, কিন্তু আমি সেটাও পারলাম না।
❝তুমি আমার নাম জানতে চাইবে না?❞
আমার ব্রেইন হ্যাঙ হওয়া থেক্ব কিছুট উন্নতির দিকে গিয়েছে। তাই শেষ পর্যন্ত প্রশ্ন করলাম,
❝আপনার নাম কি? ❞
আপুটা হাসলো। কথায় কথায় হেসে ওঠা কি তার স্বভাব?
❝আমার নাম কণা। তুমি আমাকে চিনবে না। আমি তোমাকে চিনি❞
জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করল, কিভাবে চেনেন আমায়? মুখ দিয়ে প্রশ্ন বেরুলো না। সে আবার বলছে,
❝তুমি শুভকে চেনো? আমি শুভর গার্লফ্রেন্ড❞

এবার আমার আকাশ থেকে পড়ার পালা। শুভ ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড কেন আমার কাছে এসেছে? আমি কি করেছি? এই মানুষ কেন আমাকে গাড়িতে তুললো? অজানা ভয়ে আমার হাত পা কেমন ঠান্ডা হয়ে উঠছে। চশমার এপাশে আমার চোখ জোড়া ভীত। কণা আপু আমাকে বলল,
❝শুভর সাথে তোমার খুব ভালো সম্পর্ক, তাই না?❞
আমি দুপাশে মাথা নেড়ে তীব্রভাবে প্রতিবাদ জানালাম।
❝শুভ ভাইয়া আমাকে শুধু বকে। দেখলেই বকে। ছাদ থেকে নিচে নামিয়ে দেয়। আর শুধু পঁচা পঁচা নামে ডাকে❞

কণা আপু বোধহয় মজা পেলেন। কন্ঠে কৌতুক মিশিয়ে বললেন,
❝তাই? কি কি নামে ডাকে?❞
❝দুইশিং ওয়ালী, তেঁতুল ফুল, কানি, এসব বলে❞
❝তোমাকে ভালোবাসে, এটা বলে না?❞
কণা আপুর কথা শুনে মনে হলো ভুল শুনলাম।
❝কি বলে? বুঝিনি আমি❞
❝বললাম, তোমাকে ভালোবাসার কথা বলে না?❞
আমি অবাক হয়ে গেলাম। এটা কেমন প্রশ্ন?! এই অশুভ লোকটার সাথে সব অশুভ অশুভ জিনিস জড়িয়ে আছে। অশুভ ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ডকেও আমার এখন অশুভ মনে হচ্ছে। এতক্ষণ তাকে সুন্দর লাগলেও এখন একটা পেত্নী মনে হচ্ছে, তেঁতুল গাছের পেত্নী।

কণা আপুর কথা শুনে আমার দম বন্ধ লাগছে। গাঈর কাঁচ তুলে এসি চালু করা, গাড়িও ঝাঁকি ছাড়া চলছে। আর আমার মনে হচ্ছিল কানের মাঝে কি যেন বাজছে। কণা আপু বললেন,
❝সরি এভাবে বলেছি বলে। আসলে শুভর সাথে আমার সম্পর্ক খুব একটা ভালো চলছে না। আমি ওর গার্লফ্রেন্ড, নাকি এক্স গার্লফ্রেন্ড হয়ে গিয়েছি, এখনো জানি না। ও আমাকে আর সহ্যও করতে পারছে না। আমি ওর প্রতি একশ ভাগ ঝুঁকলেও তার আর এখন আগ্রহ নেই। হয়ত ভাবছ, এসবের সাথে তোমার সম্পর্ক কি? সম্পর্ক আছে, অবশ্যই আছে। সম্পর্ক আছে বলেই তোমাকে নিয়ে আসলাম। যেদিন তোমার এক্সিডেন্ট হলো, সেদিন থেকে ও বদলে গেছে। একেবারেই বদলে গেছে! আমাকে চেনে না, ভালো লাগে না। অনেক খুঁজে দেখলাম, সম্ভবত তোমার সাথে ওর কিছু একটা আছে। তাই সে আমাকে সহ্য করতে পারছে না❞

আমি কাঁদতে শুরু করেছি। আমাকে কাঁদতে দেখে আপু ঘাবড়ে গেল।
❝আহা মেয়েটা! কাঁদছ কেন?❞
❝আপনি মিথ্যা কথা বলছেন!❞
❝কোনটা মিথ্যা?❞
❝শুভ ভাইয়ার সাথে আমার কিছুই নেই। ভাইয়া তো সবার সাথেই টাঙ্কি মারে, কথা বলতে চায়।আমার বোনের সাথেও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু আমাকে কখনো কিছু বলেনি। কসম! সত্যি! আমাকে কিচ্ছু বলেনি। আপনি শুধু শুধু মিথ্যা বলছেন। এসব ঠিক না!❞

আমি কেঁদেই যাচ্ছি।বড্ড অপমান বোধ হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত শুভ ভাইয়ার গার্লফ্রেন্ড আমাকে এসে এসব বলবে? আপুটা আমার এক হাত চেপে ধরে বলল,
❝হয়ত তোমার কথাই সত্যি। কিন্তু আমি শুভকে চিনি। ও আমাকে এভাবে ফেলে দেয়ার মানুষ না। শুভ আর আমি এক সাথে থেকেছিও। এক ঘরে এক বিছানায়! এটা হতে পারে না! তোমার বা অন্য কারো জন্য হলেও ও আমাক ছাড়তে পারে না!❞

শেষের কথা গুলো উনি প্রায় ফিসফিস করে বলল। আমি খেয়াল করলাম, তার চোখেও পানি। আমার হাত ছেড়ে এবার সে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
❝সরি আপু, আমারই বোধহয় ভুল হয়েছে। তোমাকে কি যে সব বলে যাচ্ছি!উফ! থাক, তুমি কেঁদো না। আমার কথায় মন খারাপ করো না। আমি আসলে…❞
কান্নায় তার কন্ঠ বুঁজে আসলো। অচেনা এই মানুষটার জন্য আমার খারাপ লাগছে। শুভ ভাইয়ার প্রতি আরেকবার ঘৃণা জন্মাচ্ছে। সে কি করে ওই আপুকে ছেড়ে দিতে পারে? আপুটা আমাকে ছেড়ে কান্না মুছলো। মুখ নিচু করে বলল,
❝শুভ আর আমার সম্পর্কটা বেশ গভীরে চলে গেছে। এত গভীরে গিয়েছে যে আমি উঠতে পারছি না, চোরাবালির মত পা দেবে গেছে। যতউ চেষ্টা করছি, ততই ডুবছি। তাই তোমাকে খুঁজে বের করলাম। ভেবেছি, হয়ত তোমাদের মাঝে কিছু একটা আছে। এখন মনে হচ্ছে, ভুল করেছি। তোমার ছোট মনে আঘাত দিয়েছি। আসলে আমারই দোষ। শুভর মত ছেলেকে নিয়ে এতদূর কেন গিয়েছি? এটাই যে পাপ! আমারই ঠিক হয়নি!❞

গাড়ি চলছে। আমি থম মেরে বসে আছি। পাশে কণা আপু মাথা চেপে ধরে রেখেছে। আমার মায়া হচ্ছে। ভীষণ মায়া। আচ্ছা, শুভ ভাইয়া তার নামের মত শুভ না হয়ে অশুভ হয়ে গেল কেন? অশুভ আত্মা একটা, অশুভ ছায়া?

কণা আপু আমাকে বাসায় নামিয়ে দিল। নামিয়ে দেয়ার আগে আমার হাত ধরে আবার ক্ষমা চাইলো। আসলে সে ভেবেছে, আমার কারণে ভাইয়া তাকে সহ্য করতে পারছে না। এখন তার মনে হচ্ছে, ভাইয়া আসলে উনাকে কখনো ভালোবাসেনি! আমি কেবল ভাবছি, মানুষ ভালো না বাসলেও কি এক বিছানায় যেতে পারে? কি বিছরি, ছিঃ! বাসায় ঢুকতে ঢুকতে আবিষ্কার করলাম, শুভ ভাইয়ার প্রতি পাহাড়সম ঘৃণা আর বিতৃষ্ণা জন্মেছে। এই জীবনে আর তার শেষ হবে না!

চলবে…

(এত দেরী হলো বলে বিশাল করে দুই পর্ব এক করে দিলাম!)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here